Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সয়লা পরব

স্বতোৎসারিত শাশ্বত প্রেম ও অমৃতময় মানব জীবন উদযাপন

সয়লা উৎসব একটি অতীব প্রাচীন উৎসব। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, ‘সয়লা’ কথাটির উৎস ‘সই’ অর্থাৎ বন্ধু। সয়লা উৎসব প্রকৃতপক্ষে সই পাতানোর উৎসব বা বন্ধুত্বের উৎসব। বহু পূর্ব হতেই ভারতবর্ষ তথা বঙ্গভূমির বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে, জনপদে এই উৎসবটি প্রচলিত ও সমাদৃত ছিল। আমাদের পূর্বাপূর্ব আচার্যগণ তথা আউলবাউল, সুফী, ফকির, দরবেশগণ সম্প্রীতি ও মানব মৈত্রীর জন্য ও সমাজ জীবনে হিংসা, বিবাদ, নিন্দা, কামনাবাসনা জর্জরিত মানুষের প্রাণে আনন্দ, প্রেম ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, প্রসারিত করার নিমিত্ত এই সয়লা উৎসবের প্রচলন করেছিলেন।

কতকগুলি ইষ্টকের উপর ইষ্টক সাজালেই যেমন সৌধ, ইমারত বা ঘরবাড়ি তৈয়ারি করা যায় না, তেমনই জড় যন্ত্র পিষে ভোগ্য দ্রব্যের বিপুল সম্ভার উৎপাদন করলেই কিন্তু একটি সুদৃঢ় মানবীয় সভ্যতা গড়ে ওঠে না। একটি ইটের সহিত আর-একটি ইটের সুদৃঢ় একত্ব স্থাপনের জন্য যেমন সংযোজক সিমেন্ট-বালির প্রয়োজন, তেমনই একটি মানব হৃদয়ের সঙ্গে আর-একটি মানব হৃদয়ের নিবিড় সম্বন্ধ স্থাপনের জন্য চাই শ্রদ্ধা ভক্তি বিশ্বাস ও সর্বোপরি প্রেম বা বন্ধুত্ব। শুধুমাত্র অর্থ, বিদ্যা, মান, যশ ও খ্যাতি এইগুলি থাকলেই কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীতে আনন্দ বা শান্তি আসবে না এবং এতে মানুষের প্রাণও জুড়াবে না। আমাদেরকে সুন্দর ও সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে হলে প্রথমেই যা প্রয়োজন তা হল প্রেম বা বন্ধুত্ব। প্রেম বা বন্ধুত্ব ছাড়া সুস্থ, আনন্দময় ও শান্তিময় সমাজ গড়া আকাশকুসুম কল্পনামাত্র। আজকের এই পৃথিবীতে একমাত্র ওই একটি বস্তুর অভাবেই আমাদের সকল প্রকার শান্তির প্রচেষ্টা ব্যর্থতার আঘাতে ধূল্যবলুণ্ঠিত। প্রেম বা বন্ধুত্ব ছাড়া এই মানব সভ্যতা একটি প্রহসনমাত্র। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যন্ত্রের উৎপাদন দক্ষতা অপরিসীম হলেও প্রেম বা প্রীতিহীন এই মানব কৃষ্টি মরুভূমির ধূ-ধূ বালুকারাশিমাত্র।

ক্ষুধার নিবৃত্তি যেমন আহার্য দ্বারা উদরপূর্তির ফল তেমনই এই মানব প্রেম ও সেইরূপ ঈশ্বরীয় প্রেমের বা বন্ধুত্বের অনিবার্য পরিণতি। কোনও কৃত্রিম উপায়েই মানবের একত্ব বা পরিপূর্ণতা আসে না। একমাত্র অন্তরের দেবতার সঙ্গে আন্তর সম্বন্ধ স্থাপিত হলেই মানুষে মানুষে প্রেম, প্রীতি ও বন্ধুত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান যুগে সমস্যা, হিংসা ও নিন্দায় বিধ্বস্ত এই মানব সমাজ, রাষ্ট্র তথা পৃথিবী যদি মহামিলনের আলোক চায়, তা হলে আমাদেরকে সেই আচার্যগণের প্রদর্শিত পথেই গমন করতে হবে। বর্তমান এই যন্ত্রসভ্যতার চাপে ও প্রতিযোগিতার দৌড়ে আমরা সকলে হাঁফিয়ে উঠেছি। এখন আমাদের প্রয়োজন হল সমস্ত রকম তর্ক ও বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদেরকে মুক্ত করা।

