Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

পরীক্ষাটা শেষ হতে আর মাত্র পনের মিনিট বাকি। সে কী লিখছে জানে না, কিন্তু যতই এগিয়ে আসছিল শেষের ঘণ্টাটা, খুশির বান ডেকে যাচ্ছিল তার মধ্যে। শেষ পরীক্ষাটার জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার আগে যখন কলম খুঁজতে বোনেদের টেবিলে ঢুঁ মেরেছিল, তখনই চোখে পড়েছিল জিনিসটা! ঘড়ির কাঁটার ওই দমদম মুহূর্তে সামান্যই উল্টেপাল্টে দেখতে পেরেছিল তাকে, কিন্তু তাও জিনিসটা চুম্বক হয়ে লেগে রইল, এমনকি পরীক্ষার হলেও পিছু ছাড়ল না! প্রশ্নপত্রটা মোটেই সুবিধের ছিল না আজ, একটা সময় তো খাতা ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল! বানিয়ে বানিয়ে আর কত লেখা যায়! কিন্তু জিনিসটার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই উতলা হয়ে উঠেছিল মন, শুরু হয়েছিল এক তীব্র ছটফটানি! হাত-পা-চোখ-মুখ শক্ত করে সে ট্রেন ছোটাতে লাগল খাতায়, যেভাবেই হোক শেষ করতে হবে পরীক্ষাটা, আর তারপরেই তো হাতের মুঠোয় এসে যাবে জিনিসটা পুরোপুরি, সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াটাও, যেখানে সে থাকবে একদম একা, আর কারও প্রবেশাধিকার থাকবে না সেখানে!

বইটা একটা সবুজ মলাটে ঢাকা ছিল, আর এর ফলে আদিম প্রচ্ছদটা ঢাকা পড়েছিল। সাহিত্য কেন্দ্রের বইগুলো এমনই থাকে; শুধু তাই না, একটি পলি আবরণের ছিটকানিও আঁটা থাকে হার্ডকভারটির চার কোনা ঘিরে! কেন্দ্রের এই ঢাক ঢাক আর গুড় গুড় ব্যাপারটাই বোধহয় ছাত্রদের কাছে এর আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয় অনেকখানি! তবে আজ অবধি সংগঠনটির সদস্য হতে পারেনি সেতু; বোর্ডের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেতাব তাদের স্কুলের মাথায়, স্বভাবতই ছাত্রদের পড়াশুনোয় বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটে এমন কিছু সহ্য করা হয় না সেখানে! অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির সব কিছুই সেতুর নখদর্পণে— প্রতিটা বই, তার নিয়মকানুন, ঠিকুজি! সাহিত্য কেন্দ্র তাদের স্কুলের উঠোন মাড়াতে না পারলে কী হবে, সেতু ঠিকই ওদের চৌকাঠ পেরিয়ে গেছে!

বইয়ের অন্তরের এতটা খবর তার বোনেদেরও কাছেও থাকে না, যারা কিনা তাদের অপেক্ষাকৃত শ্রীহীন স্কুলের সুবাদে মাসে চারটে করে বই নিয়ে আসতে পারে। বাসায় ঢোকার পর বইগুলোর যাবতীয় ট্রিটমেন্ট সেতুর হাতে— সে এগুলো পড়বে, সেরা সেরা লাইনগুলি মার্ক করবে, তারপর এমনকি বোনেদের খাতার হোমওয়ার্কও করে দেবে। কেন্দ্রের লোকেদের অত সময় নেই যে হাজার হাজার সদস্যের হাতের লেখার ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাবে। শেষে যখন পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে অনেক অনেক বই পুরস্কার নিয়ে বাসায় ফিরবে তার বোনেরা, সেতু জানে সে বইগুলোও তার হবে। ছবি তোলা, বান্ধবীদের দেখিয়ে ক্রেডিট নেয়া ইত্যাদি সব সারা হয়ে গেলে উপহারগুলির আর কোনও খোঁজ থাকবে না। তখন সেগুলো নিরুপদ্রবে বসবাস করতে থাকবে সেতুর ঘরে।

নামটা আর ভেতরের ছবিগুলোই তার প্রাথমিক ক্রাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরীক্ষার আগে শুধু পাতা উল্টানোর চিন্তা করেই বইটিতে ঢুকেছিল সে, তবে না না করেও আস্ত একটা চ্যাপ্টার ঢুকে পড়েছিল তার মাথায়! কে জানে, শেষের ওই সময়টুকু সিলেবাসে দিলে হয়তো প্রথম স্থান প্রাপ্তিটা তার ঝুঁকির মুখে পড়ত না। কিন্তু বইটার মধ্যে যেন কিছু একটা ছিল! ডেকে চলেছে বইটা তাকে আকুল সুরে! আর এজন্যই পরীক্ষা শেষে যখন বাড়ির পথে রিকশাটায় চেপে বসেছিল, তখন সে কিছুই দেখছিল না আশেপাশের; তার চোখে তখন একটি মহাদেশ, আর দু’শো বছর আগের একটি সময়! বাড়িতে ঢুকে স্কুলব্যাগটা কোনওরকমে টেবিলে ছুড়ে ফেলে জুতো-মোজা-শার্ট খুলছিল যখন, তার হাত-পা রীতিমত কাঁপছিল! কেবলি মনে হচ্ছিল, সময় চলে যাচ্ছে, আর একটু হলে আর ফিরে পাওয়া যাবে না! এরপর উসাইন বোল্টের গতিতে ভাত, তরকারি গিলে যখন সে বিছানায় এলিয়ে পড়ল তাকে নিয়ে, তখন গলায় বিঁধে রয়েছে একটা কাঁটা, আর খাবারকণিকারা লিপ্ত হয়েছে যুদ্ধে; এত লোড একসাথে খুব কমই নিতে হয়েছে তাদের আগে!

পুরো একটা মাস, মানে পরীক্ষার পনের দিন ও তার আগের পনের দিন, বলা যায়, খুবই কষ্টে কেটেছে সেতুর। আলমারির বইগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে, আর সে তাদের দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে। এর মধ্যে যতবার আল্লার কাছে হাত তুলেছে, পরীক্ষাটা দ্রুত শেষ হওয়ারই প্রার্থনা করেছে সে; ভাল পরীক্ষা, ফার্স্ট হওয়া— মাথাতে একদমই আসেনি। কিন্তু আজ যখন দিনটি এল, আলমারির বইগুলোর দিকে একটিবার তাকানোর কথাও মনে এল না তার! বরং নতুন বইটির গন্ধ মাতিয়ে দিতে লাগল তাকে; এর কভারকে তার কাছে মনে হল এক চিরহরিৎ বন, কচি পাতা বিছানো যারা বিস্তীর্ণ বনপথে!

আঙ্কল টমস কেবিন ইতোমধ্যে শত হাত ঘুরে ফেলেছিল রেকর্ডকার্ড অনুযায়ী! অস্থিরমতি ছাত্রদের হাতের ভেলায় চড়তে চড়তে সামান্য ছিলেটিলে গেছে কোথাও, পোকার আদর-অত্যাচারে কোথাও তৈরি হয়েছে গভীর ক্ষত— বইটার পুরনো হওয়ার এরাই একমাত্র সাক্ষী। বইটা শুরুর আগে খানিক শুঁকে নিল সেতু, সাহিত্য কেন্দ্রের বইগুলোর একান্ত নিজস্ব গন্ধটি এই বইতেও মিস হল না! বিষয়টা তাকে প্রায়ই ভাবায়, মানে, এই যে মন উদাস করা, প্রাণ আকুল করা গন্ধ— তা কি কেন্দ্রের একান্ত আবিষ্কার, না কি, এটি আপনাআপনি জন্মায়! আগের মত আজও সাত-পাঁচ ভেবে যখন কোনও গ্রহণযোগ্য উত্তর পেল না, তখন কালবিলম্ব না করে মস্ত একটা ঝাঁপ দিল সে বইটার গহ্বরে, এবং মুহূর্তেই পুরো নিমজ্জিত হল!

বইটিতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়েছিল সেতু। কিন্তু প্রাণপণ সাঁতরেও কেন জানি ঠাঁই মিলছিল না। বেশ কয়েক গ্যালন জল গিলে যখন আবিষ্কার করল, এ শুধুই এক নিগ্রো ক্রীতদাসের অত্যাচারিত হওয়ার কাহিনি, অনেকখানি দমে গেল সেতু। আর সে কিনা ভেবেছিল টম কাকা নামের একজনের সাঙ্ঘাতিক সব অ্যাডভেঞ্চারে ভাসতে চলেছে! কেন্দ্রের আগের বইগুলোর কথা বার বার মনে পড়ছিল, সেই রবিনসন ক্রসো, সেই টারজান, সেই শার্লোক হোমস— দ্য সাইন অফ ফোর, রবিনহুড, মমি রহস্য, অদৃশ্য মানব, চাঁদে অভিযান, ফিহা সমীকরণ!

একবার তো ভেবেছিল বইটাকে ‘বাপের বাড়ি’ দিয়ে আসবে। কিন্তু সেই খোয়ারটা… যেখানে বেঁধে রাখা হয়েছিল টমকে, ভীষণ… ভীষণ চমকে দিল তাকে। এই কালো ক্রীতদাসটা, প্রথমে যেরকম ভেবেছিল, সেরকম নয় মোটেই! কিছু একটা ব্যাপার আছে ওর মধ্যে! খোয়াড়ে পশুর পরিবেশে থেকেও ব্যাটা ঈশ্বরকে ডাকতে পারে! আর কী অদ্ভুত সেই ডাক— ‘হে যিশু, আমার এই নশ্বর দেহটাকে নিয়ে যত পারে ওরা নিজেদের কাজে লাগাক, কিন্তু আমার মনটাকে যেন ওরা তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে না পারে।’ একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় সেতুর শরীর বেয়ে!

এর আগে শেকল পরিয়ে যখন গাড়িতে উঠানো হয় টমকে, আর ক্রীতদাস ব্যবসায়ী হেলির লোকেরা তাকে লক্ষ্য করে চাবুক ঘুরিয়ে গান করতে থাকে, তখনো টম আকাশের দিকে হাত তুলে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করেছিল। তার ঠোঁট দুটো সমানে নড়ছিল, কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসা স্বর পুরোই চাপা পড়ছিল হেলির লোকেদের উন্মাদ নিনাদে। রাস্তা দিয়ে ভ্যানবোঝাই মুরগিগুলো যখন যায়, তখন ওদের গলাগুলোকে এরকম নড়তে দেখেছে সেতু, শরীরটা তাদের পুরো পথ জুড়েই দুলতে থাকে, একজনের ওপর আরেকজন পড়তে থাকে, এভাবে ক্ষণে ক্ষণে ভীষণ রকম একটা রোলার কোস্টার রাইড হয়ে যায় তাদের! কিন্তু টম তো একজন মানুষ, তাকেও কেন পশুপাখির মত বেঁধেছেদে নেয়া হচ্ছে? অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্তে এল সেতু— টম মানুষ হলেও একজন নিগ্রো, দেখতে একদম আদিম মানুষদের মত। সেই যুগে তো পশু-পাখি-মানুষেরা একই সাথে বাস করত বনে। তারপর তো বিবর্তনের পথ ধরে মানুষ সভ্য হয়েছে। কিন্তু টম রয়ে গেছে আগের মতই! কোনও বিবর্তন হয়নি ওর!

বইটাতে এমন আরও অনেক কিছু ছিল, যা এক অচেনা-অজানা দেশে নিয়ে গেল সেতুকে এবং ক্রমেই বেঁধে ফেলতে লাগল তাকে, প্রবল এক পাকদণ্ডিতে! এলিজার দুধের বাচ্চার ওপর এলিজার অধিকার থাকবে না? তাকে চাইলেই বিক্রি করে দিতে পারে অন্য মানুষেরা? আবার এলিজার স্বামী জর্জ হ্যারিস যা উপার্জন করবে তুলোর খামারে কাজ করে, সেসবের অধিকার তার মালিকের; এমনকি স্ত্রীর ওপরও কোনও অধিকার নেই লোকটির, স্ত্রীকে পেতে হলে মালিক শেলবির কাছ থেকে কিনে নিতে হবে তাকে! দাস ব্যবসায়ী হেলি ভেবেছিল, একটা পেতলের দুল আর পুরনো গাউন পেলেই এলিজা তার শিশুপুত্র জিমকে কোল থেকে ছেড়ে দেবে। ওদিকে এলিজা কিনা সন্তানের জন্য বরফের নদী অতিক্রম করছিল!

আরও একটা বিষয়টা খুব অবাক করল সেতুকে; মালিকেরা ক্রীতদাসদের হাতে বই একদমই সহ্য করতে পারত না। জর্জ হ্যারিস তুলো পেজার যন্ত্র আবিষ্কার করে তো মালিকের অত্যাচারেরই স্বীকার হল! ক্রীতদাসদের যে মেধা, মনন ও স্বাধীন সত্তা আছে, সে যুগে তা-ই কেউ বিশ্বাস করত না! বইটির এক জায়গায় এক মহিলাকে যখন বলতে শোনা যায়; ‘দেখুন, ওরা যদি স্বাধীন হয়, পথেঘাটে না খেয়ে মরবে। তার চেয়ে বেশ সুখেই আছে, নিশ্চিন্ত আশ্রয় পাচ্ছে, এর চেয়ে আর বেশি কী আশা করতে পারে!’, তখন অনেকক্ষণ ধরে কথাটা নিয়ে ভাবে সেতু, কিন্তু কোনও সমাধানে পৌঁছুতে পারে না। নিগ্রো ক্রীতদাসেরা দেহে-মনে অন্য মানুষদের থেকে শক্তিশালী ছিল; উপোস, আর অত্যাচার সওয়ার ক্ষমতা ছিল ওদের অনেক বেশি, আর এজন্যই না কি তাদের লাভজনক মনে করত তুলোর খামারিরা। কিন্তু ক্রীতদাসেরা সইত কেন মালিকদের নিপীড়ন? কে তাদের বাধা দিয়ে রেখেছিল?

বইয়ের পাতায় চোখ পড়ে থাকলেও সেতু সেখানে ছিল না। সময়ের আবর্তনকে কাজে লাগিয়ে সে চলে গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ বছর আগের সেই আদিম পৃথিবীতে। হঠাৎ একটা বেসুরো খটখট শব্দ থামিয়ে দিল সেতুকে। বইয়ের অক্ষিপট থেকে চোখের পেখম তুলে সেতু দেখতে পেল, উপরে ফ্যানের পাখাগুলো থেমে দাঁড়িয়েছে, আর নীচে একটি মেয়ে ঝাড়ু হাতে আস্তে আস্তে রুমের কোনার দিকে এগুচ্ছে! একটা কড়া ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল সেতু, মেয়েটিকে আগে দেখেনি। আগে মাসে মাসে বদলানো হলেও এখন প্রতি সপ্তাহেই নতুন মানুষের দেখা মিলছে বাড়িতে। ছুটা বুয়া নামের সাথে পারফেক্ট সঙ্গত করে এরা দিনরাত ছুটে বেড়ায় পাড়াটাকে মাথায় করে!

মেয়েটি ঝাড়ু শেষে মোছার কাজটি অনেকখানি সময় নিয়ে করল। একটি বিশ্রী গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল ঘরময়, কিন্তু সেটা ঘরমোছার বালতিটা থেকে, না কি, মেয়েটির নোংরা জামাকাপড় থেকে, তা বুঝে উঠতে পারছিল না সেতু। অবশেষে রুম থেকে অদৃশ্য হওয়ার আগে পাখাটা ছেড়ে দিয়ে গেলে সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল! অত গরমের দিন না হলেও সেতু দরদর করে ঘামতে শুরু করেছিল; ফ্যান ছাড়া সে একদম থাকতে পারে না, কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে তার! এই কাজের লোকগুলো পারে কী করে, তা তার মাথায় ঢোকে না। যেমন, এই মেয়েটি এখন অন্তত আরও তিনটে রুমে একই কাজ করবে, ফ্যানটা বন্ধ করে দেবে, পরে ঝাড়ু, শেষে ঘর পোঁছ! তাছাড়া, রান্নাঘরে যখন তরকারি কাটা, রান্নার সাজসরঞ্জাম, আর চুলোর ইন্তেজাম চলবে, এমনকি বাথরুমে গিয়ে কাপড়গুলোকে গোসল করিয়ে আনবে ধুপধাপ আওয়াজ তুলে, তখনও তো সে কোনও ফ্যান পাবে না! সম্ভবত ওদের শরীর এভাবেই তৈরি হয়ে গেছে! এখানেও সেই এভুলেশন, বিবর্তনবাদের খেলা!

‘একটি কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ ক্লো, যে-ভগবানের আশ্রয়ে এখানে আছি, সেই ভগবান সেখানেও আছেন… তিনিই সেখানে আমার একমাত্র আশ্রয়।’— টমের এই সংলাপটার নীচে পেন্সিল দিয়ে রেখা টেনে দিতে দিতে একটা স্বস্তির স্রোত বয়ে গেল সেতুর মনে! দাস ব্যবসায়ী হেলি তাকে তুলোর বাগানের মালিকের কাছে বিক্রি করে দেবে, স্ত্রীর এমন আশংকার মুখে বেরিয়ে এসেছিল সংলাপটা। বেচারা টমের জন্য খুব খারাপ লাগছিল সেতুর! কী কারণে যেন ওর ওপর মায়া পড়তে শুরু করেছিল! সত্যি এভাবে ভেবে দেখেনি সেতু কখনও। ঈশ্বর সর্বত্র আছেন, সে তো পাঠ্যবইতেই পড়েছে। কিন্তু টমের সাথেও সে থাকছে সর্বত্র। একা হয়ে যাচ্ছে না টম; স্ত্রী, পুত্র জর্জ কাছে না থাকলেও ঈশ্বর তাকে সঙ্গ দেবেন!

টম যখন জাহাজে চেলা কাঠ তুলছিল তখন খুব টেনশান হচ্ছিল সেতুর, যদি সে-ও অন্যদের মত পা হড়কে পড়ে যায়, তাহলে তো তাকেও চাবকে লাল করে দেবে! এরপর জাহাজের পাটাতন থেকে তুলে নিয়ে যখন স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে দেয়া হল টমকে, স্বস্তির নিশ্বাস হুড়মুড় করে ছুটতে লাগলে সেতুর নাসারন্ধ্র বেয়ে! যা হোক, এত পরে হলেও হেলি চিনতে পেরেছে টমকে! এরপর ছোট্ট মেয়ে ইভাকে উদ্ধারে যখন জাহাজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দেয় টম, তখন রীতিমত দোয়াদরুদ পড়তে শুরু করে দিয়েছিল সেতু! তার আনন্দ আর বাঁধ মানল না, যখন দেখতে পেল, তার মনের গুপ্ত ইচ্ছেটি ঠিকই শুনেছেন সৃষ্টিকর্তা! সেই ইচ্ছেকে সন্মান জানাতে ইভার বাবার মত একজন দয়ালু মানুষের কাছে বিক্রি হয়ে তাদের বাড়িতে আশ্রয় পেল টম।

‘আমি তো মানুষ নই, আমি তো জন্মাইনি!… আমি কেবল বড় হয়েছি আপনা থেকে!’ টপসির এ কথাগুলোয় আবার বন্দি হয়ে পড়ে সেতু, কথাগুলোর কী এক যাদুকরী শক্তি! তাকে আকাশপাতাল ঘুরিয়ে আনে, বিবর্তনের চাকায় ভর করে! আশ্রিত টপসির বাবা-মা নেই বলে সে নিজেকে মানুষ করে না। যাদের বাবা-মা থাকে না, তারা তাহলে অমানুষ? পশুপাখি বাবামাকে চেনে না বলেই কি তারা মানুষ বলে দাবি করতে পারে না নিজেদের? আচ্ছা, এককালে তো মানুষও পশুপাখির মতই ছিল, তখন মানুষ নিজের বাবামাকে চিনতে পারত? হঠাৎ কীসের সাথে যেন একটা ঘষা লাগে তার পায়ে!

আরেকটু হলেই একটা বিশাল গর্তে পড়তে যাচ্ছিল সে পা ফসকে! কিন্তু এ কোথায় এসে পড়েছে সে! একবার মনে হয়, এখানকার কিছুই চেনা নেই তার! আবার মনে হয়, এখানে তো আগেও এসেছে সে, শুধু জিনিসগুলো সব বদলে গেছে! হঠাৎ দেখতে পায়, নুরু হেঁটে যাচ্ছে একা একা! দূর থেকে ডাকলে সে দাঁড়িয়ে পড়ে! তারপর কী একটা বলতে দেখা যায় সেতুকে, কিন্তু নুরুর মধ্যে কোনও ভাবান্তর নেই, সে যেমনি ছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকে কাঠের মত। এক পর্যায়ে সেতুকে ভীষণ রেগে উঠতে দেখা যায়। সে সর্বশক্তিতে হামলে পড়ে নুরুর ওপর! আস্তে আস্তে দৃশ্যটা ছোট হয়ে আসতে থাকে, সেখানে শুধু এক জোড়া পা, আর স্যান্ডেল! দৃশ্যটা বড় করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে সেতু, কিন্তু তার আগেই মুছে যায় ছবিটি। এরপর রিলে করার চেষ্টা করে সে! কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না! প্রবল এক অস্থিরতা পেয়ে বসে তাকে!

পরদিন বেশ সকাল করে বিছানা থেকে উঠল সেতু। হাতে ধরা বইটাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তার শোয়া কোনওকালেই ভাল ছিল না, সারা রাত এপাশ ওপাশ করেছে নিশ্চিত, আশ্চর্য হল, তাও বইটা ছিটকে পড়েনি, জড়িয়ে থেকেছে তার গা ঘেষে! বেশ ভাল একটা ঘুম, অনেক দিন বাদে! কিন্তু মাথাটা আর-একটু খোলতাই হতেই রাতের খচখচটা ফিরে এল! কী বলছিল সে নুরুকে, কী নিয়ে ক্ষুদ্ধ ছিল সে? কী ছিল ঘটনাটা! ব্রেকফাস্ট করতে করতে মাকে জিজ্ঞাসা করল সে নুরুর কথা।

যখন শেষবার বাসা শিফট করে, তখন বাসার নিয়মিত কাজের মেয়েটা তাদের সঙ্গে নতুন জায়গায় আসতে চাইল না। সময়টা ছিল রোজার মাস, যাকাতের কাপড় নিতে মায়ের হাত ধরে এসেছিল নুরু। কিন্তু অন্যদের মত ছিল না সে; বাড়ির বাচ্চাদের সাথে মিশে গিয়েছিল মুহূর্তেই, ছুটোছুটি করছিল মেঝে কাঁপিয়ে। অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে আর হাতে কয়েকটা কড়কড়ে নোট গুঁজে দিয়ে যখন ওকে কিছুদিনের চেয়ে নেয় সেতুর মা, কিন্তু তখন কে জানত যে, নতুন বাসায় একদমই লোক পাবে না, আর নুরুই হয়ে যাবে একমাত্র ও স্থায়ী কাজের লোক! বাসার সব কাজ যেগুলো ঠিকা ঝিরা করত, সেতুর মা সব শিখিয়ে দিতে লাগল নুরুকে। কিন্তু দিন দিন কাজের চাপ বাড়ছিলই। একদিন নুরুকে আর পাওয়া গেল না, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও। শেষে জানা গেল, সে বাড়ি চলে গেছে।

প্রথমটায় বুঝতে পারলেন না সালেহা বেগম ছেলে কার কথা জিজ্ঞেস করছে। পরে যখন মনে পড়ল, মুখটা বেঁকে গেল, বিতৃষ্ণা, ক্ষোভ আর সন্তোষ একে একে খেলে যেতে লাগল সেখানে, ‘হ হ, কোন কালের কোন মামা পাতাইছিল কার লগে জানি, পলাইয়া ওইহানেই উঠছিল। হুনছি, অহন ফেরিতে আন্ডা বেচে! ছ্যামড়া নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারল! এইহানে তিনবেলা খাইতে পারত, ভাল জামা কাপড় ফিনতে পারত। কিন্তু এই জাত কহনো নিজের ভাল বুঝতে পারে না!’ এরপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মা যখন বলল, এর বাইরে আর কিছু জানা নেই তার, তখন তার মুখখানা এতটা বিকৃত হয়ে উঠল যে, সেখান থেকে চোখ ফেরাতেই সেতু পুনরায় টম কাকার কুটিরে কড়া নাড়তে শুরু করল।

‘তার পিঠে বুকে কব্জিতে চাবুকের লম্বা কালশিটা দাগ আছে। তার ডান হাতের চামড়ার ওপর আমার নামের আদ্যক্ষর ক্রীতদাসত্বের চিহ্ন হিসেবে মুদ্রিত আছে। জ্যান্ত ধরিয়ে দিলে চারশো ডলার, গুলি করে মেরে ফেললে আর চারশো।’ কেনটাকির একটি হোটেলের দরজার সামনে এমন হুলিয়া ঝোলানো ছিল হয়েছিল যে ব্যক্তির জন্য, সে আর কেউ নয়, জর্জ হ্যারিস নামের এক যুবক যে পালিয়ে এসেছিল বাঘের গুহা থেকে! আগের দিন খুব বেশি এগুতে পারেনি, নতুন নতুন সব বিষয় আর ঘটনা তাকে পুরোই ঘোরের মধ্যে রেখেছিল, থামিয়ে দিচ্ছিল বারবার। এই সময়গুলোতে বইগুলোও যেন স্থির হয়ে যায়, একটি পাতায়, বা, একটি প্যারায়, বা, কখনও একটি বাক্য, বা একটি শব্দে বন্দি হয়ে থাকতে হয়! পরের পাতায় যেতে তখন বড্ড দেরি হয়ে যায়।

সময় পুষিয়ে নিতে শেষের চাপ্টারগুলো অবশ্য সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে পরিণত হয়; তাড়াহুড়ো, হৈচৈ, আর দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়! জর্জ হ্যারিসকে নিয়ে সেইরকমই এক দৌড়-ঝাঁপের মধ্যে সে ছিল বইটির খোলা মাঠে। কিন্তু ইভার মৃত্যুটা তাকে আবার থামিয়ে দিল। টমের মুক্তির সনদটা আদায় করেই ছাড়বে ইভা বাবাকে দিয়ে, তারপর আবার টম ফিরে যাবে মি. শেলবির নিরাপদ ও সুখের ডেরায়, তার নিভৃত কুটিরে আবার সে নেচেগেয়ে মাতিয়ে রাখবে, স্বপ্নটা টমের পাশাপাশি সেতুও যে বুনেছিল! তারপরের পাতাগুলো যে কী রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাটল! কী হবে টমের? ইভার বাবা তার মৃত্যুশিয়রে রাখা কথাগুলি কি রাখতে পারবে! ইভার মা দেখতে পারত না টমকে; কিন্তু ইভার বাবার ওপর সেতুর অনেক ভরসা ছিল! কিন্তু শহর থেকে ফিরে মুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করবেন কথা দিয়ে যখন আততায়ীর হাতে রক্তমাখা লাশ হয়ে ফিরে এলেন তিনি ঘরে, মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল সেতুর! দুনিয়াটা অর্থহীন মনে হতে লাগল তার কাছে, সব কিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা বোধ হল! টমের মুক্তির স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেলে, সেতুর মনে হল, সে নিজেই যেন অন্তরীণ হল। ওই অভেদ্য খাঁচা যেন কেউ আর নেই তাকে বের করার!

হঠাৎ তীব্র এক শোরগোল তার সেই খাঁচার শরীরে ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ তুলল, আর টমের কুটির থেকে ঝপাং করে বের করে দিল। এক দৌড়ে এসে সে দেখতে পেল নতুন মেয়েটির চুল ধরে টানাটানি হচ্ছে! মাছের কড়াইতে কী মনে করে আঙুল দিয়ে ফেলেছিল, আর তা পড়ে গিয়েছিল মায়ের চোখে। এরপর কৈফিয়ত চাইলে মেয়েটি পুরো অস্বীকার করে। একে তো অপরাধ করেছে, তার ওপর অস্বীকার, সুতরাং…। তিন বেলাতেই তো খেতে দেয়া হয়; যখন পাকের ঘরের পিঁড়িতে বসে গিলতে থাকে গোগ্রাসে, ডাইনিং টেবিলের থেকে যাওয়া খাবারগুলি, তার পুরোটাই ঢেলে দেয়া হয়, তারপরও কেন! বান্দির বাচ্চা, চুন্নি, রাক্ষস ইত্যাদি সব শব্দ প্রবল ধোঁয়া তৈরি করতে থাকে বাসাটা জুড়ে! কিন্তু মেয়েটির মধ্যে কোনও ভাবান্তর দেখতে পায় না সেতু। সেতুর হঠাৎ মনে হয়, বিবর্তনের পথ বেয়ে এমন এক শ্রেণির প্রাণী জন্ম নিচ্ছে, যাদের চোখে কোনও অশ্রু থাকবে না, ব্যথার সংকেতেও যারা নির্বিকার থাকবে!

দম বন্ধ হয়ে আসছিল সেতুর, নিশ্বাস ছাড়ার এক প্রবল তাড়া থেকে টম কাকার প্রেক্ষাগৃহে পুনরায় প্রবেশ করে সে। কিন্তু সেখানেও আছে ইভার মা! ইভার ফুফু ওফেলিয়ার মত সেতুরও খানিক আশা ছিল, হয়তো প্রয়াত স্বামী মি. ক্লেয়ারের অনুরোধ রাখবেন তিনি। কিন্তু শেষমেশ যখন নিলামে তোলা হল টমকে, সেতুর মনে নতুন একফালি আশা জেগে ওঠে— শেলবিদের অবস্থা নিশ্চয়ই ভাল হয়েছে, জর্জ তার প্রিয় টম কাকাকে নিশ্চয়ই বাড়ি নিয়ে যেতে আসবে! এত ভাল একজন মানুষ টম, নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা তার জন্য ভাল কিছুই রেখেছেন!

জমে উঠেছিল নিলাম। নাম, বয়স, উচ্চতা, বুকের ছাতি, কাজ করার ক্ষমতা ইত্যাদির বিশদ বিবরণ লিখে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল ক্রীতদাসদের পিঠে। নিলামদাররা তাদের শক্ত-সমর্থ দাসদের উঁচু বেদির উপর নিয়ে আসছিলেন সবাইকে দেখাতে। ক্রেতাদের অনেকে ক্রীতদাসদের পিঠে কখনও লোহার দণ্ড দিয়ে আঘাত করে, অথবা, কখনও চাবুক ছুটিয়ে শক্তি পরীক্ষা করছিলেন। কেউ কেউ আবার ক্রীতদাসদের মুখ হাঁ করিয়ে দাঁতে ঘুষি চালিয়ে দেখতে চাইছিলেন ওদের দেহের জোর। সেতু অনেক ভেবেও বের করতে পারে না কোথায়, কিন্তু সে নিশ্চিত এমনটা সে দেখেছে আগে! একটা সময় তার শিরা দপদপ করতে থাকে, আর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়! প্রতি বছর কোরবানির হাটে এরকম দৃশ্যই তো চোখে পড়ে! একই সাথে আরও একটি দৃশ্য মনে পড়ে যায় সেতুর! সাইমন লেকির খামারে যাওয়ার পথে নদী থেকে নামার সময় আঁজলাভরে জল খেতে গেলে, হাত, পা আর কোমরে বেড়ি পরানো ক্রীতদাসদের শেকল ধরে টান দেয়া হলে ওরা যখন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে, তখন নৌকা-বোঝাই কোরবানির পশু ডাঙায় নামানোর দৃশ্যটা খোঁচাতে থাকে সেতুকে।

‘বটে! ধর্মনিষ্ঠা! চলো তুমি আবাদে, তোমার দেহ থেকে ধর্ম নিংড়ে বের করব, এই নিগার শোন, এই বই যদি আর ছুঁবি, তোর পিঠের চামড়া আর আস্ত রাখব না, আজ থেকে আমার হুকুমই তোর বাইবেল। আমিই তোর গির্জা বুঝলি!’ চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে সেতুর, অক্ষরগুলো উধাও হয়ে এক অন্তহীন মেঘের রাজ্য তৈরি হয় সেখানে, পেঁজা তুলোর মত ভেসে বেড়াতে থাকে। সেতুর মনে কিঞ্চিৎ যেটুকু আশা ছিল, তার কিছুই ঘটল না, মনের অশুভ চিন্তাটাই সত্য হয়ে বেরিয়ে পড়ল, নরপিশাচ এক মালিকের কাছে জমা পড়ল তার প্রিয় টম।

চেইন দিয়ে বাঁধা বাঘের মত একপাল বুলডগ লেলিয়ে দিয়ে তুলার মাঠে তাদের ছেড়ে দেয়া হল, তুলোয় ছিটকে পড়তে লাগল তাদের গায়ের রক্ত, সেই তুলো কালো হয়ে আবার ধুলোয় মিশে যেতে লাগল। আট-দশজন মজুরের ভাগে জোটে একটা গম পেষাই পাথর। সেই পাথরের জাঁতায় গম পিষে নিয়ে পরে শুকনো পাতা, আর গাছের ডাল জ্বালিয়ে ময়দার তাল পাকিয়ে একটুকরো রুটি সেঁকে নিতে হত, আর এই ছিল টমদের সারাদিনের খাবার। একটা অন্তিম পরিণতি আস্তে আস্তে নিকটবর্তী হচ্ছিল! তবু সামনের পাতাগুলিতে তার কৌতূহল ধরে রাখল ক্ষীণ এক আশা, হয়তো টমের মহানুভবতা ও পরিশ্রম তার নতুন মালিক সাইমন লেকিকে শুধরে দেবে! যিশুর বাণী, ‘আমাকে তুমি সমর্পণ করো তোমার সব ভালবাসা… আমি তোমাকে অভয় দিচ্ছি, প্রয়োজনের সময় আমি তোমাকে ডেকে নেব আমার পাশে… তুমি নিশ্চিন্ত থেকো… তুমি আমারই।’ যেন আশার প্রদীপটি জ্বালিয়ে রাখে টমের পাশাপাশি সেতুর মনেও!

তুলোর খামারে টমের যে খুপরিটা ছিল, তার খড় ও পাতাগুলো হঠাৎ কী কারণে উড়তে শুরু করল, ঘরের ছাদ আর দেয়ালগুলো খসে যেতে লাগল। লক্ষ লক্ষ তুলোর পেঁজা ভেসে বেড়াতে লাগল, আর সেতু নিমিষে তলিয়ে গেল তার মাঝে। যখন কিছুটা সয়ে এল চোখে, তখন চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পেল এক ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে! সারা দুনিয়া তুলোর বিশাল চাদরে আটকে রয়েছে! একের পর এক তুলো সরিয়ে সে হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল সেতু। নুরুকে দেখা যাচ্ছে, গম পিষে যাচ্ছে এক মনে, কোনওদিক না তাকিয়ে! এতক্ষণ কোথায় ছিল শয়তানটা? সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছে সে! হারামির বাচ্চাটা সারাদিন ধরেই কাজ করে যাবে, কিন্তু সেতু কোনও অর্ডার দিলে একটুও ভ্রুক্ষেপ করবে না, শুনেও না শোনার ভান করবে। মাঝে মাঝে চড়থাপ্পড়ও খায় সেতুর হাতে, তবু নির্বিকার থাকে, মুখ ফাঁক করে না! এতে আরও রাগ ধরে সেতুর, সারা শরীরে আগুন ধরে যায়! সেতুর মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, ওর গলাটা টিপে ধরতে! কিন্তু বাসার মালিক তো ওর বাবা, ও নয়! তীব্র একটা অসহায়ত্ব ওর ভেতর হাঁসফাঁস করতে থাকে, চাপা আক্রোশ ফণা তুলতে থাকে!

ভীষণ ছটফট করতে করতে ঘুম ভেঙে যায় সেতুর! কিছুটা আড়মোড়ার পর চিন্তাটা আবার ফিরে আসে সেতুর, সেদিন কী হয়েছিল নুরুর সাথে! কেন ও অমন করেছিল! এর মধ্যেই প্রাতকৃত্য ও প্রাতরাশ সেরে আবার আঙ্কল টমস কেবিনকে নিয়ে শুয়ে পড়ে সে! পরীক্ষা শেষের এই দিনগুলোতে সে ইচ্ছেমত শুয়ে পড়তে পারে। স্কুল বন্ধ, কারও কিছু বলার নেই, কওয়ার নেই। কিন্তু আজ বইটির কিছুদূর এগোতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে ভীষণ করে! দৃশ্যগুলো তার খুব চেনা লাগে! কেবলই মনে হতে থাকে, সিনেমাটা দেখেছে আগে কোথাও! সব কাজ অক্ষরে অক্ষরে করে দিলেও সাইমন লেকির মনে হয়, টম তাকে মনে মনে ঘৃণা করে! অন্য শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার করলেও যখন সে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায় না, বরং চুপচাপ মাথা হেলিয়ে বসে থাকা, টমের সেই বিস্ময়কর নীরবতা সাইমনের অপরাধবোধকে জাগিয়ে রক্তাক্ত করে তোলে।

সাইমনের কেবলি মনে হয়, টম যেন নীরবে ভর্ৎসনা করে চলেছেন তাকে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে থেকে ঈশ্বরকে অবমাননা! তাও একজন ক্রীতদাস হয়ে! তাই বিনা অপরাধে টমের ওপর নেমে চাবুকের ঝড়! আর টমের শরীর ও মন দুই-ই ভেঙে পড়তে থাকে! আগে কাজ থেকে ফিরে রুটি তৈরি করবার সময় শুকনো পাতার আগুনে বাইবেলটা খুলে অন্তত একটা দুটো পরিচ্ছেদ পড়ত, এখন তাও পারে না টম! তবে কি তার বিশ্বাস উঠে গেছে? ভাবতেই শিউরে উঠে সে, আর ছেঁড়া-ময়লা বাইবেলখানা খড়ের চালের ভেতর থেকে বের করে আনে। তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে! সব কিছু ঝাপসা দেখতে থাকে সে। তবু তারই মাঝে চলে বিড়বিড় করে প্রার্থনা, ‘যিশু আমাকে সাহায্য করুন বা নাই করুন, তাঁকে ছাড়া কিছু জানি নে। তিনি আমাকে ছাড়লেও আমি তাঁকে ছাড়ব না।’

শেষের পাতাগুলোয় আর সংবরণ করতে পারে না সেতু নিজেকে! বুক ফেটে যে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়, একটা সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তাকে বেরিয়ে আসতে দেয় সে! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বেরুতে থাকে নোনাজলের ধারা, বুকের জলাশয়কে খালি করে, একটা ভীষণ ঘূর্ণি তুলে, থেমে থেমে!

কিন্তু দরজাটা খুলে ফেলতে হয় শীঘ্রই। বাইরে আবার চিৎকার, চেঁচামেচি। মেয়েটি আজ আবার গুরুতর একটা অপরাধ করেছে। আলুগুলো যেভাবে কাটার কথা, সেভাবে না কেটেই কড়াইতে বসিয়ে দিয়েছে! এবং এ কাজ সে করেছে বলে দেয়ার পর। মা নিশ্চিত, ইচ্ছে করেই এ কাজ করেছে বান্দির বাচ্চাটা! আর যায় কোথায়! গতকাল চলেছিল হাত, আজ পাও জুড়ে বসে! তবু মেয়েটির মুখে কোনও রা নেই, চোখে নেই কোনও অশ্রু। কী করে পারে কে জানে! কিন্তু সেতু পারে না। ছুটে যায় নিমিষে মায়ের কাছে, কিন্তু তীব্র এক চোখরাঙানি তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয়, ‘ছি ছি, কেউ কহনো হুনছে, পুরুষমানুষ বাড়ির কাজের লোকের বিষয়ে কথা কয়!’

সেতুর মনে হয়, নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সে; কেউ যেন তার পায়ের ওপর কয়েক মণ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে! সে পাগলের মত শরীরটা মুক্ত করতে চেষ্টা করে, কিন্তু মনে হয়, কোনও এক টানে সে ক্রমশ নীচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে! আস্তে আস্তে সে পুরো নিস্তেজ হয়ে পড়ে, আর অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করে চারপাশে! আর কী আশ্চর্য, ঠিক সেই মুহূর্তেই, হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত ঘটনাটা তার মনে পড়ে যায়! সেদিন নিজের স্যান্ডেলটা খুঁজে পাচ্ছিল না সেতু; পরে আবিষ্কৃত হয়, সেটি পায়ে চাপিয়েই বের হয়েছিল নুরু বাইরের দোকান থেকে আলুপুরি কিনে আনতে। বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেতু, চড়-থাপ্পড়-লাথির সাথে জুটেছিল স্যান্ডেল থেরাপি, স্যান্ডেল দিয়ে পিষে দিয়েছিল সে নুরুর পায়ের খুদে আঙুলগুলো, গলগল করে রক্ত বেরিয়েছিল অনেকক্ষণ ধরে! যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল, তা এক সময় গ্যাংরিনের আকার ধারণ করেছিল!

এরপর মায়ের মুখোমুখি আর কখনও হয়নি সেতু! পুরুষমানুষ হয়েই থাকে সে, আর নিজেকে পুরো আলাদা করে নেয় সবকিছু থেকে। তার একান্তই নিজস্ব একটি জগৎ তৈরি হয়, বইটার মতই যেখানে কারও প্রবেশাধিকার থাকে না। সে একা একা বড় হতে থাকে, বনের সন্ন্যাসীর মত, প্রথম যুগের মানুষের মত, যাদের মা-বাবা কেউ থাকে না।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »