Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

যুদ্ধপ্রস্তুতি

ভিতরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে যেন দম আটকে যাচ্ছে রুদ্রর। দোতলার এই ঘরটা খুব একটা বড় বা ছোট, তা নয়। এই লিভিংরুমের ভিতরে দাঁড়ানোর জায়গা থাকলেও কয়েকজন লোকের সমাগমে ভর্তি হয়ে গেল। ঘরের মধ্যিখানে একটি টুলের ওপর সাদা কাপড় বিছিয়ে বসানো রয়েছে একটা ছবি। বিভিন্ন রকমের ফুলের তোড়া সেই ছবি ঘিরে, যেন আগলে রেখেছে। ধুপকাঠির ধোঁয়া খুব সামান্য হলেও আস্তে আস্তে গোটা ঘর ধোঁয়াশা করে তুলল। কয়েকজন ভারতীয় দম্পতি ছবির সামনে প্রজ্জ্বলন করলেন কয়েকটা মোমবাতি। মেডিকেল ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী এবং প্রফেসরদের সমাগম বিস্তারিত; কারণ একটাই। মোমবাতির আলো ছবির প্রতিবিম্ব হয়ে জ্বলজ্বল করছে। কেউ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে, কেউ একদৃষ্টে ছবির দিকে চেয়ে।

এই ঘরের মুখোমুখি রয়েছে ব্যালকনি। বাইরে ধ্বংসস্তূপ। রুদ্র বেরিয়ে ব্যালকনির কাছে দাঁড়াল। কোথাও কেউ নেই। সবাই যেন ইতিমধ্যে পালিয়েছে নিজেদের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্যে। আশেপাশের বিল্ডিং, অ্যাপার্টমেন্ট সব কিছু ছিন্ন; গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে অসাড় হয়ে। বাইরে রোদের তীব্রতা প্রবল, কিন্তু সেই রোদে নেই কোনও প্রাণ, আলোর রেখা যেন কোথাও পৌঁছল না। দূর থেকে ম্লান দৃষ্টিতে দেখতে লাগল এই যুদ্ধের দুর্যোগ। ব্লাইন্ডগুলো নামিয়ে দিল রুদ্র, পাছে কেউ যদি সন্দেহ করে; যতটা সম্ভব এড়ানো যায় আর কী। ঘরের মধ্যে ফের তাকিয়ে ছবির সামনের ভিড়টাকে মনোযোগ দিয়ে দেখল, এদের কয়েকজনকে ছাড়া বাকিদের সে আগে কখনও দেখেনি। সোমকের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে চেনা-অচেনা সবাই তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে ছুটে এসেছে। এদের দেখলে আশ্চর্য হত বটে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়। ছবির মধ্যে একটা মৃদু হাসির ভাব; সোমক হয়তো হাসছে লোকের সমাগমে, আর হয়তো হাসছে তাঁর বন্ধুকে অতীত এবং আগামীর মধ্যে রেখে চিরকালের জন্য বিদায় নেওয়ার জন্যে।

—রুদ্র?

গলার আওয়াজ শুনে বিস্ময়ের সঙ্গে রুদ্রর চোখ পড়ল তার পাশে দাঁড়ানো যুবতীর ওপর। আজই তার সাথে প্রথম দেখা হল, ভাগ্যের খেলা এমন; যুদ্ধের টানে দুই মানুষের সাক্ষাৎ, ভেবেই লজ্জা লাগল। সোমক কত বার তার ব্যাপারে বলেছিল। একবার দেখা করবার প্রসঙ্গও উঠেছিল। ছয় মাস আগেই বিয়ে করেছিল সোমক, কলকাতায় মা-বাবা ওঁর জন্যে পাত্রী দেখে রেখেছিলেন। শেষমুহূর্তে যদি বিয়ে না করার বেগড়বাই করে বসে, সেই ভেবে ছেলেকে ডেকে তড়িঘড়ি বিয়ে দেন।

সে পাশে কখন দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি। কণ্ঠস্বর শুনে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

—অনেক ধন্যবাদ তোমায়, আসার জন্য।

—ধন্যবাদ কীসের? আমায় আসতেই হত।

একটা হালকা হাসির ভাব এসেও যেন আবার মিলিয়ে গেল প্রণতির গম্ভীর মুখে। সে বলে উঠল, সোমকের কাছে তোমার অনেক কথা শুনেছি।

—আমিও।

প্রণতির দৃষ্টিতে রয়েছে দুঃখ, প্রবল কষ্ট, আর মনে ভয়ংকর বেদনা। রুদ্র খেয়াল করে দেখল, তার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কয়েকদিন যে ঠিক করে ঘুমাতে পারেনি সেটা বেশ বোঝা গেল। অথচ প্রণতিকে দেখে মনে হল না তার এই বিষয়ে কোনও ধারণা আছে। বাইরের সংগ্রাম ও কোলাহল তার শরীরে কোনও আঁচ আনেনি, কিন্তু মনের দুর্দশা রৌদ্রহীন সূর্য ও ছিন্ন গাছের সদৃশ। এই বাস্তবের সঙ্গে জড়িয়ে কীভাবে নিজেকে সামলে রাখছে, খুব জানতে ইচ্ছে করল রুদ্রর। অবশ্য এটা নিয়ে বিশেষ কিছু প্রকাশ করল না।

—আমি জানি না এটা আমার বলা উচিত কিনা, কিন্তু কোনও অসুবিধা হলে আমি তোমার পাশে আছি। বলতে দ্বিধা বোধ করো না। কথাটা শেষ হতেই প্রণতির মুখে আবার একটা ক্ষুদ্র হাসির রেখা দেখা দিল।

—অসহায়তায় আমি কোনওদিন কারুর কাছে কিছু চাইনি। তোমার কাছ থেকে কী চাইতে পারি বলো?

একটু ভেবে, রুদ্র বলল, এই যুদ্ধ তোমার একার নয়, আমাদের সবার।

এই কথা শুনে প্রণতি তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। সেই দৃষ্টি যেন অপলক। ঘরের দিকে চেয়ে দেখল এক এক করে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এভাকুয়াতে করে সাবওয়ের অধীনে সব নাগরিকদের ঠাঁই নেওয়া নিরাপদ, ঘোষণা করেছিল রাষ্ট্রপতি। কয়েকজন চেনা লোক বাদে একে একে সব বেরিয়ে পড়ল।

রুদ্র চোখ নামাল মাটির দিকে। পাশে তাকিয়ে দেখল, প্রণতি ছবিটার দিকে চেয়ে; দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। ক্ষণিকের জন্য রুদ্রর মনে হল হাতটা বাড়িয়ে সেই জলের রেখাটা মুছে দিক। কিন্তু তার ক্ষত যেরকম স্পষ্ট, রুদ্র ততটাই ভাবশূন্য। নিজের শরীর যেন স্নিগ্ধতা ত্যাগ করেছে।

—ওদের সাথে তুমি চলে যাও, আর সতর্ক থেকো।

—আর তুমি?

—আমি আসছি। একটু ইতস্তত করে বলে উঠল রুদ্র।

প্রণতি কিছু বলল না। তার সামনে হাতজোড় করে, মাথানত করে বেরিয়ে গেল। ছবির দিকে আর তাকাল না।

***

সকাল সাড়ে দশটায় বেরিয়ে কোনও রকমে একটা ক্যাবে করে রুদ্র গেছিল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং সেদিনই পূর্বাভাস দেওয়া হয় এক হিংস্র মিলিটারি অপারেশনের। কলেজের ক্লাস নিতে গিয়ে খবর আসে রাজ্যের কিছু অংশে হয়েছে বিস্ফোরণ। রাতারাতি গোটা শহর ও দেশের রূপ পাল্টে যায় ভয়ংকর আতঙ্কে। কিছুটা আনমনা হয়ে রুদ্র ভাবতে লাগল দুদিন আগের ভোরবেলার ফোন কলটা। রাত ২টো অবধি লেখার কাজ শেষ করে শুতে শুতে প্রায় আড়াইটে-তিনটে বেজে যায়। আধ ঘণ্টাও হয়নি, বালিশের পাশে রাখা মোবাইল বেজে উঠল। প্যাট্রিসিয়া নামক এক ছাত্রী, সোমকের ফেলো জার্নালিস্ট, পুরো ঘটনা সংক্ষেপে জানায়। মিলিটারি নিউট্রালাইজ হয়ে যাওয়ার ফলে প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনী শহরের কাছাকাছি থাকার সম্ভাবনায় সোমক ও তার টিম বেরিয়ে পড়ে একটি সেফহাউসের উদ্দেশে। পুলিশরাও সঙ্গে ছিল, কিন্তু সন্দেহ হতেই শত্রুসেনা হামলা চালায় সেফহাউসের ওপর। কয়েকজন পুলিশও আহত হয়। সব শোনার পরে ফোনটা রেখে পাথর হয়ে বসেছিল রুদ্র। তারপর কী মনে হতেই উঠে মুখ ধুয়ে জামাকাপড় পরে বেরিয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে কোনও কথা বলতে পারেনি। আর আজ সেই ছবির আশেপাশের ভিড় যেন তাকে ঠেলে বের করে দিল।

