Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে

ভারত-পাকিস্তান বর্ডার ওয়াঘায় ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের। কিন্তু যখন যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছিলাম, তখন ভারত পাকিস্তানের মাটিতে একটা ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ করে দিয়েছে। কিন্তু তা বলে তো আর ঘুরতে যাওয়া বাতিল করা যায় না! দুর্গাপুজোর অষ্টমীর সকালে বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিলাম বাগডোগরার উদ্দেশে। পরের দিন সকালে আমাদের ফ্লাইট। কিন্তু বাগডোগরা থেকে আমাদের দিল্লি যাওয়ার বেসরকারি উড়ানে এতটাই লেট করেছিল যে, দিল্লি থেকে অমৃতসর যাওয়ার কানেক্টিং ফ্লাইট মিস হওয়ায় উপক্রম হয়েছিল। প্লেনের অন্যান্য সহযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম, ভুলটা আমারই হয়েছিল। এক কোম্পানির ফ্লাইটে টিকিট করলে সেই ফ্লাইট আমাদের জন্য দিল্লি এরারপোর্টে অপেক্ষা করত। কিন্তু আমার পরিবারের তিনটি টিকিটই ছিল অন্য কোম্পানির ফ্লাইটে।

যাইহোক, দিল্লি যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে অমৃতসরের ফ্লাইট উড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। রীতিমত দৌড়ে গিয়ে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে শুনলাম, অমৃতসরে ফ্লাইটও লেট। এর আগে দৌড়ে ট্রেন, বাস ধরার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু দৌড়ে ফ্লাইট ধরার অভিজ্ঞতা সেবার প্রথম হল। বিভিন্ন কাজের সূত্রে বেশ কয়েকবার দিল্লি যাওয়ার দরুন দিল্লি এয়ারপোর্টের মোটামুটি সবই চিনতাম। তবে যখন বোর্ডিং পাস নিয়ে লাউঞ্জ পেরিয়ে গেলাম, ততক্ষণে অমৃতসরের ফ্লাইটের যাত্রীদের লাইন শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে একটা লাভ হয়েছিল, অনেক বেশি টাকা দিয়ে ফ্লাইটের যে সিট বুক করতে হয়, আমরা দেরি করায় আমাদের ভাগ্যে জুটেছিল সেই দামি সিটগুলো।

অমৃতসরের আকাশ থেকেই দেখতে পেলাম স্বর্ণমন্দির। এয়ারপোর্টে নেমে বাইরে থেকে পোস্টপেড ট্যাক্সিতে শহরের হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নীচে নেমে দেখা পেলাম এক বাঙালি টুরিস্ট পরিবারের। তারা জানালেন, ওয়াঘা থেকে ফিরেছেন এবং সার্জিকাল স্ট্রাইকের পরে সেই দিনই প্রথম ওয়াঘার বিখ্যাত প্যারেড শুরু হয়েছে। মনটা আনন্দে নেচে উঠল। সেই সন্ধেতে আমরা গেলাম স্বর্ণমন্দিরে। রাতের আলোতে স্বর্ণমন্দিরের আলাদা সৌন্দর্য।

আমাদের লক্ষ্য ছিল, মূলত আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত। স্বর্ণমন্দিরের বিখ্যাত লঙ্গরখানায় প্রসাদ খেয়ে হোটেলে ফিরে পরের দিন সকালে অমৃতসর শহর ঘুরে গেলাম কুখ্যাত সেই জালিয়ানওয়ালাবাগে। যেখানে একশো বছর আগে ব্রিটিশ সরকার নির্বিচারে গুলি করে প্রচুর ভারতীয়কে হত্যা করেছিল। সেই পুরানো বাড়িগুলো এখনও রয়েছে। রয়েছে সেই ব্রিটিশ সৈনিকদের গুলির চিহ্নও। সাদা দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা রয়েছে। রয়েছে সেই কুয়ো। যেখানে ব্রিটিশ সৈন্যের গুলি থেকে প্রাণে বাঁচতে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের পরেই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। জালিওয়ানাবাগের মিউজিয়ামে রাখা রয়েছে কবিগুরুর সেই চিঠির অনুলিপি। ছবি দিয়ে বোঝানো হয়েছে, সেই হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিক ঘটনা। সব দেখতে দেখতে মনটা কেমন ভারি হয়ে উঠেছিল। প্রায় ঘণ্টাদেড়েক জালিওয়ানাবাগে কাটিয়ে রওনা দিলাম পাকিস্তান সীমান্ত ওয়াঘার উদ্দেশে।

আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে।

পথে পাঞ্জাবের গ্রাম দুচোখভরে দেখলাম। রাস্তায় এক ধাবার দুপুরের খাবার ‘সরষো কা সাগ’ আর ‘মকইয়ের রুটি’ খেলাম। সঙ্গে চিল্ড বিয়ার। ওয়াঘার অনেক আগেই আমাদের গাড়ি থেকে নেমে যেতে হল। সার্জিকাল স্ট্রাইক হওয়ার কারণে পথে অসম্ভব রকম কড়া চেকিং হল। প্রায় পাঁচবার চেকিং পেরিয়ে যখন দুই দেশের সীমান্তের কাছে পৌঁছলাম, তখনও সীমান্তে অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। ওয়াঘার বিখ্যাত হল সেখানকার প্যারেড এবং দুই দেশের সীমান্তের পতাকা নামানোর অনুষ্ঠান। সেসময় ভারত এবং পাকিস্তান— দুই দেশেরই সীমান্তের দরজা খুলে দেওয়া হয়। যাইহোক, অক্টোবর মাসে রোদে প্রচণ্ড কষ্ট করেই বসে রইলাম অনুষ্ঠান দেখার জন্য।

বিকাল পাঁচটা নাগাদ শুরু হল ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাচ, গান সহ দেশাত্মবোধক নানা অনুষ্ঠান। আমরাও সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিলাম। বেশ মজা হল। সবশেষে শুরু হল প্যারেড। আমাদের জাতীয় পতাকাকে কীভাবে সন্মান জানানো হয়, সেখানেই প্রথম দেখলাম। যখন দুদেশের সীমান্তের দরজা খুলে গেল, দেখতে পেলাম পাকিস্তানের অনেক লোক আমাদের মতই ওই দেশের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছেন। পাকিস্তানের এলাকায় রয়েছে মহম্মদ জিন্নার বিশাল আকারের ছবি। নির্দিষ্ট সময়ে দুই দেশের পতাকা নামানো হল। দেশাত্মবোধের আবেগে কেমন আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। গলা ছেড়ে সকলের সঙ্গে চিৎকার করেছিলাম ‘বন্দেমাতরম’। রোদের গরম, কষ্ট সবই ততক্ষণে ভুলে গিয়েছি।

আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে।

যখন অনুষ্ঠান শেষ হল, আবার ফিরে এসেছিলাম অমৃতসরে। পরের দিন অন্য রাজ্যে হিমাচল প্রদেশের খাজ্জার যাওয়ার কথা। সেটা আবার হিন্দি ফিল্মের বিখ্যাত শুটিং লোকেশনে। দিলীপ কুমার, শাম্মি কাপুর, অমিতাভ বচ্চন থেকে ইদানীংকালের কিং খান পর্যন্ত, সবাই কোনও না কোনও ফিল্ম সেখানে শুটিং করেছেন। কেউবা একাধিক ফিল্ম। সেকথা অন্য, কখনও আবার বলা যাবে। আপাতত ওয়াঘার গল্প এখানেই শেষ করছি।

চিত্র: গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »