ছোট থেকেই ছেলেটির সঙ্গী ছিল মিউজিক। মাইসোরে কনভেন্ট মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসিক্যাল ইউরোপিয়ান মিউজিক শিখেছিলেন। পিয়ানো বাজানোতেও দক্ষতা অর্জন করেন। তখন ছ’বছর বয়স। তারপর যখন ব্যাঙ্গালোরের বিশপ কটন বয়েজ স্কুলে পড়েন, পিয়ানো বাজানোয় ডুবে থাকতেন। সেই সঙ্গে মিউজিকোলজির বক্তৃতা শুনতেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। সুর ও সঙ্গীতের অনুরাগের পেছনে ছিল ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডেন এবং একজন মিশনারি শিক্ষিকার বিশেষ ভূমিকা।
সেই ছেলেটি যখন ম্যাড্রাস ক্রিশ্চান কলেজ থেকে ফিজিক্স নিয়ে বি.এসসি পাশ করছেন; পাশাপাশি ক্লাসিকাল মিউজিকেও বি.এ ডিগ্রি অর্জন করছেন তিনি। পরবর্তীতে সেই ছেলেটি যখন লন্ডনের কিং’স কলেজে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বিষয় নিয়ে পিএইচ.ডি করছেন, ওই একই সময়ে সেখান থেকে এল.আর.এস.এম (LRSM) কোর্সে ডিপ্লোমা পাশ করছেন ‘মিউজিক’ বিষয় নিয়ে। আবার সেই তরুণটিকেই দেখা যাচ্ছে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজিক-এ পিয়ানো বাজানোর প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছেন কিংবা অপেরা আর অর্কেস্ট্রার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন।
যাঁর কথা বলছি, তিনি ড. রাজা রামান্না (Raja Ramanna, ১৯২৫–২০০৪)। ভারতবর্ষের অন্যতম নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। ভারতের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠায় রূপ দেওয়ার পেছনে ছিল যাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেউই বুঝতে পারেন না— রামান্নার নামের পাশে লেখা PhD, LRSM কেন। নামের পাশে ওইভাবে লেখাটাই পছন্দ ছিল রামান্নার। কিন্তু ওই LRSM-এর কী মানে? LRSM-এর পুরো কথাটি হল— ‘Licentiate of the Royal School of Music’। যা ইংল্যান্ডের ‘Royal Schools of Music’-এর একটি মিউজিক ডিপ্লোমা উপাধি।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। ড. রামান্নার ভূমিকা একদিকে যেমন প্রযুক্তিবিদ, নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট, প্রশাসক, লিডারের, অন্যদিকে মিউজিসিয়ান হিসেবে, সংস্কৃত সাহিত্যের স্কলার এবং ফিলোজফি গবেষক হিসেবেও ছিল তাঁর ভূমিকা। ড. হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন তিনি। ভারতের এনার্জি এবং প্রতিরক্ষা প্রোগ্রামে সঠিক দিশা দেখিয়েছেন রামান্না।
তাঁর লেখা ‘In Years of Pilgrimage’ নামক গ্রন্থে পিয়ানো বাদন সহ তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। মিউজিকের ওপর লেখা তাঁর গ্রন্থটির নাম ‘The Structure of Music in Raga and Western Music’। প্রায়শই তিনি বেঠোভেন, মোৎজার্ট কিংবা ফ্রানজ লিস্টের সুর বাজাতেন কনসার্টে।
রামান্নার পূর্বসূরী হোমি ভাবার সঙ্গে তাঁর পরিচয়পর্বটিও একটি বেশ মজাদার ঘটনা। সেসময় ভারতবর্ষের দিকপাল বিজ্ঞানী ড. হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। ভারতের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের জনক। আর রামান্না তখন পিএইচ.ডি স্টুডেন্ট। সালটা ছিল ১৯৪৪। প্রথম সাক্ষাৎ হচ্ছে দুজনের। ট্রিনিটি কলেজের একজন অধ্যাপক তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। রামান্নাকে সেই অধ্যাপক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘স্টেট গেস্টহাউসে একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী আছেন, সঙ্গে আছেন তাঁর মা। দারুণ মিউজিক অনুরাগী। এই গেস্টহাউসেও গ্রামাফোনে তাঁরা মিউজিক শোনেন। তুমি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করবে?’ এভাবেই পরিচয় হল দুজন মোৎজার্ট অনুরাগীর।
