২০১৮ সালের জুন মাসে পড়েছি বৃক্ষাচার্য শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন শর্মার ‘জীবনস্মৃতি মধুময় পৃথিবীর ধূলি’। সুন্দর, সাবলীল আর প্রাঞ্জল বর্ণনা। মুগ্ধ হয়ে পড়েছি পুরো বই। আমার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছিল শিমুলিয়া, কাঁচলিরপার, সাঝিপাড়া, কাঁঠালিয়া, বামনতকি বাজার, দুরবিন টিলা, পাথারিয়া পাহাড় ইত্যাদি জায়গা। আর দ্বিজেন স্যারের প্রকৃতিবিদ্যার প্রথম শিক্ষাগুরু শোভাবুড়াও আমার চোখের সামনে তিরধনুক নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, যিনি তাঁকে প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন।
২০১৬ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে কর্মরত থাকাকালীন দ্বিজেন স্যার আমাকে একবার মুঠোফোনে কল করেছিলেন। আমি খুশি হয়েছিলাম অনেক। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের ‘প্রকৃতিবার্তা’-য় বাংলাদেশের লতাগুল্ম নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। স্যার এটা পড়েই আমাকে ফোন করেছিলেন। কোথায় পড়াশুনা করেছি— তার খোঁজ নিয়েছিলেন এবং কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রকৃতিবার্তা লেখার সঙ্গে উদ্ভিদের ছবি ছাপিয়েছিল কিন্তু ছবির নিচে উদ্ভিদের নাম দেয়নি। বিষয়টি আমি সম্পাদক তুষারকান্তি সরকারকে জানাই। পরবর্তীতে প্রকাশিত প্রতিটি লেখাতেই উদ্ভিদের ছবির সঙ্গে তার নাম ছাপা হয়। আমরা যারা উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে লিখি, স্যার তাদের সম্পর্কে জানতেন এবং তাদের ভালবাসতেন— এটা পরিষ্কার। স্যারের ফোন করার দিনটি আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
নিকড়ি নদীর তীরে পাথারিয়া পাহাড়ের কোলে বেড়ে উঠেছেন দ্বিজেন শর্মা। বাবা চন্দ্রকান্ত কবিরাজের বাড়িতে ছিল অনেক ফুলগাছ, আম-কাঁঠালের গাছ আর বনৌষধি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর উদ্ভিদ ও প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ, যা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেকের মনে, উদ্বুদ্ধ করেছেন উদ্ভিদ চেনা, গাছ লাগানো ও প্রকৃতি সংরক্ষণে। মানুষ, প্রকৃতি ও ইকোসিস্টেমের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের ওপর খুব জোর দিতেন, গুরুত্ব দিতেন এ সম্পর্করক্ষার ওপর।
বাংলাদেশে প্রকৃতি ও নিসর্গবিষয়ক লেখালেখিরও পথিকৃৎ দ্বিজেন শর্মা। পরবর্তী জীবনে জীবিকার জন্য তিনি যেখানেই গেছেন, নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন প্রাণ ও প্রকৃতির রূপের সন্ধানে। উদ্ভিদ জগৎ, প্রকৃতি বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে লিখেছেন।
দ্বিজেন শর্মা বাংলাদেশের রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন, তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ে তোলায় সবাইকে সম্পৃক্ত করতে আজীবন প্রচার চালিয়ে গেছেন। উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে লেখা দ্বিজেন শর্মার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ প্রকৃতিপ্রেমী ও গবেষকদের কাছে অন্যতম আকরগ্রন্থ। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি এর পুনর্মুদ্রণ করে। লেখক এই গ্রন্থে ঢাকার সুদর্শন বৃক্ষরাজির আকার, আয়তন, আকৃতি, বর্ণ এবং এর ভেষজ গুণের বর্ণনা দেন। বইটি ১৯৯৭ সালে আমি কিনেছিলাম। আমি অনার্স শ্রেণিতে ট্যাক্সোনমি পড়াই আর উদ্ভিদ নিয়ে লিখি। খুব কাজে এসেছিল বইটি। তাঁর এই বইয়ে গাছ, ফুল ও ফলের বর্ণনার সঙ্গে উঠে এসেছে ময়মনসিংহ গীতিকা, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সিলেটের লোকগীতি ছাড়াও মধ্যযুগের কাব্যগাথা। তাঁর ‘হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ড্যালটন হুকার’ বইটিও আমি পড়েছি।
যাঁদের লেখা পড়ে আমি উদ্ভিদ বিষয়ক লেখালেখিতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে দ্বিজেন স্যার অন্যতম। আমার বই ‘বাংলার শত উদ্ভিদ’ আমি নওয়াজেশ আহমেদ এবং দ্বিজেন শর্মাকে উৎসর্গ করেছিলাম।
নগরে বেড়ে ওঠা একটি প্রজন্মকে বৃক্ষ, তরু-লতা আর ফুল-ফলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে মুখ্যভূমিকা পালন করা প্রকৃতিপ্রেমী দ্বিজেন শর্মা অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেছেন। তিনি রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন, তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ে তোলায় সবাইকে আহ্বান জানিয়েছিলেন দ্বিজেন শর্মা।
তিনি ‘তরুপল্লব’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের সভাপতি ও আয়োজক হিসেবে তিনি তরুণ গবেষক ও স্বেচ্ছাসেবীদের প্রায়ই রমনা পার্ক, বলধা গার্ডেন ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে যেতেন। গাছপালা ও বৃক্ষরাজির সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। শেখাতেন দেশি ফুলের জাতপাত ও রকমফের। শেখাতেন প্রকৃতিকে ভালবাসতে ও শ্রদ্ধা জানাতে। তরুপল্লবের একটি গাছচেনা কর্মসূচিতে আমি গিয়েছিলাম ২৬ এপ্রিল ২০১৯ গাজীপুরের টাঁকশালে ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে। উদ্দেশ্য পারুল সন্দর্শন।
নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা নেই কিন্তু তাঁর কর্ম ও আদর্শ আমাদের উদ্ভিদ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে অনুপ্রেরণা যোগাবে যুগ যুগ ধরে। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।