এই লেখায় কভারের ছবিতে দেখতে পাচ্ছি— একজন বৃদ্ধ মানুষের কাঁধের দুপাশে পা ছড়িয়ে একটি বাচ্চা মেয়ে বসে। তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে খানিকটা আন্দাজ করা যাচ্ছে যদিও, তবু বলে দিই। কাঁধের ওপর বসা বছর দুয়েক বয়সের ওই বাচ্চা মেয়েটি নাতনি, আর যিনি দু-পা ধরে আছেন তিনি দাদু। ছোট্ট নাতনির মুঠিতে ধরে রাখা দাদুর সাদা চুল, আর দাদুর হাতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে একটি বুনো ফুল, সম্ভবত যেটি আসার পথে গাছ থেকে তোলা হয়েছে।
এবার দেখব নাতনিকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির ওই পক্ককেশ দাদুর পরিচয়টি কী?
জীববিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের চেনা চেনা লাগবে হয়তো ছবির এই দাদুকে। ওই দাদু এবং নাতনির পরিচয় দেওয়ার আগে বলি, পরবর্তী সময়ে এই ছবিটিই নাতনির সবচেয়ে প্রিয় ছবি। বড় হয়ে এই নাতনি তাঁর সঙ্গে দাদুর মধুর সম্পর্কের অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন। নাতনি লিখেছেন, ‘কী প্রাণবন্ত ছিলেন আমার দাদু, আপাদমস্তক হাসিখুশি, কেয়ারিং, একজন পরিপূর্ণ ফ্যামিলিম্যান।’ স্মৃতিচারণায় নাতনি আরও লিখছেন, ‘ক্লাস ফাইভে উঠে আমার স্কুলের শিক্ষকের কাছে আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম যে, আমার দাদুর কথা এনসাইক্লোপিডিয়া-তে আছে। আরও কয়েক বছর পরে আমি জানতে পারি যে, আমার দাদু একজন বিজ্ঞানী, যিনি নাকি বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ায় সফল হয়েছেন।’
ছবির এই পরিপূর্ণ সাংসারিক দাদুই হলেন বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস হ্যারি কম্পটন ক্রিক (Francis Harry Compton Crick, ১৯১৬-২০০৪)। ফ্রান্সিস ক্রিক হিসেবেই যিনি বেশি পরিচিত। একজন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। আর বিজ্ঞানীর এই নাতনির নাম কিন্ড্রা ক্রিক (Kindra Crick)। যুগান্তকারী একটি আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই কীর্তিমান বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিকের নাম। জীবনের আশ্চর্যময় যে অণু, যার পোশাকি নাম ‘ডিএনএ’— তার আণবিক গঠন উন্মোচনের অন্যতম একজন নায়ক তিনি। আমরা আজ সকলেই জানি, ‘ডিএনএ’-র মধ্যেই থাকে বংশগতির উপাদান, যা জীবনের মূল চাবিকাঠি। গগনচুম্বী মাইলফলক তাঁদের এই আবিষ্কার জীববিজ্ঞানের দুনিয়ায় আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। ১৯৫৩ সালের ২৫-এ এপ্রিল ‘নেচার’ গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয় সেই দিকপ্লাবী আবিষ্কারের ফলাফল। গবেষণাপত্রে তাঁরা নিশ্চিতভাবে বলেছিলেন, ‘ডিএনএ’ অণুর গঠনটি ‘ডাবল হেলিক্স’ চেহারার। অনেকটা ‘ঘোরানো সিঁড়ি’-র মত। এই অবদানের জন্যে অন্য আরও দুজন গবেষকের (ওয়াটসন এবং উইলকিন্স) সঙ্গে ১৯৬২ সালে ফিজিয়োলোজি ও মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ফ্রান্সিস ক্রিক।
উল্লেখ করা দরকার, ‘ডিএনএ’-র আণবিক গঠন (স্ট্রাকচার) ‘ডাবল-হেলিক্যাল, তা জানার পরবর্তী সময়ে ডিএনএ-র কার্যকারিতা সম্বন্ধে বিশদে জানা সম্ভব হয়েছে, একাধিক কীর্তিমান বিজ্ঞানীর গবেষণা থেকে। আরও একটা কথা মনে করিয়ে দিই, ‘ডিএনএ’ অণুর গঠন নির্মাণের মধ্যেই রয়েছে এমন সমস্ত বৈশিষ্ট্য, যার জন্যেই ডিএনএ অণুগুলি অভিনব ক্ষমতা আর ক্রিয়াকুশলতার অধিকারী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বলতে হয়, ‘ডিএনএ’ অণুর নিজেদের অবিকল প্রতিলিপি গঠন করতে পারার ক্ষমতার কথা।
‘ডিএনএ’ নামের এই রাসায়নিক অণুর মধ্যে যা থাকে তা জীবনের নকশার সংকেত আকারে তথ্য (জেনিটিক কোড অফ লাইফ)। কত তথ্য থাকে তার একটু আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করি। এক গ্রাম ডিএনএ-র মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ ‘সিডি’-র (কমপ্যাক্ট ডিস্ক) মধ্যে যত তথ্য ধারণ করতে পারে, সেই পরিমাণ বিপুল ক্যাপাসিটি বা ধারণ ক্ষমতা।
এখানে অন্য আর একটি অজানা কথা বলব। খুব বেশি বছর আগের কথা নয়। দশ বছর আগে, ২০১৩ সালে, নিউ ইয়র্ক অকশন-এ সাত পাতার একটি হাতে লেখা চিঠির নিলামে রেকর্ড দাম উঠেছিল ৫.৩ মিলিয়ন ডলার। ওই চিঠিটি কার? চিঠিটি ছিল ১৯৫৩ সালের ১৯ এপ্রিল ফ্রান্সিস ক্রিকের লেখা। লিখেছিলেন তাঁর বারো বছরের পুত্র মাইকেলকে। কী চমৎকার সহজ সরল ভাষায় লেখা সেই চিঠি, যেখানে বাবা যিনি স্বয়ং ফ্রান্সিস ক্রিক তাঁর স্কুলে পড়া পুত্রকে ডিএনএ অণু গঠনের আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন ছবি এঁকে! তখন একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়ে মাইকেল। ওই চিঠিতে সহজবোধ্যভাবে ছেলেকে বুঝিয়েছেন ডিএনএ অণুর গঠনের সৌন্দর্য। বুঝিয়েছেন, কীভাবে জীবন থেকে সৃষ্টি হয় জীবনের। চিঠিতে ‘ডিএনএ’ ডাবল হেলিক্স গঠনের স্কেচ হাতে এঁকে বুঝিয়েছেন। ছেলেকে লেখা চিঠিতে যা ছিল তা আসলে তাঁদের সদ্য আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ কাজের সারাৎসার! চিঠিটি পড়লে আশ্চর্য লাগে, কী করে পেরেছিলেন ওইরকম একটি জটিল বিষয়কে জলের মত সহজ করে বোঝাতে!
আবার দাদু ক্রিক ও নাতনির কথায় ফিরে আসি। ফ্রান্সিস ক্রিকের ছেলে মাইকেল ক্রিক, তাঁরই মেয়ে হল কিন্ড্রা। দাদুর কাঁধে বসা যাঁর ছবি দিয়ে শুরু করেছি এই লেখা। ফ্রান্সিস ক্রিকের সেই ছোট্ট নাতনি কিন্ড্রা বড় হয়ে একজন চিত্রশিল্পী হন। প্রথমে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিক্যুলার বায়োলজিতে ডিগ্রি পেয়েছেন, তারপরে শিকাগোর স্কুল অফ দ্য আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে পেইন্টিং নিয়ে কোর্স করেন কিন্ড্রা। দাদু এবং দাদুর কীর্তি কিন্ড্রার জীবনে বিরাট প্রভাব। অনেক চিঠিপত্রে উঠে এসেছে দাদুর সঙ্গে নাতনির স্নেহের সম্পর্কের নানান কথা। দাদুর লেখা চিঠিতে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্ড্রা বলেছেন,— ‘দাদু যথেষ্ট সমীহ করতেন ফ্রাঙ্কলিনের কাজ। ওয়াটসনের লেখা বইয়ে রোজালিন্ডকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা সত্য থেকে অনেকখানি দূরে।’
ফ্রান্সিস ক্রিকের যখন ষাট বছর বয়স তখন তিনি ক্যালিফর্নিয়ার সাল্ক ইন্সটিটিউট অফ বায়োলজিক্যাল স্টাডিজ-এ জয়েন করছেন, সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করার জন্যে। ডিএনএ গঠন নিয়ে গবেষণা, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ক্ষেত্র— ‘তাত্ত্বিক নিউরো বায়োলজি’। পরবর্তী আটাশ বছর ‘নিউরো বায়োলজি’ ক্ষেত্রে গবেষণা করেছেন ক্রিক। নাতনি কিন্ড্রা সাল্ক ইন্সটিটিউটে অন্য একটি গবেষণাগারে ইন্টার্নশিপের কাজ করেছেন। সেসময় দাদুর ল্যাবরেটরিতে অনেকবার গেছেন কিন্ড্রা। দাদুকে তখন একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এখানে তো কিছু যন্ত্রপাতি নেই, টেস্টটিউব নেই, কী কাজ করো তুমি তাহলে?’ দাদু বলেছিলেন— ‘আমি এখানে বসে চিন্তা করি।’
ফ্রান্সিস ক্রিকের দ্বিতীয় স্ত্রী ওডাইল ক্রিকও (Odile Crick) ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী। ভিয়েনা এবং লন্ডন থেকে আর্টের শিক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালের সুবিখ্যাত নেচার পত্রিকার দিকপ্লাবী যে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে একমাত্র যে ‘ডিএনএ’ গঠনের স্কেচটি আছে তা ছিল ওডাইলের আঁকা, অনেকেই সে কথা জানি না। নেচার পত্রিকার ওই স্কেচটিই পরবর্তী সময়ে আইকনিক হয়ে রয়েছে।
এখানে ক্রিকের নাতনি কিন্ড্রার একটি বিখ্যাত ভাস্কর্যের ছবি দিলাম। যা ৫,০০,০০০ ডলারে নিলামে দাম উঠেছিল। দাদুর স্মৃতির উদ্দেশে একটি নতুন বায়োমেডিকেল রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্যে সেই টাকা দিয়েছেন কিন্ড্রা। ২০১৫-তে আয়োজিত হয়েছিল এই ‘অর্থ সংগ্রহ প্রোগ্রাম’। সেই প্রোগ্রামের থিম ছিল ‘হোয়াট ইন ইয়োর ডিএনএ?’ কিন্ড্রা তাঁর শিল্পকর্মের শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘হোয়াট ম্যাড পারস্যুট’, যা ছিল দাদুর প্রতি শ্রদ্ধা আর সেই সঙ্গে বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রতি ভালবাসার নিদর্শন। বস্তুত, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত দাদু ফ্রান্সিস ক্রিকের লেখা ‘What Mad Pursuit: A Personal View of Scientific Discovery’ শীর্ষক বই থেকে নামটি রেখেছিলেন।
শুধু জীবনেই নয়, কিন্ড্রার অনেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পেও রয়েছে দাদুর প্রভাব। দাদু ও ঠাকুমার ডিএনএ এইভাবে কিন্ড্রার শরীরের মধ্যেও প্রবাহিত।
আজ ৮-ই জুন, কিংবদন্তি বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিকের জন্মদিন। তাঁর ১০৭ বছরের জন্মদিনে রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
অসাধারণ সুন্দর একটি উপস্থাপনা … মন ছুঁয়ে গেল।
প্রাপ্তি