Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বাঙ্গিটোলার ছানার মণ্ডা এবং সত্তরোর্ধ্ব ষষ্ঠীচরণ

শুধু মিহি ছানা আর গুঁড়ো চিনির একটা আনুপাতিক মিশ্রণ। সঙ্গে পরিমাণমত ক্ষীর আর সামান্য এলাচ গুঁড়ো। তার সঙ্গেও যদি কিছু মেশাতে হয়, তা হল ভক্তি, নিষ্ঠা আর সংস্কার। এই উপকরণেই তৈরি হয় মালদার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মিষ্টি বাঙ্গিটোলার মণ্ডা। প্রায় ১০০ বছরের কাছাকাছি সময় পেরিয়েও শেষ হয়ে যায়নি তার ঐতিহ্য। অন্যান্য দেবস্থানের মণ্ডার মত এই মিষ্টি শক্ত নয় বা এতে চিনির প্রাধান্য নেই। নেই ময়দার মিশ্রণও। স্বাদ অনেকটা কাঁচা সন্দেশের মত আর এই স্বাদই তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

মালদার কালিয়াচক-২ ব্লকের অন্তর্গত ভাঙন অধ্যুষিত প্রাচীন মৈথিল গ্রাম বাঙ্গিটোলা। সেখানকার ঐতিহ্যবাহী মুক্তকেশী মন্দির সংলগ্ন দোকানগুলিতে এখনও পাওয়া যায় এই মিষ্টি। তবে কতদিন আর পাওয়া যাবে তা বলতে পারেন না বিক্রেতারা। কেননা নতুন প্রজন্ম মজেছে রকমারি আইটেমের মিষ্টিতে। চাহিদা হারিয়েছে মণ্ডা। মণ্ডার কারিগরও অমিল। ফলে কাচের শো-কেসের এক কোনায় অভিমানে পড়ে থাকে এই ঐতিহ্যশালী প্রাচীন মিষ্টি।

চলছে মণ্ডা বানানো।

এই গ্রামের প্রাচীন বাসিন্দারা বলেন, প্রায় ৭০-৮০ বছর আগে এখানকার বাসিন্দা ইন্দুভূষণ ঝা এই মিষ্টি বানানো আরম্ভ করেন। এটি মূলত পূজাকেন্দ্রিক মিষ্টি অর্থাৎ সারাবছর বানানো হলেও পূজা-পার্বণে এই মিষ্টির চাহিদা বেশি। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত মৈথিল জনজাতি বিষয়ক গবেষক সৌমেন্দু রায়ের পর্যবেক্ষণ: বাঙ্গিটোলার বিখ্যাত মুক্তকেশী কালীপূজায় নিবেদিত ১০০টা ডালার মধ্যে অন্তত ৯০টিতে এখনও অনিবার্যভাবে এই মিষ্টির উপস্থিতি। যুগ পরিবর্তনেও ম্লান হয়ে যায়নি এই ঐতিহ্য।

ভক্তি, বিশ্বাস এবং অলৌকিকত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই মিষ্টি অমর হয়ে আছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে। ‘ভূতনি দিয়ারা’ খ্যাত ঔপন্যাসিক জয়ন্ত জোয়ারদারের ছোটগল্প ‘খারিজ’-এ দেখা যায়, অমৃতি মোড়ে একটি পরিবার আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে, কখন তাদের আত্মীয় মায়ের প্রসাদী বাঙ্গিটোলার মণ্ডা নিয়ে পৌঁছাবেন। এক পথ দুর্ঘটনা অবশ্য তাকে আর পৌঁছতে দেয় না। অভিজিৎ সেন বা অমর মিত্রের উপন্যাস ও ছোটগল্পেও এই মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়।

মণ্ডা বানানোর দৃশ্য।

ক্রমশ উৎসাহ হারাচ্ছেন কারিগরেরা। তাই বাঙ্গিটোলা স্ট্যান্ড সংলগ্ন ছোট্ট একটি দোকানে টিমটিম করে এই মিষ্টির ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন সত্তরোর্ধ্ব ষষ্ঠীচরণ সাহা ও তাঁর ছেলে উত্তম সাহা। কাঁপা কাঁপা হাতে ষষ্ঠীচরণ আজও বানিয়ে চলেছেন এই মিষ্টি। পরবর্তী প্রজন্মের উত্তম দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছেন এই মিষ্টিকে টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু আর কতদিন? একই প্রশ্ন তাঁদের দুজনের চোখেই ভেসে বেড়ায়। কোনও উত্তর মেলে না।

Advertisement

এই মণ্ডা নিয়ে একটি ভিন্ন মতও আছে। উত্তরবঙ্গ সংবাদের প্রবীণ সাংবাদিক কল্লোল মজুমদার দাবি করেন, এই ছানার মণ্ডা অনেকটাই ইংরেজবাজার শহরের ঐতিহাসিক পাঁচ বোনের কালীপূজায় একজন দেবীকে নিবেদিত ভোগের কাঁচা সন্দেশের সমতুল্য। ‘কাচ্চিখাউকি’ নামে প্রচারিত এই দেবীর প্রধান ভোগ কাঁচা সন্দেশ। অর্থাৎ, জেলার দুই প্রান্তের দুই প্রাচীন কালীর ভোগের একটা উপকরণগত সাদৃশ্য রয়েছে। ছানার মিষ্টি যে গৌড়বঙ্গের শক্তিপীঠের দেবীদের ক্ষেত্রে ব্রাত্য নয়, এই ব্যাখ্যা করেছিলেন সদ্যপ্রয়াত ঐতিহাসিক ড. তুষারকান্তি ঘোষ।

বহুজাতিকের নামী পানীয়ের নিচে অবহেলায় পড়ে আছে বাঙ্গিটোলার মণ্ডা।

তবুও চৈত্রের ধুলো পাকিয়ে ওঠে গ্রামের পথে। পিচগলা রাজপথকে সামনে রেখে পথের পাশের দোকানে অবহেলার ধুলো মেখে পড়ে থাকে ঐতিহ্য, হারিয়ে যায় ইতিহাস। হারাতে হারাতেও হারায় না অনেক কিছু। ফেলনা আধুলির মত মহাকাল এইটুকুই গর্ব করার মত বস্তুই ছুড়ে দিয়েছে বাঙ্গিটোলার মণ্ডার দিকে।

চিত্র: লেখক

গম্ভীরার কিংবদন্তি সুফি মাস্টার: পড়েছিলেন ব্রিটিশের রোষানলেও

4 Responses

  1. পুরানো অনেক কিছুই হারাতে হারাতে আবার ফিরে আসতে পারে , বিখ্যাত বাঙ্গিটোলার মন্ডা কে ভালোভাষার রসে ডুবিয়ে আমাদের কাছে পরিবেশন করেছেন লেখক , এর ঐতিহ্য কোনো দিন ও ম্লান হবে না

  2. ইতিহাস আর ঐতিহ্য জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই লেখাটিতে। এমন কত কিছুই আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে!

  3. হারিয়ে যাওয়া মিষ্টিগুলি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা হোক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 5 =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »