‘ভূতের রাজা দিল বর, জবর জবর তিন বর’। বর আমরা পাই বা না-পাই ভূতের রাজাকে অল্পবিস্তর সবাই চিনি। অন্ধকারের ভেতরে একটা জড়ানো জড়ানো খোনা খোনা আওয়াজ আর তার সঙ্গে গা-ছমছমে একটা আবহ। নস্টালজিক। কিন্তু এ তো গেল সাহিত্যিকের কল্পনা, সত্যিই কি ভূতের রাজা বলে কিছু আছে? আসুন, একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক। ও হ্যাঁ, ‘অপসর্পন্তু তে ভুতা যে ভুতা ভুবি সংস্থিতা…’ বলে একটু সর্ষে ছিটিয়ে নেবেন। তাদের গুণকেত্তন চলছে তো, বলা তো যায় না কখন এসে ঘাড়ে চড়ে বসেন।
যদি লৌকিক মান্যতার দিকে নজর রাখি তাহলে দেখতে পাব ভূতেদেরও রাজা আছেন। তিনি ব্রহ্মদত্যি। কোনও ব্রাহ্মণ অপমৃত্যুতে মরলে ব্রহ্মদত্যি হন। ইনি আবার রামনামে পিছু হটেন না। রীতিমত পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করতে হয়। তাই বহু জায়গায় এনাকে সন্ন্যাসীবাবা, বাবাঠাকুর, সন্ন্যাসীঠাকুর ইত্যাদি নামে পুজো করা হয়। ইনি বেলগাছে বাস করেন। বিশাল চেহারা, পায়ে কাঠের খড়ম আর কাঁধে ধবধবে সাদা পৈতে। অনেক সময় একটা হুঁকো নিয়ে গুড়গুড় করে তামাক খান।
এই ব্রহ্মদত্যি নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে। আবার শিউরে দেওয়ার মত গল্পের সংখ্যাও কম নয়। উত্তর ভারতে এই ব্রহ্মদৈত্যকে ব্রহ্মরাক্ষস বলে। তবে ব্রহ্মরাক্ষস বাঙালি ব্রহ্মদৈত্যের মত মিশুকে নয়। বাংলার জল হাওয়ায় ব্রহ্মদৈত্য বেশ আমুদে এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিবারেরই একজন হয়ে ওঠেন।
এ তো গেল লৌকিক ভূতের রাজার কথা। এবার দেখি আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে কী বলে। এই ভূতের রাজার সন্ধান পেতে হলে চলে যেতে হবে উৎসে। অর্থাৎ ভূত কী তা জানতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এবং বিজ্ঞানসম্মত ভাষা হচ্ছে সংস্কৃত। আর এই ভাষার শব্দে শব্দে তার উদ্ভবরহস্য লুকিয়ে। তাই সোজা চলে গেলাম সংস্কৃত শব্দকোষে। এখানে ভূত শব্দের অনেক অর্থ। আমি তাদের মধ্যে আমাদের যেগুলো প্রয়োজন সেগুলো নিলাম। ভূত মানে আত্মা, পুত্র, পরিশোধিত, যা হয়েছে, জাগতিক মূল উপাদান, ইত্যাদি। অর্থাৎ ভূত মানে যেমন আত্মা তেমনি পুত্র। কেন? উত্তরটা শাস্ত্রেই দেওয়া আছে। পুত্রের মাধ্যমে পিতা নিজের আত্মাকে দর্শন করেন। ইজমবাদীরা ক্ষুন্ন হলেন তো? ক্ষুন্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। পুত্র মূলত পুংলিঙ্গবাচক হলেও আসলে উভলিঙ্গ। এর দ্বারা পুত্র ও কন্যা উভয়কেই বোঝায়। এর স্বপক্ষে অনেক উদাহরণ আছে যা আমাদের এখানে আলোচ্য নয়।
অর্থাৎ ভূত হল সেটাই যা মৃত্যুর দ্বারা পরিশোধিত হয়েছে। যা পঞ্চভৌতিক আশ্রয় ত্যাগ করেছে। যা অতীত হয়েছে। এখন আমরা আলোচনা করব পঞ্চভৌতিক দেহ পরিত্যাগের পর আত্মার কী হয় সে নিয়ে।
মৃত্যুর পর তেরোদিন আত্মা থাকে নিজের বাড়িতেই। সেসময় তার যাতনাদেহ থাকে না। সে থাকে নিরাকার। এসময় প্রতিদিন শ্রাদ্ধের ফলে আত্মার যাতনাদেহের এক একটি অঙ্গ গঠিত হয়। পূর্ণ যাতনাদেহ পেলেই যমদূতেরা আত্মাকে যমলোকের উদ্দেশে রওনা হয়। এখানে বলে রাখা ভাল ভৌতিক দেহের পাপপুণ্য অনুসারে যাতনাদেহ তিন ধরনের গতি পায়। ঊর্ধ্বগতি, স্থিরগতি এবং অধোগতি।
