Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বিরতি

অদিতি ও নীহারবালা

এখন বিরতি বিজ্ঞাপনের। সাড়ে ছ’টার সিরিয়ালে বিরতি ছোট। এক্ষুনিই শেষ হয়ে যাবে। দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকালেন তিনি। ফুঁসে উঠলেন একটু। একটু বিরক্তিবোধ। ‘এখনও এল না? কী যে রাজকাজ্জ করছে বুঝি না। তাও তো মাত্র দুটো।’ পাঁচ ছেলে-মেয়ে মানুষ করেছেন নীহারবালা। আর তাঁরা তো এগারো ভাইবোন।

বয়সোচিত ব্যাধিতে পীড়িত হলেও সিরিয়াল একটাও মিস করেন না নীহারবালা। সাড়ে পাঁচটা থেকেই বসে পড়েন। তখন একটা রান্না দেখায় যদিও।

নিজে রান্না কিছু কম জানেন না নীহারবালা। না হলে এই মুখোপাধ্যায় পরিবারে এতগুলো বছর— এখন অবশ্য হেঁশেল সামলানোর সব দায়দায়িত্ব অদিতির। আর এই বয়সেও রিটায়ারমেন্ট নেবেন না? বিয়ের কম বছর পেরোল সুপ্রভাতের? প্রথম দু-আড়াই বছর তো ছিল ওর অ্যাপ্রেন্টিস। তার পর যখন তমালিকা ওর পেটে—

চা হাতে প্রবেশ অদিতির। রাখা নীহারবালার সামনের সেন্টার টেবিলটায়। বসা নীহারবালার পাশটিতে। আর্তনাদ সোফাটার। ওর দিকে কৃপাদৃষ্টি হেনে বরফজল গলায় নীহারবালা— এতটা বয়স হল, এখনও আক্কেল হল না? ছেলেটা আসবে খেটেখুটে— বলতে বলতেই চায়ের কাপ তুলে নেওয়া। চুমুক দেওয়া।

‘ম্যাগি করে রেখেছি। এলেই গরম করে—’

‘থাক। এসব অনাছিস্টি এ বাড়িতে আগে হয়নি, এখনও হবে না।’

‘এর মধ্যে আবার অনাসৃষ্টি কোথায় পেলেন মা?’

‘ম্যাগিটা আপাতত কোথায় রেখেছ?’

‘কেন ফ্রিজে।’

‘সুপ্রভাত এলে ফ্রিজ থেকে বের করে গরম করে নেবে। তাই তো। তা ওর জুতো কোট খুলে দেবে কে? যাও, ওটা ওয়ার্মারে রাখো। আমাদের পরিবারে স্বামীরা যখনই বাইরে থেকে এয়েচেন—’

কারণে-অকারণে পরিবারের কথা বলতেন নীহারবালা। তখন চোখ চকচক করে উঠত এই সত্তরোর্ধ্ব বিধবার।

ইতিহাসের অন্ধকূপ

সপ্তদশ শতকে বাংলায় বাণিজ্য করতে আসে ওলন্দাজরা। তাদের ঘাঁটি হয় চুঁচূড়া ও সন্নিহিত অঞ্চল। মুখোপাধ্যায়রা তখন ঘাঁটি গাড়ে চুঁচুড়ায়। ওলন্দাজদের বাণিজ্যে যুক্ত হয় তারা। অষ্টাদশ শতকের ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের পর মোটামুটি ঠিক হয়ে যায়, বাংলা তথা ভারতের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে হয় ফরাসি, নয় ইংরেজরা। এদিকে দিল্লিতে মোগল সরকার থাকলেও তারা তখন দুর্বল। ১৭৫৭-র পলাশির যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজরা। ওই যুদ্ধে ফরাসিরা সিরাজকে সমর্থন করেছিল।

এর কিছু পরে, অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শেষ দশকে মুখোপাধ্যায় পরিবারের এক যুবক দুর্গাপ্রসন্ন ঠিক করেন, পৈতৃক ভিটা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য করবেন। কিন্তু তাঁর পিতা ফরাসি ও সিরাজের সমর্থক হওয়ায় পুত্রের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। দুর্গাপ্রসন্ন ব্যবসার জন্য তাঁর কাছে তিনশো টাকা চেয়েছিলেন, পাননি।

যা হোক দুর্গাপ্রসন্ন ফারসি, সংস্কৃত ও ইংরাজিতে কৃতবিদ্য হওয়ার দরুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যান সহজে। উনি কলকাতায় আসেন ১৭৯০ সালে। ওই বছরই কোম্পানির হাউসে কাজ জুটিয়ে নেন। দু’বছর বাদেই ঠনঠনিয়ায় বিশাল জমি কেনেন তিনি। আর ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলে এক সাহেবের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে বরিশালে তিনি জমিদারি ক্রয় করেন। সমসাময়িক দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামমোহন রায়ের মতই তিনি জমিদারদের সংগঠন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন। ছিলেন নীলকরদের সমর্থক। কৃষকদের প্রবল বিরোধী। তিনি মনে করতেন ধান ও পাটের জায়গায় নীলের চাষ হলে তাতে বাংলার ভালই হবে।

তবে দুর্গাপ্রসন্ন নন, এই বংশের প্রধান পুরুষ মৃগেন্দ্রনারায়ণ। দুর্গাপ্রসন্নর নাতি। সুপ্রভাতের ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ। তাঁর আমলেই ঘটে জমিদারির বৃদ্ধি। নতুন জমিদারি ক্রয়। রাধামাধবের প্রতিষ্ঠা। বেশকিছু তুলো ও পাটের শেয়ার কেনেন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন রকম কন্ট্র্যাক্টরি করে বেশ টুপাইস আসেও পকেটে। বর্তমান মুখোপাধ্যায় বাটীটি তাঁরই নির্মাণ। এর মেঝের মার্বেল এসেছিল ইটালি থেকে। নীহারবালা যা প্রায়ই অদিতিকে বলে থাকেন। যার পরে অবশ্যম্ভাবীভাবে জুড়ে যায়, ‘তোমার বাবা দেখেছে এসব?’

মনে মনে হাসে অদিতি এসব শুনে। মৃগেন্দ্রনারায়ণের আমলের প্রতিপত্তির ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট নেই আজ। ইংরেজ চলে যাবার পর থেকেই শুরু এই পরিবারের পতন। জমিদারি হাতছাড়া। প্রথমে দেশভাগে। পরে ল্যান্ড সিলিং অ্যাক্টে। আটের দশকের পর থেকে মারাত্মক পতন ঘটেছে পাট আর তুলোর শেয়ারে। এই পরিবারের হাতে কিছু খনি ছিল। তাও আজ জাতীয়কৃত। আর-পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের বউয়ের মত সব করতে হয় অদিতিকে। তমালিকা-ঋকদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া, স্কুল থেকে নিয়ে আসা, রান্না করা, ব্যাংক-পোস্ট অফিস, ইলেকট্রিক বিল, গ্যাসের বুকিং, সব করতে হয় তাকে। নীহারবালা তো ডিরেকশন দিয়েই খালাস। সুপ্রভাতও সমর্থন করে মাকে। ‘বয়সটা ভেবে দেখেছ? রিটায়ারমেন্ট আছে কেন তবে?’

সুপ্রভাতের কথা

সর্বদাই মায়ের হয়ে ওকালতি। বিয়ের পর থেকেই সুপ্রভাতের এই গুণ চোখে পড়েছে অদিতির। ওনার মায়েরই যেন শুধু বয়স হয়েছে। আর কথায় কথায় পারিবারিক ঐতিহ্যের গাওনা। চাকরি করতে চাইলে কী সুপ্রভাত দেরি করে এসেছে কেন তা জানতে চাইলেও উত্তর সেই একই। মাঝেমাঝে সুপ্রভাতকে অদিতির মনে হয় মস্তিষ্কহীন দম দেওয়া পুতুল বলে।

ও বিছানায় যা খ্যাপামি করে তা দেখে অন্য কিছু ভাবতে পারে না অদিতি। প্রতি রাতেই তার অদিতির শরীর নিয়ে ধামসানো চাই। অদিতির শরীর খারাপ থাকলেও বা তার উপর অমানুষিক খাটাখাটনি গেলেও। অদিতি অবাক হয়ে যায় এই সুপ্রভাতের সঙ্গে বিয়ের আগের সুপ্রভাতের তুলনা করে। সে কল্পনাও করতে পারে না একটা মানুষ এভাবে পাল্টে যেতে পারে বলে।

আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

‘বেঁচে গেছিস’, বর্ণালীকে বলে অদিতি।

ওরা কলেজের বন্ধু। ওদের একটা গ্রুপ ছিল। বর্ণালী, ক্যামেলিয়া, শ্রীজা, মেহের। অদিতিও ছিল। ছিল আরও কেউ কেউ। ওদের ঠেক ছিল এই রতনবাবু টি অ্যান্ড স্ন্যাক্স। চায়ের সঙ্গে ফিস ফ্রাই, ফিস রোল, ফিস কাটলেট।

চারদিকে তাকিয়ে বর্ণালী বলে ওঠে, ‘দোকানটা অনেক পাল্টেছে বল।’

‘কত বছর কলেজ ছেড়েছি বল। তার পরেও এক থাকবে? আমরা পাল্টাইনি?’ অদিতির জবাব।

‘হুঁ, পাল্টানোই মানুষের ধর্ম’, উদাসনেত্রে দার্শনিক জবাব বর্ণালীর।

‘সবার?’ ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন অদিতির। তার পর স্বাভাবিক গলায়, ‘তা তোর খবর কী বল।’

ইতোমধ্যে এসে গিয়েছিল ওয়েটার। তাকে দুটো চা আর দুটো ফিস ফ্রাইয়ের কথা বলে অদিতি।

ওয়েটারটি নতুন। অদিতিরা যখন কলেজে পড়ত, এসব ওয়েটার-ফোয়েটার ছিল না। রতনবাবুই একা হাতে সব করতেন। তবে তিনি তখন ছিলেন চুয়াল্লিশ। হিরোর মত চেহারা। আজ ষাটোর্ধ্ব। বুদ্ধিমান ওয়েটার কথাতেই বুঝেছিল, কলেজে পড়াকালীন এই দোকানের রেগুলার খদ্দের ছিল অদিতিরা। তাই সোজাসুজি বলল, ‘এখন আমরা চিকেন প্রিপারেশনও করি। আমাদের চিকেন পকোড়া হিট।’

‘তাই নাকি? নিয়ে এসো তো দুটো প্লেট’, বর্ণালীর আদেশ। ‘‘প্লেটে থাকে ক’পিস?’’

ওয়েটারটা চারটে আঙুল তুলল। তার পর বলল, ‘আমাদের পিসগুলো বড় বড়। অন্য দোকানের ছ-সাতটার সমান।’ অদিতি মোবাইল খুলে হোয়াটসঅ্যাপ নোটিফিকেশনগুলো দেখছিল। মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ না-সরিয়েই বলল, ‘য-পিসই থাক, দামটা কিন্তু আমি দেব।’

‘একদম না’, প্রতিবাদ বর্ণালীর। তার কথাতে জানা গেল, সে লিলুয়ার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়। এখন স্কুল করোনার কারণে বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস করাতে হয় তাকে।

আরও জানা গেল সে বিয়ে করেনি। তার ফিঁয়াসে ইন্দ্রদীপ তাকে চাকরি ছাড়তে বলেছিল। সেইজন্য। অদিতি জানিয়েছিল তার কথাও। দুই সন্তান, বনেদি পরিবার, সুপ্রভাতের চাকরি আর তার আঠারো ঘণ্টার গৃহকর্মের কথা।

‘বাঃ, খাঁচার পাখি আর বনের পাখি’, কাউন্টার ছেড়ে অদিতিদের টেবিলের সামনে রতনবাবু। পুরনো কাস্টমারদের দেখলেই যেরকমটা উনি করে থাকেন সর্বদাই। আর কখন যে এসে দাঁড়িয়েছেন উনি, বর্ণালী-অদিতিরা তার পায়নি টের।

বিরতিটা আরও অনেকক্ষণ নিয়েছিল তখন।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজো: অতীত দিনের স্মৃতি

মহালয়া দিয়ে হত পুজোর প্রকৃত সূচনা। শরতের ভোররাতে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অন্তহীন, এবং এখনও তা সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অগণিত। আমাদের শৈশবে বাড়ি বাড়ি রেডিও ছিল না, টিভি তো আসেইনি। বাড়ির পাশে মাঠে মাইক থাকত, আর প্রায় তিনশো গজ দূরের এক বাড়িতে মাউথপিস রাখা থাকত। সেখান থেকে ভেসে আসত মহালয়ার গান, ভাষ্য।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপূজা, মূর্তিপূজা: দেশে দেশে

আসলে বাঙালি নিরন্তর এক অনুসন্ধানী, ব্যতিক্রমী, অভিনব-চিন্তক, ক্রমবিকাশপ্রিয় ও অন্তিমে রহস্যময় জাতি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান আস্তিক নাস্তিকে মিলিত এই জাতি সঙ্ঘারাম আর মিনার, ধ্বজা ও ওংকার, জগমোহন-মিরহাব-স্তূপ-ভস্মাচ্ছাদিত এক জাতি, নিজ মুদ্রাদোষে নয়, মু্দ্রাগুণে আলাদা।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শারদোৎসব: বাংলাদেশে

দুর্গাপুজো কেবল ভক্তের জন্য-ই নয়, ভাল লাগাদের জন্যও। যে ভাল লাগা থেকে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন কোরানশরীফ বাংলায় অনুবাদ করেন, অদ্বৈত আচার্য যবন হরিদাসের উচ্ছিষ্ট নিজহাতে পরিষ্কার করেন, স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম-তনয়াকে কুমারীপুজো করেন! দুর্গা বাঙালির কাছে, ধর্মনির্বিশেষে আগ্রহের, যেহেতু এই দেবী পরিবারসহ আসেন, আর সঙ্গে নিয়ে আসেন কাশফুল আর শিউলি। তাই তো সনাতন রামপ্রসাদ, খ্রিস্টান মাইকেল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলমান কাজী নজরুল দুর্গাকে নিয়ে কলম না ধরে পারেননি!

Read More »
কাজী তানভীর হোসেন

ধানমন্ডিতে পলাশী, ৫-ই আগস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কয়েকদিন ধরে যা ঘটেছিল, তা শুরু থেকেই গণআন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে একটা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা কার্যক্রম দেখেই চিনে যাই ঘটনাটি কারা ঘটাচ্ছে। আগুন আর অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করার স্বভাব রয়েছে বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের। তারা যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা করে না।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমরা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিলাম, যাঁকে খুব সঙ্গত কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’ বলা হয়। পেয়েছি প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী। এবং জ্যোতি বসুর মতো সম্ভ্রান্ত, বিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখর কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে অধিক ছিলেন বুদ্ধদেব। কেননা তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা, দেশবিদেশের শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক সম্পর্কে সর্বদা অবহিত, এককথায় এক আধুনিক বিশ্বনাগরিক মানুষ পাইনি। এখানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনন্যতা।

Read More »