ইউনিভার্সিটি থেকে টিচার’স ডরমিটরির দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। ফিরে রুদ্র ওর শার্টটা খুলে ঘরের তারে ঝুলিয়ে দিল। হাওয়াতে সেটা আস্তে আস্তে দুলছে। হাতমুখ ধুয়ে কোনও রকমে খাওয়া শেষ করে ঘরের আলো নিভিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ওর চোখে অবশ্য ঘুম নেই, মনটা যেন কীরকম ব্যতিব্যস্ত লাগছে। মাথা ঠান্ডা করতে গিয়ে সে চোখ বুজল আর অমনি যেন দেখতে পেল এক মুখশ্রী, খুবই পরিচিত, কিন্তু কোথাও যেন মনে হল, সে বেশ অসহায়। সেই ছবি আর কারও না, আজই সকালে দেখা ওর পাশে দাঁড়ানো সেই যুবতী।

একটা ছোট্ট হাসি ফুটে উঠল রুদ্রর ঠোঁটে। তৎক্ষণাৎ এই চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলে আবার বালিশে মাথা দিল। কতরকম যুদ্ধের বিষয় সে বইয়ে পড়েছে। লাভক্ষতি সব কিছু বিচার করা হয়েছে। তাহলে কি ইতিহাসের পাতায় আবারও আরেক যুদ্ধের নাম প্রকাশ হতে চলল? ফের লেখা হবে হারজিতের ব্যাপারে; ফের লেখা হবে অতিক্রমের ফলাফল। কিন্তু কেউ যুদ্ধ-কান্নার বিশ্লেষণ অক্ষর দিয়েও বর্ণনা করতে পারবে না; যুদ্ধের নেই কোনও ভাষা, সবই ছিনতাই করা মানুষের গোঙানি। মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় মর্ম, চেতনা এবং ভালবাসাকে। প্রণতির কথা ভেবে নিজেকে তার সাথে জড়ানো খুব একটা উচিত কাজ হবে না। চোখ বুজে পড়ে রইল অন্ধকার ঘরে।

***

সময় দাঁড়িয়ে আছে অর্থহীন, রাস্তাগুলো মরুভূমির আকার ধারণ করেছে। কোথাও কেউ নেই। চারিদিক খাঁ খাঁ করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্রর একটু যেন হালকা লাগল নিজেকে। আজ শনিবার, এইটুকু সে আন্দাজ করতে পারল, কারণ একটা বই ফেরত দিতে যেতে হবে লাইব্রেরি। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকজনের সম্মুখীন হওয়া, তাদের কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া সবই যেন এক কর্মের নিষ্ফলতার ইঙ্গিত। সময়ের সাথে সাংঘাতিক রকম পাল্লায় পড়লে সব মুহূর্ত যেন ক্ষণিকের মধ্যে ক্ষুদ্র হয়ে হারিয়ে যায়। কিন্তু এই সময়টাই থেকে থেকে প্রসারিত হয়ে, প্রতিটা উঁচুনীচুকে সংগঠন করে। আজ সে হাঁটছে আগামী যুদ্ধক্ষেত্রের ওপর।

কলেজের সামনে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে একবার গেটের দিকে তাকাল, যেখানে সোমক ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত। এক মুহূর্তের জন্য সেই দৃশ্য ভেসে উঠল ওর চোখে। শরীরে একটা উত্তেজনা খেলে গেল। চোখ সরিয়ে মাটির দিকে স্থির হয়ে তাকাল। তারপর অবিলম্বেই একটা সিগারেট ধরিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেল লাইব্রেরির উদ্দেশে।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে ডান দিকের বুক শেলফে কতগুলো বাংলা এবং ইংরেজি গল্প সংকলন একত্রে সাজানো। তার পাশেই হচ্ছে লাইব্রেরিয়ানের ডেস্ক। রুদ্র বইটাকে শেলফে রেখে এগিয়ে গেল ডেস্কে; পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে সেটা দেখাতেই লোকটা অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে দেখল। একটা রেজিস্টার এগিয়ে দিল সই করার জন্যে। সেটা ফেরত দিতেই রুদ্র লক্ষ্য করল ডেস্কের পিছনে শেলফের এক কোনায় ধুলো পড়া কতগুলো স্টুডেন্টস রেজিস্টার। ক্লাস ব্যাচ অনুযায়ী পর পর রাখা হয়েছিল।

—ইয়ং ম্যান! হোয়াই আর ইউ হিয়ার? লোকটা ক্ষীণ স্বরে বলে উঠল।
—টু রিটার্ন দি বুক।
—ইন দি মিডিল অব ডিস্ ক্রাইসিস?
একটু হেসে রুদ্র বলল, আই উইল কাম ব্যাক তো রিড এগেইন। টিল দেন ইট শুড বি হয়ার ইট ওয়াস।

লোকটা বেশি কিছু বলল না। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আর একটা সিগারেট ধরাল। কিছু কিছু জিনিস দেওয়া-নেওয়া করা খুব শক্ত কাজ নয়। কিন্তু দেওয়ার বদলে কী চাইছি সেটাই তো আসল বাস্তব। আর কে দেওয়া-নেওয়ার এই মীমাংসা করে? যদি ভগবান থাকেন, তাহলে কীসের বদলে প্রাণ নেন তিনি? রাস্তায় নেই কোনও ট্রাফিক, নেই গাড়ি। মনে মনে কী ভেবে আবার হাঁটতে শুরু করল, ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তার ওপার চলে গেল কোনও দিকে না তাকিয়ে।

ডরমিটরির কাছাকাছি আসতেই গেট খোলা দেখে একটু অবাক হল রুদ্র। এই সময় কে আসতে পারে? কোনও ফোর্স এলে বাড়ি অবধি হেঁটে আসা সম্ভব ছিল না, তাহলে কারা?

সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখল, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রণতি।

—তুমি এখানে!

বিদ্যুৎ বেগে একটা ভয় নেমে গেল রুদ্রর শরীর দিয়ে।

—এই জায়গাটা নিরাপদ নয়। আর একা থাকাটাও সেফ না।

—তাই বলে তুমি এখানে আসলে কী করে? বাকিরা সবাই কোথায়?

—সাবওয়েতে। একটা গোটা রাত তোমায় দেখতে না পেয়ে ওয়ার্ডেনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার ঠিকানাটা। সে আমায় আসতে দিচ্ছিল না ঠিকই, কিন্তু সোমককে হারিয়েছি, তোমার কোনও ক্ষতি হতে দিতে চাই না।

রুদ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনল, তারপর বলল, ভেতরে এসো।

ঘরে ঢুকতেই দুজনের ছায়া মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। ব্যালকনির দরজা খুলতেই আলো ঢুকে পড়ল।

রুদ্র বসল একটা মোড়ার ওপর। বাইরের হাওয়া তার ঘরে ঢুকে যেন তাকে হালকা ছুঁয়ে চলে গেল। ওর সোমকের কথা মনে পড়ল। অবাক লাগছিল, যার সাথে এত সময় কাটিয়েছে, আজ তাকে বেশি সময় দেওয়া গেল না। যার কাছে প্রাণখোলা গল্প করতে পারত, তার কাছে হঠাৎ এমনভাবে বদ্ধ অনুভব করবে, ভাবতেও পারেনি রুদ্র। বন্ধুর কথা যতই মনে করতে লাগল, সাথে সাথে প্রণতির ছবিও ভেসে উঠল। তার চুল ছিল আলখোলা, পরনে হালকা কাজ করা অফ হোয়াইট শাড়ি, ডান হাতে একটা ঘড়ি এবং গলায় শুরু চেন। কোনও সাজ ছাড়াই তাকে বেশ মানানসই লাগছিল।

—প্রণতি?

ব্যালকনির দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাল রুদ্রর দিকে।

—তুমি চলে গেলে না কেন?

খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর প্রণতি জবাব দিল, খুব কাছ থেকে মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছি আমি। কীভাবে এখনও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি নিজেও জানি না। হয়তো এরকমই হয়। আঘাত এমন বিচ্ছেদ আনে যে মন আর শরীর অসংযুক্ত হয়ে পড়ে। যদি দেশে ফিরে যাই, কার জন্য ফিরব আমি?

রুদ্রর মুখে কথা নেই; কী বলবে বুঝতে পারল না। সেও কি তাই ভেবে যায়নি? যুদ্ধ এখনও গাঢ় হয়নি, এমবেসি সব ব্যবস্থা করেই দিয়েছিল। নিজের দেশের মাটির ছোঁয়া এখন সবচেয়ে বড় পাওনা ছাড়া আর কী হতে পারে?

—তুমি রয়ে গেলে কেন? পাল্টা প্রশ্ন করল প্রণতি।

দূরে কোথাও একটা ভীষণ বিকট শব্দ ভেসে উঠল। দুজনে ঘুরে তাকাল ব্যালকনির বাইরে। আশেপাশে কিছু নেই, কিন্তু দূরে, বহু দূরে আকাশে কালো ধোঁয়ার ছোঁয়া লেগেছে। গাঢ় কালো মেঘের মত, কালবৈশাখী ঝড়ের আকাশ মনে হল। রুদ্র ও প্রণতি পাশাপাশি দাঁড়াল, বলার আর কিছু বাকি নেই, ভয়ের সংবেদন দুই পক্ষকে এক করেছে।

—এটাই কি শেষ?

ঢোঁক গিলে রুদ্র বলল, ‘এটাই শুরু।’

চিত্রণ: মুনির হোসেন
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বরিশাল শ্মশান-দীপালি

সমগ্র উপমহাদেশে বরিশাল শ্মশান একটি বিশেষ কারণে অনন্য। এই শ্মশানের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিবছর কার্তিকী অমাবস্যায়, (যাকে শাস্ত্রে ‘অশ্বযুজা’ মাস বলে) সেখানকার এই শ্মশানে যে কালীপুজো হয়, সেখানকার পুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশীর রাতে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য, ওখানে যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সমগ্র শ্মশান জুড়ে কয়েক হাজার মঠ বা স্মৃতিসৌধ আছে, মুসলমানদের যেমন আছে বনানী বা অন্য বহু গোরস্তানে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বৌদ্ধসম্প্রদায়ের প্রবারণা ও কঠিন চীবরদান উৎসব

বিশ্বের বহু দেশেই এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। স্পেন ও ফ্রান্স-সহ ইয়োরোপীয় দেশে চীনা, জাপানি, বাঙালি বৌদ্ধরা পালন করেন যেমন, তেমনই বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে কুয়াকাটা-কলাপাড়া এই উৎসবে মেতে ওঠে। ইওরোপীয়দের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকবছর আগে দালাই লামা যেবার শিলিগুড়িতে তাঁর বার্ষিক অনুষ্ঠান করলেন, সেবার প্যারিস থেকে আগত বেশ কিছু ফরাসির সঙ্গে আলাপ হয়, যাঁরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। তাঁদের কাছেই শুনেছিলাম, ফ্রান্সে বহু মানুষ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেন।

Read More »
শায়ক মুখোপাধ্যায়

শায়ক মুখোপাধ্যায়ের দুটি কবিতা

যাদের কাছে আজকে তুমি পৌঁছে গেছ,/ সবাই কিন্তু আয়নার মতো এখানে/ এখনও পুরো ফিরে আসতে পারেনি;// আয়না হয়ে কেউ আবার ফেরে নাকি!/ হয়তো কেউ কেউ বা কাছে ফিরে আসে;// সূর্যের রং হরিদ্রাভ কুসুম আলো/ শেষ আশ্রয় হৃদয়শূন্য হয়ে গেলে,/ যারা তবুও মনে করে রক্তের গন্ধ/ আজ শিরায় শিরায় নতুন যাদের/ ফিরে আসা এখানে অথবা যেখানেই দূরে হোক,// সে সবের প্রয়োজন সমস্তটাই ফুরিয়ে গেছে।

Read More »