Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সুজিত বসুর কবিতাগুচ্ছ

ছাপিয়ে নিস্বনে তবু

স্টিরিওতে বেজে যায় ডোনা সামারের গলা আর্ত শীৎকারে
বারান্দার অন্য প্রান্তে বনি এম, জ্বরদগ্ধা কুমারী বিলাপে
আশ্লেষ ঘনত্ব ভাব, পাভলভস্কায়া স্ট্রিটে কেমন বিজয়ে
মত্ত মাতালের গলা, জড়িত স্খলিত কারো পদক্ষেপে কাঁপে
মদালসা করিডর, স্বর্ণকেশী রাজকন্যা শরীরের ভারে
বসেছে ছুরিকা হয়ে, মে দিবসে আমি বুঝি বারাঙ্গনালয়ে
বসে আছি ঝিমধরা, রাস্তার পতাকা থেকে রক্তিম আবির
ঝরে পড়ে দুর্নিবার, ও শুধু আবির বুঝি, ও কিছু রক্তের
রাখেনি তো প্রতিচ্ছবি, উনিশশো সতেরো সালে শীতপ্রাসাদের
দুয়ারেই রেখেছিল অগ্নির স্ফুলিঙ্গ জ্যোতি, এখন পশ্চিমী
নৃত্যের গুঞ্জন ধ্বনি, পশ্চিমবঙ্গের বুকে যন্ত্রের দানব
ওয়ালজের সুরে সুরে নেচে যাবে মায়াময়, নিঃস্ব এ শরীর
ছাপিয়ে নিস্বনে তবু ঝরে কেন রক্ত স্রোত, অকর্ষিত ভূমি
কেন থাকো প্রতিবিম্বে মায়াবী দর্পণে এই, স্টিরিওর নব্
ঘোরালে বাজে না কেন বজ্রনাদে শঙ্খরব কাস্ত্র হাতুড়ি!

*

চানের ঘরে কালকেউটে

চানের ঘরে যেই গিয়েছি লাফিয়ে ওঠে কালকেউটে
বাষ্পে ধূমে প্রায়ান্ধকার ঘরের মধ্যে সাপের ফণায়
ফেনিয়ে ওঠে নীলচে দ্যুতি, সাবান সাবান ফেনায় জলে
লেপটে আছে শরীর জুড়ে, চাঁদ সদাগর লোহার ঘরে
ছিদ্র কেটে শাপশাপান্ত, অ্যাদ্দিন তো দিব্বি ছিলে
পাষাণ হয়ে রন্ধ্রভারে, হঠাৎ কেন আজকে উঠে
মুষল হয়ে অস্থি ভাঙো, স্বস্তিটুকু, ঘনায় ঘনায়
নিকষ অমাবস্যা কালো, নরক বা বেহেশতে
প্রথম পদচ্ছায়া আমার, অচেনা অঞ্চলে
বুক কাঁপানে মূর্তি ছায়া, আমায় ঘিরে লৌহকঠিন স্বরে
সাপের এমন ফুঁসিয়ে ওঠা, আমার কাছে ঘেঁষতে
কি শাপ তোমায় সাহস দিল, ক্ষিপ্ত প্রতিমূর্তি
শরীর জুড়ে বিষিয়ে ওঠে, অন্ধ কারাকক্ষে
রাখব না আর বন্দি করে, তোমায় আমি মুক্তি
দেবই দেব সত্যি দেব শানবাঁধানো মেঝেয় এবার
আর পারি না আর পারি না, বিষের নীলে গ্রন্থি গলা
জ্বলতে জ্বলতে নীলকণ্ঠ, তুমিও জানো অলি
মুষল হাতে এই নিয়েছি, প্রমত্ত এই চাপে
যাক ভেঙে যাক শক্ত তালা, গলার সরু নলি বেয়ে
সাপ চলে যাও, সাপ চলে যাও সুজিতটাকে সঙ্গে নিয়ে
শরীর থেকে যেই বেরোল অলি জানো শরীর অবশ
পক্ষাঘাতে আজ নিপাতে প্রাচীন মহাপাপে
তোমার জন্য জমিয়ে রাখা নৈবেদ্য ভালবাসার
রূপান্তরে অশ্রু ভরা বিনষ্ট অঞ্জলি।

*

রোম নগরী তোমায় চিনি

মনের মধ্যে জড়িয়ে আছে, মনের মধ্যে তিন কুলুপে
রঙিন রোমান চাবি দিয়ে শক্ত করে নিপুণ চাপে
কোন জাদুকর রাখলে এমন বন্দি করে ভোমরাটিকে
রোম থেকে তাই ফ্লোরেন্স যেতে চিকনকালো সূক্ষ্ম পাপে
তলায় শ্যামল নৌকোখানি, নিঝুম রাতে একটু চুপে
ফিসফিসোনো বিষের ধোঁয়া, এমনতর সর্পিলতা
আমার জন্যে রোম নগরী, আমার জন্যে শ্বেত মদিরা
পাত্র ঠোঁটে ঠেকিয়ে রাখো, চুলের কালো মৌচাকে আর
চিরুনি সোনা কাঁকড়া দাঁড়া, কখনো কেউ তোমরা ফিকে
নীলচে রঙের পরদা দেখো, তোমরা নাকি রোমান নারী
অশ্বক্ষুরে শহর দাপাও, এমনধারা আজব কথা
কে বিশ্বাস করবে এমন কে আর আছে তপস্বিনী
ট্রেনের কাচে আধঝলকে তরল ধাতুর তীক্ষ্ণ ব্রীড়া
ফোটাও যত উন্মাদিনী, অস্ত্রখানি তার বুকে যার
তির বেঁধানো জন্ম, মায়ার রোম নগরী তোমায় চিনি।

*

ভেনিসে প্রতীক্ষাঘরে

নিশুতি নিঝঝুম ঝুম, অন্ধকার ঘর ভরে অজস্র কুহেলি
ভেনিসে প্রতীক্ষাঘরে ঝুমঝুম ঘুমঘুম, মায়াবী আঁধারে
দুচোখে বিঁধেছে তির, এ কার প্রতীক্ষা বলো ধূধূ জলধারে
মরীচিকা ঝিকমিক, জ্যোৎস্নাময় কুয়াশায় অপরূপ খেলি
কেবল নিজের সঙ্গে, এ খেলার গোলঘরে রুমালচুরির
বৃত্ত ঘুরে চলাফেরা, ভিয়েনার ট্রেন এসে সরল ঋজুতা
দেখাবে বাঁকানো তার বাজপাখি ঠোঁট দিয়ে, সে তার কিছুটা
মুখাগ্র আড়ালে রাখে, ঝমঝম ঝমঝম বর্ষা মেঘ তীর
সহসা ফুটেছে চোখে কৃষ্ণসার অন্ধকারে, গোধূলি গোধূলি
ভেনিস স্টেশন জুড়ে, ফিকে নীল পুরু পরদা দোলনা ঝুলনে
ঝুলেছে নিঃসাড় চুপ, এ রাসপূর্ণিমা এই বৃন্দাবন ধূলি
মেখেছ বৈষ্ণব গায়ে, তারই ঝড় বৃষ্টিধারা ভেনিস স্টেশনে
শরীরে তোমার ঝরে কুয়াশার বর্শা হয়ে, ভিয়েনার ট্রেন
এ থেকে কতটা মুক্তি দিতে পারে, চারিদিকে সমুদ্র সফেন।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
2 years ago

অসাধারণ অসাধারণ। শব্দচয়ন আর ছন্দের শরীর নিয়ে এমন ভাঙাগড়া এসময় খুব কম চোখে পড়ে। কবি আর কবিতা কোনো কালের গন্ডিতে বাঁধা থাকেনা; মননে নিগড় বাঁধে না কোনো ভূগোলের শক্ত সীমানা। এসব লেখায় সেসব বেশ বোঝা যায়। একমাত্র এক শক্তিশালী কবিই পারেন পঞ্চাশ বছর প্রায় নাড়া দেবার মতো রচনার মধ্যে নিজেকে উজাড় করতে। সুজিত বসু আদ্যান্ত কবিতা, তাঁর কবিতা কখনো ফুরানোর নয়। অভিনন্দন কবিকে। ভালভাষাকে ধন্যবাদ, তাঁরা কবিকে পৌঁছে দিচ্ছেন অনুরাগী ও মনোযোগী পাঠকের কাছে

J.Ghosh
J.Ghosh
2 years ago

খুব ভাল লাগল। সুজিত বসুর কবিতা আগে পড়িনি। কবি সম্পর্কে আগ্ৰহ জাগল।

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »