Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসু (৩০.১১.১৯০৮—১৮.০৩.১৯৭৪) রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখক। রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, অনুবাদ ও পত্রিকা-সম্পাদনায় অভিনিবিষ্ট ছিলেন।
তিরিশের দশকে যখন সমগ্র বিশ্বের এক ক্রান্তিকাল, সে-সময়ে সাহিত্যজগতে পা রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিতে রেকর্ড নম্বর পাওয়া এই কবি। প্রথমে ‘প্রগতি’, ও পরে ১৯৩৫ থেকে ‘কবিতা’, এই দুটি পত্রিকার নাম তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে আছে। এই দ্বিতীয় পত্রিকার মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কবিতার নবজন্ম ঘটে। তরুণ কবিরা এই পত্রিকায় কবিতা ছাপা হলে জাতে উঠতেন বলে মনে করতেন নিজেকে। পূর্ববঙ্গ তথা ৪৭-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের কবিরাও,— শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক প্রশ্রয় পেয়েছেন তাঁর পত্রিকায়, যেমন পেয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ। বুদ্ধদেব তাঁর এই পত্রিকার মাধ্যমেই জীবনানন্দের কাব্যকৃতি সাধারণ পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন। মূলত বুদ্ধদেবের দাক্ষিণ্যেই জীবনানন্দ প্রাথমিকভাবে কবি হিসেবে পাঠকের মনোযোগ লাভ করেছিলেন।
বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।
অনুবাদের ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর অনন্য অবদান ফরাসি কবি বোদলেয়ারের কবিতা বাংলায় নিয়ে আসা। এ বইটি তাঁর ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অপরিহার্য একটি দিশারী হয়ে দেখা দেয়, যার মাধ্যমে ফরাসি তথা ইয়োরোপীয় সাহিত্য, এবং বিশেষ করে কবিতার প্রতি সাধারণ পাঠক এবং কবি-সাহিত্যিকদের আগ্রহ তৈরি হয়। এজন্যই অনতিবিলম্বে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একের পর এক ফরাসি ও অন্যান্য ইয়োরোপীয় কবিদের কবিতা অনুবাদে হাত দেন। সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়রাও এক-ই পথের পথিক হয়েছিলেন। অনুবাদচর্চার সে ছিল এক উজ্জ্বল সময়।
কেবল বোদলেয়ার-অনুবাদের মধ্যেই সীমিত থাকেননি বুদ্ধদেব। অনুবাদ করেছেন রাইনের মারিয়া রিলকে, হ্যেল্ডারলিনের কবিতাও। তাঁর সঙ্গে ভারতের অবিসংবাদী কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাসের ‘মেঘদূত’। অনুবাদক বুদ্ধদেব বাংলা সাহিত্যের এক স্বতন্ত্র অধ্যায়।
অনুবাদ ছাড়াও বুদ্ধদেব বসুর আরও এক অনন্য কাজ বাংলা কবিতার একটি সঙ্কলন সম্পাদনা করা। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে তিরিশের দশক পর্যন্ত কবিদের কবিতা তাঁর সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-য় স্থান পেয়েছে। তরুণ কবিদের, কী এপার বাংলা, কী ওপার, সম্মানজনক উপস্থিতি এ-সঙ্কলনটিকে মর্যাদা দিয়েছে। এখানে স্থান পাওয়া তরুণ বহু কবির কবিতাই আছে, যাঁদের অনেকের-ই তখন পর্যন্ত কোনও কাব্যগ্রন্থ-ই প্রকাশিত হয়নি, এবং পরে তাঁরাই কবি হিসেবে বাংলা কবিতার জগতে স্থান পেয়ে গেছেন। যথার্থ জহুরি ছিলেন তিনি— সাহিত্য, ও বিশেষ করে কবিতা বিচারের।
১৯৬১-তে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে ইয়োরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রিত বক্তা হয়ে তিনি কবিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। দু’জনের দেখাসাক্ষাৎ, পত্রবিনিময়, সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা বুদ্ধদেবের জীবনে সম্ভ্রান্ত অর্জন। তিনি শান্তিনিকেতনে একটি বাড়িও করেছিলেন। একথা নিঃসংশয়ে বলা চলে, বুদ্ধদেব বসু ছিলেন একদিকে রবীন্দ্রনাথ, অন্যদিকে বুদ্ধদেবের পরবর্তী প্রজন্ম, এই দুই যুগের অচ্ছেদ্য সেতুনির্মাতা।
কোনও কোনও লেখক কেবলমাত্র নিজ সৃষ্টির কাজটিই করে যান। কেউ কেউ আবার হয়ে ওঠেন তাঁর সময়ের সাহিত্যের অভিভাবক ও প্রতিভূ। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তাঁর যুগে। যেমন রবীন্দ্রনাথ। তেমনই রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু।
সাহিত্যজীবনের শেষপর্বে তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন অসাধারণ কয়েকটি কাব্যনাট্য, ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’, ‘প্রথম পার্থ’, ‘অনাম্নী অঙ্গনা’, ‘কালরাত্রি’ ইত্যাদি। বাংলা কাব্যনাট্য জগতের বিস্ময়কর সংযোজন এগুলো। আর দিয়ে গিয়েছেন ‘মহাভারতের কথা’ নামে অযুত মননসঞ্চারী বিশ্লেষণাত্মক গ্রন্থ। তাঁর অকালপ্রয়াণ বইটিকে সম্পূর্ণাঙ্গ করতে দেয়নি। তবু এই গ্রন্থে তিনিই প্রথম পাশ্চাত্যের দুটি মহাকাব্য, হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’-র প্রতিতুলনা এনে সমালোচনার মাত্রাকেই ব্যাপ্তি দিয়ে গেছেন।
বুদ্ধদেব বসু গত হয়েছেন পঞ্চাশ বছরের ওপর। কিন্তু তাঁর প্রভাব বাংলাসাহিত্যে আজ-ও অপ্রতিরোধ্য। তাঁর রচনাশৈলী আমাদের ঈর্ষণীয়, সম্পাদনা অনুসরণীয়, সাহিত্যে তাঁর মনোযোগ ও একনিষ্ঠতা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

চিত্র: গুগল

Advertisement

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 + three =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »