১৮৫৮-য় সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নিজের শিক্ষাদর্শকে বাস্তব রূপ দিতে তিনি ছিলেন আগাগোড়া আপসহীন। বাধাবিপত্তি কাটাতে না-পারলে বিদ্যাসাগর নির্দ্বিধায় চাকরি ছেড়েছেন— ব্যক্তিগত অসুবিধের কথা কখনই ভাবেননি। ঠিক যে, খামখেয়ালিপনা আর আত্মসম্মানবোধ ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। সবমিলিয়ে বলা যায়, এমন মানুষ সরকারি কর্মচারী হিসেবে যে স্বস্তি পাবেন না— এ তো অনিবার্য! অবশ্য পাশাপাশি ছিল বিদ্যাসাগরের অগাধ আত্মবিশ্বাস— কারও সাহায্য না-পেলেও একা-একা লক্ষ্যে পৌঁছনোর প্রত্যয়। তাই শিক্ষাবিস্তারে সরকারি ব্যবস্থা ও পরিকাঠামোর ওপর আস্থা হারানোর পর তিনি থেমে যাননি। সংস্কৃত কলেজের অধ্যায়কে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যমে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে বিদ্যাসাগর গড়ে তুলেছেন আর-একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান— মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন।
১৮৫৯-এ শঙ্কর ঘোষ লেন-এ ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল খোলেন কয়েকজন ভদ্রলোক। তাঁদের অনুরোধে বিদ্যাসাগর স্কুলের পরিচালন কমিটিতে যোগ দেন। সে-কমিটি পরে পাল্টায়; সম্পাদকের পদ নেন বিদ্যাসাগর। ১৮৬৪-তে প্রতিষ্ঠানটির নাম হল হিন্দু মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন। কমিটির বাকি পাঁচজন সম্পর্ক ছেদ করায় অথবা মারা যাওয়ায় ১৮৬৮ থেকে স্কুলের দায়িত্ব পড়ল বিদ্যাসাগরের ওপর। ১৮৭২-এর গোড়ায় দ্বারকানাথ মিত্র আর কৃষ্ণদাস পালকে নিয়ে তিনি আলাদা কমিটি গড়লেন; তখন স্কুলের নাম দাঁড়াল মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন। সে-বছরই ফার্স্ট আর্টস (এফ. এ.) পর্যন্ত পড়ানোর জন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট-এর কাছে অনুমতি চাওয়া হল।
বিদ্যাসাগর জানতেন, বাঙালি শিক্ষকরা পড়াতেন বলে স্কুলের শিক্ষার মান নিয়ে রেজিস্ট্রার জে. সাটক্লিফ (যিনি একইসঙ্গে ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ) আর সিন্ডিকেটের অন্যান্য সায়েব সদস্য আপত্তি তুলতে পারেন। তাই স্বরাষ্ট্র সচিব ও সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ই. সি. বেইলি-কে একটি চিঠিতে তিনি আগেই মনে করালেন: সংস্কৃত কলেজে যেহেতু এদেশীয় অধ্যাপকরাই স্নাতক স্তর অব্দি পড়ান সেইহেতু এমন যুক্তি অবান্তর। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও শিক্ষকের মান নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিদ্যাসাগরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকেই বরং মানদণ্ড ধরা উচিত। সেইসঙ্গে তিনি জানালেন তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। সরকারি প্রেসিডেন্সি কলেজের মাইনে ছিল সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে; অন্যদিকে, ধর্মীয় কারণে অনেক অভিভাবকই ছেলেদের মিশনারি কলেজে পাঠাতেন না। ফলে ম্যাট্রিকুলেশনের পর লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হত বহু ছাত্র। তাদের উঁচুমানের শিক্ষা দেওয়াই ছিল মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনের লক্ষ্য। দরকার পড়লে, ইংরেজি সাহিত্যের জন্যে ইংরেজ অধ্যাপক নেওয়া হবে— এমন আশ্বাসও অবশ্য তিনি দিয়েছিলেন বেইলি-কে। মনে রাখা ভাল, ১৮৬৪-তে একই আবেদন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নাকচ করেছিল; এবার সেটি অনুমোদন পেল।
দুবছর পর, ১৮৭৪-এ, এফ এ পরীক্ষার ফল বেরনোর আগে খুবই উৎকণ্ঠায় ছিলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু দেখা গেল, দ্বিতীয় হয়েছেন যোগীন্দ্রচন্দ্র বসু; সরকারি বৃত্তি পেয়েছেন চারজন ছাত্র। সাটক্লিফ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘the Pundit has done wonders’— পণ্ডিত তাক লাগিয়ে দিয়েছেন’। ছাত্ররা ক্রমাগত ভাল ফল করায় এরপর ১৮৮১-তে স্নাতক স্তর অব্দি পড়ানোর সুযোগ পায় মেট্রোপলিটান ইন্স্টিটিউশন। শুধু তা-ই নয়, ১৮৮২-তে আসে বি এল পাঠ্যক্রম পড়ানোর অনুমোদন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এভাবেই ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন। শিক্ষক নির্বাচন, তাঁদের ওপর নজর রাখা, ছাত্রদের শাসনের পাশাপাশি আবদার মেটানো, শিক্ষক ও কর্মচারীদের দেখভাল— একা হাতে সব সামলাতেন বিদ্যাসাগর। প্রতিষ্ঠানটির জন্যে জমি কেনা ও বাড়ির তোলার সময় তিনি ধার-দেনাও করেন প্রচুর— যা ১৮৯১-এ পুরোপুরি শোধ হয়। নির্মাণ চলাকালীন নিজে তদারকি করতেন বিদ্যাসাগর। ১৮৮৭-র জানুয়ারিতে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন নতুন (এখনকার) বাড়িতে উঠে এল। সবমিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল তখন।
মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনকে সঠিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিদ্যাসাগরচরিত-এ তিনি লেখেন:
সংস্কৃতকলেজের কর্ম ছাড়িয়া দিবার পর বিদ্যাসাগরের প্রধানকীর্তি মেট্রোপলিটান ইনস্টিটুশ্যন। বাঙালির নিজের চেষ্টায় এবং নিজের অধীনে উচ্চতর শিক্ষার কলেজ স্থাপন এই প্রথম। আমাদের দেশে ইংরাজিশিক্ষাকে স্বাধীনভাবে স্থায়ী করিবার এই প্রথম ভিত্তি বিদ্যাসাগর-কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইল। যিনি দরিদ্র ছিলেন, তিনি দেশের প্রধান দাতা হইলেন; যিনি লোকাচাররক্ষক ব্রাহ্মণপণ্ডিতের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনি লোকাচারের একটি সুদৃঢ় বন্ধন হইতে সমাজকে মুক্ত করিবার জন্য সুকঠোর সংগ্রাম করিলেন, এবং সংস্কৃতবিদ্যায় যাঁহার অধিকারের ইয়ত্তা ছিল না, তিনিই ইংরাজিবিদ্যাকে প্রকৃতপ্রস্তাবে স্বদেশের ক্ষেত্রে বদ্ধমূল করিয়া রোপণ করিয়া গেলেন।
একথা ঠিক যে, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন পাঠ্যক্রমের আমূল পরিবর্তন ঘটানো অথবা সরকারি সাহায্যে নানা জায়গায় স্কুল খোলার মত ছড়িয়ে কাজের সুযোগ এখানে ছিল না। কিন্তু মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে বিদ্যাসাগর যা করলেন— তা এককথায় নজিরবিহীন। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঙালি শিক্ষক-অধ্যাপকদের দিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের বাংলা-ইংরেজিতে লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা হল। ঠিকই যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষাব্যবস্থার বাইরে তিনি যেতে পারেননি। তবু সায়েবদের বিদ্যাসাগর দেখিয়ে দিলেন বাঙালির ক্ষমতা কতখানি। জাতীয়তাবাদের আদিযুগে এর রাজনৈতিক তাৎপর্য অসীম। স্বদেশি আন্দোলনে বয়কট কর্মসূচি গ্রহণের বহু আগে বিদ্যাসাগর গড়ে তোলেন এক সম্পূর্ণ দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান— যার সাফল্য সায়েবদেরও চমকে দেয়।
প্রশ্ন ওঠে, বিদ্যাসাগর কি আদৌ ব্রিটিশ শাসনের বিরোধী ছিলেন? এ কথা ঠিক নয় কি যে, রামমোহন রায়ের মতই শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি থেকেছেন সর্বদাই সরকার ও নানা ব্রিটিশ আধিকারিকদের ওপর নির্ভরশীল? সকলেই জানেন, ধর্মের পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গেও বিদ্যাসাগর সরাসরি সম্পর্ক রাখেননি কোনওদিন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (যা ছিল জমিদারদের রাজনৈতিক সংগঠন)-এর নেতা ও তাঁদের কাজকর্ম নিয়ে তিনি রীতিমত ঠাট্টা করতেন। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন ‘ভারত-সভা’ (১৮৭৬)-র সভাপতির পদ নিতেও রাজি হননি তিনি। ‘শারীরিক অসুস্থতার দোহাই’ দিয়ে আনন্দমোহন বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আর শিবনাথ শাস্ত্রীর অনুরোধ বিদ্যাসাগর ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি, ১৮৮৬-তে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-এর দ্বিতীয় অধিবেশন (কলকাতা)-এ যোগ দেওয়ার প্রস্তাব এলে তিনি বলেন:
বাবুরা কংগ্রেস করছেন, আস্ফালন করছেন, বক্তৃতা করছেন, ভারত উদ্ধার করছেন। দেশের হাজার হাজার লোক অনাহারে মরছে, সেদিকে কারও চোখ নেই। রাজনীতি নিয়ে কী হবে? যে-দেশের লোক দলে দলে না খেয়ে প্রত্যহ মরে যাচ্ছে, সে দেশে আবার রাজনীতি কি?
খেয়াল রাখা দরকার, রাজনৈতিক সভা-সমিতি নিয়ে বিদ্যাসাগর এমন নেতিবাচক মনোভাব দেখালেও মাঝেমাঝে তাঁর মতামত শুনে অন্যরা কিন্তু বিব্রত হতেন যথেষ্ট। এমনই চরমপন্থী ছিল সেসব মন্তব্য। ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের ওপরের কথাগুলি বলার পর বিদ্যাসাগর তাঁদের প্রশ্ন করেন: “দেশের স্বাধীনতা পেতে গেলে শেষ পর্যন্ত যদি দরকার হয় তারা কি তলোয়ার ধরতে পারে?” এছাড়া, ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে বিপ্লবী দলের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে মেদিনীপুরের এক বৃদ্ধ পণ্ডিত (জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু) জানান যে, বিদ্যাসাগর তাঁর বন্ধুদের বলতেন, “তোমাদের আর উপায় নাই, জঙ্গলে গিয়ে পল্টন তৈয়ার কর।’’ জ্ঞানেন্দ্রনাথ আরও জানান, বিদ্যাসাগর “সময়ে সময়ে এত গরমভাবে কথা বলিতেন যে, বন্ধুরা তাঁহার ঘরে কপাট বন্ধ করিয়া দিতেন।’’
বোঝা যায়, প্রথমদিককার রাজনৈতিক সভাসমিতির কর্মপদ্ধতির সঙ্গে একমত হতে পারেননি বিদ্যাসাগর। শাসকের কাছে অনুনয়-বিনয় করে মধ্যবিত্তদের জন্যে কিছু দাবি আদায়ে তাঁর সায় ছিল না। তাই নিজের কাজের এলাকা হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষা ও সমাজ-সংস্কারের নির্দিষ্ট গণ্ডি— ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো আর নারীর দুঃখ-দুর্দশা দূর করা— যেখানে সর্বস্ব পণ করে তিনি এগোতেন ধাপে ধাপে, একটি লক্ষ্যপূরণের পর আর-একটির দিকে। দেশ-কাল-পরিস্থিতি অনুযায়ী যতখানি পরিবর্তন সম্ভব বিদ্যাসাগরের পরিকল্পনায় ঠিক ততখানি ধরা পড়ত। আর বেশিরভাগ সময়ে তিনি তা হাসিলও করতেন। আদ্যপান্ত বাস্তববাদী ছিলেন বিদ্যাসাগর।
পাশাপাশি মনে রাখতে হবে বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর কথা— অন্যদের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের যা অন্যতম কারণ। নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি ছিলেন সর্বদা অনড়; দেশি-বিদেশি কারও কাছেই তাঁর মাথা নত হত না। বিদ্যাসাগরের জীবনে আকছার ঘটেছে এমন ঘটনা। বিশেষত বিভিন্ন সময় ব্রিটিশদের সঙ্গে নানা বিষয় তাঁর মতপার্থক্য অন্য একটি দিক খুলে দেয়। হিন্দু কলেজের প্রিন্সিপাল কার-এর সামনে যেমন টেবিলে চটিসুদ্ধ পা তুলে দিয়েছিলেন তেমনি ছোটলাট হ্যালিডে-র সঙ্গে দেশি পোশাকে দেখা করেছিলেন তিনি। চটি পায়ে ঢুকতে না-পেরে ভারতীয় যাদুঘরের কর্তৃপক্ষকে বিদ্যাসাগর কড়া চিঠি লেখেন একবার। এছাড়া, মনে রাখা দরকার, সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যক্রম নিয়ে ব্যালান্টাইন-এর প্রস্তাবের বিরোধিতা আর অর্থকষ্ট সত্ত্বেও প্রেসিডেন্সি কলেজের সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে ইওরোপীয়দের সমান বেতন দাবি। এসব ঘটনায় স্রেফ তাঁর তেজস্বী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়— এমন নয়, তাঁর স্বদেশিকতাও স্পষ্ট ফুটে ওঠে। বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই তাঁকে “বঙ্গীয় সমাজের সর্বপ্রধান বিদ্রোহী” বলে সম্বোধন করেছিল ‘প্রবাহ’ পত্রিকা। সেখানেই লেখা হয়: রামমোহন ছিলেন প্রথম বিদ্রোহী। শিবনাথ শাস্ত্রী বলেন, রামমোহনের মতই বিদ্যাসাগরের ছিল ‘স্বদেশপ্রিয়তা’— সমাজ, শিক্ষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে তাঁর আগ্রহ। খেয়াল রাখা জরুরি, ভারত-সভার প্রথম সভাপতির পদ না-নিলেও বিদ্যাসাগর এমন উদ্যোগের ব্যাপারে ‘বিশেষ উৎসাহ’ দেখিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগরের কাজকর্মর সঙ্গে যে ব্যাপক অর্থে রাজনীতির যোগ ছিল— এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই। তাঁর কাছে জাতীয়তাবাদের অর্থ: সমাজে গঠনমূলক কাজ, সভা-সমিতিতে বক্তৃতা নয়। বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণ ও বিস্তার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অমানবিক লোকাচারের বিরোধিতা আর ইওরোপীয় প্রগতিশীল ধ্যানধারণার প্রচার— সবের মধ্যে দিয়েই জাতির ভিত গড়েন তিনি। রামমোহনের ঐতিহ্য— আধুনিকতার ধারায় দেশীয় সমাজকে সামিল করা— ছিল বিদ্যাসাগরের মডেল। ব্রিটিশ শাসনকে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিতে প্রথম দেখেছিলেন এঁরা; বুঝেছিলেন, তাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলতে হবে দেশ। তাঁরা দুজনেই উপলব্ধি করেন, সরাসরি ব্রিটিশ-বিরোধিতার বদলে সমাজগঠন তখন অনেক বেশি জরুরি। আর-একটি কথা: রামমোহনের থেকেই বিদ্যাসাগর পেয়েছিলেন বাধাবিপত্তি পেরিয়ে একা-একা কাজ করার প্রেরণা। ভুললে চলবে না, রামমোহন আর বিদ্যাসাগরের কাজের রাজনৈতিক মাত্রা সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন স্বয়ং অরবিন্দ ঘোষ (পরে শ্রীঅরবিন্দ)।
মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন তৈরি নিঃসন্দেহে বিদ্যাসাগরের শেষজীবনের প্রধান কীর্তি। সেখানকার শিক্ষকদের জন্যে পেনশনের ব্যবস্থা করতে পারেননি বলে জীবনের শেষ দিনগুলিতেও দুঃখ ছিল তাঁর। বলা যায়, সমাজ-শিক্ষা-রাজনীতি নিয়ে তাঁর যাবতীয় ধ্যানধারণা দানা বেঁধেছিল মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে। তাই স্বাধীনভাবে নিজের মত সেটি বিদ্যাসাগর গড়তেও চেয়েছিলেন। স্বাভাবিক যে, সব ব্যাপারে তিনিই শেষকথা বলতেন। খুঁটিনাটি ব্যাপারের পাশাপাশি শিক্ষক নির্বাচন, তাঁদের বেতন, ক্লাসে তাঁদের আচরণ, এমনকি, তাঁদের ছাঁটাই (তারমধ্যে জামাই সূর্যকুমার অধিকারীও ছিলেন)— সবই একা করতেন বিদ্যাসাগর। কখনও সেসব ঘটত মুহূর্তের সিদ্ধান্তে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাঁকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষর মতামতের জন্যে অপেক্ষা করতে হত। সেইসময় মতবিরোধের জেরে সংঘাতও ঘটত। মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে তেমন সম্ভাবনাই ছিল না।
দুই
সেপ্টেম্বর ১৮৭১-এ ইংল্যান্ডে আই.সি.এস. পাশের পর দেশে ফিরলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতায় তিনি পেলেন সাদর অভ্যর্থনা। সেই অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সিলেটে তিনি সহযোগী ম্যাজিস্ট্রেট-এর পদে যোগ দেন ২২ নভেম্বর। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সুরেন্দ্রনাথ বুঝলেন: প্রশাসনিক স্তরে ভারতীয়দের মেনে নিতে অনেক ব্রিটিশ আধিকারিকই চাননি— যেন তাঁদের মৌরসিপাট্টায় অবশেষে ভারতীয়রা ভাগ বসাল। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল, ব্রিটিশ সরকারের নীতি আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক বিস্তর। সুরেন্দ্রনাথের খ্যাতি আর সাফল্য কর্তাব্যক্তিদের চোখে লাগল। ফলে, একটি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ জানালেন ম্যাজিস্ট্রেট সাদারল্যান্ড। কোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিশন সুরেন্দ্রনাথকে দোষী সাব্যস্ত করল। ১৮৭৪-এ ইংল্যান্ডে গিয়ে দরবারের পরও ভারত সরকারের সুপারিশ পাল্টানো গেল না— চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন সুরেন্দ্রনাথ। এর জেরে তাঁর ব্যারিস্টার হওয়ার সম্ভাবনাও ভেস্তে গিয়েছিল।
উদারনীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান আর ব্রিটিশ সংবিধান-স্বীকৃত ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার সম্পর্কে সুরেন্দ্রনাথের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তাই চাকরি খুইয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, প্রশাসনিক স্তরে ভারতীয়দের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে অবস্থা নিশ্চিত পাল্টাবে। নিজে বঞ্চিত হলেও অন্যরা যাতে তাঁদের অধিকার অর্জন করেন— তার জন্যে গণসংগঠন আর জনমত তৈরির কাজ বেছে নিলেন তিনি। সভা-সমিতির গুরুত্ব নিয়ে সুরেন্দ্রনাথের মনে সন্দেহ রইল না। বরং তাঁর প্রত্যয় জন্মাল: আগামীদিনে শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির এসব ছাড়া গতি নেই।
ইংল্যান্ড থেকে জুন ১৮৭৫-এ কলকাতায় ফেরার পর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সুরেন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। দেশসেবা অভীষ্ট হলেও সংসার চালানোর উপায় তাঁর জানা ছিল না। বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছেন:
ইংরেজ আমলাতন্ত্র তাঁহাকে [সুরেন্দ্রনাথকে] দাগিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিল বলিয়া তাঁহার পক্ষে কোন বড় বেসরকারি কর্ম্ম পাওয়াও অসম্ভব হয়। সেকালে আমাদের সমাজে ইংরেজ রাজপুরুষদিগের এমনই প্রভাব ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি সুরেন্দ্রনাথকে তাঁহার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে ইংরেজীর অধ্যাপক পদে নিযুক্ত না করিতেন, তাহা হইলে সুরেন্দ্রনাথের ভবিষৎ জীবন কি হইত তাহা বলা যায় না।
বলা বাহুল্য, বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রজি হয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। বেতন দুশো টাকা— যা ছিল সহযোগী ম্যাজিস্ট্রেটের মাইনের অর্ধেকেরও কম। বন্ধু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলেকে বরাবরই স্নেহ করতেন বিদ্যাসাগর; সুরেন্দ্রনাথের বিলেতে গিয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর খুব উৎসাহ ছিল। পরীক্ষায় তাঁর বয়েস নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে বিদ্যাসাগর কলকাতা পুলিশ কোর্টে সে-বিষয় সাক্ষ্য দেন। দুর্গাচরণের কাছে প্রথমদিকে ইংরেজি শিখেছিলেন বিদ্যাসাগর। পরে ডাক্তার হয়ে বিদ্যাসাগরের মুমূর্ষু শিক্ষক গঙ্গাধর তর্কবাগীশের বিনামূল্যে চিকিৎসাও করেন দুর্গাচরণ। বিধবাবিবাহ প্রকল্পেও দুর্গাচরণ টাকা (যদিও প্রতিশ্রুতিমত নয়) দেন। এ বিষয়ে নিজের তিক্ত মনোভাব বিদ্যাসাগর জানান একটি চিঠিতে। অবশ্য বন্ধুর মৃত্যু্র পর তিনি চোখের জল সামলাতে পারেননি। এতটাই গভীর ছিল তাঁদের সম্পর্ক।
