Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

গড়িয়া: ত্রিপুরার জনজাতিদের উৎসব আজ সর্বজনীন

ত্রিপুরার কয়েকটি উপজাতি সম্প্রদায় বিশেষ করে ত্রিপুরী, জমাতিয়া, নোয়াতিয়া ও রিয়াং সম্প্রদায়ের মধ্যেই সাধারণত ‘গড়িয়া পূজা’ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে সামাজিক কাঠামো অনুসারে এই গড়িয়া পূজার পদ্ধতি, রীতিনীতি সম্প্রদায়ভেদে কিছুটা পার্থক্যও থাকলেও উদ্দেশ্য মূলত এক।

বর্তমানে সর্বজনীন চেহারা নিলেও ‘গড়িয়া পূজা’ ত্রিপুরার বিশেষ কয়েকটি উপজাতির এক মহান গৌরবময় পূজা ও উৎসব। তাঁদের সমাজে কোন যুগ থেকে এই পূজা চলে আসছে তা বলা কঠিন, তবে বয়সের দিক দিয়ে এই পূজা-উৎসব যে সুপ্রাচীন তা বলতেই হবে। গড়িয়া দেবতা তাদের পরম আরাধ্য এবং উপজাতিদের বদ্ধমূল ধারণা ও বিশ্বাস, তাঁর শুভাশিস ছাড়া জাগতিক কল্যাণ, সুখশান্তি, ভোগবিলাস ও অস্তিত্ব কোনওটাই সম্ভব নয়। তাই, দেবতাকে পরম ভক্তিভরে শ্রদ্ধা নিবেদনের অভিপ্রায়ে প্রতিটি উপজাতি নরনারী এই ‍পূজা-উৎসবের শুভদিনের জন্য সাগ্রহ প্রতীক্ষায় থাকেন। এসময় তারা প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, শোক-তাপ, হতাশা-বেদনা, অতৃপ্তি-অপ্রাপ্তি ভুলে নাচ-গান, হাসিঠাট্টায় মশগুল হয়ে থাকেন।

গড়িয়া মূর্তি তৈরি হয় বাঁশ, আদিবাসীদের হাতেবোনা তাঁতে তৈরি কাপড় ও চাল দিয়ে।

কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ গড়িয়া কথাটা শুনলে ভাবেন যাদবপুরের কাছে অবস্থিত গড়িয়া বা গড়িয়াহাটের কথা। কিন্তু ত্রিপুরার বাসিন্দাদের কাছে গড়িয়া একটা উৎসবের নাম। বৈশাখ মাসের সপ্তম দিনে হয় মূল গড়িয়া পূজা। আগে গড়িয়া পুজো ত্রিপুরার জনজাতিদের লৌকিক দেবতার পুজো হিসাবে চিহ্নিত হলেও আজ তা সর্বজনীনতা লাভ করেছে। গড়িয়া পুজো এখন সমগ্র ত্রিপুরাবাসীর। ত্রিপুরায় উনিশটি জনজাতি সম্প্রদায় রয়েছে। এরা অনেকাংশই বিশ্বাস করেন, গড়িয়া দেবতা এমন এক অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন দেবতা যাঁর কৃপাতেই মানুষ সুখে ও শান্তিতে বসবাস করতে পারেন। তাঁর ইচ্ছাতেই দেশের সমৃদ্ধি ঘটে।

খুব জাঁকজমকভাবে ত্রিপুরার জনজাতি সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পুজো পালন করে থাকেন। পুজোকে কেন্দ্র করে নানান ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। ভোগে থাকে বিভিন্ন প্রকারের পিঠে। তাছাড়া পাঁঠা, হাঁস-মোরগ, পায়রা বলি দেওয়া হয়। এই পূজায় হাঁসের ডিমও ব্যবহৃত হয়। ভোগেও মাংসের আয়োজন করা হয়। জনজাতিদের বিশ্বাস, গড়িয়া পুজোর সাতদিনের মধ্যে যদি কেউ অসুস্থ হন কিংবা কোনও বিপদে পড়েন তা হলে গড়িয়া দেবতার মানত করলে সেই ব্যক্তি সুস্থ উঠবেন। এই পূজা অনেকটা শাক্ত মতে শিবের রাজসিক পূজা। মতান্তরে হিন্দু দেবতা দুর্গাপুত্র গণেশকে সনাতন ‍আদিবাসীরা গড়িয়ারূপে পূজা করেন। জনজাতিরা এই পূজার পূজারীদের ‘অচাই’ এবং প্রধান পূজারীকে ‘চন্তাই’ বলে বিশেষ মর্যাদা দেন।

