বহুদিন আগে থেকেই ওকে আমি রাস্তায় ঘাটে, বাজারে, শপিং মলে দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রথমে আকৃষ্ট হয়েছিলাম ওর রূপে। তারপর আমার সঙ্গে সাদৃশ্যে। যেন আমার যমজ বোন। আমারই মত দেখতে কারও সঙ্গে হরদম দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে শুনে রোশনাই হেসে কুটি কুটি, ‘মা, তোমার স্প্লিট পার্সোনালিটি কেস। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও।’
ইদানীং মেয়েটাকে অফিস যাতায়াতের পথে দেখি। মেয়ে না বলে মহিলা বলাই ভাল। খবরের কাগজ আজকাল বৃদ্ধা না লিখে প্রৌঢ়া লেখে। আমার মতই বছর পঞ্চাশেক বয়স। আমার মতই ছোট চুল, চোখে চশমা, কথা বলতে গেলেই গালে গভীর টোল পড়ে। নিখুঁত দাঁতের সেটিং, হাসলে ভারী সুন্দর দেখায়, এক লহমায় ওর বয়স কমে যায় যেন পনেরো বছর। সত্যি কথা বলতে কী, বয়সটাকে ও যেন ওই রকমই জায়গাতেই বেঁধে রেখেছে। এই বয়সে এসে আমি যেমন হয়েছি, সেইরকম চোখের কোলে গাঢ় কালি নেই, কাঁধদুটো সামনে অসহায় ঝুলে পড়ে কুঁজো করে দেয়নি, মোটা হয়ে যাওয়া সিঁথির দুপাশে বিস্তৃত টাকের অনিবার্যতা নেই। একটা ঝলমলে ভাব সবসময় ওকে আলতো জড়িয়ে ধরে থাকে। তার সঙ্গে একটা সমীহ জাগানো গাম্ভীর্য, মর্যাদাবোধের ছোঁয়া। মারাত্মক কম্বিনেশন, আমারই ওকে দেখলে মনটা ভাল হয়ে যায়, কিন্তু কাছে ঘেঁষার সাহস পাই না। এই এসি বাসটা ভর্তি বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে, কেউ ইউনিভার্সিটিতে যায়, কেউ কাজে, ও উঠলে তারা সবাই মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওকে দেখে, আমি লক্ষ করেছি। কন্ডাকটার টিকিট কাটতে এসে খুচরো নিয়ে কোনও আপত্তিই তোলে না। ওর পাশে যে বসে সে সসম্ভ্রমে সিঁটকে এক ঠায় বসে থাকে। যেন কোনওভাবেই ওকে বিরক্ত না করা হয়।
ভদ্রমহিলা নামে আমার গন্তব্যেই। সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপর। নিজের ছায়া দেখতে পাই না, কিন্তু ওকে দেখতে পাই, আমার সামনে অল্প হিল তোলা জুতো পরে সোজা হেঁটে যাচ্ছে শরীরের ঢেউগুলো ভাঙতে ভাঙতে। আমার অফিসে তো একটু দেরি করে এলেও চলে। ওরও কি তাই? যাদবপুর কফি হাউস অব্দি একসঙ্গে আগুপিছু যাই আমরা, তারপরই ও যেন কোথায় উবে যায়। অনেকদিন তক্কে তক্কে থেকেছি কোন গলিতে ঢোকে দেখব, কিন্তু পারিনি। হাঁটুর ব্যথা আমাকে খুব ভোগায়। জোরে হাঁটতেই পারি না।
আবার আমার ফেরার সময় হলে সেই কফি হাউসের সামনেই কোনখান থেকে যে ও হঠাৎ উদয় হয়, কে জানে। খুব ইচ্ছে হয় একসঙ্গে গল্প করতে করতে বাসস্ট্যান্ড অব্দি ফিরি, একই সিটে পাশাপাশি বসে সারা রাস্তা অনেক কথা বলি। আমার এই শনির দশা সত্ত্বেও ওর সঙ্গে আমার চেহারার এত মিল, হয়তো লতায়-পাতায় আত্মীয়তা বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইচ্ছে হলে কী হবে, ওর ওই অসম্ভব ব্যক্তিত্ব আর মোহন রূপের কারণে বেশি কাছে ঘেঁষার সাহস পাই না। যদি পাত্তা না দেয়। শত হলেও, আমি তো একটা ক্ষয়াটে বুড়ি, থুড়ি প্রৌঢ়া মাত্র, যে সারা জীবন মানিয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে টবের কেঁচো হয়ে গেছে।
একদিন উল্টোদিক থেকে দেখলাম ইউনিভারসিটির দিকের ফুটপাতে ও হেঁটে যাচ্ছে। পরনে একটা আবছা হলুদ শাড়ি, কালো সবুজ সুতোর কাজ করা চওড়া পাড়। চেহারাটা দোকানগুলোর আড়ালে চলে যাচ্ছে, আবার নজরে আসছে, উঁচু গ্রীবায় সূর্যাস্তের মৃদু আলো লেগে আছে, চুল উড়ছে বাতাসে, কালো ব্যাগটা দু-একবার হাতবদল হল, খুব অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে, যেমন আমারও অভ্যেস। বয়স যে স্থূলতা দেয়, ওর শরীরকে তা অপূর্ব ভরন্ত করে তুলেছে। একবার দেখলেই মনে রাখার মত মানুষ।
তাই সেদিন ও আমার পাশের সিটে বসে অন্যমনস্কভাবে যখন বলল, ‘আপনাকে কেন যেন আমার খুব চেনা লাগে’, তখন আমি এত অভিভূত হয়ে পড়লাম যে এক গাল হেসে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলাম না। এত দিন ধরে যত কথা ভেবেছি সব একসঙ্গে কণ্ঠার কাছে ঠেলাঠেলি করলে কী আর পরিষ্কার করে কিছু বলা যায়! ও আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে পড়তে লাগল। উঁকি মেরে দেখি ঝুম্পা লাহিড়ির ‘দা নেমসেক’।
সেদিন আমার ব্যথাবেদনা খুব বেড়েছিল, আগে মা অমাবস্যা পূর্ণিমায় ব্যথা বাড়ে বললে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিতাম, এখন কনকনানি শুরু হলে নিজেই ক্যালেন্ডারে কী তিথি খুঁজে বেড়াই। সে কারণে এত আস্তে হাঁটছিলাম যে বাসের চাকা গড়ানোর ঠিক আগের মূহুর্তে পাদানিতে উঠতে পারি। দাঁড়ানো ছাড়া তখন আর উপায় ছিল না, তবে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলেই ওকে দেখতে পেলাম সামনের দিকের সিটে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে গভীর মনযোগে কথা বলছে। এত ডুবে আছে ওরা পরস্পরের মধ্যে যেন এই বাস ভর্তি লোক, এত ক্যালোর ব্যালোর, এসব ওদের কথায় কোনও ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না। মহিলার সাইড ফেস দেখতে পাচ্ছি আমি, হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে চোখ আর ঠোঁটের কোণ, কী একটা কথায় উচ্ছল হয়ে ভদ্রলোকের কাঁধে আলতো চাপড় মারল।
উনি কি ওর হাজব্যান্ড? মাথা ভর্তি নুন গোলমরিচ চুল, খুব লম্বাই হবেন বা, সিটের ব্যাকরেস্টের ওপরে চওড়া কাঁধ জেগে আছে। পেছন থেকে মনে হল, দেখেছি একেও। যেন খুব চেনা কেউ। উঁকি মেরে দেখতে যাব, ভিড় বাসে কেউ পা মাড়িয়ে দিল। রেগে চেঁচালাম, ‘উঃ বাবা, চোখ নেই নাকি!’ সপাটে উত্তর এল, ‘পেছন থেকে সমানে ধাক্কা দিচ্ছে যে! আপনিও তো তখন থেকে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছেন, সোজা হয়ে দাঁড়ান!’
আমার আর ওদের ঠিকমত দেখা হল না। নিজের স্টপে নেমে বাসের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি, ভদ্রমহিলাও উঠে দাঁড়িয়েছে, হয়তো সামনের স্টপে নামবে। কিন্তু তখনও একটু নিচু হয়ে কথা বলে যাচ্ছে, মুখময় চাপা হাসির উদ্ভাস। ভদ্রলোককে আর দেখতে পাইনি।
ভেবেছিলাম বুড়ো বয়েসেই জীবনে সত্যিকারের প্রেমের দেখা মেলে। আসলে কাঁচা নাটক নভেলে সিনেমায় এমনই তো দেখায়। বর গভীর আদরে বউয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে, বউ অ্যাক্সিডেন্টের পর হাতভাঙা বরকে পরম মমতায় খাইয়ে দিচ্ছে। হিসু-পটি পরিষ্কার করছে। আগে প্রত্যেকদিন ফিরতে ফিরতে ভাবতাম আজ প্রকাশের মুড একটু ভাল থাকবে। কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে আগের মত মোহন হাসবে, বলবে, ‘এলে? আজ এত দেরি হল যে? চা করি?’ তা তো হয়ইনি, বরং ইদানীং ওর কপালের ভাঁজ আমাকে দেখলেই আরও গভীর হয়। কী যে এত অসন্তোষ, কে জানে! আমার মত ব্যথাবেদনায় ভোগে না, লোহা খেলে লোহা হজম করে দেবে, আর সময় পেলেই যে সিনেমাগুলো গেলে তাতে লাস্যময়ীদের কোনও অভাব নেই, উঁকি মেরে দেখেছি আমি। এমনিতেও মহিলা মহলে ও খুব পপুলার। দুহাতে খরচ করে, কারণ রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে এসেছে বলে বিপুল টাকা মাইনে পায়। মেয়েদের সঙ্গে মেশা ছাড়াও সন্ধের পর খুব দামি সুরাপান ওর আর একটি শৌখিনতা। কিন্তু ফিনফিনে কাচের গ্লাসে সোনালি তরল ছলকে উঠলেই আমার প্রতি বিতৃষ্ণা ওর যেন আরও বেড়ে যায়। সেদিন অফিস থেকে ফিরে বললাম, ‘মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?’ কীবোর্ড থেকে চোখ না তুলেই বলল, ‘কী নিয়ে?’
মেয়েটাও বাবার মতই হয়েছে। কিম্বা বাবার দেখাদেখি এইরকম হয়েছে। আমাকে পাত্তাই দিতে চায় না। পড়াশুনোর সুবিধে হবে, এতদূর থেকে যাতায়াতের সময় নষ্ট হবে না, এইসব বলে গড়িয়ার দিকে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিল। এখন শুনছি ওর ক্লাসমেট রণিত ওখানে ওর সঙ্গে থাকে। মানে ওরা লিভ ইন করছে। সেই নিয়ে এককথা-দুকথায় তুলকালাম বেঁধে গেল। ‘প্রকাশ, তুমি সব জানতে। শয়তান, আমাকে বলোনি’, আমি একথা বলতেই প্রকাশ গ্লাস ছুড়ে মারল মেঝেতে। হিসিয়ে উঠে বলল, ‘কেন বলব? লেট দেম লিভ দেয়ার লাইফ। আমার মত যেন ওরা পচে গলে শেষ না হয়ে যায়। আর একটা কথা শোনো, তুমি এখন রিডান্ড্যান্ট হয়ে গেছ, ডোন্ট এক্সপেক্ট, তোমার অনুমতি নিয়ে এবাড়িতে সব কাজ হবে!’
তারপর কিছুদিন রিডান্ড্যান্ট কথাটার সব রকম অর্থ আমাকে দিনরাত তাড়া করে ফিরতে লাগল। উঠতে বসতে শব্দটা আমায় টিজ করছিল, তুমি বেকার, তুমি কোনও কম্মের নও। কেউ তোমায় পোঁছে না। তোমাকে দিয়ে আর কোনও কাজই হবে না। কারও জীবনে তোমার আর কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই, তুমি একজন আদ্যন্ত ব্যর্থ মানুষ! তোমার বাঁচা-মরা সবই সমান।
কানের কাছে বাতাস এসে সারাক্ষণ এইসব বলে গেলে মনের অবস্থা কেমন হয়! হাত চলে না, পা চলে না, মনে হয় সারাক্ষণ ঘুমিয়ে থাকি, কেউ দুটো সহানুভূতির কথা কইল কী, চোখ ভরে গেল জলে! সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে দীর্ঘদিন ওষুধ খেয়ে তবে সে যাত্রা রক্ষা পাই! তারপর থেকে ঝগড়াঝাটি এড়িয়ে চলবার চেষ্টায় থাকি। কিন্তু সবসময় পারি না।
আজই যেমন অফিস থেকে ফিরে দেখি বসবার ঘর ফুলের গন্ধে ম ম করছে। টেবিলে ট্রে-র ওপর দামি কাচের গ্লাস সাজানো। বিমলের মা কাচের প্লেটে কাজু কিসমিস শসা সাজিয়ে রাখছে। রান্নাঘর থেকে চিকেন ফ্রাইয়ের গন্ধ আসছে। এখুনি কোনও অতিথি আসবে। আমি বাথরুমে স্নান করতে করতেই শুনতে পেলাম কলিং বেল বাজল, দরজা খুলে যাবার আওয়াজ আর প্রকাশের ভরাট গলা, এসো এসো। ওর ঘরে পারমিশন ছাড়া ঢুকি না। বিমলের মা ট্রে হাতে দরজা ঠেলে ঢোকার সময় যেটুকু দেখা যায় দেখলাম, দুজন মানুষ দরজার দিকে পেছন করে সোফায় বসে আছে, প্রকাশের নুন গোলমরিচ চুলের পাশে ছোট চুলের চশমা পরা কোনও মহিলা। ওরা কথা বলছে সব ভুলে গিয়ে, মাঝে মাঝে ঠোঁটে তুলে নিচ্ছে কাচের গ্লাস। মহিলাকে আমার এত চেনা লাগছে, টুকরো কথা আর টুকরো হাসির আওয়াজও এত চেনা, কে ও ভাবতে ভাবতে আমার ব্রহ্মতালুতে অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল। আজ একটা এস্পার ওস্পার করতেই হবে।
কিন্তু রাত সাড়ে ন’টায় আমি কোথায় যাব! প্রকাশ যাকে একটু আগে গাড়িতে তুলে দিল, বারান্দার অল্প আলোতেও ভাল করে দেখে নিয়েছি, সে আমার ঈর্ষা এবং ভাল লাগার সেই সহযাত্রী। যাবার সময় বারান্দায় গোল চেয়ারে আমি একা বসে আছি দেখে একটু ইতস্তত করল, মনে হল যেন দুহাত জোড় করে নমস্কার করবার চেষ্টা করল, তেমন কোনও আড়ষ্টতা নেই। কিন্তু প্রকাশের দিক থেকে আলাপ করিয়ে দেবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই দেখে মোরাম বিছানো বাগানের রাস্তাটুকু একটু মন্থর হেঁটে গিয়ে সাদা অডিতে উঠে কাচ নামিয়ে প্রকাশকে টা টা করল।
আমার রক্ত ফুটছিল। প্রকাশ বারান্দায় উঠে আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, জীবনে প্রথম এমন ভাষা ব্যবহার করলাম, বস্তিতেও যার চল আছে কিনা সন্দেহ। একদম বিচলিত না হয়ে প্রকাশ টোকা দিয়ে ধুলো ঝাড়ার মত বলল, ‘এবার তুমি এসো। শেষ বয়সটা আমি শান্তিতে থাকতে চাই। সকালে উঠে যেন তোমার মুখও না দেখি।’
খুব দরকারি কিছু ওষুধপত্র, জরুরি কাগজ আর কয়েকটা কাপড়চোপড়েই ব্যাগ ফুলে উঠল। শরীরে আর মনে ব্যথার পাহাড় জমিয়ে এর বেশি কি কেউ টানতে পারে! কিন্তু এত রাতে আমি যাব কোথায়? একটা উবার ডাকলাম। কী ডেস্টিনেশন দিয়েছিলাম মনে নেই, ড্রাইভার বলল, ‘এসি চালালে এক্সট্রা একশো টাকা লাগবে ম্যাডাম। এতটা রাস্তা।’
অনেকটা আসবার পর একটা ঘোরানো দীর্ঘ ব্রিজ যখন পার হচ্ছি মনে হল আমি গড়িয়ায় আমার মেয়ে রোশনাইয়ের ফ্ল্যাটে যাচ্ছি না তো? সে তো বাবার কাছে সব শুনেটুনে আমার ওপর বেজায় খাপ্পা, সম্পর্ক রাখবে না বলে দিয়েছে।
আমার অবচেতন সেসব ভুলেটুলে নিশ্চয়ই ডেস্টিনেশনে সেই ঠিকানাই দিয়েছে! রোগা আর সাদা হাতের ছোট্ট মেয়ে আমার, আমার ঢলঢলে চুড়িগুলো পরে যে বলত, ‘মাম্মা আমি তুমি হয়ে গেছি।’ আমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে পুরো দ হয়ে রাতের বেলায় কত কী যে বলতে চাইত রুগণ মেয়েটা, সারাদিনের ক্লান্তিতে আমি ঘুমিয়ে পড়লে রাগ করত, ‘বলব না তোমাকে কিছু। আড়ি, আড়ি, আড়ি।’
তিন আড়ি কি তিন সত্যির মতই মজবুত? তবু দ্যাখ বিপদে পড়ে তোর কাছেই যাচ্ছি রে রোশনাই। বন্ধন ছিঁড়ে ফেলা কি অতই সহজ!
ফ্ল্যাটে আলো তো জ্বলছিলই, ইংরেজি গানের উঁচু আওয়াজে গিটারের জোরালো শব্দে বাইরেটাও ভেসে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছে অনেকে মিলে কোনও পার্টি টার্টি হচ্ছে। কলিং বেল টিপতে গিয়ে দেখি, এমন বেখেয়ালি মেয়ে আমার দরজাটা খোলাই রয়েছে। একটুখানি ফাঁকে চোখ রেখে দেখি সব অল্পবয়েসি ছেলেমেয়ে, কেউ গল্প করছে, কেউ গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে, আর তাদের মধ্যমণি হয়ে সোফায় যে বসে আছে সে আমার খুব চেনা, ছোট চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো রিমলেস চশমায় ঢাকা, মুগা রঙের শাড়িতে তাকে লাগছে যেন স্বয়ং নাফিসা আলি। রোশনাইয়ের সব কথায় সে হাসছে আর হাসলেই গালে গভীর টোল!
খুব চমকে উঠলাম। আর তখনই কে যেন আমার কাঁধে আলতো টোকা দিল। রণিত! হাতে স্প্রাইটের বোতল। দোকানে গেছিল হয়তো, আমাকে ওইভাবে দেখে অবাক হয়ে গেছে, ‘আপনি কাকে চাইছেন? রোশনাইকে কি ডেকে দেব?’
রণিত এতবার আমাদের বাড়িতে গেছে, খেয়েছে, গল্প করেছে, রোশনাইয়ের সঙ্গে বসে নোটস তৈরি করেছে! অথচ আমার সঙ্গে কথা বলছে যেন একদম অচেনা কেউ! আমি বললাম, ‘না, মানে, এই আমমি…।’ ও নিজে থেকেই বলল, ‘রোশনাইয়ের মায়ের আজ জন্মদিন। সেই উপলক্ষে পার্টি হচ্ছে। আপনি কি ওঁর বন্ধু? নিশ্চয়ই রোশনাই আপনাকে আসতে বলেছে। ওই তো উনি সোফায় বসে আছেন, চলুন না ভেতরে চলুন।’
কার জন্মদিন! কত তারিখ আজ! কিছুই মনে পড়ল না। তবু ভাগ্যিস উবারটা দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম! হতবাক রণিতের মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে বললাম, ‘স্টেশন।’ ড্রাইভার গাঁইগুঁই করতে লাগল, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে ম্যাডাম। আমার বাড়ি তেঘরিয়ায়।’ কিন্তু আমার মুখে এমন কিছু ফুটে উঠেছিল, দড়ি গলায় এঁটে বসবার আগের হতাশা নাকি বাঁচার জন্য ডুবন্ত মানুষের হাঁকপাঁক মিনতি, সে স্টেশনে আমাকে নামিয়ে দিল।
আমার গাঁঠরি নিয়ে দেহাতি মেয়েমানুষের মতই আমি বেঞ্চে বসেছিলাম। যেন গঙ্গাসাগর ফেরত কেউ, যাকে এ শুকদেব কা বহু বা পুনিয়া কি মাইয়া বলে বহুবার মাইকে ডেকেও আত্মীয়স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া যায়নি। অচেনা শহরের অজানা স্টেশনে তাই আমি বোঁচকাবুঁচকিসহ একা বসে আছি, চোখে ঘুম নেই, কোথায় যাব জানি না।
এত রাতে স্টেশন নির্জন হয়ে এসেছে। যে বুড়িটি ঢোকার মুখে হাত তুলে ভিক্ষা চাইছিল তার হাত এখন অবশ ঝুলে আছে। শেষ বাদামওয়ালাটাও তাকাতে তাকাতে চলে গেল। জলের বোতল, কেক বিস্কুটের দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্ল্যাটফর্মটাকে একটু বেশি অন্ধকার লাগছে। বাচ্চা নিয়ে ঘুমিয়ে কাদা যে অল্পবয়েসি ভিখারিনী, দূরে দাঁড়ানো লোকটা তার ওপর নজর রাখছে, না আমার ওপর কে জানে! একটা ফাঁকা লোকাল এসে দাঁড়াল। আমার সামনের কামরা থেকে নেমে এল একটা ছেলে। তার হাত ধরে সালোয়ার কুর্তা পরা একটা সাদামাটা মেয়ে। আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় মেয়েটি বলল, ‘আজ কপালে দুঃখ আছে রে! মা বলেছিল তাড়াতাড়ি ফিরতে।’ উত্তরে ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে হাসল কেবল, যেন বলতে চাইল, খুব সরি, সবই আমার জন্য।
যতক্ষণ দেখা যায়, ওদের দেখলাম। একটু ভালবাসার কাঙাল আমি যেন স্ট্র দিয়ে শুষে নিতে চাইছিলাম এই পৃথিবীতে আমার ফুরিয়ে যাওয়া ছোট ফ্রুটির প্যাকেটটা। যতই টানছিলাম শুধু হাওয়ার বুদবুদ উঠে আসছিল সুপ সুপ আওয়াজে। তবু কাত করে, কোনায় স্ট্র ফিট করে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা!
ছেলেটার চাপদাড়ি দেখে হঠাৎ মনে পড়ল, সুশানের কথা। আমার ছোটবেলার বন্ধু। কতবার বলেছে, ‘আমার এখান থেকে ঘুরে যা। আমার স্কুল, আদিবাসী অনাথ বাচ্চারা, দেখবি তোর আর যেতে ইচ্ছা করবে না।’ আমিই সংসার আর চাকরি নিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে ওসবকে মাথায় আনিনি।
চলে যাব চম্পাঘাঁটি? ফিরতে ইচ্ছে না করলে বাচ্চাগুলোকে রেঁধেবেড়ে খাওয়াতে তো পারব।
হঠাৎ স্টেশনের এ মাথা থেকে ও মাথা চেঁচিয়ে উঠল একটি যান্ত্রিক স্বর, চম্পাঘাঁটি যানে কা মেইল ট্রেন আ রহি হ্যায়। আপ লোঁগোনে কৃপয়া করকে…।
মেইল ট্রেন! এ স্টেশনে তো সেটা দাঁড়াবে না। আরও অপেক্ষা করতে হবে! ভাবলাম উঠে গিয়ে এনকোয়ারিতে জিজ্ঞাসা করি লোকাল ক’টার সময়। তারপর সুশানকে একটা ফোন করে নেব। যদি অবশ্য সে এত রাতে জেগে থাকে। তবে অবাক হবে না, আমার সৃষ্টিছাড়া পাগলামির সঙ্গে ওর ভালই পরিচয় আছে।
অনেকক্ষণ বসে থেকে কোমর ধরে গিয়েছিল, দাঁড়িয়ে একটু আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতেই টের পেলাম ঝড়ের গতিতে মেইল ট্রেন ঢুকছে। কী স্পিড রে বাবা! নিমেষের মধ্যে আলো জ্বলা সব ক’টা কামরা যেন হুড়োহুড়ি করতে করতে এর ঘাড়ে ও পড়ার কম্পিটিশনে নেমে চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল৷ আর এক মুহূর্তের ভগ্নাংশেরও কম সময়ে দেখে নিলাম একেবারে শেষ কামরার জানালা দিয়ে হাসি হাসি মুখ বার করে আছে সেই আমার আমি, যাকে কিছুক্ষণ আগে রোশনাইয়ের ফ্ল্যাটে জন্মদিন পালন করতে দেখে এলাম৷ সেও নিশ্চয়ই সুশানের কাছে যাচ্ছে, আর পৌঁছবেও আমার অনেক আগে। তার চুলের ওপর পিছলে যাওয়া আলো, তার চশমার কাচের ঝিলিক, তার মুগা রঙের আঁচল, ভাল করে প্রাণভরে দেখার আগেই গতির কাছে ছিনতাই হয়ে গেল, অন্ধকারে কিছুক্ষণ শুধু জেগে রইল ট্রেনের পেছনের তীব্র লাল আলো।
মেল ট্রেনের তীব্র গতিতে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে ধুলো, কাগজের টুকরো, পাতা, খড় উড়ছিল। রেললাইন থেকে পেচ্ছাপ পায়খানার গন্ধ উঠে আসছিল। ভিখারি-বাচ্চাটা ঘুমের মধ্যেই খুনখুন করে কেঁদে উঠতে অন্ধকারে দাঁড়ানো লোকটি আরও একটু পিছিয়ে গেল। রোশনাই আমায় সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে বলেছিল। কাল যদি বেঁচে থাকি দেখাব। আমারই সার্থক আর সম্পূর্ণ হতে চাওয়া সত্তা আমাকেই হারিয়ে দেবে বার বার, এ আমি সহ্য করব না।
ঘূর্ণির মত ধুলো আর নোংরা ওপরে নিচে নেমে নেমে আমায় স্নান করিয়ে দিতে থাকলে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ পয়লা এপ্রিল, আমার জন্মদিন।
অসাধারণ গল্প। কী অভিঘাত! মুগ্ধ হলাম পড়ে।
খুব ভালো লাগলো
অসাধারণ লাগলো। একেবারে অন্যরকম।
কী অসাধারণ! খুব ভালো লাগল, আপনার গল্প আমার যেমন লাগে আর কী!
বেশ অভিনবত্ব আছে গল্পে। খুব ভালো লাগলো
“পেছন থেকে সমানে ঝাপটা দিচ্ছে যে! আপ্নিও তো ঝুকে ঝুকে পড়ছেন, সোজা হয়ে দাড়ান।”… গল্পটি এমনি ঝুকে পড়ার, দেখার। একটি মানসিক রোগের আড়ালে একটি গল্প বলা হয়েছে, নিজেকেই পেছন থেকে দেখার, আবিষ্কার করার, মিলিয়ে নেয়ার…। এ গল্পগুলো মনের মধ্যে থাকে, পুরু পর্দায় ঢাকা থাকে। কিন্তু কোন জাগ্রত কলমে সেই অন্দরলোকের ভাবনাও উঠে আসে, যেখায় জীবন, ব্যধি একাকার হয়ে যায়। খুব ভাল লাগল্য এপ্রিল ফুল।