এই সাক্ষাৎকারের পরে তাঁদের দুজনের আবার দেখা হচ্ছে ভারতে, বছর পাঁচেক পরে। তিন বছর পরে টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এ (Tata Institute of Fundamental Research, TIFR) রামান্নাকে নিউক্লিয়ার সায়েন্স বিভাগের স্থায়ী ফ্যাকাল্টি পদে নিযুক্ত করার জন্যে আহ্বান জানালেন ভাবা। দুবছর পরে দেশে ফিরে ড. রামান্না ট্রম্বে-তে অ্যাটমিক এনার্জি এসটাব্লিশমেন্ট, যা পরে হয়েছে ‘ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার’ (Bhaba Atomic Research Centre, BARC), সেখানে যোগ দেন। শুরু হল ভারতের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স তথা নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির এক নতুন অধ্যায়।
একজন পরিপূর্ণ এবং প্রতিভাধর মানুষ রাজা রামান্না তাঁর কৃতিত্ব ও সাফল্যের জন্যে অজস্র সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। ড. হোমি ভাবা এবং বিক্রম সারাভাই যে পথে শুরু করেছিলেন সেই পথকে আরও সুবিস্তৃত করেছেন ও উচ্চতম পর্যায়ে তুলে নিয়ে গেছেন। ভারতের শক্তি এবং নিরাপত্তা কার্যক্রমে মুখ্যভূমিকায় থেকে যথাযথ রূপ দিয়েছেন। ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তিস্থাপনা এবং সফল রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তথা পরীক্ষামূলক শান্তিপূর্ণ বিস্ফোরণের অন্যতম সফল সৃষ্টিকারীর নাম রাজা রামান্না।
‘পোখরান’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের প্রায় সকলেরই পরিচয় আছে। উনপঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭৪ সালের ১৮ মে। কী হয়েছিল সেদিন, মনে পড়ে? রাজস্থানের এই পোখরানে ভারত প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষা করে। যে খবরে বিশ্ববাসী চমকে উঠেছিল। আর এক বছর পরে, পঞ্চাশ বছরে পড়বে পোখরানের মাটিতে ভারতের ইতিহাস সৃষ্টি করার দিন। গুরুত্বপূর্ণ সেই মিশনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’। ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ কেন? আসলে, যেদিন এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছিল, সেই দিনটি ছিল বুদ্ধপূর্ণিমার দিন, বুদ্ধজয়ন্তী। পোখরানে সফলভাবে পারমাণবিক পরীক্ষার পরে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বপ্রথম বার্তাটি দেওয়া হয়েছিল, ‘বুদ্ধা ইজ স্মাইলিং’, বুদ্ধ হাসছেন। আর প্রধানমন্ত্রীকে এই বার্তাটি যিনি দিয়েছিলেন তিনি ভাবা রিসার্চ সেন্টারের তৎকালীন অধিকর্তা রাজা রামান্না। ভারতের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষার সাফল্য দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অন্যতম হিসেবে উঠে আসে ভারতের নাম৷ এই মিশনের পোশাকি নাম ছিল ‘পোখরান-১’। এত গোপনে এই পরীক্ষা করা হয়েছিল যে, ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামও এই বিষয়ে আগাম কিছু জানতে পারেননি। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের বিজ্ঞানীদলের প্রধান ছিলেন ড. রাজা রামান্না।
ড. রামান্না ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর পদে ছিলেন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ এবং ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ ছিলেন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান। কলকাতায় ‘ভেরিয়েবেল এনার্জি সাইক্লোট্রোন সেন্টার’ (Variable Energy Cyclotron Centre, VEC) প্রতিষ্ঠায় ড. রামান্নার ছিল বিশেষ ভূমিকা এবং সহায়তা। এখনও রাজা রামান্নাকে ‘ভারতবর্ষের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের জনক’ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ পুরস্কার ভাটনগর সহ ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান পুরস্কার পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ সম্মান সহ পেয়েছেন আরও একাধিক সম্মান। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টর অফ সায়েন্স উপাধিতে সম্মানিত হয়েছেন। প্রায় এক বছরের মত ‘ইউনিয়ন মিনিস্টার অফ স্টেট ফর ডিফেন্স’-এর দায়িত্ব সামলেছেন।
আমরা বোধ হয় খুব তাড়াতাড়ি তাঁকে ভুলে গেলাম! গতকাল ২৮ জানুয়ারি নিঃশব্দে পেরিয়ে এলাম রাজা রামান্নার জন্মদিন।