সাময়িক অর্থকষ্ট মেটার পাশাপাশি মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনের চাকরি সুরেন্দ্রনাথকে আর-একভাবে সাহায্য করে। পড়ানো ছাড়াও যুবকদের মধ্যে বরাবর স্বদেশি চেতনার বিস্তার চেয়েছেন তিনি। মেট্রোপলিটানে ইনস্টিটিউশনে সেই সুযোগ পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে ‘ছাত্র সমিতি’ স্থাপন করেছেন আনন্দমোহন বসু; সেখানে সক্রিয় অংশ নিলেন সুরেন্দ্রনাথ। খোলা হল বিভিন্ন কলেজে তার শাখা-সংগঠন। কলকাতা, উত্তরপাড়া, খিদিরপুর ইত্যাদি জায়গায় তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। সুরেন্দ্রনাথের বক্তৃতা জুড়ে থাকত ভারতীয় ঐক্য, ইতিহাসচর্চা, উচ্চ ইংরেজি শিক্ষা, চৈতন্য আর জুসেপ্পে মাৎসিনি (১৮০৫-৭২)-র জীবনবৃত্তান্তর মত বিষয়।
রাজনীতিতে ছাত্রদের আগ্রহ বাড়ুক— তাই সুরেন্দ্রনাথ বিশেষভাবে মাৎসিনির দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, মানবতাবাদ ও ইতালির সংযুক্তিকরণে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বলতেন। এমনকি, বাংলায় মাৎসিনির জীবনী বের করার পেছনেও তাঁর উদ্যোগ ছিল। সুরেন্দ্রনাথ অবশ্য ছাত্রদের সতর্ক করতেন এই বলে যে, ইতালীয় রাজনীতিবিদের বৈপ্লবিক তত্ত্ব তারা যেন এড়িয়ে যান। আমরণ শান্তিপূর্ণ ও সংবিধানসম্মত পথেই এগোতে চেয়েছেন তিনি।
কলেজ ছাত্রদের পেরিয়ে সরাসরি রাজনীতির জগতে সুরেন্দ্রনাথের ঢোকার সুযোগ এল ১৮৭৬-এ। জমিদারদের ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ নিয়ে সন্তুষ্ট না-থেকে সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলন আর জনমত তৈরির প্রয়োজন ক্রমশ বাড়ছিল। মধ্যবিত্তদের একটি সংগঠন হোক— এমন চেয়েছিলেন দ্বারকানাথ মিত্র ও বিদ্যাসাগর। তাঁদের অবশ্য মাথায় ছিল শুধু বাংলার প্রসঙ্গ। কিন্তু আনন্দমোহন বসু, অক্ষয়কুমার সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ তখন গোটা ভারতের প্রেক্ষিতে চিন্তাভাবনা করছেন। তাই ২৬ জুলাই যে সংগঠন জন্ম নিল, তার নাম ‘ভারত-সভা’।
সমগ্র দেশে সুরেন্দ্রনাথ ও তাঁর সহকর্মীরা গড়ে তুলতে চাইলেন শক্তিশালী জনমত ও গণআন্দোলন, ভারতে নানা জাতির ঐক্য আর হিন্দু-মুসলমানের সৌহার্দ্য। এসবের প্রচার আরও দরকার পড়ল যখন ১৮৭৭-এ আই.সি.এস. পরীক্ষায় বসার বয়েস কমে দাঁড়াল একুশ থেকে উনিশ। কারও সন্দেহ রইল না যে, ভারতীয়দের প্রশাসনের বাইরে রাখতেই এই ফন্দি। এর বিরুদ্ধে আর একইসঙ্গে ইংল্যান্ড আর ভারতে আই.সি.এস. পরীক্ষা দেওয়ার দাবি উঠল। গ্রীষ্মের ছুটিতে ভারত-সভার প্রতিনিধি হিসেবে সুরেন্দ্রনাথ বেরিয়ে পড়লেন— লাহোর, অমৃতসর, দিল্লি, আগ্রা, এলাহাবাদ, বারাণসী ইত্যাদি নানা জায়গায় গেলেন। তাঁকে স্বাগত জানালেন সকলে; প্রতিষ্ঠিত হল ভারত-সভার অনেকগুলি শাখা। স্বার্থের ভিত্তিতে ততদিনে মধ্যবিত্তদের মধ্যে ঐক্য দেখা দিয়েছে; সমগ্র দেশে তাই প্রথমবার জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে একটি সাধারণ মঞ্চ গড়ে উঠল। শুরু হল ভারতে জাতীয়তাবাদের একটি নতুন পর্ব। সমাজ-শিক্ষা-ধর্মসংস্কার— কিছুই আর রাজনীতির আওতার বাইরে থাকল না। ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)-এর গোড়াপত্তনের অন্যতম কারণও সেটি।
তিন
মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে সুরেন্দ্রনাথ রোজ দু-ঘণ্টা ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন; কলেজে পৌঁছে লাইব্রেরি থেকে ওয়েবস্টারের ডিকশনারি নিয়ে ছুটে ক্লাসে ঢুকতেন। ১৮৭৯ অব্দি এভাবে চলল। ততদিনে তরুণ ব্রাহ্মদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিবিড় হয়েছে; জাতীয়তাবাদী চেতনা সকলকে একজায়গায় এনেছে। তাই খুবই স্বাভাবিক যে, সিটি স্কুল (পরে কলেজ)-এ ইংরেজি পড়ানোর অনুরোধ সুরেন্দ্রনাথ সানন্দে গ্রহণ করবেন। তাঁর মনে হল: সেখানে দিনে দু-ঘণ্টা সময় দিলে শুধু একশ টাকা বাড়তি উপার্জন হবে— তা নয়, ছাত্রসমাজের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক বাড়বে। এমন ভাবা ভুল যে, স্রেফ টাকার জন্যে আনন্দমোহন বসুর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। একইসময় ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সাতশো টাকা মাইনের চাকরির প্রস্তাব এসেছিল— যা তিনি নেননি।
মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনের পাশাপাশি সুরেন্দ্রনাথ সিটি কলেজে পড়ান— কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না বিদ্যাসাগর। অধ্যক্ষকে তাঁর কড়া নির্দেশ: সুরেন্দ্রনাথকে জানানো হোক সিটি কলেজ ছাড়লে বাড়তি একশো টাকা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনেই তিনি পাবেন; এতে সম্মত না-হলে পরদিনই সুরেন্দ্রনাথ বরখাস্ত হবেন। আনন্দমোহন বসুর সঙ্গে বন্ধুত্ব আর সিটি কলেজের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্যে বিদ্যাসাগরের শর্ত ফেরালেন সুরেন্দ্রনাথ। মেট্রোপলিটানে এক-ঘণ্টা বাড়তি সময় দিতে অবশ্য তিনি রাজি ছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর সে-কথা শুনবেন না। অগত্যা ১৮৮০-তে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন থেকে ইস্তফা দিলেন সুরেন্দ্রনাথ। এক মাস পর অধ্যক্ষ রবার্টসন-এর অনুরোধে তিনি ফ্রি চার্চ কলেজে ঢুকলেন— যেখানে পড়ালেন ১৮৮৫ অব্দি।
সুরেন্দ্রনাথ মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তিনি চলে যাওয়ায় মনমরা হয়ে পড়েন ছাত্ররা। বিদ্যাসাগর জানতে চান: এই কলেজে সুরেন্দ্র কতটুকু represent করে? মোট পাঠ্যসূচির দশ ভাগের মাত্র এক ভাগ! “তা এতে যদি সুরেন্দ্র না হলে কলেজ না চলে তাহলে বলতে হবে আমি কেউ নই, আমি তাহলে মরে গেছি! ছেলেদের বলে দাও সুরেন না থাকলে যারা এ-কলেজে থাকতে না চায় আমি তাদের সকলকে সার্টিফিকেট দেব।’’ নিজের তৈরি মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনকে সম্পূর্ণ নিজের মতেই চালাতে চেয়েছেন বিদ্যাসাগর। কাউকেই তিনি রেয়াত করেননি। পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি ইনস্টিটিউশনের ভার নেওয়ার দু-বছর পর ১৮৮৪-তে যখন সুরেন্দ্রনাথ উচ্চশিক্ষার জন্যে নিজের প্রতিষ্ঠান (রিপন কলেজ) খুললেন তখন বিদ্যাসাগর তির্যক মন্তব্য করেন: “সুরেনকে জিজ্ঞেস করো, আনন্দমোহনের প্রতি সেন্টিমেন্ট এখন গেল কোথায়?” কিন্তু তাই বলে সুরেন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর স্নেহ এতটুকু কমেনি। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর কিছুদিন আগে সুরেন্দ্রনাথ যখন দেখা করতে এলেন তখন তাঁকে কাছে বসতে বললেন; এমনকি, সুরেন্দ্রনাথের পাকা চুল দেখে বিস্মিতও হলেন বিদ্যাসাগর। উল্টোদিকে সুরেন্দ্রনাথও ছিলেন বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সর্বদা শ্রদ্ধাশীল।
তাহলে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ঘিরে বিদ্যাসাগর-সুরেন্দ্রনাথের বিচ্ছেদের কারণ কি তাঁদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত? বিদ্যাসাগরের খামখেয়ালিপনা অথবা সুরেন্দ্রনাথের অকৃতজ্ঞতার নমুনা? আমার মনে হয়: নিছক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর গণ্ডি পেরিয়ে গোটা ঘটনাটি ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিচার করলেই এর মূলে পৌঁছনো যাবে।
বিদ্যাসাগর আর সুরেন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল একটি প্রজন্মর ব্যবধান। আধুনিক মনোভাবাপন্ন এক শিক্ষিত সম্প্রদায় গড়তে চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর; অন্যদিকে, সেসব প্রগতিশীল তরুণের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন সুরেন্দ্রনাথ। বিদ্যাসাগরের কাজের জগৎ ছিল দেশি সমাজ— তাই বহুক্ষেত্রে তিনি পেয়েছিলেন উদারমনস্ক ব্রিটিশ আধিকারিকদের সাহায্য। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের প্রজন্ম প্রশাসনের অংশ হতে চাইল— সাম্রাজ্যবাদী চেতনার সঙ্গে তাঁদের সরাসরি সংঘাত তো স্বাভাবিক! সাংবিধানিক পথ হলেও তা ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রথম ধাপ। প্রত্যক্ষ রাজনীতি বিদ্যাসাগর এড়িয়ে চললেও সুরেন্দ্রনাথ তা পারেননি। সহযোদ্ধা অথবা সভা-সমিতি ছেড়ে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকা তাঁর কল্পনার অতীত। বিদ্যাসাগরের যাবতীয় কীর্তির ভিত্তি তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ। কিন্তু শেষবিচারে সুরেন্দ্রনাথকে মধ্যবিত্তশ্রেণির রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিনিধি বলেই ধরতে হবে। গণরাজনীতির যুগে এমনটাই দস্তুর। রামমোহন থেকে বিদ্যাসাগরে এসে জাতীয়তাবাদের আদি যুগ শেষ হয়। পরের যুগটি সুরেন্দ্রনাথের প্রজন্ম পেরিয়েও এগিয়ে চলল— এক পর্ব থেকে আর-এক পর্বে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদের ধরনধারণ এভাবেই বদলে গিয়েছিল।
রচনাপঞ্জি
ইন্দ্রমিত্র। করুণাসাগর বিদ্যাসাগর। আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৬।
চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগর। কলেজ স্ট্রিট পাবলিকেশনস্, ১৩৯৪ ব.।
বিনয় ঘোষ। বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ। ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৯৯।
বিহারীলাল সরকার। বিদ্যাসাগর। ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৯৯১।
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। নবভারত পাবলিশার্স, ১৯৮৩।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিদ্যাসাগরচরিত। বিশ্বভারতী, ১৪০০ ব.।
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। বাঙালির নতুন আত্মপরিচয়: সমাজসংস্কার থেকে স্বাধীনতা। অবভাস, ২০০৫।
বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ। চিরায়ত প্রকাশন, ২০১১।
Banerjea, Sir Surendranath. A Nation in Making. Rupa, 2016.
Mitra, Subal Chandra. Isvar Chandra Vidyasagar. A Story of His Life and Work. Rupa, 2018.
Great post . onek kichu natun janlam . Thank you .