অ রু ণ ক র
খবরের লিঙ্কটা পাঠিয়েছিল তৃষা। পরিবেশ রক্ষা এবং সামাজিক উদবর্তনে অভিনব উদ্যোগের জন্য সুন্দরবন লাগোয়া প্রত্যন্ত গ্রামের এক স্কুলশিক্ষকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার সংবাদ। ম্যানগ্রোভ বাঁচানোর পাশাপাশি ঘরে ঘরে স্বল্প খরচে সৌরবিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়ে তিনি ওই এলাকার প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রা আমূল বদলে দিয়েছেন।
প্রাপকের নামটা পড়ে চমকে উঠেছিল অনীশ। তূর্য বাইন! সুন্দরবন সংলগ্ন কোনও গ্রাম থেকে কলকাতার কুলীন কলেজে পড়তে এসেছিল সে।
ওই লিঙ্কটা পাঠাবার পেছনে তৃষার সূক্ষ্ম উদ্দেশ্যটা বুঝতে দেরি হয়নি অনীশের।
সম্প্রতি ফেসবুকের দৌলতে তৃষার সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হয়েছে অনীশের। ও এখন দিল্লি আইআইটিতে পড়ায়। ও-ই মাঝে মাঝে তূর্যর প্রসঙ্গ তুলত।
দেশে ফেরার দিন তিনেক পরে কিছুটা তৃষার অনুরোধে এবং কিছুটা ব্যক্তিগত কৌতূহলের বশে বেরিয়ে পড়েছিল অনীশ।
লোকাল ট্রেন হলেও তাতে যে এমন অমানুষিক ভিড় হতে পারে, কল্পনাও করতে পারেনি সে। তিনজনের বসার জায়গায় গাদাগাদি করে চারজন, আবার প্রতিটি গলির মধ্যে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে।
অনীশের রীতিমতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। অন্যান্য যাত্রীরা রাজনীতি, মূল্যবৃদ্ধি, গেঁড়ির উপকারিতা এমনকী ট্রাম্পের বিদেশ নীতি নিয়ে আলোচনায় মত্ত। ট্রেন কম্পার্টমেন্ট তো নয়, যেন চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া!
বারুইপুর আসবার পর সামনে বসা লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বসুন। অনীশ ভাবল, উনি বোধ হয় নেমে যাবেন। কিন্তু ভদ্রলোক নামলেন না, ওর সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। এর মধ্যেই একজন বসে থাকা যাত্রীর সঙ্গে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীর জোর ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। যিনি বসে আছেন, তিনি উঠবেন না, অথচ যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর দাবি উঠতেই হবে, এটাই নিয়ম!
পাশ থেকে অন্যান্য যাত্রীরা নানারকম মন্তব্য করে দু’জনকেই উৎসাহ দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, একদম উঠবেন না মশাই, পয়সা খরচ করে টিকিট কেটেছেন কি সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্যে?
আবার কেউ বলছেন, দেখছেন কী, কান ধরে টেনে তুলে দিন।
দু’একজন বলল, না উঠলে কোলে বসে পড়ুন। ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন হেঁকে উঠল, নারদ, নারদ, লাগ ভেলকি লাগ!
একসময়ে সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক সত্যি সত্যি সিটে বসা লোকটার কোলে বসে পড়লেন। ব্যাস, শুরু হল হাতাহাতি, ঠেলাঠেলি, অশ্রাব্য গালিগালাজ, দেখতে দেখতে পুরো কম্পার্টমেন্টটা যেন নরক হয়ে উঠল।
পাশের ভদ্রলোক পকেট হাতড়ে একটা বিড়ি কানের কাছে ধরে দু’আঙুলে মোচড় দিয়ে শব্দ শুনলেন। তারপর ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে ধরিয়ে আয়েস করে ধোঁয়া ছাড়লেন।
প্যাচপেচে গরম, ভিড়ের চাপে চিঁড়েচ্যাপটা মানুষের ঘামের দুর্গন্ধ, বিড়ির ধোঁয়া, সব মিলিয়ে অনীশের বমি হওয়ার উপক্রম। তবু একটু আগে সামান্য কারণে ঘটে যাওয়া ধুন্ধুমার দেখে প্রতিবাদ করতে সাহস হল না। নামখানায় নামতে নামতে জামা-প্যান্ট ঘামে ভিজে জবজবে, গলা শুকিয়ে কাঠ।
সামনের চায়ের দোকানে গ্রামটার নাম জিজ্ঞেস করতে ভদ্রলোক কাচের গেলাসে খট খট করে চামচ নাড়তে নাড়তে বললেন, সি তো লদী পেরিয়ে যেতি হবে। ওই ভ্যানে করে লদীর ঘাটে চলে যান। ওপার থে ফের ভ্যান পেয়ি যাবেন।
মোটরচালিত বেশ বড়সড় মাল বওয়া ভ্যান, কমপক্ষে জনাদশেক প্যাসেঞ্জার না হলে ছাড়বে না।
ভ্যানওয়ালা অমায়িক গলায় বলল, আপনি বরং এট্টু চা-জল খেয়ে ল্যান, প্যাসেঞ্জার হলি আপনারে ডেকে নোবো।
অনীশ দেখল, কথাটা ভদ্রলোক মন্দ বলেননি। ছোট্ট দোকান হলেও প্যাকেজড ড্রিঙ্কিং ওয়াটার থেকে থার্মোকলের বাক্সে বরফচাপা কোল্ড ড্রিঙ্ক, সবই পাওয়া যাচ্ছে।
এক নিশ্বাসে প্রায় আধ বোতল জল শেষ করে সবে চায়ে চুমুক দিয়েছে, এমন সময় ভ্যানওয়ালা ডাকল, বাবু আসেন, আজ আর হবে না মনে হচ্ছে। ছ’জন পেইচি, চলেন, যাই।
ইট বিছানো এবড়োখেবড়ো পথ এবং স্প্রিং বর্জিত মালবাহী ভ্যানের যৌথ সঙ্গতে শরীরের কলকব্জাগুলো যেন খুলে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল। তবু নদীর ঘাটে পৌঁছে অনীশের বেশ লাগল। বহুদিন সে এমন অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পায়নি।
ঘাট বরাবর সার সার মাছ ধরার ট্রলার দাঁড়িয়ে। পুরো এলাকাটা জুড়েই কেমন এক আঁশটে দুর্গন্ধ। দীর্ঘদিন ঠান্ডার দেশে থাকতে অভ্যস্ত অনীশ গলগল করে ঘামতে শুরু করল।
ভটভটিতে নদী পেরিয়ে ওপারে পৌঁছেই কিন্তু ও অবাক হয়ে গেল। টিকিট গুমটির সামনে স্বয়ং তূর্য দাঁড়িয়ে। রোদে পোড়া কালো চেহারা, একমুখ দাড়ি, ইস্তিরিহীন দোমড়ানো মোচড়ানো প্যান্ট, আধময়লা একটা শার্ট, কে বলবে, এই ছেলেটা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে স্ট্যান্ড করেছিল।
ওর গলদঘর্ম চেহারা দেখে হাসতে হাসতে তূর্য বলল, চটে গেছিস নিশ্চয়! এ লাইনে ট্রেনে খুব ভিড় হয়। এত কষ্ট করে এলি, এখানে আবার রিকশা চলে না, এখন ভ্যানে বসতে পারবি তো?
অনীশ বলল, তোর কি ধারণা, স্টেশান থেকে নদী পর্যন্ত আমার জন্যে হেলিকপ্টার ছিল?
তূর্য মৃদু হাসল। বলল, স্বাচ্ছন্দ্যে থাকলে মানুষের অসুবিধার বোধগুলো তীক্ষ্ণ হয়। সে সব উপেক্ষা করে তোর এই হুট করে চলে আসাতে আমি কিন্তু খুব অবাক হয়েছি।
—খুশি হোসনি?
—কে জানে! হয়তো হয়েছি।
গ্রামে পৌঁছে বড় ভাল লাগল অনীশের। পথে যার সঙ্গে দেখা হয়, সে-ই হাত তুলে তূর্যকে নমস্কার করে। একজন মানুষ যে সকলের কাছে এতটা শ্রদ্ধার্হ হয়ে উঠতে পারে, তা এখানে না এলে হয়তো জানাই হত না।
কাঠা দশেক জমির মধ্যে ব্যারাকের মতো দু’সারি বারান্দাওয়ালা ঘর। পলেস্তারাহীন ইটের গাঁথনি, টালির চাল, তার ওপর সার সার সোলার প্লেট। তবে কনভেনশনাল প্লেটের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
একপাশে একটা ছোট ডোবা। সেটার মধ্যে হুটোপাটি করে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে চান করার নামে একে অপরের গায়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করছিল। তূর্যকে আসতে দেখেই সবগুলো জল থেকে উঠে দুদ্দাড় দৌড় লাগাল। কচিকাঁচাগুলোর কাদা মাখা চেহারা বেশ দেখবার মতো বটে।
তূর্য হাসতে হাসতে বলল, এই আমার আশ্রম। একটু জিরিয়ে নিবি, নাকি আমার স্কুলটা দেখে আসবি? আজ অবশ্য রোববার, স্কুল বন্ধ।
অনীশ এমনিতেই সাংঘাতিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বলল, মাথায় থাক বাবা তোর স্কুল। ঘরে ফ্যান আছে তো?
দুপুরে খাওয়ার সময় দেখল, উলটো দিকের বারান্দায় সেই বাচ্চাগুলো সার দিয়ে খেতে বসেছে। অতি সাধারণ আটপৌরে চেহারার একজন মাঝবয়েসি মহিলা, ওদের খেতে দিচ্ছেন।
তূর্য হাসতে হাসতে বলল, ওগুলো আমার ছেলেমেয়ে।
খাওয়া থামিয়ে হাঁ করে তূর্যর দিকে তাকাল অনীশ। বলল, মানে? তুই বিয়ে করলি কবে? আর এই বাজারে এতগুলো বাচ্চাই বা হল কী করে? এ তো একপ্রকার সোস্যাল ক্রাইম!
তূর্য হাসতে হাসতে বলল, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? তা ছাড়া বাপ হতে গেলে বিয়ে করতে হবে, এমন শর্ত কোথায় লেখা আছে? আমি ওগুলোকে পুষ্যি নিয়েছি!
—পুষ্যি নিয়েছিস মানে?
—ওই শহুরে ভাষায় তোরা যাকে বলিস দত্তক নেওয়া, অনেকটা তেমনই। ওদের কারও বাপ গেছে বাঘের পেটে, কারও মাকে নিয়ে গেছে কুমিরে। আবার কোনওটার বাপ-মা কেউই নেই। আমি ওদের বেঁচে থাকবার জন্যে লড়তে শেখাই। আর ওই যে মহিলাকে দেখছিস, ওঁর স্বামী এবং জোয়ান ছেলে, দু’জনে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার সমেত নিখোঁজ। কেউ বলে সাগরে তলিয়ে গেছে, আবার কেউ বলে বাংলাদেশি জলদস্যুরা মেরে ফেলেছে। উনিই বাচ্চাদের দেখভাল করেন। কী হল? হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন, খা! জানি, এই প্রোলেতারিয়েত খাবারে তোর খুব অসুবিধে হচ্ছে!
অনীশ খোঁচাটা গায়ে মাখল না। মোটা চালের ভাত, ডাল আর ছোট মাছের ঝাল, খুব তৃপ্তি করে খেল।
সারাটা দুপুর অনীশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তূর্যর কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিল।
কথায় কথায় সাধারণ মানুষের জন্যে সরকারি উদ্যোগের কথা তুলতে গম্ভীর হয়ে গেল তূর্য। কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে বলল, আমি দেখেছি, সব রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় এলে কিছু দানখয়রাতি করে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়। অবশ্য দু’টাকা বরাদ্দ হলে মাঝপথে দেড় টাকা চুরি হয়ে যায়। পার্টির লোকরাই বেশিটা মেরে দেয়, সঙ্গে সরকারি মেসিনারির তেল-মোবিলেও কিছুটা যায়। সরকার সব জেনেও এটা হতে দেয়। কারণ ভোট এলে ওরাই মারপিট করে, বুথ জ্যাম করে, ভয় দেখিয়ে এমনকী খুনখারাবি করে জেতার পথটা মসৃণ করে তোলে। মানুষ যদি শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হয়ে ওঠে, তাহলেই ওদের বিপদ।
অনীশ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুই রাজনীতি করিস না বলছিস, অথচ তোর মুখে তো রাজনীতির ফুলঝুরি!
তূর্য একটুও রাগল না। খুব নির্লিপ্ত গলায় বলল, রাজনীতি নয়, আমি আমার মতো করে গ্রামের গরিবগুর্বো মানুষগুলোকে বোঝাতে চেষ্টা করি, দানখয়রাতি নেওয়া আসলে একধরনের ভিক্ষাবৃত্তি। অন্যের সাহায্য ছাড়া তারা যাতে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, আমি শুধু সেই চেষ্টাটুকু করে চলেছি।
অনীশ হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে বলল, আচ্ছা, তৃষার ব্যাপারে কি কিছু ভেবেছিস? একটা মেয়ে আর কতদিন অপেক্ষা করবে?
—তুই কি ওর কথা বলবি বলেই এসেছিস?
—না, ঠিক তা নয়। আজকের দিনে এমন ভালবাসা—
হঠাৎ তূর্য হো হো করে হেসে উঠল। তারপর শ্লেষ মেশানো গলায় বলল, ভালবাসা? ভালবাসার তোরা কী বুঝিস?
অনীশ অপ্রস্তুত হয়ে চুপ করে রইল। তারপর বলল, এতদিন ও তোর জন্যে অপেক্ষা করে আছে, এটাও তো তুচ্ছ নয়।
তূর্য অধৈর্য গলায় বলল, কে বলল, তুচ্ছ? কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, আমরা প্রত্যেকেই নিজের শর্তে বাঁচতে চাই। এর অন্যথা হলে নানা দুর্বিপাক নেমে আসে। এই যেমন ধর, আমি একবার দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে এক রকমের ফুলের গাছ দেখে খুব ভাল লেগেছিল। অনেকটা গোলাপের মতো গাঢ় খয়েরি রঙের অজস্র ফুল যেন গাছটাকে আলো করে রেখেছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওটার নাম অ্যাজিলিয়া। সহজেই নার্সারিতে চারাও পেয়ে গেলাম। কিন্তু এখানকার এই নোনা জল-হাওয়ায় ফুল ফোটা দূরে থাক, মাস তিনেকের মধ্যেই গাছটা মরে গেল।
অনীশ সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু তৃষার কী হবে?
তূর্য কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে নির্বাক বসে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, তৃষা জানে, এই জীবন ছেড়ে আমি কখনও বেরতে পারব না। ওর পক্ষেও চাকরিবাকরি সহ আশৈশব যাপিত স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে এখানে থেকে যাওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়ে যে ভালবাসার কথা বলার জন্যে তোর দৌত্য অভিযান, তার ছিটেফোঁটাও যদি সত্যি হয়, সেটাকে আলগোছে আগলে রাখাই শ্রেয়। আমি চাই না, সেই মহার্ঘ ভালবাসাটুকু এখানকার এই লোনা জলের কাঠিন্যে সেই দার্জিলিং থেকে বয়ে আনা অ্যাজিলিয়ার মতো শুকিয়ে শেষ হয়ে যাক।
অনীশ খুব অবাক হয়ে বলল, কী বলছিস তুই? সে যদি মানিয়ে নিতে পারে, তোর অসুবিধে কোথায়?
তূর্য কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, আমি নিজেকে চিনি অনীশ। তৃষাকেও চিনি, তবে সেটা আমার মতো করে। কিন্তু কী করে তোদের বোঝাই, ভালবাসা বলতে তোরা যেটা মিন করিস, সেটা আমার কল্পনার সঙ্গে মেলে না।
অনীশ অবাক হয়ে বলল, তোর কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না, তৃষা তোকে ভালবাসে, তুইও যতদূর জানি তৃষাকে—
—ভুল, ভুল। ভালবাসা বলতে আমি যেটা বুঝি, তা তোকে বোঝানো শক্ত। তুই কি আজ থেকে যেতে পারবি? আমার এক জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল। ভালবাসার কথা যখন তুললি, তোকে একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে লোভ হচ্ছে। অনেকটা পথ, হাঁটতে পারবি তো?
ওর বলার মধ্যে এমন এক হেঁয়ালি ছিল যে অনীশ না বলতে পারল না।
পড়ন্ত বিকেলে বাঁধের ওপর দিয়ে ওরা দুজনে হাঁটা শুরু করল। এবড়োখেবড়ো পথ, মাঝে মাঝে বড় বড় গর্ত, নদীর অপর পাড়ের ঠাস বুনট বাদাবনে ধীরে ধীরে সন্ধে নামছিল।
যেতে যেতে তূর্য দেখাচ্ছিল, মানুষের অত্যাচারে সাফ হয়ে যাওয়া জায়গায় কীভাবে নতুন করে বনসৃজন এবং রক্ষণাবেক্ষণ চলছে।
ঘণ্টা দু’য়েক হেঁটে ফিনকি দেওয়া জ্যোৎস্নাবৃত একটা ছোট্ট গ্রামে পৌঁছল ওরা। বাঁধ লাগোয়া কয়েকটা মাত্র কুঁড়েঘর, মাটির দেয়াল, খড়ের ছাউনি, উঠোনে লম্বা বাঁশের ভারায় শুকোতে দেওয়া সার সার মাছ ধরার জাল।
একটা ঘরের সামনে গিয়ে তূর্য ডাকল, মামি আছ নাকি?
ওর ডাক শুনে অস্থিচর্মসার এক প্রৌঢ়া বেরিয়ে এলেন। মাথায় শনের নুড়ির মতো রুক্ষ চুল। তূর্যকে দেখে কোটরাগত চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ঘরের ভেতর থেকে গোঙানির মতো একটা আওয়াজ আসছিল।
ভদ্রমহিলা বললেন, দেখ না, একটুখানিও ছেড়ে আসবার জো নেই। কাছে না থাকলি ও’রম করে ডাকতি থাকে।
কুঞ্চিত মুখে অবোধ শিশুর আবদারে প্রশ্রয় দেওয়ার মমতা।
তূর্য অনীশের হাত ধরে ঘরে ঢুকল। মুহূর্তে প্রচণ্ড এক দুর্গন্ধ অনীশের নাকে ঝাপটা মারল।
টিমটিমে কেরোসিনের লম্ফ জ্বলছিল ঘরে। অস্পষ্ট আলোয় অনীশ দেখল, কাঁথা-কাপড়ের পুঁটুলির মধ্যে একজন কঙ্কালসার মানুষ শুয়ে আছে। তার ঠোঁট এবং মুখের বেশিরভাগ মাংস খসে গেছে। ফলে মাড়ি পর্যন্ত দাঁতের সারি বেরিয়ে পড়েছে।
পুঁজ-রক্তের পচা দুর্গন্ধে নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল।
মৃতপ্রায় শরীরটা মানুষের সাড়া পেয়ে যেন একটু নড়ে উঠল।
প্রৌঢ়া দ্রুত ঘরে ঢুকে তার মাথাটা পরমযত্নে কোলে তুলে নিলেন। তারপর গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অবোধ শিশুকে ভোলানোর মতো স্নেহসিক্ত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ভয় কী? এই তো আমি। কষ্ট হচ্ছে? জল খাবা?
অনীশ আর সহ্য করতে পারল না। লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এক ছুটে বাঁধের ওপর গিয়ে দাঁড়াল। ত্রয়োদশীর চাঁদের আলোয় গা ডুবিয়ে হড়হড় করে বমি করতে করতে ভাবল, তৃষাকে একবার এই ভালবাসার সমুদ্রটা দেখাতে পারলে বেশ হত।