Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

পুরুলিয়ার বাড়ি-পালানো বালকের আজ ভুবনজোড়া খ্যাতি

প্রায় কুলকুচি করার মত করে বলেন ইংরেজি, হিন্দি। বাঙালি হয়েও ‘বাংলায়’ ততটা সড়গড় না হওয়ার জন্য খানিক অস্বস্তিও আছে। সে অক্ষমতার জন্য মার্জনাও চান বারবার। গোটা বিশ্ব তাঁকে ভিকি রায় নামে একডাকে চেনে। ফোটোগ্রাফি বা আলোছবি যেন তাঁর হাতে প্রাণ পায়। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখেই এই তরুণ তৈরি করেছেন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, স্বতন্ত্র ঘরানা। রীতিমত আন্তর্জাতিক মানের আলোকচিত্রী আমাদের বাংলার পুরুলিয়া জেলার তালডাঙা গ্রামের ছেলে। এখনও সেখানে তাঁর পরিবার-পরিজনরা থাকেন কালেভদ্রে ছেলের ঘরে ফেরার অপেক্ষায়। কিন্তু বারবার আসা হয় না ‘দেশের’ বাড়ি। তিনি এখন বিশ্বনাগরিক যে। বিকল্পধারার বিষয় যাঁর স্থিরচিত্রের উপজীব্য, সেই স্ট্রিট ফোটোগ্রাফারের বেশিরভাগ দিন-মাস কেটে যায় দেশ-দেশান্তরে।

ভিকির আলোকচিত্র প্রদর্শনী। দিল্লির রোম্যাঁ রোলাঁ গ্যালারিতে।

তাঁর শৈশব, বাল্য ও কৈশোর সুখের ছিল না। বাবা ছিলেন দর্জি। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার। অভাবের মধ্যেও চাইতেন অন্তত একটি সন্তান লেখাপড়া শিখুক। ফলে তাঁকেই দাদুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে যাতে পেটভরে খেতে পাওয়ার পাশাপাশি পড়াশুনোটাও করতে পারে। কিন্তু ভিকি পালালেন সেখান থেকে। বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন, পকেটে ৭০০ টাকা মোটে। সে টাকাও আসলে মামার টাকা। তাই নিয়েই পগার পার। সিনেমায় দেখেছেন, গ্রামের গরিব ছেলে বড় শহরে গিয়ে নায়ক হয়ে উঠছে, প্রতিষ্ঠার শিখর ছুঁয়ে ফেলছে। তল্লাট ছেড়ে চম্পট তো দেবেন কিন্তু গন্তব্য জানা নেই।

পুরুলিয়া স্টেশন থেকে চেপে বসেন পুরুষোত্তম এক্সপ্রেসে। দিল্লি তখন আর ‘বহুত দূর’ মনে হয়নি। পিছনে পড়ে থাকে শৈশব-বাল্যের গ্রাম,  খেলার সাথি, মা, বাবা আর ৬ ভাইবোন। রাজধানী এত বড় হয়? শহরের বিশালতা দেখে চমকে গিয়েছিল অজগাঁয়ের বালক। কিন্তু বাড়ি ফেরার ‘মুখ’ ছিল না আর। তাই প্রথমে রেলস্টেশনে কাগজ-বোতল কুড়িয়ে, পরে রেস্তোরাঁয় ফাইফরমাস খেটে পেট ভরাতে হত। রাতের খোলা আকাশের নীচে ফুটপাতে শুয়ে মনে হত, তাঁর জন্য বরাদ্দ খোরাকিতে অন্তত পরিবারের বাকিদের পেট কিছুটা ভরছে! দুচোখে স্বপ্ন, একদিন সেও রোজগেরে হয়ে উঠবে, পরিবারের টানাটানির দিন ফুরোবে। আর মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ত।

ভিকির আলোকচিত্র প্রদর্শনী। “New Beginnings”।

বছর দুয়েক এভাবেই দিন কাটছিল। আচমকা পথশিশুদের কল্যাণে কর্মরত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নজরে পড়ে তারও ঠাঁই হয় ‘সালাম বালক’ ট্রাস্টে। সেখানে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক মীরা নায়ারের সহায়তায় অন্যান্য পথশিশুর সঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ মিলল। দশম শ্রেণি উতরে যেতেই কারিগরি শিক্ষায় টিভি-কম্পিউটার প্রভৃতি মেরামতি কোর্সে ভর্তি করানো হয় তাকে। ঘুরে যায় জীবনের মোড়। এখানেই ফোটোগ্রাফিতে ঝোঁক ও শেখার সুযোগ। ছবি তোলার হাতেখড়ি হল অধুনালুপ্ত কোডাক ক্যামেরায়। সেই সস্তার ক্যামেরায় তোলা ছবিতেই বিশিষ্ট ব্রিটিশ ফোটোগ্রাফার বেঞ্জামিন ডিক্সির নজরে আসেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে পান ডিক্সির সহযোগী হওয়ার সুযোগও। বেঞ্জামিন এসেছিলেন পথশিশুদের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের তাগিদে। তিনিই আদরের ভিকিকে উপহার দিলেন দামি আধুনিক ক্যামেরা। পরে ভিকিকে সহযোগী বানান আর-্এক প্রসিদ্ধ ফোটোগ্রাফার অনয় মাণ। এর পর থেকে পিছনে তাকাতে হয়নি আর।

১২ নভেম্বর, ২০২১।

ভিকির জন্ম ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭। ২০০৭-এ নিজের একক ছবির প্রদর্শনী Street Dreams-এর দৌলতে মাত্র কুড়িবছর বয়সেই আলোকচিত্রী মহলের চর্চায় উঠে আসেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ এবং সম্মাননা-পুরস্কারের বন্যা বয়ে যায়। সেই তালিকা দীর্ঘ। vickyroy.in খুলে সহজেই তাঁর আলোকচিত্রের নমুনা মেলে। বিশ্বাস না হলে গুগল করুন। সেখানেই পাবেন তাঁর ফুটপাত থেকে রাজপথে পৌঁছনোর হাজার-একটা গল্প। ২০১৬-য় ফোর্বস এশিয়ার “30 under 30’’ তালিকায় জায়গা পাওয়া ভিকি দিল্লিতে অতিসাধারণ জীবন কাটান। তাঁর ছবি বড় সামাজিক। সত্যি সত্যিই তাঁর ছবির দৌলতে এই বৈষম্যপ্রধান সমাজের অনেক মানুষ পেয়েছেন বেঁচে থাকার প্রেরণা ও ইন্ধন। তাঁর কথায়, সমাজ আমাকে দিয়েছে অনেক। বিনিময়ে সমাজকে আমি ফিরিয়ে দিয়েছি আমার ছবি।

চিত্র: ভিকি রায়ের ফেসবুক পেজ থেকে
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Siddhartha Majumdar
Siddhartha Majumdar
2 years ago

সম্পূর্ণ অজানা ছিল। দারুণ অনুপ্রেরণা জোগানোর একটি আশ্চর্য জীবন। ধন্যবাদ লেখাটি পড়ানোর জন্যে।

Recent Posts

নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »