জায়গা ছিল না কোনো কথা বলবার, শুনবার।
সমুদ্রের ধারে যেতে পথের বাদাম গাছগুলি
মিহি কথার কৌতুকে পাথর ফুলের ধাক্কা দিল
আমি কী বলেছিলাম, তোমরা শুনেছো যারা বেশি
শোনাবে— একটুখানি। আমি ভুলে গেছি জন্ম আছে।
কিছু যন্ত্রণার কথা যেভাবে বলেছি মনে নেই
একটু আনন্দ কথা, রয়েছে গোলাপি স্তম্ভে স্থির
অন্ধ থেকে চোখে জেগে সমুদ্র বালির স্তূপে, দেখি।
কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের ‘বলবার ছিল’ কবিতার উজ্জ্বল পঙ্ক্তিমালা। গত শতকের আটের দশকের কবির ‘বলবার ছিল’, অথচ ‘জায়গা ছিল না’! কী সেই ‘পাথর ফুলের ধাক্কা’, যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে একদিন আচম্বিতে স্বদেশের ঠিকানা থেকে, কবিতার ভুবন থেকে এবং নিজের থেকেই নিজে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন! সব স্মৃতি ও সত্তা মুছে ফেলে অন্তরালবাসী হয়েছিলেন! কোন অভিমানে ভুলে গিয়েছিলেন ‘জন্ম’ ও ‘যন্ত্রণার কথা’? হারিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ দু’দশক পর মিলেছিল তাঁর সন্ধান। তখন তিনি অন্য এক নিভৃত জগতের বাসিন্দা। এরপর কেটেছে আরও দশটি বছর। এখন তিনি সচেতন, মৃদুভাষ। সেই মৃদু অথচ স্পষ্টভাষণ শুনেছেন শুভঙ্কর সাহা। সঙ্গী শুভদীপ রায়।
প্রশ্ন : বিষ্ণুদা, কেমন আছেন?
উত্তর : ভাল।
প্রশ্ন : এই কোভিড অতিমারির কালে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছে পৃথিবী। মাঝের সময়টায় ভয় লাগেনি?
উত্তর : তেমন না। আমি তো বাইরে কোথাও যাই না।
প্রশ্ন : কীভাবে সময় কাটছে? নতুন লেখা কিছু…
উত্তর : (একটু থেমে) এই কেটে যাচ্ছে। না, নতুন লেখা কিছু পারছি না।
প্রশ্ন : আপনার লেখা অনেকে পড়তে চাইছেন, আপনার কথা জানতে চাইছেন, তাদের জন্য কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না?
উত্তর : আসলে আসছে না। তাগিদ অনুভব করছি না ভেতর থেকে।
প্রশ্ন : আপনার লেখালেখির শুরুর কথা যদি বলেন…
উত্তর : স্কুলে পড়ি তখন। নাইন-টেন হবে।
প্রশ্ন : কাদের লেখা পড়তে ভাল লাগত?
উত্তর : রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ। নজরুলও ভাল লাগত। অনেকের লেখা যেমন, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, (একটু থেমে) মহাদেব সাহা, আরও অনেকের।
প্রশ্ন : আপনার তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। কোন সময়টা?
উত্তর : ওটা ওই আশির মাঝামাঝি।
প্রশ্ন : আপনাদের তো একটা লিটল ম্যাগাজিন ছিল ‘পেঁচা’। বন্ধুদের কথা মনে আছে?
উত্তর : বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে করেছিলাম। পত্রিকার কোনও সম্পাদক ছিল না।
প্রশ্ন : বন্ধুরা যারা লিখতেন একসাথে…
উত্তর : হ্যাঁ, অসীম, সরকার মাসুদ, মো. কামাল।
প্রশ্ন : শুনেছি আপনি ভাল আবৃত্তি করতেন। আবৃত্তিচর্চার সঙ্গী ছিলেন নিশাত জাহান। তাঁর কথা যদি কিছু বলেন।
উত্তর : আমার বন্ধু। ভাল বন্ধু।
প্রশ্ন : আর দেখা হয়েছে?
উত্তর : অনেক পরে। কথা হয়েছে কয়েকবার।
প্রশ্ন : আপনার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘ভোরের মন্দির’, নিশাতের প্রকাশনা থেকেই তো বেরিয়েছিল?
উত্তর : ওরাই বের করেছিল। ওটা ১৯৯২ সাল নাগাদ।
প্রশ্ন : আপনি তো সে সময়ে ঢাকায় নেই?
উত্তর : না। বন্ধুরাই কবিতা যোগাড় করে ছেপেছিল। আমি কিছু জানি না।
প্রশ্ন : তার মানে এর অধিকাংশ কবিতাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন লেখা?
উত্তর : হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারপর তো…
প্রশ্ন : কবে জানতে পারলেন বইয়ের কথাটা? বইটাই বা হাতে পেলেন কবে?
উত্তর : অনেক পরে। বছর কুড়ি পরে। ওরা আমাকে খুঁজে দিয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন : আপনার এই কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতায় সমুদ্রের কথা এসেছে। সমুদ্র আপনার খুব পছন্দের বোধহয়!
উত্তর : ঠিকই। (চোখে উদাস চাহনি) সমুদ্রের বিস্তার আমাকে টানে।
প্রশ্ন : আপনার একটি কবিতায় পড়েছি— ‘একা আছি/ অনেকদিন অন্ধকারে/ অনেকদিন রক্তের ভিতরে স্তম্ভিত আকাশ/ সমুদ্র দ্যাখেনি’। কিছু বলুন না এই পঙ্ক্তিগুলো নিয়ে…
(কিছুই বললেন না। কিন্তু মুখের রেখায় যেন বিষন্নতা ফুটে উঠল।)
আপনি কি কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছিলেন?
উত্তর : হ্যাঁ, অল্প কিছুদিন। ঢাকার দৈনিক কাগজ ‘দিনকাল’। কাগজের সাব-এডিটর মত।
প্রশ্ন : কবি হিসেবে আশির দশকের বাংলাদেশে সাড়া জাগানো নাম বিষ্ণু বিশ্বাস। তারুণ্যের দাপটে, ঔদ্ধত্যে তখন জেগে উঠছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সেই আশির দশকে বা নব্বইয়ের প্রথমে ‘একুশে’-র উদযাপন কেমন ছিল?
উত্তর : একটা কষ্ট ছিল… কোথাও একটা বেদনা জড়িয়ে থাকত।
প্রশ্ন : শুনেছি, অতিমারির বছর-খানেক আগে একবার ঢাকায় গিয়েছিলেন।
উত্তর : বন্ধুরা নিয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন : তখন কি বন্ধুসঙ্গে কবিতা এসেছে?
উত্তর : বেশ কিছু লিখেছি। ওদের কাছে আছে।
প্রশ্ন : সেগুলো নিয়ে একটা বই হলে ভাল হয়।
উত্তর : আমি ঠিক জানি না। মনে হয় ওরা করবে।
প্রশ্ন : মাপ করবেন, আবার জিজ্ঞেস করছি, এখানে বসে কি কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে না?
উত্তর : ঠিক জানি না। তবে শুনতে ভাল লাগে। আপনার একটা কবিতা পড়ুন না!
(কবির অনুরোধে একটা নয়, দুটো কবিতা পড়তে হল। চুপ করে শুনলেন। তারপর ছোট্ট মন্তব্য করলেন, ‘বেশ’।)
প্রশ্ন : শুনেছি কবি বিভাস রায়চৌধুরী, মৃদুল দাশগুপ্ত এঁরা আপনার পরিচিত। এদের সঙ্গে কোথায় আলাপ?
উত্তর : বিভাস এসেছিলেন। দেখা হয়েছে। ঢাকাতে ওঁর বই পড়েছি।
প্রশ্ন : আর মৃদুলদা?
উত্তর : একবার মৃদুলদার বাড়ি গিয়েছিলাম। ঢাকাতেও দেখা হয়েছিল।
প্রশ্ন : এবার শেষ করব। একজন কবি হয়ে ওঠার ব্যাপারটা কী চোখে দেখেন?
উত্তর : দেখুন, কবি হয়ে ওঠা… দেশ, মানুষ এদের সবার প্রতি ভালবাসা থাকতে হবে। না হলে কবি হওয়া যায় না।
প্রশ্ন : দু’দেশেই আপনার কবিতার অনুরাগী রয়েছেন। আপনার নিজের কি মনে হয়, আপনার কবিতা বিস্মৃতির অথবা স্বীকৃতির যোগ্য?
উত্তর : সেরকম বেশি কবিতাও লেখা হয়নি… কবিতার কাছে কোনও দাবিও ছিল না।
বেশ হয়েছে।