পাঁঠা, হাঁস-মোরগ, পায়রা বলি দেওয়া হয়। এই পূজায় হাঁসের ডিমও ব্যবহৃত হয়। ভোগেও মাংসের আয়োজন করা হয়।

প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে গড়িয়া দেবতাকে নিয়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঘোরেন একদল লোক। গড়িয়া দেবতা বাড়িতে আসছেন দেখে বাড়ির নারীরা উঠানে জল ছিটিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি পিঁড়ি বসান। গড়িয়া মূর্তিকে সেই পিঁড়িতে বসনো হয়। পরিবারের কর্তা, গৃহিণীসহ সব সদস্য ধূপ দেখিয়ে বরণ করে প্রণাম করেন। একই সঙ্গে চালসহ অন্য ফসল ও নগদ টাকা চাঁদা হিসেবে দেন। দেবতাকে উঠানে পিঁড়িতে বসানোর পর পরিক্রমা করা হয় সমবেত গান ও নৃত্য সহযোগে। একইভাবে পহেলা বৈশাখ থেকে ৬ বৈশাখ পর্যন্ত এভাবে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পরিক্রমা করা হয়। বৈশাখ মাসের সপ্তম দিনে হয় গড়িয়া পূজা। এদিন গ্রাম ঘুরে যে চাঁদা সংগৃহীত হয়, তা দিয়ে পূজার আয়োজন হয়।

গড়িয়া মূর্তি হিন্দুদের অন্য সব মূর্তি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। গড়িয়া মূর্তি তৈরি হয় বাঁশ, আদিবাসীদের হাতেবোনা তাঁতে তৈরি কাপড় ও চাল দিয়ে। কোথাও পূজোর প্রসাদ হিসেবে চাল বা ভাত থেকে তৈরি সুরা পরিবেশিত হয়। ‘রাজমালা’ সহ সমসাময়িক গ্রন্থাদি মতে, মহাভারতে যযাতি নামে একজন পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। রাজা যযাতির অবাধ্য পুত্র দ্রুহ্য পিতা কর্তৃক স্বীয় রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে গঙ্গা ও সাগরের সঙ্গমস্থল ‘সাগর দ্বীপে’ নির্বাসিত হন। রাজা দ্রুহ্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দৈত্যরাজ সিংহাসন আরোহণ করেন। মহারাজা দৈত্যের পুত্রের নাম ত্রিপুর। এই রাজা ত্রিবেগ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ধাবিত হয়ে কিরাত রাজ্য অধিকার করেন এবং ত্রিবেগ ও কিরাত জনজাতির মধ্যে মহামিলন ঘটান। ত্রিপুর রাজা তাঁর বিজিত রাজ্যের নামকরণ করেন ত্রিপুরা এবং প্রজাদের নামকরণ করেন ত্রিপুর জাতি।

দেবতাকে উঠানে পিঁড়িতে বসানোর পর পরিক্রমা করা হয় সমবেত গান ও নৃত্য সহযোগে।

বিষ্ণু পুরাণ গ্রন্থে আছে, ভারত সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে কিরাতের বাস। কামরূপ (আসাম) ও রাক্ষ্যাং (আরাকান) প্রদেশের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগকে আর্যরা সুম্ম বা সুহ্ম নামে আখ্যায়িত করেন। টিবেটো বর্মন শান বংশীয় জনগোষ্ঠী সেখানে শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। এই রাজ্যটিই মহাভারত গ্রন্থে ত্রৈপুরা, কখনও বা ত্রৈপুরী নামে আখ্যায়িত হয়।

ত্রিপুরীরা নিজেদের চন্দ্রবংশোদ্ভুত ক্ষত্রিয় কুলজাত বলে দাবি করেন। নৃতাত্ত্বিক বিচারে ত্রিপুরা জাতি মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। মঙ্গোলীয়রা প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মঙ্গোলিয়া থেকে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে আগমন করেছিল। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পরিচিত ছিল বোডো (Bodo) বা বরো (Boro) নামে। পূর্ব ভারতে আর্যদের আগমনের পূর্বে এই বোডো বা বরো জনজাতি এখানে আধিপত্য কায়েম করেছিল। রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনিসূত্রে জানা যায়, ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চল রাজ্যসমূহ বোডো বা বরো জনজাতির নৃপতি কর্তৃক শাসিত হত। আর্যগণ তাদেরকে কিরাত, দানব ও অসুর নামে আখ্যায়িত করত। এই বোডো বা বরো জনজাতির একটি শক্তিশালী দল গঙ্গা, শীতলক্ষা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী প্রভৃতি নদনদীর অববাহিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ত্রিপুরীরা সম্পূর্ণ অনার্য জাতি। তাই ত্রিপুরার সনাতন অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে বৈচিত্র্যমণ্ডিত উৎসব ও পূজাপার্বণ। আর এই পূজাপার্বণে যে অনুষ্ঠানের রীতি রয়েছে, তার পুরোটাই প্রকৃতি জগতের রূপ-রসের ব্যঞ্জনায় পুষ্ট।

বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে গড়িয়া দেবতাকে নিয়ে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ঘোরেন একদল লোক।

এখন উপজাতিদের প্রধান উৎসব গড়িয়া পূজা ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বত্র যথাযোগ্য মর্যাদায়, ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পালন করা হয়। এই রাজ্যের উপজাতিদের প্রধান‌ এই উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজ্যের সর্বত্র ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। গড়িয়া পূজাকে কেন্দ্র করে গত প্রায় এক মাস ধরে উপজাতি মানুষের মধ্যে নানারকম প্রস্তুতি চলে। গড়িয়া পূজার জায়গাও তৈরি করা হয় বাঁশ দিয়ে। পূজার দিন হাঁস, মুরগি, কবুতর ও পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ কবুতর বলি না দিয়ে গড়িয়ার কাছে উৎসর্গ করে ছেড়ে দেন। এই পূজাতে প্রয়োজন হয় বাড়িতে তৈরি বিশুদ্ধ মদ ও মুরগির ডিম।

এছাড়া গড়িয়া পূজা উপলক্ষে ত্রিপুরার জনজাতিদের বাড়িতে পিঠাপুলি সহ নানারকমের চিরাচরিত খাবার তৈরি করা হয়। যেমন চিকভর্তা, হলুদভর্তা, গোদক, বাঁশের অঙ্কুর দিয়ে তৈরি নানা রকমারি খাবার, দেশি মুরগির ভর্তা, কাঁকড়া ভাজা, গুগলি শামুক দিয়ে তৈরি খাবার, বাঁশের ভেতর রান্না করা মাংস, জুমের চাল দিয়ে তৈরি খাবার অতিথি আপ‍্যায়নের জন্য তৈরি করা হয়। বাঙ্গুই ভাত, মুয়া (বাঁশের অঙ্কুর) সেদ্ধ, মাউখভি (মিষ্টি) এগুলো তো ভোজের পাতে থাকেই।

চৈত্রসংক্রান্তিকে ত্রিপুর ভাষায় বলে বিষু আর হারি। বিষু অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন গড়িয়া পূজার ঘট স্থাপন করেন গড়িয়া পূজার প্রধান পুরোহিত ‘চন্তাই, ও তার সহকারী ‘বাবুয়া’। ত্রিপুরার সংস্কৃতির এক বিশেষ অঙ্গ নাচ। ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির নিজস্ব নৃত্যধারা বজায় আছে এখানে, যা বিভিন্ন পার্বণের সময় প্রদর্শিত হয়। নিজ নিজ ঐতিহ্যের পোশাক, গহনায় সজ্জিত হয়ে এরা নাচ করেন। গড়িয়া দেবতার পূজা উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় উপজাতীয় ‘গড়িয়া নৃত্য’। এই নৃত্য মাদলের তালেতালে করা হয়। ৫-৭ দিন ধরে ‘গড়িয়া নৃত্য’ পরিবেশন করা হয়। দল বেঁধে গড়িয়া দল গ্রামে গ্রামে ঘুরে গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করে। এছাড়া পালাগান ও বিভিন্ন খেলাধুলাও এইসময় চলে।

গড়িয়া দেবতা বাড়িতে আসছেন দেখে বাড়ির নারীরা উঠানে জল ছিটিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি পিঁড়ি বসান।

লেখক মৃগাঙ্ক চক্রবর্তীর একটা লেখা থেকে গড়িয়া পূজার মিথ সম্পর্কে জানা যায়: বহুকাল আগে ত্রিপুরায় হাচুকতি আর লকতায় নামে দুজন দম্পতি বাস করত। পেশায় তারা ছিল জুমচাষি। ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকায় ওরা শান্তিতে বসবাস করত। কিন্তু শান্তি আর কোথায়? এত বছর বিয়ের পরও ওরা নিঃসন্তান। অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও সন্তান হয়নি। শেষে উপায় না দেখে হাচুকতি আর লকতায় একটা ছেলেকে দত্তক নিল। সুখেই কাটছিল এরপরের দিনগুলো। কিন্তু সে গুড়ে বালি। জন্মানোর তিন বছরের মধ্যেই সেই সন্তান অকালে মারা গেল। সন্তানশোকে মুহ্যমান হাচুকতি আর লকতায় দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে সন্তানকামনায় ব্রহ্মার উদ্দেশে প্রার্থনায় লেগে পড়ল। ওদের খাওয়াদাওয়া ঘুম সব মাথায় উঠল। সাত বছর কেটে গেলে, একদিন ব্রহ্মার টনক নড়ল। তখন তিনি নিজেই নরসিঁয়ং নামে হাচুকতি আর লকতায়ের ভিটায় জন্ম নিলেন। আর তার বছর তিনেকের মধ্যেই জন্ম নিল খুলুংতি আর মাইলুংতি নামের দুই মেয়ে। হাচুকতি আর লকতায়ের এখন ভরা সংসার। আর সন্তানশোক নেই। কিন্তু সমস্যা একটাই, নরসিঁয়ংয়ের মেরুদণ্ড অস্বাভাবিক শক্ত। অথচ বাচ্চাদের মেরুদণ্ড এত শক্ত হওয়া ভাল লক্ষণ নয়। সে যাই হোক, বড় হয়ে এই নরসিঁয়ংই হলেন নরসিংহ বা নৃসিংহ। তিনি হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করে ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করলেন। কালক্রমে নরসিংহের বীরত্বের কথা জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। এমন একজন নির্ভীক বীর ছেলের এবার তো বিয়ে দিতে হয়। কিন্তু সেখানে আর এক বিপত্তি।
ছয় ছয় বার বিয়ে দেওয়ার পরও বিয়ে ভেঙে গেল নরসিংহের। বন্ধুবান্ধবরা এসব নিয়ে নরসিংহের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করে। টোনটিটকিরি কেটে নরসিংহকে ওরা ডাকে ‘গরয়া’ নামে। কারণ নরসিংহের সবেতেই গড়মিল। বিয়ে টিকছে না একের পর এক। তাই এরকম নামকরণ। গরয়া কথার মানেই তো গড়মিল। এই গরয়া নামটাই অপভ্রংশে হল গড়িয়া।
এদিকে আগের বিয়েগুলো ভেঙে গেছে তো কী হয়েছে? তাই বলে তো আর গড়িয়াকে বিয়ে না দিয়ে থাকা যায় না। অতএব গড়িয়ার জন্য সপ্তম বারের জন্য আর একটা বিয়ের আয়োজন করা হল। পাত্রীর নাম বুকমা। বুকমার সঙ্গে গড়িয়ার বিয়ে তো হল। কিন্তু বিয়ের পরদিনই গড়িয়া জেদ ধরল, সে সন্ন্যাস নেবে। সন্ন্যাসে যাওয়ার সময় গড়িয়া সবাইকে জানাল, সে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার এক রূপ। তারপর গড়িয়া তার স্ত্রী বুকমাকে জলের দেবী আর বোন মাইলুমার আর খুলুমাকে যথাক্রমে ধান আর কার্পাসের দেবী বানিয়ে, সন্ন্যাসের উদ্দেশে নিজের বাড়ি ছাড়ল।
হাচুকতি আর লকতায়ের এই সন্তান নরসিঁয়ংই গড়িয়া দেবতা নামে ত্রিপুরার দেববর্মা, জমাতিয়া, নোয়াতিয়া, খাকলু, রিয়াং, কলই, উচই সম্প্রদায়ের মানুষদের দ্বারা পূজিত হয়ে আসছেন।

এত গেল পৌরাণিক বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা। তবে যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ পূজাতেও নানা পরিবর্তন এসেছে। এখন ত্রিপুরার বিভিন্ন জেলার লোকজন এমনকি অনেক ক্লাবের উদ্যোগেও গড়িয়া পূজার আয়োজন করা হয়। এই বারোয়ারি পূজায় গড়িয়া দেবতার বিগ্রহকে সঙ্গে নিয়ে সাত দিনব্যাপী পাড়া না ঘোরা হলেও প্রতি বছর ৭ বৈশাখ নিয়মনীতি মেনে ও পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে গড়িয়া পূজার আয়োজন করা হয়। আর এই উপলক্ষে মেলা ও নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন হয়। এই পূজা এখন তাই ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকভাবেও সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যের একটি অন্যতম প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই ত্রিপুরায় গড়িয়া পূজা উপলক্ষে রাজ্যব্যাপী সরকারি ছুটি থাকে।

চিত্র: গুগল

বাথুকাম্মা: মেয়েদের একান্ত নিজস্ব কুসুম মহোৎসব

ফুল দেই: উত্তরাখণ্ডের ফুলেল উৎসব

4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »