Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ভচুবাবু আর পিসেমশাইয়ের চ্যালারা

গাড়িটা মাঝরাস্তায় খারাপ হয়ে পড়তেই ভচুবাবু বেশ দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একে তো দিনের আলো প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, তারপর এই জায়াগাটা তার কাছে একেবারেই অচেনা। এসব ছাড়া ভচুবাবুর আরও একটা উপসর্গ আছে আর সেটা হল সামান্য বিষয়েই তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ভচুবাবুর বুড়ি ঠাকুমা বলতেন, আমাদের ভচুর জন্মই হল উদ্বিগ্নলগ্নে!

গাড়িটা অনেকক্ষণ ধরেই ঘটরমটর করছিল। ভচুবাবু ভেবেছিলেন রাস্তার মধ্যে কোথাও একটা মেরামতির দোকান পেলেই গাড়িটা দেখিয়ে নেবেন কিন্তু, এতটা রাস্তা তিনি পার হয়ে এলেন বটে অথচ, একটাও গাড়ি সারানোর গ্যারেজ এখনও পর্যন্ত তার নজরে পড়েনি। শেষমেশ প্রায় সন্ধ্যার মুখে এরকম একটা অপরিচিত আধা-মফস্বলি জায়গায় পৌঁছে ঘ্রং-ঘ্রাং শব্দ করে গাড়িটা শেষপর্যন্ত ফাইনালি জবাব দিয়ে দিল! ভচুবাবু অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু গাড়িটা আর টু-শব্দটিও কাড়ল না! অবশেষে, সেটাকে রাস্তার একধারে স্ট্যান্ড করে রেখে দীর্ঘদেহী ভচুবাবু প্রথমে নিজের শরীরটা নেড়েচেড়ে নিয়ে একটু ওয়ার্মআপ করলেন। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে জায়গাটা ভাল করে ওয়াচ করতে লাগলেন।

ভচুবাবু দেখলেন রাস্তার ওপারে একটা চা-পান-সিগারেটের দোকানে এরমধ্যেই ডুম-লাইট জ্বেলে দিয়েছে তার মালিক আর দোকানঘরটার সংলগ্ন একটা ঝুপসিপারা খড়ের চালার নিচে বাঁশের বাঁখাড়ি দিয়ে তৈরি মাচায় বসে বেশ কয়েকজন লোক জমিয়ে গুলতানি মারছে। যদিও, আশেপাশে আরও কয়েকটা চালা বা গুমটি দোকান আছে, তবুও ভচুবাবু ধীরে ধীরে রাস্তার ওপারের দোকানটার দিকেই এগিয়ে গেলেন। তারপর নিচু হয়ে চালার ভিতরে গিয়ে ঢুকে পড়লেন।

গুলতানি মারা লোকগুলো এতক্ষণে গজল্লা থামিয়ে নিজেদের মধ্যে একটু জড়োসড়ো হয়ে বসে ভচুবাবুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল! বোধহয়, একে তো লোকটাকে এই অঞ্চলে তারা কোনওদিন দেখেনি তারপর আবার, পাহাড়ের মতন তার চেহারা! লোকগুলো কোনও কথা না বলে নিরীক্ষণের ভঙ্গিতে ভচুবাবুকে দেখতে লাগল। প্রয়োজনটা তারই তাই, ভচুবাবু প্রথম মুখ খুললেন। তিনি লোকগুলোকে উদ্দেশ করে জিজ্ঞেস করলেন, আ-আচ্ছা, এখানে আশেপাশে কো-কোথাও গাড়ি সারানোর গ্যা-গ্যা-গ্যারেজ আছে?

ভচুবাবুর এই আর-এক সমস্যা। একটু উত্তেজিত হলে বা, ঘাবড়ে গেলেই তিনি তোতলাতে শুরু করেন।

লোকগুলো চোখ পিটপিট করে এতক্ষণ ধরে ওকেই আপাদমস্তক দেখছিল। এরপর তাদের মধ্যেই একজন বলে উঠল, আজ্ঞে, লেচ্চই আছে। তবে, কিলোমিটারখানেক যেতে হবেক। সেই দশরথপুরার মোড়ে।

লোকটা থামতে না থামতেই, দ্বিতীয় লোকটা বলল, উঁহু, উটি মোটেই দশরথপুরার মোড় লয়, উটি লিশ্চিন্তিপুর বাজার। আর, রাস্তা পেরাই দেড় কিলোমিটার তো হবেকই।

এবার তৃতীয় লোকটা বলল, না আঁইজ্ঞা। উটি দসরথপুরা কি, লিসচিন্তপুর সে বিসোই লিয়ে যথেষ্ট তক্ক আছেক। উটি আসোলে মাঝের মোড়। পিচে গেলে পাক্কা সোয়া-এক কিলোমিটার আর বাড়িই বাড়িই গেলে কিলোমিটারখানেক হবেক।

শেষকালে তিনজনের মধ্যে একটা ঝগড়া বেঁধে গেল এবং পাশে বসে থাকা অন্যান্য লোকগুলো ওদের এক-একজনের পক্ষ নিয়ে তাল দিতে শুরু করল। অবশেষে, যা আরম্ভ হল সেটাকে শুঁড়ির দোকানের হট্টমেলা বললেও বোধহয় কম বলা হবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটার কোনও সুরাহা হল না দেখে ভচুবাবু লম্বা-লম্বা পা ফেলে সটান দোকানির গুমটিঘরটার সামনে গিয়ে হাজির হলেন। দেখলেন, খেটো ধুতি পরা একটা টাক মাথার সিড়িঙ্গে মতন লোক দোকানের টাটে বসে তালপাখায় হাওয়া খেতে-খেতে নিবিষ্ট মনে তার দিকেই তাকিয়ে আছে আর লোকটার পাশেই তক্তার উপরে বসে একটা আট-দশ বছরের ছেলে খিনখিনে গলায় একনাগাড়ে চিৎকার করেই চলেছে, একে চন্ডো, দুই-এ পঙখো… যদিও, মাঝেমধ্যেই কোনও চায়ের খদ্দের এসে হাঁক পাড়লে সে যেন হাওয়ায় একটা ডিগবাজি খেয়ে তক্তা থেকে নেমে এসে মুহূর্তের মধ্যে খদ্দেরকে চা ছেঁকে দিয়েই আবারও দোকানির পাশটিতে বসে চেল্লাতে শুরু করছে, দশে দিঙ…

লোকটা দেখতে ওরকম বিতিকিচ্ছিরি হলে কী হবে, গলাটি তার বেজায় মোলায়েম! সে বেশ কেতা করেই ভচুবাবুকে জিগ্যেস করল, বাবুর কুথা থেকে আসা হচ্চে বটে?

ভচুবাবু বললেন, আঁজ্ঞে, বিষ্টুপুর থেকে।

Advertisement

লোকটা আবার জিগ্যেস করল, তা যাবেন কুথা?

ভচুবাবু বললেন, আঁজ্ঞে, হোঁদলনারানপুর। সেখানকার জমিদার ঁপীতাম্বর রায়চৌধুরী আমার পিসেমশায়!

ব্যস! ভচুবাবু কথাটা বলার সঙ্গে-সঙ্গেই, দোকানের ছাউনির নিচে বসে থাকা লোকগুলোর সমস্ত গজল্লা মুহূর্তের মধ্যে থেমে গেল। এমনকী, আশেপাশে, দূরদূরান্তেও আর কোনও তর্কবিতর্কই শোনা গেল না, তার বদলে কারা যেন ডিজে-বক্স বাজিয়ে দোকানটার সামনে হাজির হয়ে উদ্দাম নাচতে শুরু করে দিল! গুমটির ভিতর থেকে ব্যস্ত-সমস্তভাবে বেরিয়ে এসে সেই সিড়িঙ্গে মতন লোকটা নিজের হাতে বাঁশের মাচাখানা ঝেড়েঝুড়ে ভচুবাবুকে তাতে স্বযত্নে বসিয়ে হাঁক পারলেন, ওরে পুঁটলি, শিগগিরি বাবুর লেগে ইস্পেশাল চা আর সিঙ্গারা নে-আয়।

ভচুবাবু দেখলেন, সেই তিনটে লোক একেবারে হা-হা করে উঠে এসে তার পায়ে ঢিপঢিপ করে প্রণাম ঠুকে প্রায় আধহাতখানেক জিভ বের করে নিজেদের কানটান মলে বলল, দ্যাকেন দিকি, কী নজ্জার কতা! আপনি যে আমাদের কত্তাবাবুর কুটুমবাড়ির পরম-আত্মীয় নোক তা যেদি আগুই বলত্যান! তারপর, ওদের মধ্যেই একটা লোক ঠাকুরের প্রসাদ নেওয়ার মত করে দু-হাত বাড়িয়ে বলল, আপনার গাড়ির চাবিখান দ্যান ছ্যার, ওটা আমরাই ছাইরে নে আসচি!

তারপর,একজন গাড়ির হ্যান্ডেল ধরল আর অন্য-দুজন ‘মার ঠ্যালা হেইও-হেইও!’ বলে গাড়িটা পিছন থেকে ঠেলতে শুরু করলো। ভচুবাবু দেখলেন, তার চোখের সামনেই তিন-তিনটে লোক যেন হঠাৎই হাওয়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন!

ঘণ্টা-দেড়েক পর প্রায় হাওয়ায় উড়তে-উড়তে এসে হোঁদলনারানপুরে পৌঁছেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মোটরসাইকেলটা একদিকে আর ভচুবাবু ছিটকে পড়লেন তার পিসেমশাইয়ের দালানবাড়ির বারান্দায়! চিৎকার-চেচামেচি, দালান-কোঠা ভেঙে পড়ার আওয়াজ, সঙ্গে হিঁ-হিঁ-খিঁ-খিঁ-খোঁ-খোঁ অদ্ভুত সব শব্দ শুনে পিসিমা, তার নেওটা পুষি কাদু, গয়লা বউ, চিঁড়া-মাসি আর চাকর খাণ্ডবলাল সবাই একেবারে হাউমাউ করে দৌড়ে এল।

ভচুবাবুর যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলেন, পিসিমা তার মাথাটি কোলে নিয়ে বসে আছেন। গয়লা বউ চোখেমুখে জল ছিটিয়ে-ছিটিয়ে তার সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিয়েছে। ভচুবাবু চোখ মেলতেই পিসিমা ফোকলামুখে হেসে বললেন, ‘অবস্থা-গতিক দেখেই বুঝতে পেরেছি তোর পিসের চ্যালারা সব তোকে পৌঁছে দে গেছে!’

কথাগুলো বলে কি বলেই সব্বাই হা-হা-হি-হি করে হাসতে শুরু করে দিল। এমনকী, পিসিমার বেড়াল কাদুও!

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven + four =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »