Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সত্যজিতের নানা জানা-অজানা

সত্যজিতের পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। পারিবারিক সূত্রে তিনি সত্যজিতের আত্মীয়। এমনি কিছু প্রায়-অজানা তথ্য থাকবে বর্তমান লেখাটিতে।

চলচ্চিত্র পরিচালনা ছিল তাঁর মূল পেশা এবং আয়ের উত্স। কিন্তু পরে দেখা গেল যে লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর আয় আরও বহুগুণ বেশি হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টিতে তিনি নিজেই বিস্মিত হয়েছিলেন। আমাদের জানা মতে, পৃথিবীর আর কোনও চিত্রপরিচালক ছবি তৈরির চেয়ে লিখে অধিক আয় করেছেন বলে মনে পড়ে না।

পথের পাঁচালী’ তৈরি করতে গিয়ে তিনি তাঁর দুর্মূল্য বই ও রেকর্ড বিক্রি করতে বাধ্য হন। আশ্চর্যের ব্যাপার এখানেই যে, এই সত্যজিতের-ই চতুর্থ ছবি ‘জলসাঘর’ ও পরবর্তী চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’-এর প্রযোজক তিনি নিজে।

তিনি ছাত্রবয়সে জুজুৎসু শিখেছিলেন। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর আত্মকথা ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ এর উল্লেখ আছে। তাঁর ছোটকাকা সুবিমল রায়ের উত্সাহেই এগারো বছরের সত্যজিতের এই বিদ্যে শেখা। শিনজো তাকাগাকির কাছে। রবীন্দ্রনাথ তাকাগাকিকে জাপান থেকে আনিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে জুজুত্সু শেখাতে। পরে কিছুদিন তিনি কলকাতায় থাকতেন। এটা সে-সময়ের কথা।

সত্যজিৎ রায় গল্প লিখেছেন। ছোটদের জন্য রহস্য উপন্যাস এবং কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি লিখেছেন। এমনকি অল্পস্বল্প কবিতাও। করেছেন অনুবাদ। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, পিতা সুকুমার রায়ের মত তিনি কোনও নাটক লেখেননি। লিখলে যে তিনি উত্তম নাট্যকার হতে পারতেন তার প্রমাণ তো তাঁর করা চিত্রনাট্য। তিনি ইবসেনের নাটক ‘The Enemy of the People‘ অবলম্বনে ‘গণশত্রু’ ছবি করেছেন। সুকুমার রায়কে নিয়ে করা তাঁর তথ্যচিত্রে ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকের অংশবিশেষ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু নাটক লেখেননি।

এবার বলি তাঁর ছবি আঁকা নিয়ে। শান্তিনিকেতনে কলাভবনের ছাত্র সত্যজিৎ শিক্ষকরূপে পেয়েছিলেন নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে। প্রথমজীবনে যোগ দেন এক বিজ্ঞাপন সংস্থায়। প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বই ‘Discovery of India‘ দিয়ে। কয়েকশো প্রচ্ছদ এঁকেছেন। ছবি করতে এসে এঁকেছেন হাজার হাজার। বা হয়তো লক্ষাধিক। বেশুমার। নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর প্রত্যেক সংখ্যার জন্য ছবির পর ছবি আঁকা ছাড়াও নিজের লেখা সব বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভেতরের ছবি এঁকেছেন। এঁকেছেন অজস্র বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতি।

অথচ তাজ্জব ব্যাপার এটাই যে, এতবড় একজন অঙ্কনশিল্পী কখনও কমার্শিয়াল আর্টের বাইরে গেলেন না! গেলে আমরা জয়নুল আবেদীন-পরিতোষ সেনের মত এক চিত্রশিল্পীকে অবশ্যই পেতে পারতাম। তাছাড়া আর্থিক দিক দিয়েও তিনি লাভবান হতেন প্রচুর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টির সমগ্রতা খুঁজে পেয়েছিলেন চিত্রাঙ্কনেও। আর সেজন্য তাঁর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা-গবেষণার পাশাপাশি তাঁর বিস্ময়কর চিত্রকর্ম নিয়েও আজ দুনিয়াজোড়া আলোচনা হয়। সত্যজিৎ নিজেকে এবং সেইসঙ্গে সারা বিশ্বের চিত্রপ্রেমিকদের হতাশ করেছেন।

নিজের ছবি ছাড়াও তিনি অন্যের ছবির চিত্রনাট্য-ও লিখেছেন। যেমন, ‘বাক্সবদল’ (কাহিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)। এ ছবির চিত্রনাট্য সত্যজিতের ও পরিচালনা নিত্যানন্দ দত্তের। মার্চেন্ট আইভরির ‘সেক্সপিয়ারওয়ালা’-র সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ রেনোয়ার ‘দ্য রিভার’ ছবির সহপরিচালক ছিলেন তিনি।

সত্যজিতের কাছ থেকে আমরা আরও একটি জিনিস পাইনি। পেলে বিশ্ববাসীর বিস্ময় নিঃসন্দেহে ফুরোতে চাইত না। সেটি হচ্ছে তাঁর অভিনয়। যে পরিচালক সত্যজিৎ এত অভিনেতা-অভিনেত্রীর কাছ থেকে অভিনয় আদায় করে নিয়েছেন, সেই তিনি যদি তাঁর নিজের বা অন্য কারও ছবিতে অভিনয় করতেন৷ ঋত্বিক ঘটককে যেমন পেয়েছি। উত্পল দত্ত এক্ষেত্রে আর এক উদাহরণ। বা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবিতে পরিচালক গৌতম ঘোষকে। পরিচালক-অভিনেতার বিস্ময়কর উদাহরণ তো রয়েছেই— চার্লি চ্যাপলিন।

তবে ‘গুগাবাবা’ ও ‘আগন্তুক’-এ তাঁর ভয়েসওভার আছে। আছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-তে তাঁর পেছন ফিরে বসা। এর বাইরে খুব একটা নয়।

সত্যজিতের বিদ্যালয়জীবন শুরু হয়েছিল ক্লাস সেভেন থেকে। তার আগে তিনি বাড়িতে মূলত মা সুপ্রভা দেবীর কাছেই পড়তেন। তাতে তাঁর বিদ্যাশিক্ষার আদৌ কোনও হানি হয়নি। অসাধারণ দখল ছিল ইংরেজিতে। The Statesman পত্রিকা থেকে Crossword puzlle খুব দ্রুত সমাধান করে ফেলতেন।

তুলনায় প্রথম দিকে বাংলায় তিনি কাঁচা ছিলেন। ‘সিগনেট প্রেস’-এর মালিক দিলীপকুমার গুপ্ত তাঁকে বেশ কিছু বাংলা বই উপহার দিয়ে সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তে বলেছিলেন। উপহার দিয়ে লিখেছিলেন : ‘‘বাংলাসাহিত্যে ক’অক্ষর গোমাংস সত্যজিৎকে’’। সত্যজিতের-ই লিখিত জবানবন্দি। এই লোক-ই কিনা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ-পরশুরামের মত লেখকদের কাহিনি নিয়ে ধ্রুপদী সব ছবি নির্মাণ করেন! নিজে বাংলায় যেসব বই লেখেন তা বেস্ট সেলার হয়! আশ্চর্য বৈ কি।

বাংলা হরফ নিয়েও আগ্রহী ছিলেন তিনি। তার প্রমাণ তাঁর হাতে তৈরি রোমান ফন্ট। এটা হচ্ছে ভারতীয় মোটিফ ও ক্যালিগ্রাফির সংমিশ্রণ। রে রোমান / রে বিজার/ ড্যাফানিসহলিডে স্ক্রিপ্ট এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

বিনোদন জগতের কাউকে সাধারণত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টরেট দেয় না। চার্লি চ্যাপলিনকে সম্মানসূচক ডক্টরেট দিয়ে তারা এর ব্যতিক্রম ঘটায়। আর দ্বিতীয় ব্যতিক্রম সত্যজিৎ।

জীবনে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অস্কার। ভারতরত্ন। লিজিয়ন দ্য অনার। দেশিকোত্তম। সাহিত্যে আনন্দ ও বঙ্কিম পুরস্কার। তবে রবীন্দ্রনাথের একাধিক কাহিনির চলচ্চিত্ররূপদাতা ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্রকারের কিন্তু সাহিত্যে রবীন্দ্র পুরস্কার-ও প্রাপ্য ছিল। পাননি। প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনিমালা বা Our Films Their Films অনায়াসেই পেতে পারত।

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণদিনে স্মরণ

বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি তথা ভারতীয়। রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ১৯১২-পর্বে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যাওয়ার পর, এবং তার পরের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রায় কুড়ি বছর পূর্বেই বিবেকানন্দ শিকাগো-বক্তৃতা ও আমেরিকা-ইয়োরোপে এক নাগাড়ে প্রথম দফায় চার বছর থাকার সুবাদে আমেরিকার বিদ্বজ্জনমহলে যেমন, তেমনই জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, রাশিয়ার টলস্টয় প্রমুখের শ্রদ্ধা এবং মনোযোগ আদায় করেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রফুল্ল রায়: ব্রাত্য সময়ের কথাকার

প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’

Read More »
শৌনক দত্ত

মন্দ মেয়ে ভদ্র অভিনেত্রী: সুকুমারী দত্ত

বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »