স্বামী বিবেকানন্দ (১২.০১.১৮৬৩-০৪.০৭.১৯০২) একজন ভারতীয় বৈদান্তিক সন্ন্যাসী। তাঁর অসংখ্য পরিচয়ের মধ্যে একটি হল, ভূপর্যটকরূপে বিশ্বের ব্যাপক অংশ ভ্রমণ করা। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, রাওয়ালপিন্ডি থেকে আসাম রাজ্য, সমগ্র নিজ দেশ পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন। দু-দু’বার আমেরিকা গেছেন, চীন ও জাপান গেছেন, ইওরোপের বহু দেশ দেখেছেন। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটা ঘোরা হয়েছিল তাঁর, মাত্র উনচল্লিশ বছরের আয়ুষ্কালে। রামমোহন-দ্বারকানাথ-রবীন্দ্রনাথ-কেশবচন্দ্র সেন-শিবনাথ শাস্ত্রীরাও গিয়েছেন। তবে তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের। সনাতনপন্থীদের ধর্মীয় যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেই বিধানকে যে তিনি মানেননি, এটাও তাঁর একটা সংস্কারহীনতা ও প্রগতিশীলতা।
আশ্চর্যের কথা, এহেন বিবেকানন্দের কিন্তু দীর্ঘদিন পূর্ববঙ্গ বা ঢাকায় আসা হয়নি, যদিও একাধিক লোককে তিনি ঢাকায় আসার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য সাধু নাগ মহাশয়ের কাছেও তিনি প্রতিশ্রুত ছিলেন, তাঁর জন্মভূমি ঢাকায় তিনি যাবেন। গেলেন যখন, তখন নাগ মহাশয় আর জীবিত নেই।
ঢাকা দীর্ঘদিন ধরেই বাঙালি তথা সমগ্র উপমহাদেশের কাছেই তার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ঐতিহ্য আর রাজকীয়তার জন্য অতিখ্যাত। বাঙালি মনীষীদের কেউ-ই তাই ঢাকায় আসেননি, এমনটা হয়নি, তা সে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎচন্দ্রই হোন, বা গান্ধী-সুভাষচন্দ্র-ফজলুল হক। এসেছেন, সংবর্ধিত হয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের ঢাকায় আগমন ও দু’সপ্তাহের মতো এখানে অবস্থান নিয়ে নানান জনের নানান লেখা রয়েছে, যার ফলে তাঁর ঢাকা-বাসের তথ্য বিস্তৃতভাবে উঠে আসে।এগুলোর মধ্যে রয়েছে মন্মথ গাঙ্গুলীর স্মৃতিকথা, আইনজীবী সতীশচন্দ্র রায়ের লেখা, বিপ্লবী বীর ও পরবর্তীকালে ‘অনুশীলন সমিতি’-র হোতা হেমচন্দ্র ঘোষের বর্ণনা, তৎকালীন ‘ঢাকাপ্রকাশ’ পত্রিকায় স্বামীজি-সংক্রান্ত খবরাখবর। তাছাড়া স্বামীজি এসময় ওলি বুলকে (১৮৫০-১৯১১, পুরো নাম সারা চ্যাপম্যান থর্প বুল। একাধারে স্বামীজির ‘ধীরা মাতা’ এবং শিষ্যা। তাঁর স্বামী নরওয়েজীয় বিশ্বখ্যাত পিয়ানোবাদক ওলি বুল।) লেখা চিঠিতে। মেরী হলকে লেখা তাঁর চিঠিতে আছে পূর্ববঙ্গ দর্শন নিয়ে তাঁর মুগ্ধতা ও উচ্ছ্বাস।
পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের বর্তমান মঠাধ্যক্ষ স্বামী সম্পূর্ণানন্দজি হেমচন্দ্র ঘোষের সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, যেখানে স্বামীজির ঢাকায় অবস্থানের দিনগুলির কথা বিশদভাবে উঠে এসেছে। সম্পূর্ণানন্দজিই বর্তমানে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, যিনি ঢাকায় অবস্থিত স্বামীজির নিত্য পার্শ্বচর হেমচন্দ্র ঘোষকে দেখেছেন, ও তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচ দিন কথা বলে স্বামী বিবেকানন্দের ঢাকা-বাসের দিনগুলি সম্পর্কে অনুপুঙ্খ জেনে নিয়েছিলেন। তাঁর নেওয়া এই সাক্ষাৎকার ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ধারাবাহিক পাঁচটি পর্বে প্রকাশিত হয়েছিল।
স্বামীজি ১৯০১-এর ১৮-ই মার্চ তারিখে বেলুড় মঠ থেকে ন’জন রামকৃষ্ণভক্ত সহ ট্রেনে ওঠেন। পরদিন সকালে গোয়ালন্দ পৌঁছে স্টিমারযোগে নারায়ণগঞ্জে যান। সেখান থেকে ট্রেনে ঢাকায় আসেন। এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু মাকে ঢাকেশ্বরী তীর্থ দর্শন করানো। অতএব মা-ও এসেছিলেন। আর আসেন স্বামীজির বোন, ও মায়ের কয়েকজন সখী।
স্বামীজি তখন সারা দেশেই জননন্দিত এক তেজস্বী পুরুষ। তাই তাঁর ঢাকায় আগমন জনমানসে সাড়া ফেলে দিল। তিনি ঢাকার বিখ্যাত জমিদার মোহিনীমোহন দাসের ফরাসগঞ্জের বাড়িতে সতেরো দিন ছিলেন। গোয়ালন্দ থেকে পদ্মা দেখতে দেখতে আসা তাঁর। মন্মথ গাঙ্গুলীর স্মৃতিকথায় পাই, এক টাকা দিয়ে ষোলোটি ইলিশমাছ কেনা হল সেখানে। স্টিমার থামিয়ে নিকটস্থ গ্রাম থেকে যোগাড় করা হল চাল আর পুঁইশাক। স্বামী নিত্যানন্দ ও অন্য ভক্তরা তো ছিলেনই, মাঝিমাল্লা ও খালাসি-সহ সবাইকে নিয়ে আহার করলেন তিনি।
স্বামীজিকে দেখতে, তাঁর সঙ্গ পেতে প্রতিদিনই বহু মানুষ আসতেন জমিদারবাড়িতে। তাঁদের মধ্যে হেমচন্দ্র ঘোষ ও দেবেন্দ্রনাথ রায় অন্যতম। দেবেন্দ্রনাথের অনুরোধে স্বামীজি তাঁকে গান গেয়েও শুনিয়েছিলেন।
ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।
এর আগেই তিনি মাকে নিয়ে যান লাঙ্গলবন্দ। ঢাকার অদূরে ব্রহ্মপুত্রের পারে এটি হিন্দুদের একটি তীর্থক্ষেত্র। কথিত আছে, মাতৃহত্যাজনিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দশ অবতারের অন্যতম পরশুরাম এখানে স্নান করে শুদ্ধ ও পাপমুক্ত হন। সাতাশে মার্চ স্বামীজি এখানে ‘বুধাষ্টমী’ তিথিতে ব্রহ্মপুত্রে অবগাহন করেন।
জগন্নাথ কলেজে বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি যে কথা বলেন, তাতে বাংলাদেশের শোভা যে এই সন্ন্যাসীর মন হরণ করেছে, তা বোঝা যায়, ‘নানাদেশ ভ্রমণ করে এই লাভ হয়েছে যে, আমি বাংলার সৌন্দর্য বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পারছি।’
স্বামীজির ঢাকা আসার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঢাকায় অদূরে দেবভোগ গ্রামে সাধু নাগ মহাশয়ের গৃহে যাওয়া। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য ইনি, দুর্গাচরণ নাগ। বহুবার দক্ষিণেশ্বরে গেছেন, গেছেন বেলুড়ে। শ্রীরামকৃষ্ণের চেয়ে দশবছরের ছোট, এবং স্বামীজির চেয়ে সতেরো বছরের বড়, প্রয়াত হন ১৯৯৯-তে। প্রয়াণের আগের বছরেও দ্বিতীয়া স্ত্রী (প্রথমা স্ত্রী প্রসন্নকুমারী অকালমৃতা) শরৎকামিনীকে নিয়ে বেলুড় মঠে ঘুরে এসেছেন। ২৫-এ মার্চ তাই তিনি দেবভোগ গেলেন। তাঁকে রান্না করে খাওয়ালেন শরৎকামিনী। সেখানে বহুদিন পর সুখনিদ্রা হয়েছিল স্বামীজির, জানিয়েছেন নিজে। আসার সময় নাগ-মহিষী তাঁকে যে কাপড় উপহার দিয়েছিলেন, পাগড়ি করে তা পরেন স্বামীজি।
স্বামীজি ঢাকার মানুষজনকে যে তীক্ষ্ণভাবে অবলোকন করেছিলেন, তার প্রমাণ পাই ‘স্বামীশিষ্যসংবাদ’-এ বর্ণিত লেখা থেকে। লেখক শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর দেশ পূর্ববঙ্গ বলে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ঢাকার মানুষদের ঠিক কেমন দেখলেন স্বামীজি? স্বামীজির উত্তর, ‘আমাদের এদিকের চেয়ে লোকগুলো কিছু মজবুত ও কর্মঠ। তার কারণ বোধ হয় মাছ মাংসটা খুব খায়। যা করে খুব গোঁয়ে করে।’ এরপর সেখানকার মানুষের রান্নাবান্নায় অতিরিক্ত তেল দেওয়া ও তার ক্ষতিকরতা নিয়েও বলেছেন তিনি, ‘খাওয়াদাওয়াতে খুব তেল চর্বি দেয়, ওটা ভালো নয়। তেল চর্বি বেশি খেলে শরীরে মেদ জন্মায়’।
এখানে উল্লেখ্য, স্বামীজি ঢাকায় পৌঁছতে তাঁকে সম্বর্ধনা দেন আইনজীবী ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষ ও গণেশচন্দ্র ঘোষ। আর নারায়ণগঞ্জে তাঁকে সম্বর্ধনা দেয় ‘ঢাকা অভ্যর্থনা সমিতি’। তাঁর ঢাকার দিনগুলো নিয়ে ‘ঢাকাপ্রকাশ’ লেখে, ‘পূজ্যপাদ পরমহংস দেবের প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দকে দেখিবার জন্য অনেকেই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মোহিনীবাবুর বাড়িতে যাতায়াত করিতে লাগিলেন।’
পূর্ববঙ্গের নদীর বিশালতা ও মাধুর্য স্বভাবতই ঢাকা ঘুরে আসার বেশ কিছুদিন পর্যন্ত যে তাঁর মনে গেঁথে ছিল এবং তাঁকে মুগ্ধ না করে পারেনি, তার প্রমাণ পাই এই ভ্রমণের তিনমাস বাদে ৫.৭.১৯০১-এ শ্রীমতী মেরী হলকে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে, ‘তুমি জানো, আমার এই দেশকে বলা হয় জলের দেশ। কিন্তু তার তাৎপর্য পূর্বে কখনো এমনভাবে উপলব্ধি করিনি। পূর্ব বাংলার নদীগুলি যেন তরঙ্গসঙ্কুল স্বচ্ছ জলের সমুদ্র, নদী মোটেই নয় (স্বামীজি সমুদ্র বড় কম দেখেননি!) এবং সেগুলি এতো দীর্ঘ যে স্টিমার সপ্তাহের পর সপ্তাহ এদের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে।’
হায়, তবুও তো তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো বছরের পর বছর পূর্ববাংলার নদীর পর নদী দেখেননি!
প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৮ ও ১৯২৬, এই দুবার ঢাকা আসেন। প্রথমবার বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে। নজরুল আসেন ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’। জীবনানন্দ নিজ বিবাহোপলক্ষ্যে। ঢাকার ব্রাহ্মমন্দিরে বিয়ে হয় তাঁর। স্বামীজির ঢাকা ভ্রমণের সারাৎসার সম্ভবত এই, তিনি এখানে এসে উপলব্ধি করেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে আরও দৃঢ় ভ্রাতৃত্ববন্ধন আবশ্যক।
তাঁর ঢাকায় পদার্পণের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। তার আগে ২০২৩-এ ৭৪, বি. কে. দাস রোডের যে বাড়িতে স্বামীজি থেকেছেন, সেখানে তাঁর স্মৃতিচিহ্নিত একটি ফলক উন্মোচিত হয়েছে। সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিরূপে যোগ দিয়ে স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজি বলেন, ‘ঢাকা কেন্দ্র’-র মতো একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আছে, যারা স্বামী বিবেকানন্দের বসতধন্য একটি বাড়িকে পরিচয় করানোর ব্রত নিয়েছেন। এটি আমাদের কাছে আনন্দের ও গর্বের।
‘ঢাকা কেন্দ্র’-পরিচালক ও সে-অনুষ্ঠানের সভাপতি মোহাম্মদ আজিম বখশ বলেন, ‘স্বামী বিবেকানন্দের ঢাকায় আগমন ঢাকার ইতিহাসকে মহিমান্বিত ও সমৃদ্ধ করেছে। ঢাকার ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ যেসব ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছিল তা পুনরুজ্জীবিত করতে ঢাকা কেন্দ্র সচেষ্ট থাকবে’। এবছরটাই তো তার সুলগন হতে পারে!