এছাড়াও যাতনাদেহের থাকার জন্য চারটি জায়গা রয়েছে। ব্রহ্মলোক, দেবলোক, পিতৃলোক এবং নরকলোক। আর পথ রয়েছে তিনটি। অর্চিমার্গ, ধূমমার্গ এবং উৎপত্তি-বিনাশ মার্গ। আত্মা অর্চিমার্গে ব্রহ্মলোক এবং দেবলোক, ধূমমার্গে পিতৃলোক ও উৎপত্তি-বিনাশ মার্গে নরকে পৌঁছয়। মৃত্যুর পর আত্মা এক দিনে দুই যোজন অর্থাৎ প্রায় ষোলো’শ কিলোমিটার ভ্রমণ করে। পথে ষোলোটি নগর পড়ে। সেখানে তারা বিশ্রাম নিতে পারে। বলবেন আত্মার আবার বিশ্রাম কী? সে তো সুখ-দুঃখ-শীতোষ্ণ সব কিছুতেই নির্লিপ্ত। একদম ঠিক। আর এজন্যই আত্মা যাতনাদেহ প্রাপ্ত হয়েছে।
শাস্ত্রানুসারে আমাদের এই মহাবিশ্ব তিনটি লোকে বিভক্ত। কৃতকত্রৈলোক্য, মহর্লোক এবং অকৃতকত্রৈলোক্য। কৃতকত্রৈলোক্যে তিনটে লোক,— ভুর্লোক, ভুবর্লোক এবং স্বর্লোক। এই কৃতকত্রৈলোক্যে সবকিছু নশ্বর। এই লোকেই সূর্য চন্দ্র গ্রহাদি থাকে। এই কৃতকত্রৈলোক্যে আছে পিতৃলোক যা ৮৬০০০ যোজন দূরে অবস্থিত। মৃত্যুর পর ঊর্ধ্বগতি আত্মা পিতৃলোকে এক হতে একশ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। আত্মা সেখানকার জন্য আলাদা দেহ লাভ করে যা পিতৃলোকের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে।
আশ্বিন কৃষ্ণ প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত পিতৃলোকের অধিবাসীগণ ঊর্ধ্বকিরণের মাধ্যমে পৃথিবীতে ব্যাপ্ত থাকেন। এই কিরণকেই বলে অর্য্যমা। এই অর্য্যমা আবার পিতৃলোকের অধিপতি। সূর্যের সহস্র কিরণের মধ্যে একটি হল অমা। এই অমাতে বস্য অর্থাৎ তিথি বিশেষে চন্দ্র যখন ভ্রমণ করে তখন সেই কিরণের মাধ্যমে চন্দ্রের ঊর্ধ্বাংশ হতে পিতৃগণ পৃথিবীতে আসেন। এজন্যই অমাবস্যা, সংক্রান্তি, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ ইত্যাদিতে শ্রাদ্ধ করা হয়।
পিতৃলোকে দুরকম পিতৃগণ থাকেন। দিব্যপিতৃগণ এবং মনুষ্য পিতৃগণ। কর্মানুসারে এই শ্রেণিপ্রাপ্তি হয়। যমরাজ এই পিতৃগণের প্রধান ও ন্যায়কারক। এরপর আছেন চারজন প্রধান কাব্যবাড়নল, সোম, অর্য্যমা ও যম। এছাড়াও রয়েছেন দেবতাদের প্রতিনিধি অগ্নিস্ব, সাধ্যদের প্রতিনিধি সোমপা বা সোমসদ। দিব্যপিতৃগণের মধ্য থেকে যমরাজের ন্যায়কারক সমিতির সদস্য নির্বাচিত হন। চিত্রগুপ্ত কর্মফলের হিসেব রাখেন। মতান্তরে এই চিত্রগুপ্তের জায়গায় থাকেন যমের পুত্র শ্রবণ ও কন্যা শ্রবণী।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে আছে ‘কর্মনা পিতৃলোক বিদ্যয়া দেবলোকঃ’। কর্মের দ্বারা পিতৃলোক ও বিদ্যার দ্বারা দেবলোক প্রাপ্তি হয়। তাই জ্ঞানী ব্যক্তি যে দেবলোকে যাওয়ার অধিকারী সে বিষয়ে আর কী সংশয় থাকতে পারে। আর সৎকর্মের দ্বারা পিতৃলোক প্রাপ্ত হয়। এজন্যই পুরাণগুলোর সর্বত্রই সৎকর্ম সদাচরণ ইত্যাদির ওপর বারবার জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্রহ্মলোক আমাদের হাতে নেই। তাই তার কল্পনা করেই ক্ষান্ত থাকা যাক।
আবার সুখ আর আনন্দের পরিমাণও লোকভেদে বিভিন্ন। পিতৃলোকে মানসানন্দের পরিমাণ দশগুণ, দেবলোকে শতগুণ আর ব্রহ্মলোকে একহাজার পরার্ধ ১০২০ গুণ। শ্রীমদ্ভাগ্বত পুরাণের একাদশ স্কন্ধে বলা হয়েছে দেহের বিস্মৃতিই মৃত্যু। প্রায়ণকাল।
এই প্রয়াণ আর প্রায়ণের মধ্যে পার্থক্য গভীর। প্রয়াণ হল মৃত্যু আর প্রায়ণ হল দেহের বিস্মৃতি। দেহের বিস্মৃতি মাত্রেই যেহেতু মৃত্যু নয় তাই প্রায়ণকাল মাত্রেই প্রয়াণকাল নয়। আর জন্ম হতে মৃত্যু ও মৃত্যু হতে জন্মের গতি অনেকটা ঘাসের উপর ছিনে জোঁকের গতির মত। যাকে তৃণ জলৌকা গতি বলে। আবার অনেক জায়গায় একেপাদবিন্যাস অর্থাৎ পা ফেলে এগিয়ে যাওয়ার গতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আবার পুরাণে মৃত্যুকে স্বপ্নের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। স্বপ্নেও আমরা নবদেহ প্রাপ্ত হই। কখনও রাজা তো কখনও ফকির। কখনও দুঃস্বপ্নে বিপদে পড়ি তো কখনও সুখস্বপনে ভাসি।
স্বপ্ন শেষ হলেই সেই ক্ষণিকতণু মিলিয়ে যায়। প্রতিটা স্বপ্ন মানে আলাদা আলাদা দেহ, আলাদা আলাদা জন্ম। পার্থক্য হল এটাই যে স্বপ্নে পঞ্চভৌতিক দেহের বিনাশ হয় না। আর মৃত্যুতে পঞ্চভৌতিক দেহের বিনাশ হয়। যেটা অজর অমর অক্ষয় হয়ে থাকে সেটা হল আত্মা। আত্মার কোনও বিনাশ নাই।
তাহলে মৃত্যুর পর সঙ্গে যায় কী? শুধুই কি আত্মা? ভক্তিযোগ বলে, ‘নাম যাবে আর প্রাণ যাবে’; কর্মযোগ বলে, কর্মের বিনাশ ঘটলেই এই জন্মমৃত্যুর চক্রের সমাপ্তি ঘটে। এখানে আর-একটা তত্ত্বও আছে যা বিজ্ঞানের তত্ত্বকে হুবহু সমর্থন করে। যদিও মৃত্যুরহস্যের ব্যাপারে বিজ্ঞান এখনও শিশু। তার সহজপাঠটুকুও শেষ হয়নি।
এই তত্ত্ব বলে, মৃত্যুর পূর্বে যা মনের মধ্যে উদয় হবে আত্মার গতি তদ্রূপ হবে। অর্থাৎ আপনি যদি পাকা আমের দিকে তাকিয়ে সেটা খাওয়ার বাসনা রেখে মৃত্যুবরণ করেন তাহলে হয়তো আপনার পরবর্তী জন্ম হবে আমের পোকা হিসেবে। ডাইনিং টেবিলে খোসাছাড়ানো আমের টুকরো কাঁটাচামচ দিয়ে তুলে খাওয়ার সৌভাগ্য হবে না। ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধি ভবতি তাদৃশী।’ বিজ্ঞানও বলে, মৃত্যুর পূর্ববর্তী চিন্তা মস্তিষ্কে থেকে যাওয়ার কথা। এ নিয়ে হলিউডে একটা সিনেমাও হয়েছিল। একটা বিস্ফোরণ এড়ানোর জন্য ট্রেনের এক যাত্রীর মধ্যে ভবিষ্যৎ থেকে স্মৃতি পাঠানো হয়েছিল।
এই এতকিছু আলোচনার মাঝেও যেটা পেলাম না সেটা হল ভূতের রাজার সন্ধান। ভুল বললাম। আগেই সে সন্ধান পেয়েছি। যিনি পিতৃলোকের অধিপতি তিনিই তো পিতৃগণের রাজা। তাই যমকে এক অর্থে ভূতের রাজা বললে প্রমাদ হয় না। এই এতশত সমস্যা আর ঝামেলার মধ্যেও আমরা যে জিনিসটিকে এড়িয়ে যেতে চাই সেটা হল মৃত্যু। তাই মৃত্যুর গল্প আজ এই পর্যন্ত। শেষ মানেই তো শেষ নয়, তা শুরুর সূচনা। তাই মৃত্যুও জন্মের কারণ। সৃষ্টির দ্যোতক। শ্রীমদ্ভাগ্বত গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্ধৃতি নিয়ে বলা যায়— ‘জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।’
ভূত সম্পর্কে কত কিছু জানা হল! শাস্ত্রের আলোয় ভ্রমনের সুযোগ পাওয়া গেল। সিনেমাটা দেখা হয়েছিল আগেই। এই স্মৃতির সাথে ভূতের কোন সম্পর্ক থেকে থাকতে পারে। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
অসংখ্য ধন্যবাদ । 💐💐