Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

শুয়োর-চাষির ছেলের নোবেল জয়

গল্পটা অনেকের জানা। সেপ্টেম্বর ১৯২৮ সালের কথা। সপ্তাহ দু’য়েক পারিবারিক ছুটি থেকে ফিরে এসে আবার ল্যাবরেটরিতে যোগ দিয়েছেন ডা. অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং। জীববিজ্ঞানী এবং জীবাণুবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ তিনি। ফিরে এসে ল্যাবরেটরি-বেঞ্চের ওপর অপ্রয়োজনীয় কয়েকটি পেট্রিডিশের দিকে দৃষ্টি গেল ফ্লেমিং-এর। লক্ষ্য করে দেখলেন পেট্রিডিশগুলির গজানো ব্যাকটেরিয়ার ওপরে কয়েকটি জায়গায় গজিয়ে উঠেছে ছত্রাকের (ফাঙ্গাস) সংক্রমণ। আশ্চর্য হয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন পেট্রিডিশের ব্যাকটেরিয়া কালচারের যেখানে ফাঙ্গাস সংক্রমণ হয়েছে, তার সংস্পর্শে থাকা গজানো ব্যাকটেরিয়া-কালচারে, গজিয়ে ওঠা ব্যাকটেরিয়ার জায়গা দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন চেঁছে সাফ করে দিয়েছে। যেন ব্যাক্টেরিয়া-খেকো কোনও কিছু এই কাজটা করেছে।

মাইক্রোবায়োলজিস্ট, জীবাণুবিজ্ঞানী, ফার্মাকোলজিস্ট এবং চিকিৎসক ফ্লেমিং ওই প্লেটগুলি দেখেই, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এর সম্ভাব্য কারণ অনুমান করতে পারলেন। তিনি বুঝে গেলেন যে প্লেটে-গজানো ব্যাকটেরিয়াকে খেয়ে ফেলার পেছনে রয়েছে প্লেটে গজানো ফাঙ্গাস। তা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সংক্রমিত ওই ছত্রাক থেকে এমন একটা কিছু নিঃসৃত হয়েছে, যার সংস্পর্শে প্লেটের বিশেষ বিশেষ জায়গায় ব্যাকটেরিয়া মরে গিয়েছে।

‘পেনিসিলিন নোটেটাম’ নামের ফাঙ্গাস (ছত্রাক) থেকে নিঃসৃত পদার্থ থেকে আবিষ্কার হল ‘পেনিসিলিন’।

পেট্রি-ডিশের ব্যাক্টেরিয়াল কালচারে ফাঙ্গাস-নিঃসৃত তরলের মধ্যে থাকা উপাদানই যে প্লেটের ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলছে, সে বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত হলেন ফ্লেমিং। ‘ব্যাকটেরিয়া-কিলার’ কোনও অজানা উপাদানটিকে (যা ইনহিবিটার হিসেবে কাজ করছে) আলাদা করে তার প্রকৃতি বোঝাটাই জরুরি। এইভাবে আবিষ্কৃত হল পৃথিবীর প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক। ‘পেনিসিলিন নোটেটাম’ নামের ফাঙ্গাস (ছত্রাক) থেকে নিঃসৃত পদার্থের চরিত্রই ‘পেনিসিলিন’ গোত্রের। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যা একটি দিগদর্শী আবিষ্কার। আর এইভাবেই আবিষ্কার হল প্রথম ব্যাকটেরিয়া-নিধনকারী ‘পেনিসিলিন’ নামের অ্যান্টিবায়োটিক।

‘অ্যান্টিবায়োটিক’ শব্দটি লাতিন থেকে এসেছে। বাংলায় বলতে গেলে বলতে হয়, জীবাণুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী। এ যেন এক ম্যাজিক-ওষুধ! এই গোত্রের প্রথম আবিষ্কৃত ওষুধটিই পেনিসিলিন। স্কটিশ জীববিজ্ঞানী ও জীবাণু-বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার ফ্লেমিং যে পেনিসিলিনের উদ্ভাবক, সে কথা আমাদের সকলেরই জানা।

পেনিসিলিন আবিষ্কার চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী ফসল। পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে। এইভাবে পেনিসিলিন এবং পরবর্তীকালে অপরাপর অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনার ফলে কঠিন সংক্রমণের হাত থেকে মানুষের বেঁচে ওঠা সহজ হয়েছে।

পেনিসিলিন আবিষ্কারের এই কাহিনি স্কুলে আমরা অনেকেই পড়েছি। ফাঙ্গাস-গজানো প্লেটগুলি দেখে হঠাৎ স্পার্কের মত খেলে যাওয়া ভাবনাই বুঝিয়ে দেয় ফ্লেমিং-এর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার কথা। যে ক্ষমতা একজন সাধারণ গবেষক আর সৃজনশীল দূরদর্শী ও মেধাবী গবেষকের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। এইভাবে সাধারণ ‘দেখা’ কখন যে অবিশ্বাস্যভাবে ‘দৃষ্টি’ হয়ে ওঠে। বিশ্বকবি এই দৃষ্টিকেই বলেছেন ‘চৈতন্য দিয়ে দেখা’।

ব্যাকটেরিয়া কিলার।

এখানে আরও একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। ফ্লেমিং পেনিসিলিন চিহ্নিত করলেন ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে কাজের কাজ কিছু এগোল না। কেন না তা খুবই অস্থায়ী ছিল এবং ওই পদার্থ শরীরে গিয়ে বেশিক্ষণ কার্যকরী থাকে না। এরপর এক দশক কেটে যায়। ১৯৩৮ সালে অপরিশুদ্ধ পেনিসিলিনকে পরিশুদ্ধ করা এবং নিষ্কাশন করার কাজ শুরু করেন অক্সফোর্ডের অধ্যাপক হাওয়ার্ড ফ্লোরি এবং আর্নস্ট চেইন। ১৯৪০-এর মাঝামাঝি সময়ে সফল হন ফ্লোরি এবং চেইন। সম্পূর্ণভাবে পেনিসিলিন পরিশুদ্ধ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হলেন তাঁরা, যাতে পেনিসিলিনের কার্যকারিতা নষ্ট না হয়।

যুগান্তকারী এই আবিষ্কারের জন্যে ১৯৪৫ সালে ফিজিয়োলজি ও মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ফ্লেমিং। পরবর্তীকালে তিনি যথার্থই বলেছেন, “I did not invent penicillin. Nature did that. I only discovered it by accident.”

একজন সফল উদ্ভাবকের উচ্চতায় উঠে আসা আলেকজান্ডারের পক্ষে অত সহজ ছিল না। কেন না তিনি ছিলেন একজন শুয়োর-চাষির ছেলে। দক্ষিণ পশ্চিম স্কটল্যান্ডের আয়ারশায়ার অঞ্চলের লকফিল্ড নামের একটি গ্রামেই জন্ম। ওখানেই ছিল বাবার খামার। পূর্বপুরুষের সবারই পেশা ছিল চাষবাস। স্বাভাবিকভাবেই আলেকজান্ডারের ভাগ্যও পরিবারের সবার মত গবাদি পশু, শস্যের গোলা আর খেতখামারেই নির্ধারিত হয়ে গেছিল। এভাবেই আলেকজান্ডারের ছোটবেলা কেটেছে।

অভাবের সংসার। স্কুলে পড়াশোনা করা বিলাসিতা। তেরো বছর বয়সে রয়েল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হলেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সামর্থ্য নেই ফ্লেমিং পরিবারের। পরে চার বছর লন্ডনের একটি শিপিং-এর অফিসে কাজে নিযুক্ত হন। পরে প্রয়াত কাকার করে যাওয়া উইলের সম্পত্তি পান ফ্লেমিং। সেই সম্পত্তি বিক্রি করে ফ্লেমিং ডাক্তারি পড়েন। সেন্ট মেরিজ হসপিটাল থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি পেয়ে সসম্মানে পাশ করলেন। পরে ব্যাক্টেরিয়োলজিতে এমএসসি পাশ করেন।

ফ্লেমিং-এর নাম একটি মাইল ফলক আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত হল, যা সারা পৃথিবীতে জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও তিনি পেয়েছেন ‘স্যার’ উপাধি।

আজ ৬ আগস্ট। মহান বিজ্ঞানী স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং-এর (১৮৮১-১৯৫৫) ১৪১ তম জন্মদিন।

চিত্র: গুগল
4.2 5 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সুকান্ত ভট্টাচার্য: ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর এক কবি

‘–ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে’, সুকান্ত লিখেছেন নিজের সম্পর্কে। বলেছেন, ‘আমি এক অঙ্কুরিত বীজ’। এই বীজ মহীরুহে পরিণত হতে পারল না, বাংলা সাহিত্যের পরম দুর্ভাগ্য এটা। কিন্তু তাঁর একুশ বছরের জীবনে তিনি আভাস দিয়ে গেছেন, তাঁর সম্ভাবনা কতদূর প্রসারিত হতে পারত। সুকান্ত মানে একজন কবিমাত্র নন, তার চেয়েও আরও অধিক কিছু।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও প্রসঙ্গত

প্রয়াণের আগে, সব হিসেব বাদ দিয়ে যদি তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছরের কথা-ই ধরি, দেখব, কত প্রিয়জনের মৃত্যুশোক বহন করতে হয়েছে তাঁকে। যেহেতু তিনি ছিলেন মানুষের সান্নিধ্যপ্রিয়, তাই অন্যের চেয়ে ঢের ঢের বেশি মৃত্যুবেদনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এসব মৃত্যু তাঁকে বেদনার্ত করলেও নিজের মনোবলের জোরে সে-অরুন্তুদ বিষাদকে কাটিয়েও উঠেছেন। পাশাপাশি মৃত্যু নিয়ে তাঁর দর্শন গড়ে উঠতেও তা ভূমিকা রেখেছে। তাই তিনি বলতে পারেন, তিনি-ই বলতে পারেন, ‘দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে/ তাইতে যদি এতই ধরে/ চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?’ কেন পারেন?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার: অন্য ও অনন্য

তাঁর জন্মদিনের চেয়েও মৃত্যুদিনটিকে অধিকভাবে স্মরণ করা হয়, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। তাছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র-জগতে তো কম খ্যাতিমান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়নি, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল, ছবি বিশ্বাস-কানন দেবী-সুচিত্রা-সৌমিত্র, তবু তাঁর মতো, ঠিক তাঁর মতো স্মরণযোগ্য হয়ে রইলেন না কেউ। শ্রাবণের অনুষঙ্গে নয়, উত্তমকুমারের প্রয়াণদিবসটি চিহ্নিত চব্বিশে জুলাই তারিখটির বিধুরতায়। ১৯৮০-র এই দিনটিতে বাংলা চলচ্চিত্র-জগতের এই দিকপাল প্রতিভার জীবনাবসান ঘটে। আজ তাঁর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্তিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে উত্তম সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্যের ডালি।

Read More »
শৌনক দত্ত

রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী

নাটকটির নাম প্রথমে রেখেছিলেন যক্ষপুরী, তারপর নন্দিনী এবং পরিশেষে রক্তকরবী নামে থিতু হয়। শিলং-এ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে যে নাটক লেখা শুরু হয়েছিল তার দশম খসড়া প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রায় দেড় বছর পর আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দে—১৯২৪ সালে। প্রকাশিত হবার পরেও, একাদশতম খসড়া প্রস্তুত করার কথা ভাবেন নাট্যকার। অনেকেই বলেছেন, এটি নাট্যকারের হৃদয়ে লালন করা কোনও স্বপ্ন। কেউ কেউ এই নাটকের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার ছায়া খুঁজেছেন। নানা প্রশ্ন, নানা যুক্তি নিয়ে নাটকটি রচনার পর থেকে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত দারুণ আলোচিত ও জনপ্রিয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নাটকটি নিয়ে বহু আলোচনা। শতবর্ষে এসে দাঁড়ানো সেই রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নানামাত্রায় বিবেচনাযোগ্য একটি নাটক; বহুমাত্রিক এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।

Read More »
নুশান জান্নাত চৌধুরী

নুশান জান্নাত চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ

কিছুকাল ঘুমিয়ে, কিছুকাল লুকিয়ে,/ কিছু শহর, কিছু মানুষের ভিড়ে হারিয়ে/ আমি দেখি—// কোনও এক/ পথহারা দেবদূতের বিষণ্ণ ডানার পাশে/ আমি বুক পেতে দিয়েছি// চুলের ভেতর জন্ম নিয়েছে/ ঘাসফুল থোকা থোকা, বুকের মাঝখানে একটা প্রাচীন পেরেক,// ঝরাপাতার রাজ্যপাটে/ আমার বাম হাঁটুতে গেঁথে আছে—/ আগামী বছরের প্রথম সন্ধ্যা;

Read More »