সত্যজিতের পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। পারিবারিক সূত্রে তিনি সত্যজিতের আত্মীয়। এমনি কিছু প্রায়-অজানা তথ্য থাকবে বর্তমান লেখাটিতে।
চলচ্চিত্র পরিচালনা ছিল তাঁর মূল পেশা এবং আয়ের উত্স। কিন্তু পরে দেখা গেল যে লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর আয় আরও বহুগুণ বেশি হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টিতে তিনি নিজেই বিস্মিত হয়েছিলেন। আমাদের জানা মতে, পৃথিবীর আর কোনও চিত্রপরিচালক ছবি তৈরির চেয়ে লিখে অধিক আয় করেছেন বলে মনে পড়ে না।
‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করতে গিয়ে তিনি তাঁর দুর্মূল্য বই ও রেকর্ড বিক্রি করতে বাধ্য হন। আশ্চর্যের ব্যাপার এখানেই যে, এই সত্যজিতের-ই চতুর্থ ছবি ‘জলসাঘর’ ও পরবর্তী চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’-এর প্রযোজক তিনি নিজে।
তিনি ছাত্রবয়সে জুজুৎসু শিখেছিলেন। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর আত্মকথা ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ এর উল্লেখ আছে। তাঁর ছোটকাকা সুবিমল রায়ের উত্সাহেই এগারো বছরের সত্যজিতের এই বিদ্যে শেখা। শিনজো তাকাগাকির কাছে। রবীন্দ্রনাথ তাকাগাকিকে জাপান থেকে আনিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে জুজুত্সু শেখাতে। পরে কিছুদিন তিনি কলকাতায় থাকতেন। এটা সে-সময়ের কথা।
সত্যজিৎ রায় গল্প লিখেছেন। ছোটদের জন্য রহস্য উপন্যাস এবং কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি লিখেছেন। এমনকি অল্পস্বল্প কবিতাও। করেছেন অনুবাদ। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, পিতা সুকুমার রায়ের মত তিনি কোনও নাটক লেখেননি। লিখলে যে তিনি উত্তম নাট্যকার হতে পারতেন তার প্রমাণ তো তাঁর করা চিত্রনাট্য। তিনি ইবসেনের নাটক ‘The Enemy of the People‘ অবলম্বনে ‘গণশত্রু’ ছবি করেছেন। সুকুমার রায়কে নিয়ে করা তাঁর তথ্যচিত্রে ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকের অংশবিশেষ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু নাটক লেখেননি।
এবার বলি তাঁর ছবি আঁকা নিয়ে। শান্তিনিকেতনে কলাভবনের ছাত্র সত্যজিৎ শিক্ষকরূপে পেয়েছিলেন নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে। প্রথমজীবনে যোগ দেন এক বিজ্ঞাপন সংস্থায়। প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বই ‘Discovery of India‘ দিয়ে। কয়েকশো প্রচ্ছদ এঁকেছেন। ছবি করতে এসে এঁকেছেন হাজার হাজার। বা হয়তো লক্ষাধিক। বেশুমার। নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর প্রত্যেক সংখ্যার জন্য ছবির পর ছবি আঁকা ছাড়াও নিজের লেখা সব বইয়ের প্রচ্ছদ ও ভেতরের ছবি এঁকেছেন। এঁকেছেন অজস্র বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতি।
অথচ তাজ্জব ব্যাপার এটাই যে, এতবড় একজন অঙ্কনশিল্পী কখনও কমার্শিয়াল আর্টের বাইরে গেলেন না! গেলে আমরা জয়নুল আবেদীন-পরিতোষ সেনের মত এক চিত্রশিল্পীকে অবশ্যই পেতে পারতাম। তাছাড়া আর্থিক দিক দিয়েও তিনি লাভবান হতেন প্রচুর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টির সমগ্রতা খুঁজে পেয়েছিলেন চিত্রাঙ্কনেও। আর সেজন্য তাঁর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা-গবেষণার পাশাপাশি তাঁর বিস্ময়কর চিত্রকর্ম নিয়েও আজ দুনিয়াজোড়া আলোচনা হয়। সত্যজিৎ নিজেকে এবং সেইসঙ্গে সারা বিশ্বের চিত্রপ্রেমিকদের হতাশ করেছেন।
নিজের ছবি ছাড়াও তিনি অন্যের ছবির চিত্রনাট্য-ও লিখেছেন। যেমন, ‘বাক্সবদল’ (কাহিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)। এ ছবির চিত্রনাট্য সত্যজিতের ও পরিচালনা নিত্যানন্দ দত্তের। মার্চেন্ট আইভরির ‘সেক্সপিয়ারওয়ালা’-র সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ রেনোয়ার ‘দ্য রিভার’ ছবির সহপরিচালক ছিলেন তিনি।
সত্যজিতের কাছ থেকে আমরা আরও একটি জিনিস পাইনি। পেলে বিশ্ববাসীর বিস্ময় নিঃসন্দেহে ফুরোতে চাইত না। সেটি হচ্ছে তাঁর অভিনয়। যে পরিচালক সত্যজিৎ এত অভিনেতা-অভিনেত্রীর কাছ থেকে অভিনয় আদায় করে নিয়েছেন, সেই তিনি যদি তাঁর নিজের বা অন্য কারও ছবিতে অভিনয় করতেন৷ ঋত্বিক ঘটককে যেমন পেয়েছি। উত্পল দত্ত এক্ষেত্রে আর এক উদাহরণ। বা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবিতে পরিচালক গৌতম ঘোষকে। পরিচালক-অভিনেতার বিস্ময়কর উদাহরণ তো রয়েছেই— চার্লি চ্যাপলিন।
তবে ‘গুগাবাবা’ ও ‘আগন্তুক’-এ তাঁর ভয়েসওভার আছে। আছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-তে তাঁর পেছন ফিরে বসা। এর বাইরে খুব একটা নয়।
সত্যজিতের বিদ্যালয়জীবন শুরু হয়েছিল ক্লাস সেভেন থেকে। তার আগে তিনি বাড়িতে মূলত মা সুপ্রভা দেবীর কাছেই পড়তেন। তাতে তাঁর বিদ্যাশিক্ষার আদৌ কোনও হানি হয়নি। অসাধারণ দখল ছিল ইংরেজিতে। The Statesman পত্রিকা থেকে Crossword puzlle খুব দ্রুত সমাধান করে ফেলতেন।
তুলনায় প্রথম দিকে বাংলায় তিনি কাঁচা ছিলেন। ‘সিগনেট প্রেস’-এর মালিক দিলীপকুমার গুপ্ত তাঁকে বেশ কিছু বাংলা বই উপহার দিয়ে সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তে বলেছিলেন। উপহার দিয়ে লিখেছিলেন : ‘‘বাংলাসাহিত্যে ক’অক্ষর গোমাংস সত্যজিৎকে’’। সত্যজিতের-ই লিখিত জবানবন্দি। এই লোক-ই কিনা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ-পরশুরামের মত লেখকদের কাহিনি নিয়ে ধ্রুপদী সব ছবি নির্মাণ করেন! নিজে বাংলায় যেসব বই লেখেন তা বেস্ট সেলার হয়! আশ্চর্য বৈ কি।
বাংলা হরফ নিয়েও আগ্রহী ছিলেন তিনি। তার প্রমাণ তাঁর হাতে তৈরি রোমান ফন্ট। এটা হচ্ছে ভারতীয় মোটিফ ও ক্যালিগ্রাফির সংমিশ্রণ। রে রোমান / রে বিজার/ ড্যাফানিস ও হলিডে স্ক্রিপ্ট এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।
বিনোদন জগতের কাউকে সাধারণত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টরেট দেয় না। চার্লি চ্যাপলিনকে সম্মানসূচক ডক্টরেট দিয়ে তারা এর ব্যতিক্রম ঘটায়। আর দ্বিতীয় ব্যতিক্রম সত্যজিৎ।
জীবনে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অস্কার। ভারতরত্ন। লিজিয়ন দ্য অনার। দেশিকোত্তম। সাহিত্যে আনন্দ ও বঙ্কিম পুরস্কার। তবে রবীন্দ্রনাথের একাধিক কাহিনির চলচ্চিত্ররূপদাতা ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্রকারের কিন্তু সাহিত্যে রবীন্দ্র পুরস্কার-ও প্রাপ্য ছিল। পাননি। প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনিমালা বা Our Films Their Films অনায়াসেই পেতে পারত।