Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

গুরু নানক : জন্মতিথির শ্রদ্ধা

গুরু নানক (১৪৬৯-১৫২৯) শিখধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। এই ধর্মটি পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ধর্ম। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে তিন কোটি শিখ তাঁর মতাবলম্বী।

একটি কথা মনে রাখা জরুরি। শিখধর্ম উদ্ভূত ও বিকশিত হয় অভিভক্ত পঞ্জাবে। কিন্তু পাঞ্জাববাসী মাত্র-ই শিখ নন। তাঁদের মধ্যে মুসলমান যেমন আছেন, তেমনই আছেন বহু সনাতনপন্থীও। আছেন আদিবাসীরাও,— খোক্কর, গাক্ কারা, রাওয়াল, সানসি ও অন‍্যান‍্য।

উপমহাদেশের ধর্মীয়, আধ‍্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একদিকে সুফীবাদ ও অন‍্যদিকে ভক্তিবাদের ভূমিকা ছিল অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজামউদ্দীন আউলিয়া, খাজা মইনুদ্দীন চিশতি, রজব, রুইদাস, জোলা, কবীর, শ্রীচৈতন‍্য, জ্ঞানদেব, শঙ্করদেব, তুলসীদাস, তুকারাম যে সহজ ঈশ্বর-উপলব্ধি ও আরাধনার কথা ব‍্যক্ত করে গেছেন, তাতে অগণিত মানুষ তাঁদের অনুসারী হন। ধর্মীয় বহু কুসংস্কার দূর হয় তাতে।

গুরু নানকের ভূমিকাও এইরকম শ্রদ্ধার সঙ্গে কীর্তিত হয়। ১৪৬৯-এ মাতা তৃপ্তা ও পিতা মেহতা কল‍্যাণ দাস বেদীর সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। লাহোরের তালবন্দী গ্রামে, এখন যা নানকানশরীফ নামে পরিচিত। পিতা কাজ করতেন মুসলিম জমিদার রায় বুল্লারের ভূমিরাজস্ব বিভাগে। শিশুকালে কিছুটা ফার্সিভাষা শেখেন। পড়াশুনো খুব একটা করেননি। গান লিখতেন ছোট বয়স থেকেই। বন্ধু মর্দানাকে নিয়ে গ্রামে-গ্রামান্তরে গেয়ে বেড়াতেন। হাতে রবাব। পর্যটনপ্রিয়তা তাঁকে আঠাশ হাজার কিলোমিটার পদব্রজে পরিক্রমা করিয়ে ছেড়েছে। আধ‍্যাত্মিক এই ভ্রমণকে বলে ‘উদাসীন’। ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত,— দিল্লি কাশী কাশ্মীর বৃন্দাবন গয়া কামরূপ বাংলা তো বটেই, গিয়েছেন মক্কা মদিনা বাগদাদ, শ্রীলঙ্কা, সুদূর তিব্বত। তাঁর ধর্মীয় এষণা অতঃপর তেত্রিশ বছরে তাঁকে এই উপলব্ধি এনে দিয়েছে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ অর্থহীন, সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও সদাচরণ-ই প্রকৃত মনুষ‍্যধর্ম। বর্ণপ্রথা ও মূর্তিপূজা মানতেন না। তাঁর প্রচারিত ধর্মের তিনটি স্তম্ভ,— ভাণ্ড চাককো, কিরাত করো, আর নাম জপো।

নানক বিবাহিত ছিলেন। স্ত্রীর নাম সুলখনা। দুই পুত্র ছিল তাঁর,— শ্রীচাঁদ ও লক্ষ্মীদাস।

নানকের অনুসারীরা ‘শিখ’, অর্থাৎ শিষ‍্য। শিখদের যে ধর্মগ্রন্থ, ‘গ্রন্থসাহেব’, সেখানে হিন্দু, মুসলিম ও অন‍্যান‍্য ধর্মীয় মহাত্মাদের বাণীও স্থান পেয়েছে।

নানকের শিষ‍্যরা একত্র বসে আহার করেন। জাতপাত মানেন না। এই আহারকে বলে ‘লঙ্গর’। মধ‍্যযুগে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ওপরে উঠে মানুষকে ‘সবার উপরে সত‍্য’ দেখানোর এই যে প্রয়াস, শিক্ষালাভের জন‍্য প্রয়োজনে চীনদেশে যাওয়ার-ও যে নির্দেশনা হজরত মহম্মদ রসলুল্লাহ্-এর (সা.), তাকে মান‍্যতা দিয়েই যেন মক্কায় যাওয়া, গুরু নানকের কাছে এই শিক্ষা নিতে পারি আমরা। ‘যিনি সব মানুষকে এক বলে বিবেচনা করেন, তিনি-ই ধার্মিক’, একথা বলেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে মুসলিম মাস্তানার বন্ধুত্ব, তাঁর একেশ্বরবাদ, এসমস্ত তাঁর ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন। তাছাড়া শিখদের পবিত্র গ্রন্থে রসুলুল্লাহ্ যে শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখিত, সেটাও তাঁর ধর্মসহিষ্ণুতার প্রমাণ।

তাঁর শিষ‍্যদের প্রতি নির্দেশ ছিল প্রত‍্যূষে ওঠা, নামজপ, ঈশ্বরের নামে কাজ করে যাওয়া।

মধ‍্যযুগের সুফি ও ভক্তিমার্গের ধর্মপ্রবক্তাদের মাধ‍্যমে তাঁদের নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষাও ব‍্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাব নিয়ে এসেছিল জীবনীসাহিত‍্যের প্লাবন ও একই সঙ্গে বৈষ্ণবপদাবলীর বন‍্যাধারা। কবীরের আবির্ভাব হিন্দি সাহিত‍্যকে গতিজাড‍্য দিল। তাঁর রচিত ‘দোহা’ আর ‘বীজক’ হিন্দি সাহিত‍্যের অমূল‍্য সম্পদ। মীরাবাঈ-রচিত ভজন তেমনি রাজস্থানি-গুজরাতি-ব্রজ (বৃন্দাবনের ভাষা) ভাষার অনায়াস বহতা নিয়ে আসে। তুকারামের ‘অভঙ্গ’ মারাঠি সাহিত‍্যকে সমৃদ্ধ করে। সুফি সন্তদের গজল, তাসাউফ, পীরগাথা, জঙ্গনামাও এক্ষেত্রে উল্লেখ‍্য। নানকের প্রভাবেও গুরমুখী ভাষা অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। শিখ গুরুদের মধ‍্যেই তো দেখি গুরু নানক ছাড়াও অঙ্গদ, অমরদাস, রামদাস, অর্জুনদেব, তেগবাহাদুর ও গোবিন্দ সিং কাব‍্যচর্চা করে গেছেন। তাই ধর্মীয় ইতিহাস ও সাহিত‍্য সমধারায় বয়ে চলে। একথা প্রাচীন ধর্মসমূহের ক্ষেত্রেও দেখতে পাওয়া যায়। সাহিত‍্য ছাড়াও চিত্রশিল্প, এমনকি স্থাপত‍্য-ভাস্কর্যেরও প্রগতি ঘটে এর ফলে।

নানক সম্পর্কে বিস্তৃত তথ‍্য জানা যায় না। পুরীতে শ্রীচৈতন‍্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নাকি তাঁর। কাশীতেও কবীর-সান্নিধ‍্য ঘটে থাকতে পারে। তাঁর ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন মার্দানা নামে এক মুসলমান। পরে তিনি শিখধর্মে দীক্ষা নেন। সঙ্গীতগুণী মার্দানা তানসেনের গুরু স্বামী হরিদাসকে যন্ত্রবিদ‍্যা শিখিয়েছেন। পর্যটনপ্রিয় নানক পূর্ববঙ্গের ঢাকা ও চট্টগ্রামেও এসেছিলেন। চট্টগ্রামের চকবাজারে তাঁর আগমনের প্রমাণ মিলেছে। ইতিহাসবিদ হরিরাম গুপ্তের মতে, নানক ১৪৯৬ থেকে ১৫২১, এই পঁচিশ বছর দেশবিদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। তাঁর পোশাকে হিন্দু ও মুসলিমদের পোশাকের অনুবর্তিতা ছিল। অবশেষে পাঞ্জাবের কর্তারপুরে থিতু হন তিনি। এবং এখানেই সম্ভবত নদীতে ডুবে মৃত‍্যু হয় তাঁর। তাঁর মরদেহের হদিশ মেলেনি।

চিত্রণ: গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »