ভারত-পাকিস্তান বর্ডার ওয়াঘায় ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের। কিন্তু যখন যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছিলাম, তখন ভারত পাকিস্তানের মাটিতে একটা ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ করে দিয়েছে। কিন্তু তা বলে তো আর ঘুরতে যাওয়া বাতিল করা যায় না! দুর্গাপুজোর অষ্টমীর সকালে বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিলাম বাগডোগরার উদ্দেশে। পরের দিন সকালে আমাদের ফ্লাইট। কিন্তু বাগডোগরা থেকে আমাদের দিল্লি যাওয়ার বেসরকারি উড়ানে এতটাই লেট করেছিল যে, দিল্লি থেকে অমৃতসর যাওয়ার কানেক্টিং ফ্লাইট মিস হওয়ায় উপক্রম হয়েছিল। প্লেনের অন্যান্য সহযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম, ভুলটা আমারই হয়েছিল। এক কোম্পানির ফ্লাইটে টিকিট করলে সেই ফ্লাইট আমাদের জন্য দিল্লি এরারপোর্টে অপেক্ষা করত। কিন্তু আমার পরিবারের তিনটি টিকিটই ছিল অন্য কোম্পানির ফ্লাইটে।
যাইহোক, দিল্লি যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে অমৃতসরের ফ্লাইট উড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। রীতিমত দৌড়ে গিয়ে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে শুনলাম, অমৃতসরে ফ্লাইটও লেট। এর আগে দৌড়ে ট্রেন, বাস ধরার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু দৌড়ে ফ্লাইট ধরার অভিজ্ঞতা সেবার প্রথম হল। বিভিন্ন কাজের সূত্রে বেশ কয়েকবার দিল্লি যাওয়ার দরুন দিল্লি এয়ারপোর্টের মোটামুটি সবই চিনতাম। তবে যখন বোর্ডিং পাস নিয়ে লাউঞ্জ পেরিয়ে গেলাম, ততক্ষণে অমৃতসরের ফ্লাইটের যাত্রীদের লাইন শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে একটা লাভ হয়েছিল, অনেক বেশি টাকা দিয়ে ফ্লাইটের যে সিট বুক করতে হয়, আমরা দেরি করায় আমাদের ভাগ্যে জুটেছিল সেই দামি সিটগুলো।
অমৃতসরের আকাশ থেকেই দেখতে পেলাম স্বর্ণমন্দির। এয়ারপোর্টে নেমে বাইরে থেকে পোস্টপেড ট্যাক্সিতে শহরের হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নীচে নেমে দেখা পেলাম এক বাঙালি টুরিস্ট পরিবারের। তারা জানালেন, ওয়াঘা থেকে ফিরেছেন এবং সার্জিকাল স্ট্রাইকের পরে সেই দিনই প্রথম ওয়াঘার বিখ্যাত প্যারেড শুরু হয়েছে। মনটা আনন্দে নেচে উঠল। সেই সন্ধেতে আমরা গেলাম স্বর্ণমন্দিরে। রাতের আলোতে স্বর্ণমন্দিরের আলাদা সৌন্দর্য।
আমাদের লক্ষ্য ছিল, মূলত আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত। স্বর্ণমন্দিরের বিখ্যাত লঙ্গরখানায় প্রসাদ খেয়ে হোটেলে ফিরে পরের দিন সকালে অমৃতসর শহর ঘুরে গেলাম কুখ্যাত সেই জালিয়ানওয়ালাবাগে। যেখানে একশো বছর আগে ব্রিটিশ সরকার নির্বিচারে গুলি করে প্রচুর ভারতীয়কে হত্যা করেছিল। সেই পুরানো বাড়িগুলো এখনও রয়েছে। রয়েছে সেই ব্রিটিশ সৈনিকদের গুলির চিহ্নও। সাদা দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা রয়েছে। রয়েছে সেই কুয়ো। যেখানে ব্রিটিশ সৈন্যের গুলি থেকে প্রাণে বাঁচতে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের পরেই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। জালিওয়ানাবাগের মিউজিয়ামে রাখা রয়েছে কবিগুরুর সেই চিঠির অনুলিপি। ছবি দিয়ে বোঝানো হয়েছে, সেই হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিক ঘটনা। সব দেখতে দেখতে মনটা কেমন ভারি হয়ে উঠেছিল। প্রায় ঘণ্টাদেড়েক জালিওয়ানাবাগে কাটিয়ে রওনা দিলাম পাকিস্তান সীমান্ত ওয়াঘার উদ্দেশে।
পথে পাঞ্জাবের গ্রাম দুচোখভরে দেখলাম। রাস্তায় এক ধাবার দুপুরের খাবার ‘সরষো কা সাগ’ আর ‘মকইয়ের রুটি’ খেলাম। সঙ্গে চিল্ড বিয়ার। ওয়াঘার অনেক আগেই আমাদের গাড়ি থেকে নেমে যেতে হল। সার্জিকাল স্ট্রাইক হওয়ার কারণে পথে অসম্ভব রকম কড়া চেকিং হল। প্রায় পাঁচবার চেকিং পেরিয়ে যখন দুই দেশের সীমান্তের কাছে পৌঁছলাম, তখনও সীমান্তে অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। ওয়াঘার বিখ্যাত হল সেখানকার প্যারেড এবং দুই দেশের সীমান্তের পতাকা নামানোর অনুষ্ঠান। সেসময় ভারত এবং পাকিস্তান— দুই দেশেরই সীমান্তের দরজা খুলে দেওয়া হয়। যাইহোক, অক্টোবর মাসে রোদে প্রচণ্ড কষ্ট করেই বসে রইলাম অনুষ্ঠান দেখার জন্য।
বিকাল পাঁচটা নাগাদ শুরু হল ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাচ, গান সহ দেশাত্মবোধক নানা অনুষ্ঠান। আমরাও সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিলাম। বেশ মজা হল। সবশেষে শুরু হল প্যারেড। আমাদের জাতীয় পতাকাকে কীভাবে সন্মান জানানো হয়, সেখানেই প্রথম দেখলাম। যখন দুদেশের সীমান্তের দরজা খুলে গেল, দেখতে পেলাম পাকিস্তানের অনেক লোক আমাদের মতই ওই দেশের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছেন। পাকিস্তানের এলাকায় রয়েছে মহম্মদ জিন্নার বিশাল আকারের ছবি। নির্দিষ্ট সময়ে দুই দেশের পতাকা নামানো হল। দেশাত্মবোধের আবেগে কেমন আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। গলা ছেড়ে সকলের সঙ্গে চিৎকার করেছিলাম ‘বন্দেমাতরম’। রোদের গরম, কষ্ট সবই ততক্ষণে ভুলে গিয়েছি।
যখন অনুষ্ঠান শেষ হল, আবার ফিরে এসেছিলাম অমৃতসরে। পরের দিন অন্য রাজ্যে হিমাচল প্রদেশের খাজ্জার যাওয়ার কথা। সেটা আবার হিন্দি ফিল্মের বিখ্যাত শুটিং লোকেশনে। দিলীপ কুমার, শাম্মি কাপুর, অমিতাভ বচ্চন থেকে ইদানীংকালের কিং খান পর্যন্ত, সবাই কোনও না কোনও ফিল্ম সেখানে শুটিং করেছেন। কেউবা একাধিক ফিল্ম। সেকথা অন্য, কখনও আবার বলা যাবে। আপাতত ওয়াঘার গল্প এখানেই শেষ করছি।