মীরা নায়ার ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর বিতর্কিত সিনেমা ‘ওয়াটার’-এ বেনারসের ঘাটে ঘাটে ঘুরে পেটের তাড়নায় পতিতাবৃত্তি অবলম্বনে বাধ্য হওয়া মনোরমা নামের এক বিধবাকে দেখিয়েছিলেন। কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থনের ঢঙে সে বলেছিল বাংলার বৈষ্ণব আখড়াগুলোয় ধর্মের নামে ব্যাভিচারের কাহিনি। সিনেমাটিকে কেন্দ্র করে বিতর্কের পরিসর তৈরি হয়েছিল, কিন্তু নানা সময়ে সমাজ ইতিহাসের গবেষকরা একমত— চৈতন্য-পরবর্তী বৈষ্ণবধর্মে এই অনাচারের ইতিহাস নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী তাঁর কালজয়ী গবেষণাগ্রন্থ ‘গভীর নির্জন পথে’-তে স্পষ্ট বলছেন— ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পর মোটামুটি ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে একদিকে যেমন বহু সম্প্রদায় বা আখড়ায় বিভক্ত হয়ে বৈষ্ণবধর্ম একটা অন্য চেহারা পায়, তেমন সহজিয়া বৈষ্ণবধর্মের চর্চা বাড়ে। বাউল বা বৈষ্ণবদের এই সহজিয়া ধর্মে দেহসাধনার বিষয়টিকে নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা থেকেই ধর্মীয় সাধনার মধ্যে ব্যাভিচারের অনুপ্রবেশ ঘটে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে আরম্ভ করে বিংশ শতাব্দীর কিছুটা সময় পর্যন্ত এই অনাচারের নানা প্রমাণ সাহিত্যে বা সংবাদপত্রে ছড়িয়ে আছে। তারকেশ্বরের ‘মোহান্ত এলোকেশী সম্বাদ’ থেকে আরম্ভ করে কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-র ‘গুরুগিরি ও গোঁসাইগিরি’-র অংশগুলিতে এই ধর্মীয় অনাচারের রসালো কেচ্ছা তীব্র ভাষায় ফুটে উঠেছে। অনেক পরবর্তীতে বৈষ্ণব তাত্ত্বিক অজিত দাস তাঁর আত্মজীবনী ‘জাতবৈষ্ণব কথা’-য় খোদ সুকুমার সেনের তথ্যসূত্র উল্লেখ করে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, রামকেলিধামের মত পবিত্র বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্রও এই ধর্মীয় অনাচারের বাইরে থাকতে পারেনি। নেড়ানেড়ির কন্ঠীবদলের মত স্বীকৃত গণবিবাহের আসরের আড়ালে এমন অনেককিছুই হয়ে গেছে, যাকে কোনওমতেই অনুমোদন দেওয়া যায় না।
ইতিহাস বলে, ১৫৭৪-এর প্লেগে গৌড় নগরী জনশূন্য হওয়ার পর দীর্ঘকাল এই রামকেলি উৎসব ও মেলা বন্ধ থাকে। তারপর যখন চালু হয়, তখন থেকেই এই বৈষ্ণব গণবিবাহের রমরমা। বাউল, খুশিবিশ্বাসী, তিলকদাসী, দরবেশ, সাহেবধনী, বলাহাড়ি— মেলায় আগত সব সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবদের মধ্যে এ প্রথা চালু ছিল। পাতলা কাপড়ের একদিকে একেবারে বুক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দাঁড়াতেন বৈষ্ণবীরা। কাপড়ে ছোট ছোট ছিদ্র করে কনিষ্ঠা আঙুল বাড়িয়ে দেওয়া হত। পাঁচসিকে বা চার আনার বিনিময়ে সেই আঙুল দেখেই বৈষ্ণব বেছে নিতেন তার ‘মনের মানুষ’-কে। তারপর ওই কড়ে আঙুল ধরে বাইরে এনে ঘোমটা খুলিয়ে চারচক্ষুর মিলন, কন্ঠীবদল— অনেকক্ষেত্রে মালাচন্দন করে আনুষ্ঠানিক বিবাহ। কিন্তু বৈষ্ণবী পছন্দ না হলে তাৎক্ষণিক বিচ্ছেদ। গলার কন্ঠী নিষ্ঠুরভাবে ছিঁড়ে ফেলে, শেষবারের মত একবার দই-চিঁড়ে খাইয়ে বিদায়। সেই পরিত্যক্ত বোষ্টমীর দিকে ফিরেও তাকাত না কেউ।
কবি গীতা চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বেদানাদাসীর আশ্চর্যচরিত’ কবিতায় কন্ঠীছেঁড়া বৈষ্ণবীর এই বুকভাঙা কান্নাকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছেন। প্রাচীন মানুষেরা বলেন, এই অসহায় মেয়েরা অনেকক্ষেত্রেই লালসার শিকার হত। মেলাকে কেন্দ্র করে অস্থায়ী পতিতাপল্লির বিস্তারের কথাও অনেকে বলেছেন।
এই জায়গাটাতেই প্রতিবাদ করেছিলেন ‘গৌড়দূত’ পত্রিকার সম্পাদক লালবিহারী মজুমদার। ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক প্রদ্যোৎ ঘোষ তাঁর ‘বৈষ্ণবতীর্থ রামকেলি ও তার উৎসব’ প্রবন্ধে বলছেন— ‘‘প্রায় শতবর্ষ পূর্বে এখানে বারাঙ্গনাদের ব্যাপক উপস্থিতি হওয়ায় ‘গৌড়দূত’ পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক লালবিহারী মজুমদার তীব্র প্রতিবাদ করায় তৎকালীন জেলাশাসক জে.এন.রায় তা রদ করেন।’’ এ নিয়ে লালবিহারীর সঙ্গে মন্দির সংলগ্ন আখড়ার মোহান্ত বাবাজিদের মতানৈক্য তৈরি হয়। মিথ্যা অভিযোগ তুলে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হচ্ছে— এই অভিযোগ ওঠে তাঁদের তরফ থেকে। কর্তব্যে অটল লালবিহারীর পরিষ্কার যুক্তি ছিল— ঐতিহ্যশালী রামকেলি প্রাঙ্গণের পবিত্রতা রক্ষা করা সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও মালদাবাসী হিসাবে তাঁরও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অসহায় কন্ঠীছেঁড়া বৈষ্ণবীদের কেন কোনও সুস্থ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না— এ প্রশ্নও তোলেন তিনি।
১৯১২ পরবর্তী সময় থেকে অগ্রজপ্রতিম রাধেশচন্দ্র শেঠের ছায়া সরে যাচ্ছে লালবিহারীর মাথার ওপর থেকে। ‘গৌড়দূত’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক হিসাবে লালবিহারী একক এবং অনন্য— ফলে তিনি কার্যত একাই লড়ে যান। তিনি তাঁর লেখায় মালদায় ফিমেল স্কুল স্থাপনকে গুরুত্ব দিয়েছেন, বাল্যবিবাহের প্রতিবাদ করেছেন, সমর্থন করেছেন শিক্ষিত মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরতাকে— অসহায় মেয়েদের চোখের জল তাঁকে যে বিচলিত করেছিল, ‘গৌড়দূত’-এর একাধিক লেখাই তার প্রমাণ।
মজুমদার পরিবারের লোকশ্রুতিতে আছে, পুলিশ পাঠিয়ে নির্দেশ কার্যকর করার আগে জেলাশাসক জে. এন. রায় নিজে এসেছিলেন বর্তমান জুবিলি রোডে অবস্থিত মজুমদারবাড়ির বিখ্যাত চাতালটিতে— যে চাতাল আর ডিসপেনসারি ঘর নানা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী। মেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পতিতাবৃত্তি রোধ করার জন্য লালবিহারীর এই সাহসী পদক্ষেপ কালের গর্ভে তলিয়ে গেলেও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে।
অধ্যাপক রমাকান্ত চক্রবর্তী তাঁর ‘বৈষ্ণবিজম ইন বেঙ্গল’ নামক বৈষ্ণব ধর্মবিষয়ক আকরগ্রন্থে রামকেলি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে একজন দৃঢ়চেতা (আপরাইট) সাংবাদিকের কথা উল্লেখ করেছেন— যিনি শুধু এই মেলার প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করেছেন, তাইই নয়— এই মেলাকেন্দ্রিক কুপ্রথা দূর করতেও কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছেন। অনুমান করা অসংগত নয়: এই সাংবাদিক আর কেউ নন, লালবিহারী মজুমদার।
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তকে ঘরছাড়ার আহ্বান জানিয়ে বৈষ্ণবী কমললতা বলেছিল, চলো ঠাকুর— বেরিয়ে পড়ি। দেহসাধনা নিয়ে শ্রীকান্তের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে এই কন্ঠীছেঁড়া বোষ্টমী বলেছিল— এ পথ সত্যি যাদের জন্য নয়, তাদের সাধনা চিরকাল জলের ধারাপথে শুকনো বালির মতো আলগা থেকে যায়, কোনওদিন জমাট বাঁধে না। মেয়েরা দুঃখকে ভয় পায় না— আবার চোখের জলকেও এড়াতে চায় না। দ্বারিকাদাসের আখড়ায় এই চিরসত্য খুঁজে পেয়েছিলেন শ্রীকান্তরূপী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর রামকেলির মেলায় সাংবাদিক লালবিহারী মজুমদার।
গ্রন্থঋণ:
১. Vaishnavism in Bengal- Ramakanta Chakravarty, Firma KLM, Kolkata, 1996
২. গভীর নির্জন পথে- সুধীর চক্রবর্তী, আনন্দ, কলকাতা, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ
৩. জাতবৈষ্ণব কথা- অজিত দাস, চর্চাপদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১২
৪. মালদহের ইতিহাসের ধারা- তুষারকান্তি ঘোষ, অক্ষর প্রকাশনী, কলকাতা, ২০২০
৫. নির্বাচিত ‘গৌড়দূত’ সংকলন (মজুমদার পরিবারের সৌজন্যে)
ইতিহাসের একটি দলিল