আমাদের ছোটবেলাটা লম্প-হারিকেন আর বিজলি বাতি মিলেমিশে থাকার সময়। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের গ্রামাঞ্চলে সন্ধের পর যে আলো জ্বলত, সেখানে বিজলি বাতির উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ছিল প্রদীপ, মোমবাতি, হারিকেন, লম্প, পেট্রোম্যাক্স, মশাল, কার্বাইড বা অ্যাসিটিলিন গ্যাসবাতি এমন সব দ্যুতিময় ব্যবস্থা। কিন্তু আমি ওই গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধের প্রায় শুরুতেই বড় হয়েছি হাওড়ায়; হাওড়ার বেলিলিয়াস রোড তখন ভারতের শেফিল্ড। সেই সংকীর্ণ রাজপথের দু’পাশে সারি সারি ছোটবড় কারখানা, বলা ভাল, হাওড়ার অলিগলি জুড়েই ছোট আর মাঝারি শিল্পের রমরমা। তাই আমি বেড়ে উঠেছি বিজলি বাতির সময়েই।
তবে সে এক অন্যরকম সময়। রাতে সেই আধাশহর হাওড়ায় গৃহস্থের বাড়ি আলোকিত করার পাশাপাশি রাতেও বিজলির চাহিদা ছিল কলকারখানার কাজে। কেন না সেখানে কাজ বন্ধ হতে হতে রাত ন’টা-দশটা। তাই, বাড়ির আলো মিটমিটে, একশো ওয়াটের বাল্ব যেন নাইট ল্যাম্প। রাত দশটার আগে মোটেই সতেজ জ্বলত না সেই বিজলি বাতি। সময়টা ছিল ইনক্যানডেসেন্ট বাল্বের সময়। একটা পাতলা কাচের বাল্বের ভেতর তারের কুণ্ডলী বিজলির শক্তিতে জ্বলে হলুদ আলো ছড়াত। তবে সে-সময় সেই বাল্বের ভেতরে কাচের তলের ওপর ফসফোরেসন্স আস্তরণ দিয়ে খানিক সাদা আলোর ছড়ানোর চেষ্টাও ছিল। কিন্তু সে বাল্ব আমার বিশেষ পছন্দের ছিল না। কেন না তার ভেতরের কিছুই দেখা যেত না। স্বচ্ছ বাল্বে আমার কেরামতির সুযোগ থাকত। বাল্ব পুরনো হলেই সেটির ভেতর তারের লম্বা কুণ্ডলীটি কেটে যেত। রান্নাঘরে তেমনটি হলেই আমার ডাক পড়ত; ঠাকুমার কাতরোক্তি, দেখ না বাবা, আলোটা জ্বলছে না। শুরু হত আমার মেরামতি। বাল্বটিকে নানাভাবে, নানা দিকে ঘুরিয়ে কায়দা করে কুণ্ডলীর কাটা খণ্ডদুটি মুখোমুখি লাগিয়ে সন্তর্পণে হোল্ডারে লাগাতে পারলেই বাল্ব আবার জ্যান্ত। ঠাকুমার বিশেষ ‘সাবাসি’ মিলত। আমিও যেন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারের গর্বে গর্বিত।
এই শতকের গোড়াতেও আমাদের বাড়ির স্নানঘরে, রান্নাঘরে, কালিঝুলি মেখে হলদেটে ম্যাড়মেড়ে আলো দিত ইলেকট্রিক বাল্ব। ছোটবেলায় দেখেছি মধ্যবিত্ত গেরস্থ বাড়িতে ৪০, ৬০, বড়জোর একটি-দু’টি ১০০ ওয়াট বাল্ব ব্যবহার হত। রাস্তায় কোনও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে কিংবা দোকানে ৫০০ ওয়াট ব্যবহার হতে দেখেছি। শুনেছি শিল্পক্ষেত্রে হাজার-দু’হাজার ওয়াটের বাল্বও ব্যবহার হত। সে যাই হোক, একে তো উজ্জ্বলতা বেশিদূর ছড়িয়ে পড়তে পারে না, তার ওপর বিজলির ব্যবহার আর সেই তুলনায় ঔজ্জ্বল্যের নিরিখে সেই ইক্যানডেসেন্ট বাল্ব মোটেই শক্তিসাশ্রয়ী ছিল না। ১৯২০-৩০-এর মধ্যে বিদেশে শক্তিসাশ্রয়ী নিয়ন আলো এসে গিয়েছিল। আমাদের দেশেও পাঁচের দশকে বিজ্ঞাপনে নিয়ন সাইনবোর্ড শহর জীবনে বেশ চমক নিয়ে এল। পাঁচ-ছয়, এমনকী সাতের দশকে কত সাদাকালো ছায়াছবিতে তেমন নিয়ন সাইনবোর্ডকে গুরুত্ব দিয়ে পরিচালক জায়গা করে দিয়েছেন। দিনের বেলা যে সরু সাদা কাচের টিউব সুন্দর ক্যালিগ্রাফি হয়ে মেট্রোপলিটন বিল্ডিংয়ের ছাতে দাঁড়িয়ে থাকত, রাতে কালো আকাশের পটে সাদা আলো ছড়িয়ে সেই সুন্দর ক্যালিগ্রাফির টিউবটি ভাল লাগার আরেক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিত। ছোটবেলায় অবাক হয়ে দেখেছি ডালহৌসি স্কয়ারের মোড়ে নিয়ন আলোর কেটলি, আলোর কাপে আলোর চা ঢেলে চলেছে তো চলেছেই। সেসময় রাতের কলকাতার নিয়ন আলোর বিজ্ঞাপন ছোটবড় সকলকেই মোহিত করেছিল। সেই পাঁচের দশকের শেষেই কলকাতার ঘরে ঘরেও জনপ্রিয় হয়ে উঠল নতুন সেই আলো। নিয়ন আলো। আমাদের বসার ঘরে যেদিন সে আলো লাগানো হল, ঠাকুমা বলেছিল, ওরে বাবা, এ তো দেখি পূর্ণিমার আলো।
আমার জন্মের কিছু আগে গীতিকার-সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় সুবীর সেন গাইলেন, ‘নগর জীবন ছবির মতন হয়তো’। দেশভাগের হাজার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে, বাংলার মুক্ত, উদার, শ্যামল, পল্লিপ্রকৃতি ফেলে এসে, মানুষ বাসা বেঁধেছে শহরের ছোট ছোট উল্লম্ব সব খোপে। সেই বাহাত্তর বছর আগের গানেই আছে, ‘নিয়ন আলোয় চাঁদের আলোর ঝড়, শাওয়ারে শুনছি ঝর্নার কলস্বর’, এমন সব আধুনিক পঙক্তিমালা। যাঁরা এখনও সেই গান শোনেননি, শুনবেন; আর যাঁরা শুনেছেন, তাঁদের এ গান মনে থাকবেই। ‘বিজলি পাখা তোলে ভ্রমরের সুর, ন’তলার ছাতে হাওয়ার সমুদ্দুর’— স্পষ্ট চিনিয়ে দেয় সেই হাঁফিয়ে ওঠা নগরজীবনকে। ক্রমে সব সয়ে গেল; নিয়ন আলোও তার নাম হারাল। আমার কিশোরবেলা পৌঁছতে পৌঁছতে নিয়ন আলোর চালু নাম হল টিউব লাইট।
নিয়ন গ্যাসের আশ্চর্য ব্যবহার হাতিয়ার করেই সময়ের উদ্বর্তনে এসে হাজির হল সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প, মার্কারি ভেপার ল্যাম্প, হ্যালোজেন ল্যাম্প ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এ-সবই ছিল মূলত শিল্পে, রাজপথে কিংবা বড় বড় দোকানের পসরা সাজিয়ে তোলার আলো। আর তাদের নিজস্ব ব্যামোও ছিল হাজার রকম। সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের ছিল খানিক কমলা-ঘেঁষা রঙের আলো; তুলনায় মার্কারি ভেপার ল্যাম্পের ছিল চোখধাঁধানো নীলচে-সাদা আলো। তখন কলকারখানায় আর কিছু বড় বড় দোকানের ভেতর ব্যবহার হলেও, মূলত সেসব আলো বেশ কিছুকাল রাজপথ আলোকিত করেছে। সুইচ অন করার পর বেশ কিছুক্ষণ লাগত তাদের স্বমহিমায় আলো ছড়িয়ে দিতে। আর সে-সব ল্যাম্পের বয়েস বেশি হয়ে গেলে তো চিত্তির, সন্ধেয় জ্বালানো আলোর উজ্জ্বল হয়ে উঠতে প্রায় মাঝরাত! তার ওপর মার্কারি ভেপার ল্যাম্পের আলোয় মিশে থাকত ক্ষতিকর অতিবেগুনি বিকিরণ। তবে হ্যালোজেন ল্যাম্পের তেমন সমস্যা ছিল না আর আলোও ছিল বেশ স্নিগ্ধ সাদা; কিন্তু সে নিজেই তেতেপুড়ে এমন আকস্মিক লঙ্কাকাণ্ড ঘটাত যে, তারও স্থায়িত্ব বিশেষ টেকসই হয়নি। শাড়ির দোকানের মধ্যে এসব আলো দোকানের জেল্লা যতই বাড়াক, ক্রেতারা দেখেছি মোটেই খুশি হতেন না, কেন না এসব আলোয় ছিল বর্ণবিপর্যয় ঘটানোর অদৃশ্য শক্তি। মায়ের সঙ্গে তেমন আলোকিত দোকানে মাকে দেখেছি পছন্দের শাড়ি নিয়ে দোকানের বাইরে দিনের আলোয় আসল রংটি দেখতে; বেশিরভাগ সময়েই দোকানের ভেতরে যা মায়ের পছন্দের ঝলমলে কোনও রং, দিনের আলোয় নিতান্তই অনুজ্জ্বল, অপছন্দের।
আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও। এলইডি বাল্ব বা টিউব যতই বিজলি আর অর্থ সাশ্রয়ী হোক, আমার চোখে নিয়ন আলোর স্নিগ্ধতা অনেক বেশি আরামের। হয়তো অনেকের চোখেই, তাই আজও নানা কোম্পানির নিয়ন টিউব বাজার ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। এমনকী টিউব লাইটের চোক, স্টাটারের মতো সব উপাঙ্গ বাল্বের পেটের মধ্যে পুরে সিএফএল বাল্বও বেশ কিছুদিন দাপিয়ে ‘আলোয় আলোকময়’ করার কাজ করেছে; তবে এখন কিছু স্তিমিত হয়েছে তার বাজার। কিন্তু একথাও ঠিক যে, টেকসই, সাশ্রয়ী, লাইট এমিটিং ডায়োড ক্রমশ বাজার পুরোই দখল করে নেবে। আজ এলইডি আলোর নানা রূপ, নানা আকার, নানান তেজ কলকারখানা, শপিং মল, ছোটবড় দোকান, রাজপথ থেকে অলিগলি, পথের ধারে গাছের কাণ্ড, ল্যাম্পপোস্টের শরীর জুড়ে ঝলমলে বাহার। রাতের ‘নগর জীবন ছবির মতন’ সেজে উঠেছে। ‘হয়তো’ নয়, নিশ্চিত। তবে সেই ছবি থেকে সরে গেছে জোনাকি; কেন না তার পাঠানো আলোর সংকেত এখন তার বন্ধুদের কাছে পৌঁছয় না। আলোয় সাড়া দিয়ে অযাচিত ভিড় বাড়াচ্ছে অলুক্ষণে সব পোকারা। দিনরাত সমান করা আলোর তেজে পাখিদের সময়ের হিসেবনিকেশ গেছে গুলিয়ে, অঘটন ঘটেছে তাদের নানা শারীরবৃত্তীয় কাজে। বেচারা গাছেদের পাতার আলোকসংবেদী ক্লোরোফিল-কণারাও বিব্রত। একে তো নগরের বাতাসে মিশে থাকা বিষবাষ্পে গাছের পাতা আক্রান্ত, তার ওপর দিবারাত্র আলোকের এই ঝর্নাধারায় গাছেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাই এখন আর ক’দিন যে ‘ফুটপাথে পোষা কৃষ্ণচূড়ায় বসন্ত আসে নেমে’ চরণটি সত্যি থাকবে কে জানে! সুবীর সেনের গানটিই তাড়া দিয়ে এই লেখাটি লিখিয়েছে। তাই সেই গানের প্রথম লাইনটি শিরোনামে রাখলাম।
চিত্র: বিজন সাহা (রাশিয়া)






