Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: বিড়াল

এক-্এক জনের একেকটা নেশা থাকে। গোবর্ধনবাবুর নেশা লেখা। শুধু তাই নয়, গোবর্ধনবাবু চান পুরোদস্তুর লেখক হয়ে উঠতে। গোবর্ধনবাবুর অনেক লেখা ছাপাও হয়। কিন্তু পুরোদস্তুর লেখক হতে গেলে যতটুকু ছাপা হওয়া দরকার ততটা নয়। এই লেখা ছাপা নিয়ে গোবর্ধনবাবুর একটা অন্য দুঃখও আছে। পত্র-পত্রিকায় তাঁর যেসব লেখা ছাপার মুখ দেখে সেগুলোর বেশিরভাগই একবারে ছাপা হয় না। হয়তো একটা লেখা একটা পত্রিকায় পাঠালেন। চার-পাঁচমাস পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। কোনও সাড়া না পেলে সেটা আবার পাঠালেন অন্য কোথাও। আবার প্রতীক্ষা। ওখানে না ছাপা হলে আবার অন্য কোথাও। এভাবে ছাপার মুখ দেখতে কোনও কোনও লেখার দু’বছরও গড়িয়ে যায়। অনেক সময় গোবর্ধনবাবুর মনেই থাকে না, প্রথমে কোন পত্রিকা দিয়ে শুরু করেছিলেন।

এই লেখা পাঠানো আর প্রতীক্ষার টানাপোড়েনে গোবর্ধনবাবু বেশ কিছুদিন ধরে একটা লেখা নিয়ে খুব বিব্রত আছেন। লেখাটা ফিচার জাতীয়। লেখাটা তৈরি করেছিলেন অনেকদিন আগে। লেখাটা এখনও ছাপা হয়নি সেটা কোনও গল্প নয়। গল্পটা অন্য জায়গায়।

প্রথমে লেখাটা পাঠিয়েছিলেন ‘নবকুসুম’ দৈনিকের রবিবারের সাপ্লিমেন্টারিতে। ‘নবকুসুম’ তখন নতুন বেরোনো পত্রিকা। ওদের রবিবারের সাপ্লিমেন্টারিতে গল্প, ফিচার, কবিতা, ছোটদের বিভাগ সবই থাকে। লেখাটা ছোটদের উপযোগী ভেবে ছোটদের বিভাগেই দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ছোটরা বিড়াল ভালবাসে। সুতরাং…

ওহ বলাই হয়নি। লেখাটা বিড়াল নিয়ে। বিড়াল কোথায় পাওয়া যায়, কত দাম, বাংলা এবং ইংরেজি সাহিত্যে বিড়াল কোথায় কোথায় রয়েছে, কোন কোন বিখ্যাত লোক বিড়াল পুষেছেন, পোষেন, কোন কোন চিত্রকর বিড়ালের ছবি এঁকে গেছেন এইসব। লেখাটা গোবর্ধনবাবুর নিজের কাছে খুব মূল্যবান লেগেছিল। উনি নাম দিয়েছিলেন— ‘বিড়াল কাহিনি।’

‘নবকুসুম’-এ পাঠাবার আগে লেখাটা ঘরোয়া মজলিসে একদিন পড়েওছিলেন। সেদিন বড়শালি ফু্ট কেটেছিল— ‘জামাইবাবু আপনার এ লাইনে কিন্তু অনেক স্কোপ আছে। বিড়ালটা ছাপা হলে ইঁদুরে যাবেন। ইঁদুরের পর ছুঁচো। তারপর—’

খানিকটা অভিমানী গলায় গোবর্ধনবাবু উত্তর দিয়েছিলেন— ‘তুমি এমনভাবে বলছ যেন কাজটা কত সহজ! এই লেখাটার জন্য কত পরিশ্রম করেছি জানো? কত বই খুঁজেছি, কত জার্নাল—’

বড়শালি জামাইবাবুর মনের ভাব টের পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিল— ‘কাজটা যে কত কঠিন তা তো লেখাটাতেই পরিষ্কার। বাবাঃ, কত তথ্য!’

—‘তবেই বোঝো!’ অভিমান ভুলে গর্বে বুকটা টানটান হয়ে গেছিল গোবর্ধনবাবুর। বলেছিলেন— ‘এসব জানতে কম দূর হাঁটতে হয়েছে নাকি আমাকে!’

তিনপাতার লেখাটা নিয়ে গোবর্ধনবাবুর আশাও ছিল বিস্তর। তথ্যের সমাবেশ করতে ঠাকুরবাড়ি আর রায়বাড়ির বিখ্যাতদের রচনা তো চষে ফেলেছেন। গগন ঠাকুরের পার্শিয়ান বিড়ালের ছবি থেকে লীলা মজুমদারের ফুলীর মাছ পাহারা দেওয়া কিছুই বাদ দেননি।

লেখাটা তাড়াতাড়ি ছাপা হবে এটা তো ধরেই নিয়েছিলেন। এমনকী এ-ও ভেবেছিলেন যে প্রথা ভেঙে ‘নবকুসুম’, যে-রবিবার লেখাটা ছাপা হবে, তার আগে কোনও একদিন বিজ্ঞপ্তি মারফত লেখাটা প্রকাশের খবর পাঠকদের দিয়েও দেবে।

ক্যুরিয়রেই লেখাটা পাঠিয়েছিলেন এক মঙ্গলবার। গোবর্ধনবাবু মনে মনে হিসাব করছিলেন, লেখাটা যদি বুধবারে বিকেলে দপ্তরে পৌঁছয়, তবে কি তা সামনের রবিবারে ছাপা হতে পারে? দু-তিনটে রবিবারের সাপ্লিমেন্টারির সাবজেক্ট ম্যাটার ‘নবকুসুম’ কি আর আগাম ঠিক করে রাখেনি? তবু বলা যায় না। ভাল লেখা বলে কথা!

না, লেখাটা প্রকাশের আগাম খবরও দেখা গেল না, রবিবার লেখাটা ছাপাও হল না। হালকা নিরাশ হলেন গোবর্ধনবাবু। তবে সেটা ঝেড়ে ফেলতে দেরি হল না। মানসিকভাবে পরের রবিবার ‘নবকুসুম’-এর বিশেষ পাতায় লেখাটা দেখার জন্য তৈরি হতে লাগলেন।

পরের রবিবার ঘুম থেকে উঠলেন সকাল পাঁচটায়। মর্নিং ওয়াক গোবর্ধনবাবু কোনওকালেই করেন না। সেদিন বের হলেন। উদ্দেশ্য অবশ্য হাঁটা নয়, বাসস্ট্যান্ড থেকে ‘নবকুসুম’ সংগ্রহ করা। কিন্তু ‘নবকুসুম’ খুলে আবারও নিরাশ। গোবর্ধনবাবু মনকে প্রবোধ দিলেন, বড় কাগজ, দুসপ্তাহ লেট তো হতেই পারে। এত তাড়াতাড়ি ছাপার আশাটা একটু বেশিই আশা হয়ে যাচ্ছে।

পরের সপ্তাহে, শনিবার রাত্রিতে গোবর্ধনবাবু খাওয়ার সময় গল্প করতে করতে ভাইপো তিতাসকে বললেন— ‘নবকুসুম’-এর ছোটদের বিভাগটা কাল অবশ্যই নজর করবি। বিড়াল নিয়ে আমার সেই লেখাটা কাল পাবলিশ হবে।’

তিতাস বলল- ‘ওরা কি তোমাকে জানিয়েছে জেঠু?’

গোবর্ধনবাবু বললেন— ‘জানাবে কেন? দৈনিকের লেখা ছাপার খবর কি আগাম সব পত্রিকা জানায়? মনে তো হয় না।’

—‘তবে?’

—‘এটা আমার অনুমান। এরকম একটা লেখা ওরা আর কত ফেলে রাখবে?’

পরের দিন, ভোর পাঁচটায় উঠে আবার হেঁটে বাসস্ট্যান্ড। এদিন ‘নবকুসুম’-এর রবিবারের সাপ্লিমেন্টারি খুলে নিরাশ নয় একেবারে হতাশ হয়ে গেলেন গোবর্ধনবাবু। রবিবারের সাপ্লিমেন্টারির শেষ পাতায় থাকে ‘ছোটদের বিভাগ’। গোবর্ধনবাবু দেখলেন, সে বিভাগটাই পাল্টে গেছে। সব লেখাই ছোটদের কলমে। একটা ঘোষণাও রয়েছে— ‘এবার থেকে এই বিভাগে কেবল কচিকাঁচাদের লেখাই প্রকাশিত হবে।’

আর দেরি করার মানে হয় না। এবার ‘বাংলা মুলুক’ দৈনিক। সবচেয়ে পুরোনো, সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। গোবর্ধনবাবুর মনে হল, ‘মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার।’ তা ছাড়া লেখাটার যা মান তার জন্য এরকম ভাল পত্রিকা প্রথমে না বাছাটাই তো ভুল হয়েছিল!

‘বাংলা মুলুক’-এ গোবর্ধনবাবুর অনেক চিঠিপত্র আগে প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং ওখানে তিনি অপরিচিত মুখ নন। ওদেরও ছোটদের বিভাগ রয়েছে। শনিবার বের হয়। কিন্তু লেখাটার জন্য ছোটদের বিভাগই বা বাছবেন কেন? ওদের ‘রবিবারের সাময়িকী’-তে অনেক নিবন্ধও প্রকাশিত হয়। এই তো সেদিন, পুতুল নাচ নিয়ে একটা লেখা ছাপা হল। রবিবারের পাতাটায় প্রবন্ধ, নিবন্ধের একটা জায়গাই আছে। বিড়াল নিয়ে লেখাটা ওখানে ছাপা হতেই পারে।

বড় পত্রিকা। লেখাটা তাই টাইপ করে পাঠালেন। তিন পাতার লেখাটা দেড় পাতা মত দাঁড়াল। এটাও ক্যুরিয়র করলেন।

এবার প্রতীক্ষার পালা। আগে চিঠিপত্রের ক্ষেত্রে দেখেছেন ছাপতে কখনও কখনও এক মাসও সময় নিত ওরা। রবিবারের সাময়িকীর ক্ষেত্রে ওই সময়টার আগে কি কিছু হবার আশা আছে!

গোবর্ধনবাবু লেখাটা পাঠিয়ে অন্য লেখায় মন দিলেন। এক মাস পর থেকে ‘বাংলা মুলুক’-এর রবিবারের সাময়িকী নিয়ে আগ্রহটা বাড়তে শুরু করল। ‘বাংলা মুলুক’ বাড়িতে নিয়মিত আসে। সুতরাং বাইরে কিনতে যাবার প্রশ্ন নেই। কিন্তু মাস খানেক পর থেকে রবিবারগুলোতে কাগজওলা আসার সময়টাতে গোবর্ধনবাবু চঞ্চল হয়ে পড়তে লাগলেন। কাগজওলার আসতে একটু দেরি হলে অস্থিরভাবে পায়চারী করেন। তারপর কাগজটা দিলেই ব্যগ্রভাবে ওটা খোলেন।

কিন্তু কতদিন? মাস দেড়েক পরে, ‘বাংলা মুলুক’-এ লেখাটা প্রকাশিত হল না দেখে গোবর্ধনবাবু একটু মুষড়ে পড়লেন। এর সপ্তাহ দুয়েক পরে এক রবিবার আবার আগের মত আঘাত। যে জায়গায় প্রবন্ধ নিবন্ধ ছাপা হয়, সেখানে দেখা গেল এক ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস।
গোবর্ধনবাবু ‘বাংলা মুলুক’-এর রবিবারের সাময়িকী নিয়ে আগ্রহ হারালেন। ‘বিড়াল কাহিনি’ নিয়ে বেশ কিছুদিন আর কোনও নড়াচড়া করলেন না গোবর্ধনবাবু। গ্রীষ্মের এক ছুটির দুপুরে পুরোনো লেখার ফাইলটা ওল্টাতে ওল্টাতে আবার মাথায় এল লেখাটা কোথাও পাঠাবার কথা। কিন্তু কোথায়?

বিখ্যাত পত্রিকা অনেক হল। এবার একটু কম বিখ্যাত পত্রিকায় ট্রাই করা যাক। এক রবিবারে ‘সুপ্রভাত’-এর রবিবারের সাপ্লিমেন্টারি ‘রবিসভা’ দেখে গোবর্ধনবাবুর মনে হল, লেখাটা ছাপার এটাই বেস্ট জায়গা। একটা লেখাও ছাপা হয়েছে এই ধরনের। প্রাণী নিয়ে নয় অবশ্য। ফল নিয়ে। ‘আম— সমাজে, সাহিত্যে।’ আবার লেখাটার কপি করলেন সুন্দর করে। আর ক্যুরিয়র নয়। একটা পাঁচটাকার ডাকটিকিট দিয়ে সাধারণ ডাকে পাঠালেন লেখাটা।

সপ্তাহ তিনেক গেল। ছাপা হল না। তবু আশা ছাড়লেন না। আরও সপ্তাহ দুয়েক গেল। ছাপার খবর নেই। পরের সপ্তাহের সূচনাতে মনে হল, খুব বড় পত্রিকা তো নয়, একবার সম্পাদকীয় দপ্তরে ফোন করে দেখবেন। কিন্তু কখন ফোন করা যায়? সকালে না বিকালে? গোবর্ধনবাবুর মনে হল বিকেলটাই ভাল। চারটে নাগাদ ফোনটা করলেন। রিং হল। ফোন ধরলও যেন কেউ। কিন্তু শুধুই ভেসে এল ‘আগুন’ ‘আগুন’ আওয়াজ। ফোন কেটে দিলেন গোবর্ধনবাবু।

সন্ধেয় টিভির খবরে ব্যাপারটা জানা গেল। ‘সুপ্রভাত’-এর অফিসে আগুন লেগেছিল দুপুরে। ক্ষয়ক্ষতির কথা অবশ্য খবরে কিছু পাওয়া গেল না।

গোবর্ধনবাবু ভেবেছিলেন, ‘সুপ্রভাত’ বন্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। দিন দুই পর থেকে ‘সুপ্রভাত’ আবার প্রকাশিত হতে লাগল। তবে পাতা কমল। রবিবারে ‘সুপ্রভাত’ বের হল ‘রবিসভা’ ছাড়াই। পর পর তিন সপ্তাহ এরকম চলার পর গোবর্ধনবাবু রণে ভঙ্গ দিলেন। রবিবারে ‘সুপ্রভাত’ কেনা বন্ধ করলেন।

এবার আর তাড়াহুড়ো করলেন না গোবর্ধনবাবু। বেশ কয়েকদিন যেতে দিলেন। তারপর আবার সুন্দর করে কপি করলেন লেখাটার। এবারে কোথায় পাঠাবেন তা নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হল না। ‘যুগদর্পণ’ বলে একটা কাগজ গত দুবছর ধরে বেশ ভাল চলছে। আগে কোনওদিন খুলে পড়া হয়নি। লেখাটা ‘সুপ্রভাত’-এ পাঠানোর পরেই কাগজটা একদিন খুলে দেখেছিলেন। বেশ ভাল লেগেছিল। তখনই মনে হয়েছিল লেখাটা ‘সুপ্রভাত’-এর পরিবর্তে ওখানে পাঠালেই ভাল করতেন। এবার তাই প্রথমেই ‘যুগদর্পণ’-এর কথা মনে পড়ল। ওদের রবিবারের সাময়িকীর নাম— ‘রবিবারের যুগদর্পণ’। গোবর্ধনবাবু সাধারণ ডাকেই লেখাটা পাঠালেন।

দুসপ্তাহ গিয়েছে কী যায়নি, ঘটল আর এক ঘটনা। ‘যুগদর্পণ’ পত্রিকাটি যিনি চালাতেন তিনি চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়লেন হঠাৎ। অমনি বন্ধ হয়ে গেল পত্রিকার প্রকাশ।

গোবর্ধনবাবু এবার সত্যিই চিন্তায় পড়লেন। লেখা ছাপার জন্য একটা সময় লাগেই। যতই ঔৎসুক্য দেখান, কোনও পত্রিকাতেই সে সময়টা পার হয়নি। অথচ, ঘটেছে নানান ঘটনা। কোথাও পত্রিকার ফরম্যাট চেঞ্জ হয়ে গেছে, কোথাও আগুনে পত্রিকার রবিবারের পাতাটা উধাও, আবার কোথাও মালিকের গ্রেপ্তারে পত্রিকা বন্ধ। নাঃ, মানতেই হচ্ছে, বেশ শক্তিশালী লেখাটা।

‘বিড়াল কাহিনি’ নিয়ে আর এগোনো ঠিক মনে করলেন না গোবর্ধনবাবু। এবং শুধু তাইই নয়, নতুন কোনও ফিচার লিখতেও আর আগ্রহবোধ করলেন না। গল্প মাঝখানে বেশ কয়েকটা লিখেছেন। ছাপাও হয়েছে দু-একটা লিটল ম্যাগাজিনে। এবার পুরোপুরি গল্পতেই আত্মনিয়োগ করলেন।

সেদিন গল্পের একটা নতুন থিম মাথায়। কীভাবে শুরু করবেন ভাবছেন, এমন সময় পাশে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। সাধারণত ধরেন না। আজ কী মনে করে ধরলেন। তারপর ‘হ্যালো’ বলতেই ও প্রান্ত থেকে প্রশ্ন— ‘গোবর্ধন গোলদার বলছেন?’

—‘হ্যাঁ, আপনি?’

—‘আমি সুপ্রতিম ধর বলছি। ‘রবিবারের যুগদর্পণ’ আমার সম্পাদনাতেই বের হত। বলছিলাম—’

—‘হ্যাঁ, বলুন’, গোবর্ধনবাবুর গলায় কৌতূহল এবং বিস্ময়।

—‘আপনি ‘রবিবারের যুগদর্পণ’–এ ‘বিড়াল কাহিনি’ বলে একটা লেখা পাঠিয়েছিলেন। ‘যুগদর্পণ’ বন্ধ হয়ে গেছে জানেন নিশ্চয়।’

—‘জানি।’

—‘আমি ‘যুগদর্পণ’ থেকে আসার সময় লেখাটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। আমার একটা লিটল ম্যাগাজিন আছে। নানান ধরনের লেখা ওখানে থাকে। আপনার লেখাটা ওখানে ছাপতে চাই। আপনার অনুমতি চাইছি।’

এমন একটা প্রস্তাব পেয়ে গোবর্ধনবাবু অভিভূত। —‘আমার অমত নেই’ কথাটাও ঠিকঠাক বলতে পারলেন না। গলা কেঁপে গেল।

ফোনটা রেখে একরকম চিৎকার করেই খবরটা স্ত্রী মণিকাকে জানালেন।

সুপ্রতিম ধর নামী কবি। উনি ‘রবিবারের যুগদর্পণ’ সম্পাদনা করতেন জানা ছিল না গোবর্ধনবাবুর। এসব লোকের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে লেখালেখির লাইনে অনেক উপকার পাওয়া যায়। সুপ্রতিম ধরের ফোন নম্বরটা মোবাইলে সেভ করে রাখলেন।

পরদিন সন্ধেয় মণিকার সঙ্গে ‘বিড়াল কাহিনি’ নিয়েই কথা বলছিলেন। —‘সেই কবে লিখেছিলাম লেখাটা। এতদিনে একটা হিল্লে হল। তবে লিটল ম্যাগাজিন তো! বেশিরভাগই ঠিক সময়ে প্রকাশিত হয় না। এটা কবে হবে কে জানে।’

—‘ক’দিন পরে ভদ্রলোককে একটা ফোন করে নিয়ো।’ মণিকা পরামর্শ দিল।

—‘ঠিকই বলেছ।’ কথাটা বলেই কিন্তু গোবর্ধনবাবুর হাত মাথায়। একেবারে স্তব্ধ হয়ে বসে গেলেন। মণিকাও দেখেছে। সামনের টিভি স্ক্রিনে খবর পড়ছে মেয়েটি। আর নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে, আগে পড়া বা গুরুত্বহীন নানা খবরের সারি। সেই সারিতেই এক জায়গায় লেখা রয়েছে— ‘প্রয়াত কবি সুপ্রতিম ধর।’

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
Advertisement
4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »