একটা স্থির সময় আবর্তিত হচ্ছে নিজের চারপাশে। একটা শ্লথ বৃদ্ধি, একটা ধূসর চঞ্চলতা, একটা বৃত্তের সীমিত পরিধি যা সবসময় তর্জনী তুলে আছে তোমার দিকে। হয়তো সে দিক নির্দেশ করছে, হয়তো সে তোমাকে শাসনে রাখতে চাইছে, হয়তো বুঝিয়ে দিতে চাইছে নিজের ক্ষমতার কথা। একটি সূর্যান্ত থেকে অন্য একটি নতুন সূর্যাস্তের ভিতরে অন্ধকারের আলাদা আলাদা অধ্যায়কে চিহ্নিত করছে, যে কোনও একটি অন্ধকারকে বেছে নিতে বলছে নিজের জন্য। তারপর সূর্য ওঠার পর সেই সব স্বপ্নের ক্যানভাসে তৈরি হচ্ছে খণ্ডদৃশ্য। প্রতিটি দৃশ্যের নিঃসঙ্গতা সৎ এবং নগ্ন। সেইসব দৃশ্যেরা শেষ হয়ে যাওয়ার নয়, বারে বারে তারা ফিরে আসে তৃতীয় পৃথিবীর নিঃসঙ্গতায়। কুয়োর অনেক গভীরে জলের আশায় এই নিঃসঙ্গতা একটি দশক জুড়ে ভাঙা ইটের দেওয়াল বেয়ে শুরু করতে চেয়েছিল তাদের অভিযান। তাদের সঞ্চয়ে ছিল অতীতের শিবির থেকে জেগে ওঠা লৌহকণিকার গান, সত্তরের দগদগে অভিজ্ঞতা। কোনও কাঙ্ক্ষিত উৎসের দিকে এগিয়ে যায়নি তারা। সময়কে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছেন মানুষের মুখ ও মনের যোগাযোগ থেকে বিকীর্ণ হওয়া রং।
আমাদের পরিচয় আদর্শমুখী হতে চায়। মধ্যবিত্ত বাঙালি চিরকাল একটি সৎ রাজনৈতিক আদর্শে টিকে থাকতে চেয়েছে। ফাটল সমেত সেই টিকে থাকা বাঙালির মায়োপিক দৃষ্টি কুখ্যাত মানিক চক্রবর্তীকে লুকিয়ে রেখেছে ট্রাঙ্কের ভিতরে আর লাবণ্যর বাবাকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভবিষ্যতের জীবাশ্ম করে তুলতে। একটা সামাজিক স্থিরচিত্রের মধ্যে যেন তিনি সিসিফাসের মতো পুরাতন আপ্তবাক্যগুলিকে বয়ে চলেছেন। লাবণ্যর নিচের পোশাক থেকে খুলে গেছে তার অন্ধবিশ্বাসের গিঁট অথবা আত্মবিশ্বাসের? কে বলতে পারে সে অস্থির পরিবর্তনমুখী কুহকের বিস্তৃত জাল নয়। কিছুই তো অবশ্যম্ভাবী ছিল না সে সময়। এই মায়াচ্ছন্ন অবাস্তবের প্রশ্নগুলির মধ্যেই বাস্তবের বৈধতা প্রকট হয়ে উঠেছে অ্যাবসার্ডিটির চলনে। গল্প দিকনির্দেশ করে বলেছে, যেখানেই বাস্তব গিয়ে ধাক্কা খায় অবাস্তবের সঙ্গে ঠিক সেই বিন্দুতে বসে অনুভব হয়, বাস্তব বলে আসলে কিছু নেই। সবটাই কল্পিত অথবা সুপরিকল্পিত। তাই অপালা বলেও হয়তো সেই গল্পটিতে আসলে যে থাকে না সেও অদ্ভুতভাবে শাসন করে কাহিনির আলোকে। প্রকৃতপক্ষে না থাকা মানুষগুলি রক্তের গোলাপি রঙের লাল হয়ে ওঠাটিকে সঞ্চালনা করে। তার সাথে কথা বলার জন্য জেগে ওঠে ঘরের আসবাবপত্র যারা সঞ্চয় করে রেখেছিল এক তাৎক্ষণিক মূল্যবোধ। একটি চলমান চরিত্র একটি সামাজিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতের সঙ্গে। সমসাময়িক রাজনৈতিক আবহাওয়া তার ভাবনাকে রং করে দিচ্ছে, পরমুহূর্তে সেই সাদা রং ভেদ করে ফের জেগে উঠছে তার ভিতরে প্রোথিত ছবিরা। মৃত শিল্পী ফিরে এসেছেন জীবিত চরিত্রের বোধে। নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট কথা মনে পড়ে। হারবার্ট মৃত ব্যক্তিদের সাথে কথা বলতে থাকে এবং পেশাগতভাবে তার এই ক্রমঅভ্যুত্থান একসময় রাজনৈতিক চোখের মুখে পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। দীপশেখরের চরিত্রগুলি কিন্তু আত্মহত্যামুখী নয়, তারা প্রতিমুহূর্তে জীবনের কথা বলে গেছে। সম্ভাবনার আগামী ইঙ্গিত একেবারে গুঁড়িয়ে যায়নি কোথাও।
চরিত্রের জীবনের উপরে প্রচ্ছন্ন ছায়া ফেলে গেছে সম্পর্ক। সম্পর্কশুশ্রূষার শিশিতে ধরে রেখেছে মায়ের চোখের জল। দরজার বাইরে রেখেছে সমুদ্রের দিন। দরজার এপারের ঘরে রেখেছে আয়না এবং রূপকথা। একমাত্র জানলার ওপারে বয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার অদ্ভুত এক গল্প যেখানে এক মুক্ত ঘুড়ি উড়তে উড়তে একদিন দেশদ্রোহিতা হয়ে ঝুলে পড়ছে স্তম্ভের প্রতীক হয়ে।
বাঁধানো মলাটে দীপশেখর চক্রবর্তীর ‘তৃতীয় পৃথিবীর নিঃসঙ্গতা’ একটি স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্নের ভিতরে যাতায়াত অথবা যোগাযোগ। এই যোগাযোগের ভিতরে প্রতিটি কথোপকথন যেন স্বতন্ত্র সলিটিউড। গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেসের উনিশ’শ সাতষট্টি সালের একশ বছরের নিঃসঙ্গতা, অর্থাৎ ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুড উপন্যাসের কথা মনে পড়ে যায়।
একা, প্রগাঢ় একা যে দৃশ্য সেখানে মানুষের মুখ খসে পড়ে, ফের জেগে ওঠে আশ্চর্য চিত্ররূপের ভিতরে। ক্রাইসিস এই চিত্ররূপের একমাত্র রং। ক্রাইসিস এবং শেডস। অন্ধকার এবং তার অজস্র প্রশাখার গিঁট। তৃতীয় পৃথিবীর ভিতরে আটকে থাকা কান্না, মৃত্যু, পুরুষ এবং নারীর বিপরীত লিঙ্গের নিজস্ব অবস্থান, অভিযোজন এবং কখনও কখনও আত্মসমর্পণও বটে। অথচ এসব কিছুই তত সাদামাটা নয়। এর ভিতর থেকেও চারার বৃদ্ধিতে প্রতিবাদ জন্ম নিয়েছে আস্তাবলে যিশুর অক্ষরে এবং এর মধ্যেই ঘনীভূত হয়েছে পরিবারমুখী জীবনগুলির পেঁচানো আবর্ত। অথচ সবই স্বাভাবিক রয়েছে সর্বত্র। মৃতের দেহের ভিতরে জীবন বয়ে গেছে ফল্গুধারার মতো। কোথাও তো মনে হল না চরিত্র প্রসঙ্গ থেকে সরে গেছে বাস্তবের খাতিরে। বরং প্রতিমুহূর্তে গল্প একটি রূপকথার খুঁজতে চেয়েছে, বাস্তবের রূপকে। এখানে রূপক বাস্তব, জাদুকাঠির বাস্তব যা কল্পনাকে ছুঁতে চেয়েছে।
সেই স্পর্শটিও বড় নিঃসঙ্গ। অসাধারণ একটি ভূমিকা গল্পসংকলনটির শুরুতেই তাকে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতির জীবন দান করেছে। বাকি যা কিছু লিখলাম সবই হয়তো অতিকথন। তবুও দশটি ছোটগল্পের এই সংকলন থেকে আরও দু’একটি বাক্য উদ্ধৃত করলে বোধহয় খুব বেশি বাচালতা হবে না।
১. “ভালোবাসা যে একটা ধনতান্ত্রিক সমাজের লজেন্স বিক্রির বিজ্ঞাপন ছাড়া কিছুই নয়, এই কথাটি স্পষ্ট করে বোঝানো যেত। এও বোঝানো যেত, আসলে কেউ আমাকে ভালোবাসেনি। ভালোবেসেছে, আমার চোখের ইশারায় আসবাবপত্র সরানোর অলৌকিক ক্ষমতাকে। সমুদ্রের ধারের মেয়েরা আমাকে ভালোবেসেছিল, সাবানজলের বুদবুদের ভেতর রামধনু দেখানোর কায়দাটির জন্য। ভালোবাসা হল এই ব্যবহারযোগ্যতা।”
২. “এত সহজে দেখা যায়না পুকু। সবকিছুর জন্য দেখার একটা চোখ চাই। তুই বল, ছবি কি সবাই দেখতে পারে? ছবি দেখার চোখ তৈরি করতে হয়। তেমনই যে ছবি আঁকে, তাকে দেখারও চোখ তৈরি করে নিতে হয়। পুকু। নইলে এমন একটা মোটা চোখ দিয়ে কিছুই দেখা যায় না।”
৩. “কোথায়ই বা কী হয়! একটা আলো জ্বালানো এবং নিভিয়ে দেওয়ার মতো সামান্য জীবন ধরে কেবল অর্থহীনতা বয়ে নিয়ে চলা। একদিন পৃথিবী ধ্বংস হবে। একদিন মহাকাশ সংকুচিত হয়ে ফিরে আসবে সেই একটা বিন্দুতে। তারপর? সেখানেই শেষ? নাকি আবার শুরু হবে এই প্রবাহ? আবার লক্ষ কোটি বছর পর এমন একটা অন্ধকার বারান্দা এবং বাইরের আলো নিয়ে বসে থাকব আমি।”
৪. “তোমাদের পরিবারে যৌনতা হল টিভির রিমোট দিয়ে চ্যানেল পাল্টে দেওয়ার মতো।”
৫. “আমাদের সম্পর্কটা একটা কালো বিড়ালের আয়ুর ভেতর, যা দ্রুত ফুরিয়ে গেছিল।
৬. “তখন সবে সবে আমাদের এই ছোট শহরের আকাশ থেকে শয়ে শয়ে মৃত পাখি পড়তে শুরু করেছে। তৎকালীন বামপন্থী সরকারের উচিৎ ছিল, এই ঘটনাটিকে একটি অশুভ সংকেত হিসেবে গ্রহণ করা। কিন্তু তখনও ওরা পায়ের ওপরে পা রেখে ঘুমোচ্ছিল। এমনকী, কেউ কেউ কিনে নিচ্ছিল দেওয়ালে টাঙানোর বিরাট বড় টেলিভিশন সেট।”
আরও হয়তো অনেক কথা বাকি থেকে গেল। পাঠক হয়তো আরও বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নতুন করে আবিষ্কার করবেন ‘তৃতীয় পৃথিবীর নিঃসঙ্গতা’-কে। দীপশেখর জাদুবাস্তবতার অক্ষরে একটি সময়কালের ভিতরে ছুঁয়ে থাকলেন সেই সমস্ত মানুষদের যারা রৌদ্রের ওঠা-নামা দেখেছিল।