Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মানসাই: আশ্চর্য বিষয়ের বিস্তার

১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। কাহিনি তেমন এক সময়ে শেষ। আর শেষ হবার পর দীর্ঘ সময় চুপ করে বসে থাকতে হয় পাঠককে। ঐতিহাসিক তথ্য সত্যকে উপন্যাসের ভূমিতে এনে কাহিনি গড়ে তোলা কতটা কঠিন যে কোনও মননশীল মানুষ সেটি উপলব্ধি করেন। সেই দুরূহ কাজটি সহজেই সম্পন্ন করেছেন লেখিকা, ‘মানসাই’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের উপপাদ্য বিষয় রাজনীতি। রাজনীতির চূড়ান্ত নির্মমতা, পেশীশক্তির আস্ফালন, সমাজজীবনে তার প্রভাব সবটাই এই উপন্যাসে ভয়ংকরভাবে বিস্তার লাভ করেছে। নিষ্ঠুর হত্যার, অত্যাচারের জীবন্ত-বর্ণনা পাঠকের রক্ত উত্তপ্ত করে তোলে— এমন লেখিকার কলমের ধার। একই দলের ভিতর ফাটল, মিথ্যাচার, বিপ্লব গড়তে ব্যর্থতা, হতাশা, হাহাকার— কী নেই এই উপন্যাসে? পুলিশের অত্যাচার স্বেচ্ছাচারিতা সবটুকু তুলে এনেছেন লেখিকা নিপুণ চিত্রকরের মতো।

কিন্তু তবু এই উপন্যাসে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে চলে জীবনের জয়গান। সব হারিয়েও নতুন করে বেঁচে ওঠার মরিয়া চেষ্টা। প্রীতিলতা… চল্লিশ পেরোনো বিধবা নারী। সব হারিয়ে রিক্ত তবু জেদ তার অদম্য। যে রাজনীতি তার থেকে সব কেড়ে নিয়েছে, সেই রাজনীতিই যে মানুষের ভাল করার একমাত্র রাস্তা, তা সে ভোলে না। ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করে না সেই আগুনে। এই উপন্যাসে হিংস্র, কুটিল, অত্যাচারী শাসকের মুখোশ যেমন খুলে দেওয়া হয়েছে, ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে এক আদর্শবান জজকেও লেখিকা খুঁজে পেয়েছেন, যাদের মতো মানুষের জন্য সবকালেই নিপীড়িত মানুষ অন্তত একটা আশ্রয় পেয়েছে। আছে সত্যেন, আদর্শবান নির্ভীক এক মানুষ। রাসুর মতো অতি সাধারণ ধাইমাও আছে, যার মন আশ্চর্য ধাতুতে গড়া। আছে কুসুম। কুসুমের কথা বলতে গেলে এখনও চোখে জল উপচিয়ে পড়ছে। এই উপন্যাসে কুসুম সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সবচেয়ে সুন্দর, অনন্য।

উত্তরবঙ্গের মানসাই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাজবংশী জনপদ ও বাংলাদেশ থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষেরাই এই উপন্যাসের প্রতিপাদ্য। লেখিকার ভাষার জ্ঞান, তার প্রয়োগ যেমন চমৎকার, তেমন আশ্চর্য তাঁর বিষয়ের বিস্তার। এই উপন্যাস পড়তে গিয়ে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কত কত শব্দবন্ধের সঙ্গে আবার দেখা হয়, আখা, নাটাই চণ্ডী ব্রত আর কলার মান্দাসে ভেসে আসা কিশোর। ওই বিশেষ অংশটি পড়তে পড়তে চোখ কখন যেন ঝাপসা হয়ে আসে। বারবার পড়তে থাকি মানসাইয়ের চরের কথা, বালির কথা, নৌকোর কথা। মনে পড়ে সৈয়দ সামসুল হকের নূরলদীনের কথা, যেন শুনতে পাই, ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবায়’ লাল পতাকা কাঁধে হৈ হৈ করে জেগে ওঠে মানসাই।

এই উপন্যাস আজকের আর্থসামজিক রাজনৈতিক জীবনেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণভাবে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়া, নকশালবাড়ি আন্দোলন, কমিউনিজমের আশ্রয়ে খেটেখাওয়া মানুষের একত্রিত হবার প্রয়াস, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসের সেই সময়কার চরিত্র হলেও আজকের জীবনকেও এর সঙ্গে রিলেট করা খুব একটা কঠিন হয় না।

নাহ্, এই উপন্যাসের কাহিনি আমি একটুও বলব না, আসলে বলতে পারি না, সেটা অন্যায় হবে। এটা যার কাহিনি তাঁর অক্ষরের হাত ধরেই পাঠক এই কাহিনির কাছে এসে পৌঁছাবেন, সেটাই কাম্য। আরও আরও লিখুন আপনি প্রতিভা সরকার। অপেক্ষায় রইলাম।

মানসাই ।। প্রতিভা সরকার ।। কারুবাসা প্রকাশনী ।। মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »