বাবা এসেছে। মুখে বিকেল-সন্ধে আলো মেখে পর্দা ওড়া দেখছে। দূরের মাঠে বল পড়েছে। ছেলেদের উল্লাস-শব্দ ভেসে আসে। ঘরে মশার বিনবিন শব্দ। পায়ের কড়ার দিকে তাকিয়ে তার মাঝে চুপ করে বসে আছে বাবা। একবার মুখ তুলে বলল, ‘হ্যাঁ রে, পূরবী হলটা কি সত্যিই ভাঙা পড়ল?’
আমার অভাবের সংসার। বাবারও অভাবের সংসার। ইদানীং যখনতখন চলে আসে। দুধ-চা করে দিই। ডিশে ফেলে ঠান্ডা করে সুড়ুৎ সুড়ুৎ খায়। ঘণ্টাখানেক বসে। একটা-দুটো প্রশ্ন করে উঠে চলে যায়। প্রতিদিনের এই যাওয়া-আসার ধকল গায়ে মাখে না। আমি বিরক্ত হই।
বাবাকে অপছন্দ করি। বাবাও আমাকে অপছন্দ করে। ঘৃণার দুই প্রান্ত মিলে এক সেতু তৈরি করেছে। আমরা মানিয়ে নিয়েছি।
ঘৃণার সূত্রপাত অনেক বছর আগে। আমি ধূলিকণার মতো ভাসমান। বাবা আড্ডা দিত পূরবী সিনেমাহলের সামনে। অপছন্দের পরিসর তৈরি হল তখন থেকে।
আমার মা ছিল সুন্দরী। বিদুষী। সেকালে ডান হাতে ঘড়ি পরা টিপটপ শাড়ি গোছের মেয়ে। বাবা ছিল রকবাজ ও রগচটা। এহেন দু’জনের প্রেম হল। এক্কেবারে আকুলিবিকুলি প্রেম। এবেলায় যদি ‘জীবনেও তোমার মুখ দেখব না’, ওবেলায় তবে ঘরের সামনে ধর্না দেওয়া। একটা উল্টোপাল্টা প্রেমের পরে আর-একটা উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নিল তারা। বিয়ে করল। বাবার ছবি বিশ্বাস টাইপ শ্বশুর মানলেন না। উত্তর কলকাতা ছেড়ে তারা চলে এল এক প্রচুর আলো হাওয়ার গঞ্জে। আমি জন্মালাম সেই রোদ-হাওয়ার গঞ্জে।
ঘৃণার সূত্রপাত সেখান থেকে। জন্মের দিনে আমি বাবা নামের লোকটাকে চিনতে পারলাম না। প্রসবের সময়ে বাইরে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল বাবা। বেসরকারি হাসপাতালের করিডরের এক কোণে একটা টুলে বসে আসন্ন পুত্রসন্তানের ভাবনা ও স্বপ্নে ঢুলছিল লোকটা। বয়ঃসন্ধির লক্কা গোছের শ্যালক এসে জানাল, ‘সমীরদা ওঠো। মেয়ে হয়েছে। ওঠো ওঠো।’
বাবা উঠল। উঠে হাসপাতালের বাইরে চলে গেল। সারাদিন সারারাত আর ফিরল না। আমাকে দেখতে না চেয়ে সেদিন বৃষ্টিতে পথে পথে ঘুরেছিল বাবা।
হাওয়া গঞ্জে রেললাইনের ধারে ছোট্ট ভাড়াবাড়িটায় জীবন শুরু হল। আমার আর বাবার। সুন্দরী বিদুষী মা অসুস্থ। আমাকে কোলে নিতে পারে না। হাজারো বাধা। উপরোধে ঢেঁকি গেলার অবস্থায় বাবা এগিয়ে এল। কোলে নেওয়া, দেখে রাখা, স্নান করানো, জামা পাল্টানো শুরু হল। আমি বাবার কাছে বড় হতে শুরু করলাম।
তখন আমাদের আলো হাওয়া গঞ্জে প্রচুর সুখ। সকালের রোদে, বিকেলের বাতাসে, রাতের তারায় ঘরের ভিতরকার অন্ধকার বোঝা যেত না। বাবা পথে পথে ঘুরত। একটু বড় হতে আমাকে নিয়ে যেখানে-সেখানে এলোমেলো হাঁটত। অসুস্থ মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙছিল।
যেকোনও সম্পর্ক ভাঙার আগে অনেকগুলি ট্রায়াল চলে। ভাঙে, গড়ে, গড়ে, ভাঙে, জোড়া লাগে, আবার ভাঙে। এমন চলতে চলতে শেষে সত্যি ভাঙে। এই পর্বগুলির মাঝে জোড়া লাগার দিনগুলিতে আমরা বেড়াতে যেতাম। রবিবারের বিকেল, মা সাজিয়ে দিত। নিজে সাজত। তারপর হেঁটে নয়, রিকশায় রেলস্টেশন। রেলে চড়ে কলকাতা। সম্পর্ক জোড়ার দিনে রিকশার বিলাসিতাটুকু ওদের গায়ে লাগত না।
আমাকে ভিক্টোরিয়ার মাঠে ছেড়ে দেওয়া হত। আমি ঘাসের ওপর খেলতাম, জামা ময়লা করতাম, ঘাসের সুড়সুড়ি লেগে আপনমনে হাসতাম। দূরে বসে থাকত বাবা-মা। তাদের কত দরকারি কথা, অদরকারি কথা, মুখে আঁচলচাপা হাসি। চিলচিৎকার, মারধোর, গালিগালাজ, দোষারোপের পরে ওরা আঠা দিয়ে ছেঁড়া সম্পর্ক জুড়ত। আমি বুঝতাম, এখন ওদিকে যেতে নেই।
আমার সুন্দর মা একটা চাকরি জোটাল। ভাল চাকরি। বাবার মতো ডালডা কারখানার শ্রমিক নয়। ঘরে অভাব মরল। আমি কি আর অভাব বুঝতাম ছাই! পর্দার রং পাল্টানো, নতুন নতুন ফুলদানি, নিত্যনতুন বিছানার চাদর, শখের বাসন, বিকেলের খিদেয় দুধের আতিশয্যে বুঝলাম অভাব মরছে। জীবনকে ভালবাসতে শুরু করলাম।
মা অনেকটা দূরে। কলকাতা উজিয়ে ফিরতে দেরি হত। বাবা যেত নদীর পাড়ের কারখানায়। তাড়াতাড়ি ফিরত বটে, কিন্তু আলো-হাওয়া গঞ্জে বাবার কোনও বন্ধু ছিল না। এলাকার মানুষজন পূরবী সিনেমাহলের মানুষের মতো নয়। তারা চুপ করে থাকে, রাগী মানুষদের এড়িয়ে যায়, রগচটা মানুষদের সহ্য করতে পারে না, আড়ালে নিন্দায় সুখ পায়। বাবা একটাও বন্ধু বানাতে পারল না। আমার বন্ধুহীন ব্যর্থ বাবা ঘরে ফিরে দু’কামরার জীবনে মন বসাতে পারত না। একা একা হাঁটত। হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর যেত। রেললাইন, নদীর পাড়, হাইওয়ে ছাড়িয়ে অন্য এলাকায় চলে যেত। সন্ধে নেমে গেলে লোডশেডিংয়ে ভয় পেতাম। ভয় রুখতে আমাকে নিয়ে হাঁটা শুরু করল লোকটা।
হাঁটতে আমার ভালই লাগত। হাঁটার সময়ে বাবার মুখের আগল খুলে যেত। কত না গল্প! বারো নম্বর রমাপ্রসাদ রায় লেন! একটাই গলি ঘিরে প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প হত। একদিন বলল, ‘জানিস, আমাদের গলিতে যাত্রা হত। শম্ভুদারা বড়লোক ছিল। আভা প্রেসের মালিক। ওরা টাকা দিয়ে প্রতিবছর যাত্রাপার্টি আনত। একবার হল কী, ওদের ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছিল। যাত্রার টাকা দিতে পারল না। সেবছর সবেমাত্র পুজো শেষ হয়েছে, সব ঘরেই পকেটে টান। আমি গিয়ে ধরলাম সুবলদাকে। সুবলদার একটা পা খোঁড়া ছিল আর টালিগঞ্জের স্টুডিওতে ভাল কাজ করত। সবসময় পকেটভর্তি থাকা লোক, বুঝলি! তো সে তো সব শুনেটুনে বলল, ‘কীইইইই! আমি থাকতে পাড়ায় যাত্রা বন্ধ হবে! এখুনি চিৎপুর যা। ভাল বায়না করে আয়। যত লাগে দিবি, ভাববি না!’ তারপরে ভারি তৃপ্ত মুখে বাবা বলল, ‘এইভাবে পাড়ায় যাত্রা করালাম, জানিস!’
একদিন আবার চটকলের ধার দিয়ে হাঁটছিলাম। নানান জাতির মানুষ এই রাস্তায় ভিড় করে থাকে, চটকলে কাজ করে, রাতে নেশা করে, ভদ্রলোকেরা যায় না ওদিকে। কিন্তু বাবার বাছবিচার নেই। শিশুকন্যাকে নিয়ে সটান হেঁটে চলেছে খালপাড়ের দিকে। এমন সময় রাস্তায় হট্টগোল। ভরা বিকেলে একটি লোক নর্দমার ধারে পড়ে আছে। তাকে ঘিরে কয়েকজন নারী ভোজপুরি ভাষায় দুর্বোধ্য কিছু বলছে। একটা ঝামেলা লাগার মতো অবস্থা। তাই দেখে বাবা বলল, ‘আমাদের বারো নম্বর রমাপ্রসাদ রায় লেনেও এমনি ঝামেলা বেধে যেত। যেদিন যেদিন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা থাকত, সেদিন তো ঝামেলা বাধবেই। ওহ! সেবারে কী হল জানিস, তখন ইডেনে খেলা হত। সবাই খেলা দেখতে গেছি। আমাদের তো টিকিট লাগত না। আর টিকিটের অত পয়সাই বা পাব কোথায়! জীবনদা বা পল্টুদাকে ধরে ঢুকে যেতাম গ্যালারিতে। আমরা একা ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার। রঘু, শম্ভুদা, অজয়, কেলো, বিনয় সবক’টা মোহনবাগান সাপোর্টার। ইস্টবেঙ্গল সেবার হারল। আর যায় কোথায়! আমাকে আর কমলকে ধরে সবাই বলল মুচলেকা দিতে হবে। লিখতে হবে, ‘আজ থেকে আমরা মোহনবাগান সাপোর্টার হলাম!’ এই অবধি সব ঠিক ছিল। আমরাও ইয়ার্কি হিসেবেই নিচ্ছিলাম। তারপরে হঠাৎ রঘু আর কেলো বলল, ‘লেখ, লেখ শালা বাঙালের বাচ্চা!’ অমনি আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল! দিলাম এক ঘুষি। মারপিট লাগল। কমলটাও খেপে ছিল। কিন্তু বুদ্ধি করে ঠনঠনিয়ার দিকে চলে গেল। চিনে বাপিকে খবর দিল। চিনে বাপি শুনেই দলবল আর কাচের বোতল নিয়ে এল। গলি জুড়ে যা অ্যাকশন হল না! সব বাপ বাপ বলে ভয় পালাল। পরদিন আবার সব ঠিক। পূরবীর সামনে আড্ডা দিলাম সবাই।’ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, সেই ভয়ংকর ছেলেটাকে মা ভালবেসেছিল!
জানি, পাঠক ভাবছেন একটি তুচ্ছ গল্পের ভিতরে আবার দুটি তুচ্ছ গল্প ঢুকল কেন! কিন্তু, কী করব! বাবা যে সেই তুচ্ছ গল্পগুলো নিয়েই বাঁচত। আর হাঁটত।
অনেক রাতের দিকে কোনও কোনও দিন মাকে ডাকলে সাড়া দিত না মা। আমাকে ঢাল করে রাখত। ঢালের মতো মাঝে পড়ে বেড়ে উঠছিলাম আমি। ওদের ঝগড়া কমে গিয়েছিল। কথাও।
তারপরে একদিন আমার দশ বছর বয়সের দুপুরবেলায় সরপুঁটির ঝোল-ভাত খেয়ে শুয়েছিলাম মায়ের পাশে। ঘর জুড়ে আলো-গঞ্জের হলুদ-বাদামি রোদ। মিহি হাওয়া। উসখুস করে উঠে পড়ল মা। সাজল। অনেকক্ষণ ধরে গুনগুনিয়ে সাজল। ডান হাতে ঘড়ি, টিপটপ শাড়ি। আমাকে সাজিয়ে দিল না। শুধু বেরোবার আগে বলল, ‘আসছি। দরজাটা বন্ধ করে দে।’
দরজা বন্ধ করলাম। সন্ধে হল। বাবা ফিরল। রাত হল। খিদে হল। মা আর ফিরল না। তার নতুন প্রেমিকের সঙ্গে রেল তখন অনেক দূর চলে গেছে। আলোগঞ্জ ছাড়িয়ে, কলকাতা ছাড়িয়ে, রাজ্য ছাড়িয়ে ভিনরাজ্যে। দু’কামরায় পড়ে রইলাম আমি আর বাবা। আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করল বাবা।
বিছানার চাদর কালচে হতে শুরু করল। পর্দা সব পুরু ময়লার আস্তানা। ফুলদানিতে ধুলো পড়ল। শখের বাসন বিক্রি হল। আর বিকেলবেলার খিদে ভুলে গেলাম আমি। শরীর মানিয়ে নিল।
একটা জ্বালা। তীব্র জ্বালা! বারুদের মতো যখনতখন জ্বালিয়ে দিত সব। আমি সেই জ্বালার ভিতর পড়ে মার খেতাম। উৎসবের দিনগুলিতে আমি পড়ে পড়ে মার খেতাম। দূরে রকেট ছাড়ত কেউ। রংমশালের আলো। হাউইবাজি শিস দিয়ে আকাশে উঠে যেত। তারাবাজি আলো হয়ে ফুটত। আর মাটিতে খালিপেটে আমার চুলের মুঠি টেনে ধরত বাবা। সামান্য কারণে হাত চালানোর সুযোগ পেলেই শরীরে বেল্টের দাগ পড়ত। আমাদের ব্যাপারে কেউ আসত না। যে ঘরের মা পালিয়ে যায়, সেই ঘরে কেউ আসে না। আমি মারের দাগ লুকিয়ে স্কুল যেতাম। বন্ধুরা হাসত, ‘তোর মা পালিয়ে গেল কেন!’
বছরগুলো ঘুরছিল। আমরা শাকভাত আর পুরনো বইতে চালিয়ে নিচ্ছিলাম। জামা আঁট হচ্ছিল। জামা এলে চাল হয় না, চাল হলে জামা হয় না। তোরঙ্গ জুড়ে মায়ের শাড়ি। পরতে শুরু করলাম।
একদিন বেলা তিনটের রোদ। একটু পরে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি শেষে আবার রোদ হবে। আলো-হাওয়া গঞ্জের এটাই নিয়ম। সেদিন ঘরে শাকভাত খাইনি। মায়ের গোলাপি শাড়ি পরে চুপ করে শুয়েছিলাম। আমার দুর্বল, যন্ত্রণাকাতর শরীরের ওপর গোলাপি শাড়িটা ধীরে ধীরে লাল হয়ে গেল। স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায় লাল রং ছড়িয়ে গেল সুতোয় সুতোয়। আমি ভয়ে কেঁদে উঠলাম।
অল্প কিছুক্ষণ পরে মায়ের শাড়িটাই ছিঁড়ে ফেললাম। বালিকা বিদ্যালয়ের শেষ বেঞ্চে শেখা বিদ্যেয় আমি জানতাম কী করতে হয়। বাবা ফিরল অনেক রাতে। ঠান্ডা শাকভাত কিছুটা খেল। ভাত খাইনি বলে মারধোর করল খুব। সেদিন থেকে বাবাকে ঘৃণা করি আমি।
অনিমেষ এসেছিল তারও কিছু বছর পরে।
আমাকে মায়ের মতন দেখতে। মায়ের শাড়ি পরে দূরের এলাকায় টিউশন পড়াতে যাচ্ছিলাম। নবচক্র মোড়ের মাঠে খেপ খেলতে আসা অনিমেষ আমাকে দেখল। পাস মিস করল। ওর দলের ছেলেরা গালাগালি দিয়ে উঠল। দ্রুত সরে গেলাম।
পরদিন ম্যাচ নেই। দল নেই। অনিমেষ একা দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরদিনও। আমি তাকে কিছুই বলিনি। সে শুধু দাঁড়িয়ে থাকাটা নিয়মিত করে নিল। আমি শুধু তোরঙ্গের ভিতরে হাত চালিয়ে প্রতিদিন মায়ের ভাল শাড়ি খুঁজে আনতে শুরু করলাম।
একদিন ভরসন্ধেয় ময়ূরকণ্ঠী রঙের শাড়ি পরে বেরচ্ছিলাম। একটা সুবিধে রয়েছে। এই অপুষ্ট শরীরেও আমাকে সাজতে হয় না। মায়ের জিন। মনভোলানো রূপ। ময়ূরকণ্ঠী রংটা পুরনো হলেও বোঝা যাচ্ছে না। বন্ধ তোরঙ্গের বদ্ধ গন্ধটা ছাড়া আর কোনও অভাব মেখে নেই। পরে ফেললাম, কিন্তু বেরোতে পারলাম না। অসময়ে বাবা ফিরল। তখন কারখানার বাইরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সময় কাটিয়ে দিত বাবা। কারও সঙ্গে দেখা হলে বারো নম্বর রমাপ্রসাদ রায় লেনের গল্প করতে চাইত। আমি সেইসব গল্প ঘৃণায় মুছে দিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকেই আমাকে অত্যাচারের ফিকির খুঁজত বাবা।
ছোট আয়নায় দেখলাম বাবা বলছে, ‘এই যে, দুশ্চরিত্র মেয়ে! কোথায় যাচ্ছিস!’
‘পড়াতে।’
‘তোর মা-ও যেত অমন চাকরিতে। জানা আছে।’
আমি কথা বাড়ালাম না। এখন কথা বাড়ালে চলে না। মাঠের ধারে অনিমেষ এসেছে। চুপ করে বেরোতে যাচ্ছিলাম, বাবা হুঙ্কার দিল, ‘কোত্থাও যাবি না। ঘরে বসে থাক!’
বললাম, ‘যেতে হবে। ছাত্রীর পরীক্ষা!’
বাবা চুল টেনে ধরল, চিৎকার করে বলল, ‘তোর মাকেও যেতে হত। রোজ যেতে হত কাজে! এখন সে মাগীর ছেলে হয়েছে! শুনেছিস? তোর মায়ের ছেলে হয়েছে!’
তারপরে আমাকে মাটিতে পেড়ে ফেলল বাবা। কোমরে লাথি মারতে শুরু করল। নির্দয়, হুঁশহীন একেকটা লাথি মারে আর বলে, ‘তোর মায়ের ছেলে হয়েছে! তোর মায়ের ছেলে হয়েছে!’ বলতেই থাকে। বলতে বলতে কষ বেয়ে থুতু গড়ায়, থুতু গড়িয়ে ময়লা কলারে নামে, তবু কী এক আক্রোশে বাবা এক বাক্য বলে যায়। কোমরে লাথি চালিয়ে যায়।
সেদিনের পর তিন-চার দিন উঠতে পারলাম না। তিন দিনের মাথায় জানালায় টোকা। অবাক কাণ্ড। দরজায় টোকা না দিয়ে জানালায় টোকা মারবে কে! দু’চারবার শুনে নীচের পাল্লা খুলে দিলাম। অনিমেষ! খুঁজে খুঁজে চলে এসেছে। পাথুরে মুখে বললাম, ‘আমি অসুস্থ!’
তারও পরে মাসখানেক কাটল। থিমপার্কের নারকেল গাছের আড়ালে নিয়ে গেল অনিমেষ। জানতাম কী হবে। ওর আঙুল খেলছিল। গলায়, বুকে, স্তনবৃন্ত জাগিয়ে তোলার খেলায় মেতেছিল। আমি বলে ফেললাম, ‘আমার মা না পালিয়ে গেছে। অন্যের সঙ্গে। কয়েক বছর আগে। একটা ছেলেও হয়েছে।’
অনিমেষের আঙুল থেমে গেল। চোখ দুটো কুঁচকে গেল। বলল, ‘ছিঃ!’
সেই প্রথমবার আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। বাবার মতো! বাবার মতো! ইচ্ছে হল হাতুড়ি দিয়ে ওর সবক’টা আঙুলের গাঁট ভেঙে দিই। হাত নিশপিশ করছিল। ওর বেঁটেখাটো পুরুষালি আঙুল মটকে ধরলাম। খেলোয়াড় ছেলে চিৎকার করেও আঙুল ছাড়াতে পারছিল না। যন্ত্রণায় ওর ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছিল। একটা হাতুড়ি! পেলেই কেল্লা ফতে! কিন্তু অনেকক্ষণের চেষ্টায় ও আঙুল ছাড়িয়ে নিল। দূরে ছুটল। আমাদের আলো-হাওয়া গঞ্জে আর কোনওদিনও অনিমেষকে দেখতে পাইনি।
এরপর আমি আবার একা। ডালডার কারবারের দিন শেষ হয়ে আসছিল। বাবার কুসুম কারখানা বন্ধ হল। আমাকে মারধোরের পরিমাণ বেড়ে গেল।
আমি পালিয়ে বেড়াতাম। সারাদিন কাজ খুঁজতাম। একদিন কাজ পেয়েও গেলাম। শপিং মলে। ভাল কাজ। ওদের দেওয়া টিশার্ট পরে জামাকাপড়ের সামনে দাঁড়ানো, কাস্টমারকে হেল্প করা, এইসব। মেয়েদের জামাকাপড়ের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তাম। বেলা এগারোটা থেকে রাত ন’টা কখন যে কেটে যেত! ঘরে দুটো পেট বাঁচল। এরকম সময়ে নির্ঝর এল।
নির্ঝর বাইক চালাত। ছুটির দিনে বাইক নিয়ে আসত। ঘরের ভিতর বাবার বিড়বিড়ানি, একই রমাপ্রসাদ রায় লেন, নয়তো মাকে গালিগালাজ অসহ্য মনে হত। মিথ্যে বলে বেরিয়ে আসতাম। কলকাতা। নলবন, প্রিন্সেপ ঘাট, সেন্ট্রাল পার্ক। সুস্বাদু খাবার। প্রেম। পেট ভর্তি হয়ে গেলে নির্ঝরকে ভালবাসতে, আদর করতে ইচ্ছে হত।
একদিন সেক্টর ফাইভের আগে একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের সামনে বাইক থামাল নির্ঝর। অল্প কিছুক্ষণ আগে আমার পেট ভরে গিয়েছিল। ফলে আপত্তি ছিল না। স্মার্ট নির্ঝর এগিয়ে এল। একই কাজ, একই ভাবনা, নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু আমার ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুম ঘুম পেল। আর ঘুমের ঘোরেই কিনা জানি না, বলে ফেললাম, ‘আমার মা পালিয়ে গেছে। প্রেমিকের সঙ্গে। আমি বাবার সঙ্গে থাকি। বাবা আমাকে রোজ মারে!’
নির্ঝর আমার টিশার্টটা কাঁধের ওপর তুলে দিল আবার। গম্ভীর স্বরে বলল, ‘বেরোবে? আমার তাড়া আছে!’
বাবার মতো আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল! একটা পাথর দিয়ে ওর মাথা থেঁতলে দিতে ইচ্ছে হল। ঘিলু ছিটকে যাক, তবু পাথর না থামুক! হাতের কাছে মাটির শো-পিসটা পেয়ে ওর মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ে দিলাম। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। নির্ঝর বেরিয়ে গেল। আর কোনওদিনও দেখিনি।
ঘরে ফিরে দেখলাম পায়ের কড়ার দিকে তাকিয়ে বাবা বিড়বিড় করছে। পূরবী সিনেমাহল, রমাপ্রসাদ রায় লেন, শ্রীমানি বাজার, ঠনঠনিয়া। আমাকে দেখেই চিৎকার করে উঠল, ‘কোথায় ছিলি! ছুটির দিনে কাজ! বুঝি না কিছু?’
মনে মনে বললাম, ‘শালা, পাগল!’
রাতে চুপি চুপি ব্যাগ গুছিয়ে রাখলাম। বাবার থেকে পালিয়ে যাব বলে। মায়ের মতো। পালাব। সকালে বাবার পথে পথে ঘোরার সময় হলে বেরিয়ে যাব আর ফিরব না।
তাই করলাম। শপিং মলের এক বান্ধবী ঘর ঠিক করে দিল। ঠিকানা- আমহার্স্ট স্ট্রিট, রমাপ্রসাদ রায় লেন। সরু গলি। মুখে একটা কালীপুজো হয়। বাবার থেকে পালাতে চেয়ে আমি এক অদ্ভুত ঠিকানায় এসে পড়লাম। তবে শপিং মলটা কাছে হল।
জানতাম না আমার সেই আলো-হাওয়া গঞ্জে বাবা খুঁজছে কিনা। জানতাম না নদীর পাড়ে, চটকলে, নবচক্র মোড়ে, রেললাইন জুড়ে বাবা খুঁজেছে কিনা। জানতাম না বাবা কী খাচ্ছে, কীভাবে রয়েছে। কিন্তু তিন-চারদিন আগে একটা ঘটনা ঘটল।
বেলা দশটায় দরজা খুলে দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে। খাওয়া নেই। মুখ এলোমেলো, জামা প্যান্ট ময়লা। অনেক বছর পরে বারো নম্বর রমাপ্রসাদ রায় লেনে এল। আমাকে দেখেই চিৎকার জুড়ে দিল।
‘জানি না নাকি তুই এখানেই আসবি! তোকে আমি চিনি না? বিষ! বিষ জন্মেছে একটা! অমন মায়ের অমন মেয়েই তো হবে! দুশ্চরিত্র!’
দেখলাম আশেপাশের জানালা খুলে গেল। উঁকি মারছে। দোতলার রেলিং ঘেরা পুরনো ঝুলবারান্দা থেকে মুখ ঝুলছে। এটা আমাদের অভ্যস্ত গঞ্জ নয়। শান্ত স্বরে বললাম, ‘ভিতরে এসো। দুধ-চা করে দিই, খাও।’
তারপর থেকে বাবা রোজ আসে। দুধ-চা করে দিই, ডিশে ফেলে সুড়ুৎ সুড়ুৎ খায়। আর জিজ্ঞাসা করে, ‘হ্যাঁ রে, পূরবী সিনেমাহলটা সত্যিই ভাঙা পড়ল?’
ঘিঞ্জি এলাকায় ঘরগুলো ঠান্ডা হলেও বিকেলে খুব গরম লাগে। এখন হাঁসফাঁস করছি। বাবা রোজকার মতোই চা খাচ্ছে, দূরের হৃষীকেশ পার্কে খেলবার আওয়াজ, অন্ধকার হয়ে আসছে। একটু স্নান দরকার। তাছাড়া বাবার মুখের সামনে বসে থেকে কীই বা করব!
পুরনো দিনের ছ্যাতলা ধরা বাথরুমে এলাম। স্নান সেরে নিতে হবে। গা-মাথা ভিজিয়ে একটু আরাম। জানালার তাক থেকে শ্যাম্পুর কৌটো নিলাম। শেষ। যতটা পারা যায় হাতে তুলে নিয়ে কৌটো ফেলে দিতে কোণে রাখা ডাস্টবিনের পা-দানিতে চাপ দিলাম। বালতির ঢাকনা উঠল, ভিতরে বাবার মাথাটায় সাদা সাদা মুড়ির মতো পোকা ধরে গেছে। মাছি বিনবিন করছে। শ্যাম্পুর কৌটোটা ফেলে দিলাম। বালতির মুখ বন্ধ হল।
তিনদিন আগে বাবা এসেছিল। তারপর থেকে রোজ আসে। রমাপ্রসাদ রায় লেনে হঠাৎ মাছি বেড়ে গেছে। কিছু একটা পচছে। দূরে হুটারের শব্দ। শব্দটা কাছাকাছি আসছে।
বেরোবার আগে স্নান সেরে নিতে হবে। ততক্ষণ বাবা যদি বসে থাকতে চায় তো বসে থাকুক!