‘রালফ ফক্সের নাম শুনেছ?/ শুনেছ কডওয়েল আর কনফোর্ডের নাম?/ ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কথা জানো?/ এই বীর শহীদেরা স্পেনকে রাঙিয়ে দিল/ সবুজ জলপাই বন হল লাল/ মার বুক হল খালি,/… তবু বলি, সামনে আসছে শুভদিন’। এ-কবিতা যখন লেখা হয়, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর দুঃশাসন একদিকে, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করাল দাঁত ছিঁড়ে খাচ্ছে পৃথিবীকে। আর সেই জগদ্ব্যাপী জাহান্নামের আগুনে বসে পরাধীন দেশের এক কমিউনিস্ট কবি, মূলত যাঁকে আমরা কথাকাররূপেই জানব, লিখে চললেন চারণগাথা। সোমেন চন্দ। শৈশবে, মাত্র চার বছর বয়সে মাতৃহারা, বাবা রেলওয়ে কর্মী। জন্ম ১৯২০-র ২৪-এ মে, ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যায়, গ্রাম তেঘড়িয়া, মামার বাড়িতে। পড়াশোনা ঢাকার বিখ্যাত পোগোজ স্কুলে, ১৮৪৮ সালে যে-বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছিলেন আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী নিকোলাস পোগোজ। বহু খ্যাতিমান প্রতিভার শিক্ষার পীঠস্থান এই বিদ্যালয়টি,– ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, শামসুর রাহমান, অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম। মাইকেল মধুসূদন আর স্বামী বিবেকানন্দের পদধূলিরঞ্জিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সোমেন এখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে মিটফোর্ড মেডিক্যাল-এ ভর্তি হয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য, এসময় তাঁর যক্ষ্মারোগ ধরা পড়ে। সেজন্য, এবং আর্থিক কারণেও বটে, সোমেন মাত্র একবছর ডাক্তারি পড়েই পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটান। শুরু হয় তাঁর নতুন জীবন, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তিনি জড়িয়ে পড়েন, সভ্য হন কমিউনিস্ট পার্টির।
বামপন্থী চিন্তাচেতনা তখন সারা দেশে বেশ জোরালো আকার ধারণ করেছে। ১৯১৭-তে রুশ বিপ্লবের বছরেই তাসখন্দে মহান অক্টোবর বিপ্লবের নেতা লেনিনের বন্ধু এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে এক আলোচনাসভা বসে, ভারতে কীভাবে কমিউনিজমকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন অবনী মুখোপাধ্যায়, রোজা ফিটিংগফ, মোহম্মদ শফিক, এম. পি. টি. আচার্য প্রমুখ। এর কয়েক বছর পর ১৯২৫-এর ২৬-এ ডিসেম্বর ভারতের কানপুরে বসে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম অধিবেশন, এস. ভি. ঘাটের নেতৃত্বে। দ্রুত তার কার্যাবলি সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মুম্বাইতে ডাঙ্গে, চেন্নাইয়ে সিঙ্গারাভেলু, যুক্তপ্রদেশে শওকত ওসমানি, পাঞ্জাব-সিন্ধুতে গোলাম হোসেন, বাংলায় মুজফফর আহমেদ এতে অগ্রণী ভূমিকা নেন। চল্লিশের দশকে দেশের অন্যান্য জায়গার মত বাংলাতেও কমিউনিস্ট আন্দোলন নানা কারণে ব্যাপকতা লাভ করে। প্রথমত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যা মূলত ছিল পুঁজিবাদ বনাম সাম্যবাদের লড়াই। বাংলায় কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন কমিউনিস্ট ভাবধারা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ঢাকাতে কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, অচ্যুৎ গোস্বামী, সদানন্দ সেন, অমৃতলাল দত্ত, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন প্রমুখ এই ভাবধারার ব্যাপ্তি ঘটান। সোমেন চন্দ সহ ঢাকার আরও অনেকের বামপন্থী চিন্তাধারা ও মতাদর্শে আস্থাশীল হওয়ার কারণ এটাই। তারা একই সঙ্গে লড়ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও।
সোমেন চন্দ যখন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, এবং পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত। অচিরেই আবার পার্টি থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়, যখন ভারতের কমিউনিস্ট পর্টি হিটলারের সোভিয়েত আক্রমণের কারণে (২২.০৬.১৯৪১, অপারেশন বারবারোসা) ব্রিটেনকে সমর্থন দেয়। তারা এ যুদ্ধকে আখ্যায়িত করে ‘জনযু্দ্ধ’ নামে। গঠিত হয় ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’। গোপন অবস্থানে থেকেই সোমেন চন্দরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ‘প্রগতি পাঠাগার’-এ নিয়মিত বৈঠক হত, পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হত বিপ্লবী চেতনার বাণী। ছিল ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’, যার মাধ্যমে বিপ্লবাত্মক লেখা রচিত ও প্রচারিত হতে থাকে। সোমেন চন্দের লেখক হিশেবে আত্মপ্রকাশ এর হাত ধরেই ঘটে। পবিত্র সরকার লিখছেন, ‘অবিলম্বেই সোমেন এ-পাঠাগারের পরিচালকের দায়িত্ব পান।… এ তরুণটির মধ্যে জেদ ও সঙ্কল্পের দৃঢ়তা ছিল, ছিল জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও বহু-অধ্যয়নজনিত এক গভীর আত্মপ্রত্যয়। যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে, ১৯৪১ সালে। তখন এ সদস্যপদ খুব সহজলভ্য ছিল না।’
খুব অল্প বয়স থেকেই সোমেনের লেখালেখির শুরু। কবিতা লিখেছেন সামান্যই, মাত্র গোটাতিনেক কবিতা পাওয়া যায় তাঁর। তিনি গল্প লেখাতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। প্রায় কিশোর বয়স থেকেই তিনি পার্টির কাজে নিয়োজিত। তাঁর সম্পর্কে ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং সশস্ত্র বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশী তাঁর আত্মকথা ‘অগ্নিযুগের কাহিনী’-তে লিখছেন, ‘১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি সোমেন তাঁর দক্ষিণ মৌশুণ্ডি পাড়ায় আমাদের কমিউনিস্ট পাঠচক্রে যোগ দেয়। সে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে শুনত, বেশি প্রশ্ন করত না।’ সাম্যবাদী নেতা রণেশ দাশগুপ্ত সোমেনকে রবীন্দ্রনাথ, রোমা রোলাঁ, বারবুস, আন্দ্রে জিদ, রালফ ফক্সের রচনা পড়াতেন। মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়। তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অগ্রজ কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘নিজস্ব একটি জীবনদর্শন না থাকলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। সোমেন চন্দ ছিল কমিউনিস্ট। সাহিত্যিক হিসাবেও তার রচনায় নানাভাবে ফুটে উঠেছে কমিউনিজমের জয়ধ্বনি’। আবার তাঁর পরবর্তীকালের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ লিখেছেন, ‘সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প ‘ইঁদুর’ পড়ার পরপরই নিম্নমধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ও ‘মনসুর জীবন’ নামে তিনটি গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি’ (‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর ভূমিকা)।
তাঁর লেখার সূত্রপাত ‘ক্রান্তি’-র সংকলনে ‘বনস্পতি’ গল্পের মাধ্যমে। জীবিতকালে তাঁর কোনও গ্রন্থ প্রকাশিত হতে পারেনি, যেমন পারেনি সুকান্তর। মৃত্যুর পর ১৯৪৩-এ ঢাকা থেকে তাঁর গল্পগ্রন্থ বেরোয় ‘সংকেত ও অন্যান্য গল্প’ নামে। আর কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ‘বনস্পতি ও অন্যান্য গল্প’, ১৯৪৪ সালে। পরবর্তীতে ১৯৭৩-এ রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বেরিয়েছিল তাঁর গল্পসমগ্র। বাংলা একাডেমি ঢাকা থেকে তাঁর রচনাবলি বেরিয়েছে, জীবনীও। কলকাতা থেকেও রচনাবলি বেরিয়েছে তাঁর। তাঁর বিখ্যাত গল্পগুলির মধ্যে আছে ‘সত্যবতীর বিদায়’, ‘দাঙ্গা’, ‘সঙ্কেত’, ‘রাণু ও স্যার বিজয়শঙ্কর’ ইত্যাদি। ‘দাঙ্গা’ গল্পে সেসময়ের ঢাকার দাঙ্গার পট উঠে এসেছে, যেমন সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্প বা সলিল চৌধুরীর ‘ড্রেসিং টেবিল’ গল্পে প্রতিফলিত হয়েছে কলকাতার দাঙ্গা। সোমেন তাঁর ‘সঙ্কেত’ গল্পটিতে বিপ্লবের স্বার্থে শ্রমিক ও কৃষকের ঐক্যবদ্ধতার ওপর জোর দেন। আবার ‘একটি রাত’ গল্পে আছে ম্যাক্সিম গোর্কির বিশ্বখ্যাত ‘মা’ উপন্যাস প্রসঙ্গ। গল্পের প্রধান চরিত্র সুকুমারের মা ছেলের মুখ থেকে ‘মা’-এর কথা শুনে নিজেই বইটি পড়ে ফেলেন! প্রথমদিকের গল্পে শরৎচন্দ্রের প্রভাব থাকলেও সোমেন অচিরে সে প্রভাব কাটিয়ে ওঠেন। পরে তাঁর আদর্শ হন প্রগতিবাদী লেখকেরা, বিশেষ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। জীবনে একবার-ই কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। ইচ্ছে থাকলেও তাঁর প্রিয় লেখক মানিকের সঙ্গে দেখা হয়নি তাঁর। তবে এখানে এসে একটি ছবি তোলেন, সুকান্ত ভট্টাচার্যের মত এটি তাঁর-ও একমাত্র ছবি। এটি তুলেছিলেন গৌরপ্রিয় দাশগুপ্ত। সোমেন চন্দের যাবতীয় লেখার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে তাঁর অসাধারণ গল্প ‘ইঁদুর’। মাত্র ঊনিশ বছরের সোমেন এটি লিখেই রাতারাতি বিখ্যাত হন। এবং অচিরে গল্পটি ভারতীয় ও বিদেশি বহু ভাষায় অনূদিত হয়। কমিউনিস্ট মতবাদ বনাম পুঁজিবাদী মতবাদ হল এ-গল্পের প্রতীকী কাহিনি। গল্পের মা চরিত্রের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত মানুষের চেতনা ব্যক্ত করেছেন লেখক। সমাজে ধনী-নির্ধনের দ্বন্দ্ব ও শোষক-শোষিতের সম্পর্ক আর শোষিতের (যারা ইঁদুর মারার কল কেনার-ও সামর্থ্যবঞ্চিত) অসহায়তার শব-ব্যবচ্ছেদ পাই এ-গল্পে।
এহেন প্রতিভাকে প্রাণ দিতে হল উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাতে! তারিখটি ছিল মার্চের আটই, ১৯৪২। সরদার ফজলুল করিম তাঁর আত্মস্মৃতিতে এইভাবে ঘটনাটির বিবরণ দিয়েছেন, ‘ঢাকার বুদ্ধিজীবী, লেখক প্রভৃতি শহরে এক ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলন উপলক্ষ্যে শহরে খুবই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক মহল প্রায় তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।… সম্মেলনের দিন সকালে উদ্যোক্তাদের অন্যতম তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ আততায়ীর হাতে নিহত হন।’ মিছিলটি ঢাকার লক্ষ্মীবাজার বটতলার কাছাকাছি পৌঁছলে আততায়ীরা মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মিছিলকারীরা ছত্রভঙ্গ হলেও সোমেন ছুরিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে হত্যাকারীরা অতি নিষ্ঠুরভাবে রড দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করেই ক্ষান্ত হয়নি, শাবল দিয়ে তাঁর চোখ খুবলে নেয়। জিভ পর্যন্ত টেনে ছিঁড়ে ফেলে। ২৬-এ মার্চ ১৯৪২-এ আনন্দবাজার পত্রিকা লেখে, ‘পূর্ব হইতে চিন্তা করিয়া ও সম্পূর্ণ অকারণেই তাঁহাকে হত্যা করা হইয়াছে, এবং সম্ভবত তাঁহার বিপক্ষ দল-ই এই কার্য করিয়াছে।’ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সমবেদনা প্রকাশ করেন প্রমথ চৌধুরী, আবু সয়ীদ আইয়ুব, বুদ্ধদেব বসু, সুবোধ ঘোষ, সমর সেন, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ। জীবনে মাত্র বাইশটি বসন্ত দেখেছিলেন সোমেন চন্দ। কিন্তু তিনি অমরত্ব পেয়ে গেছেন তাঁর স্বল্প কিছু রচনার দৌলতে। তিনি যে শহীদ কবিদের জয়গান গেয়েছেন গোড়ায় উদ্ধৃত তাঁর কবিতায়, তাঁদের অন্যতম লোরকা। দুর্ভাগ্য, লোরকার মৃতদেহটি পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি! তাঁর-ই বিখ্যাত কবিতা ‘Gacela of the Dark Death’ দিয়েই লেখাটি শেষ করি, ‘l want to sleep for half a second,/ a minute, a century,/ but l want everyone to know that l am still alive!’