একমাত্র নিরুপাধি প্রেমের মাধ্যমেই হয় আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন। নিরুপাধি প্রেমের বিষয়টি হল, যে প্রেমে কোনও বিষয় নেই অর্থাৎ শুধুমাত্র ভালবাসার জন্য ভালবাসা। যাতে স্বসুখ নেই, যা স্বার্থশূন্য। কবি বিদ্যাপতি এই প্রেম বা বন্ধুত্বের বিষয়ে একটি সুন্দর কথা বলেছেন:

কত বিদগ্ধজন রস অনুমানি, অনুভব কাহক ন পেখ
বিদ্যাপতি কহ প্রাণ জুড়াইতে, বন্ধু লাখে না মিলল এক।

জাতির কবি বিদ্যাপতি তাই আক্ষেপ করে বলেছেন— ভারতে বিদ্যা আছে, প্রতিভা আছে, ধনৈশ্বর্য আছে কিন্তু প্রাণ জুড়াবার মত বন্ধু নেই বা মানুষ নেই। সত্যই তাই। পুঁথিগত বিদ্যা আর অর্থের অহংকারে মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সবই রয়েছে। নেই শুধু মানুষকে মানুষ ভেবে ভালবাসা।

ধর্মের অনুশাসন এবং সামাজিক লোকাচারে বৈষম্যতায় আমরা আমাদের সহজতা ও প্রকৃত মনুষ্যত্বটিকেই বিসর্জন দিচ্ছি। সবার উপরে যে মানুষই সত্য বা প্রেমই সত্য এই কথাটি আমরা সকলেই প্রায় ভুলতে চলেছি। আর এই কথাটি ভুলে গেলেই মানুষ তখন অমানুষ হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষকেই সকল মানুষের হৃদয় বেদনা অনুভব করতে হবে। তাই বাউলের ভাষাতেই বলি—

মানুষের জন্য মানুষ কাঁদিয়া বেড়ায় রে
যে চিনিল সেই মানুষে, সেই তো আপন হল রে।

প্রত্যেক মানুষের জন্যই প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয় কেঁদে উঠবে আর তা একমাত্র এই প্রেম বা বন্ধুত্বের মাধ্যমেই সম্ভব। আর এর জন্যই আমাদের এই সয়লা বা বন্ধুত্বের উৎসব পুনঃপ্রচলন করা। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’— এই অমোঘ সত্যটির আলোকে আমরা বলতে চাই— সবার উপরে প্রেম সত্য, তাহার উপরে নাই।

পৃথিবীর ইতিহাসকে স্পর্ধা করে একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করি, প্রকৃতপক্ষে ভালবাসার মানুষ বা প্রকৃত মানবদরদী মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে কি শান্তি আসতে পারে? তা কোনওদিনই পারে না। বর্তমান এই সয়লা উৎসবে আমরা সেইরকম মানুষেরই সন্ধান করছি আর আমরা আশা করি যাঁরা বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন তাঁরা অবশ্যই সেই সোনার মানুষই হবেন বা প্রেমিক মানুষই হবেন। যাঁদের প্রাণ হবে সমগ্র পৃথিবীর প্রাণীকুলের জন্যই নিবেদিত। তাঁদের সাধনার মূলমন্ত্রটি হবে:

সহজ হও, সরল হও
মানুষ ধরে মানুষ হও
মানুষ হওয়াই মানুষের সাধনা।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

One Response

  1. আশা করি আরও পড়তে পারব শ্রদ্ধেয় ফকির সাধন দরবেশের লেখা। শ্রদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four − 3 =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »