Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ভূতের একটি বাজে গল্প

সুকুমার রায় লোকটিকে আমি খুব মানি। ওই যে বলেছিলেন না, বড়মামা কিছুই বিশ্বাস করতে চায় না। এই পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্তটিও চমৎকার। মানুষ বড় হয়ে গেলে ‘হোঁৎকা’ হয়ে যায় আর তখন কিছুই বিশ্বাস করতে চায় না। আমার এই গল্প ধৈর্য্য ধরে কেউ পুরোটা পড়লেও শেষে গিয়ে বলবেন, দুর, কীসব আজেবাজে লেখা, সময় নষ্ট। আমি বাবা তাই শিরোনামেই ‘বাজে গল্প’ লিখে দিলাম। আমার আর দায় নেই।

আমি বিজ্ঞান পড়া, বিজ্ঞান চর্চা করা লোক।‌ কিন্তু আমার চিরকাল মনে হয়েছে, এই দুনিয়ায় কয়েকটি নির্বিষ ভূত থাকলে বিজ্ঞানের কী আর এমন আসত-যেত! আর এ-ব্যাপারে আমার গুরুদেব প্রেমেন মিত্তিরের মেজকর্তা। তিনিই কোন বাল্যকালে আমার মাথায় ভূত খোঁজার ভূতটি চাপিয়ে দিয়েছেন। এখন যেখানেই বেড়ানোর প্ল্যান করি, খুঁজে দেখি কাছাকাছি কোথায় ভূতুড়ে বাড়ি, ভূতের নেত্তস্থল আছে। সেখানে থাকা বা যাওয়া আমার অবশ্যকর্তব্য। ভূভারতে তেমন ভূতুড়ে জায়গার কোনও অভাব নেই। গেলেই হল। দার্জিলিংয়ে ডেবরে পানির বনবাংলো, কালিম্পংয়ের মরগ‌্যান হাউস, সুরাটের ডুমা’স বিচ, গোলকোন্ডা ফোর্ট মায় আমাদের কলকাতার পার্ক স্ট্রিট কবরখানা, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, রাইটার্স বিল্ডিং এমন হাজার একটা। তবে সরকারের দপ্তরগুলো নবান্নে চলে যাবার পর রাইটার্স বিল্ডিং এখন কলকাতার ভূতেদের পুনর্বাসনের সবচেয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়। এখানে অবশ‌্য যে গল্প বলতে বসেছি, সেসব ঘটনা ঘটল এই হালে। বছর তিনেক আগে অক্টোবরের শেষে, উত্তরাখণ্ডে।

কাঠগুদাম থেকে যখন রওনা হয়েছিলাম তখনও ভোরের আলো ফুটতে ঢের দেরি। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ থেকে দু’রাত্তির থাকব বিনসরের কেএমভিএন-এর বাংলোয়। সেখানে আপনারা অনেকেই থেকেছেন। প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট উচ্চতায় সেই বাংলো। পৌঁছতে শেষটায় ঘন পার্বত্য অরণ্যের মধ্যে দিয়ে সংকীর্ণ ষোলো-আঠারো কিমি পথ পার হয়ে বাংলোর দরজা। পৌঁছে দেখি রিসেপশনে বড়সড় জটলা। চারটি ট্যুরিস্টের দল তখনই বেরিয়ে পড়ার তোড়জোড় করছে। জানা গেল, গতদিনের মেঘভাঙা বৃষ্টিতে গোটা কুমায়ুন বিপর্যস্ত। আলমোড়ার পরে ধসে চাপা পড়েছে ট্যুরিস্টের গাড়ি। হতাহত বেশ কয়েকজন। চৌকরির পথ ভেঙে গেছে। বিনসরের এই জঙ্গলের পথ বিপর্যস্ত হলে সে রাস্তা সারিয়ে তুলতে বহু সময় লাগবে। তাই ট্যুরিস্টরা সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। নিচের কোনও উচ্চতায়, যেখান থেকে সহজে ঘরে ফেরার ট্রেন ধরা যায়। এও জানা গেল, বৃষ্টিতে কাঠগুদাম আর লালকুঁয়ার মধ্যে রেললাইন আর একটা ব্রিজ ভেসে গেছে। তাই লালকুঁয়ার পরে ট্রেন এগোতে পারছে না। কয়েক মিনিটেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের যাবতীয় আপডেট পাওয়া গেল।

ট্যুরিস্টদল একে একে নেমে যেতে লাগল। পাহাড়-প্রমাণ বোঝা নিয়ে বেড়াতে বেরোনো ভারতীয় পর্যটকদের, বিশেষত বাঙালিদের, চিরকেলে অভ্যেস। গন্ধমাদন সঙ্গে থাক, বিদেশ-বিভুঁইয়ে কখন কী কাজে লাগে! বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। গাড়ির ছাদে বাক্স-প্যাঁটরা তোলা গেল না। আবার গাড়ির ভেতর সব মালপত্র ঢোকার পর চারজনের আর জায়গা নেই। তাঁদের সহায় হল আমাদের গাড়ির ড্রাইভার, নেগী। বিনসরের ম্যানেজার আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন, তিনি পরশু আমাদের জঙ্গলের রাস্তা পার করে নিচে চৌকরির রাস্তায় তাঁর ফোর-হুইল ড্রাইভ জিপে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু রাস্তা খারাপ হলে আমাদের ভাড়ার সেভেন-সিটার গাড়িটি আটকে যাবে। তাই নেগী উদ্বৃত্ত চারজনকে নিয়ে নিচে নেমে গেল। সে পরশুদিন জঙ্গলের রাস্তার শেষমাথায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। বিনসরের সেই বিশাল বাংলোর মধ্যে রয়ে গেলাম আমরা চারজন।

কেএমভিএন-এর বিনসর বাংলো।

সাড়ে চারটে বাজছে। প্রায় অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কুয়াশার চাদরে মোড়া চারপাশ। বাংলোর টিনের চাল আর অরণ্যের ওপর অঝোরে ঝরে পড়া ধারাপাতের একটানা শব্দের যুগলবন্দী ছাড়া আর কোনও আওয়াজ শোনার উপায় নেই। বিনসরের বাংলো বুকিংয়ের সময় জানিয়ে দিয়েছিল সন্ধে ছ’টা থেকে আটটা অবধি সোলার আলো জ্বলবে। পরে মোমবাতি ভরসা। বিশাল বাংলোর অন্দরের কোনায় কোনায় শেষবিকেলেই চাপ চাপ অন্ধকার জমে উঠেছে। আধো আলো আধো-অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে বাংলোটা দেখছি। একতলায় টানা করিডরের কোলে পরপর ছ’টা ঘর। দোতলাতেও তাই। আমাদের বরাদ্দ হয়েছে একতলার ১০১ আর ১০৩ নম্বর ঘরদুটো। প্রথমটায় হিমাংশুদা আর মন্দিরাদি আছেন আর পরেরটায় আমি ও অর্ক। রিসেপশনের বাঁদিকে সিঁড়িতে গোটা সাতেক ধাপ নামলেই একতলা; আবার তেমনই কয়েকটা ধাপ সিঁড়ি উঠলেই দোতলা। আর ডানদিকে কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ উঠলেই বেশ প্রশস্ত সুসজ্জিত ডাইনিং হল আর তার লাগোয়া কিচেন। আলো আরও কমে এসেছে। এখনও আধঘণ্টা পরে হয়তো সোলার বিজলী বাতি ‘হাজির সাব’ বলবে। অর্ক বলল, চলুন ঘরে গিয়ে স্যাক থেকে টর্চ বের করে আনি। এমন বর্ষার সন্ধেয় আমি ভাবছিলাম, এসময় চিকেন পকোড়া আর কফি পেলে মন্দ হত না। ঠিক সেই সময়েই সিঁড়ির মুখে হঠাৎ সিড়িঙ্গে মত একজন বলে উঠল, সাব, আপলোগ চিকেন পকোড়া অউর কফি লেঙ্গে? আমরা খানিক অবাক হয়ে নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম; আমরা যে জানতাম এই বাংলোয় ডিম ছাড়া আর কিছুই মেলে না! তা কে বাবা তুমি অন্তর্যামী মুস্কিল আসান এলে! তার আপাদমস্তক নানা গরম কাপড়ে ঢাকা, আর সেগুলোর রং অন্ধকারে কিছু বোঝা না গেলেও তার গলার লাল-হলুদ মেশানো একটা মাফলার বেশ দেখা গেল। আমার সম্মতিসূচক জবাবটি নিয়েই সেই লাল-হলুদ মাফলার নিমেষেই সিঁড়ির উপরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

ঠিক সন্ধে ছ’টা বাজতেই আলো যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘরে। সব সুইচ হয়তো এখানে দেওয়াই থাকে। তখনই দরজায় টোকা দিয়ে ফর্সা, বেঁটে, গাঁট্টাগোঁট্টা হাসিখুশি এক যুবক চিকেন কাবাব আর কফি ট্রে-তে সাজিয়ে রেখে ‘গুমনাম হ্যায় কোই, বদনাম…’ শিস দিতে দিতে চলে গেল। হিমাংশুদাদের ডেকে নিয়ে সন্ধের কফির আড্ডা আমরা জমিয়ে তুললাম। যেমন হঠাৎ আলো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘরে, তেমনই হঠাৎ ঝুপ করে সব আলো নিভে গেল। এত নিরন্ধ্র জমাট অন্ধকার অনেকদিন ছুঁয়ে দেখিনি। কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে। একটানা বৃষ্টি ঝরে পড়ার শব্দ। অর্ক, টর্চটা নিয়ে চল, আবার ঘুরে দেখি। অন্ধকার ঠেলে টর্চের আলো যেন এগোতেই চায় না। সিঁড়ির মুখে হঠাৎ খানিক আলো দেয়ালের গায়ে লম্বা ছায়া ফেলে এগিয়ে আসতে দেখি সেই লাল-হলুদ মাফলার দুটো মোমবাতি করিডরের দু’মাথায় জ্বেলে দিয়ে গেল। আর তাতেই ওই লম্বা করিডর যেন আলোয় ঝলমল করে উঠল। ভাই, তুমি আমাদের ১০১ আর ১০৩ কেন দিলে? ১০২ দিলে পরপর দুটো ঘর হলে সুবিধা হত। উত্তরে সে যে কী বলল, সবটা ঠিক বুঝলাম না; এটুকু বোঝা গেল ওই ঘরের ওয়াশরুম ঠিক নেই। তা না হয় হল, কিন্তু আমাদের দোতলার ঘর তো দেওয়া যেত! এবার আর তার কোনও জবাব পাওয়া গেল না। শুধু যেমন নিঃশব্দে সে এসেছিল, তেমনই ধীরপায়ে করিডরের শেষে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর যেতে যেতে হালকা স্বরে জানিয়ে গেল, ন’টার পর রাতের খাবার পাওয়া যাবে না।

ভরসা মোমবাতি।

১০২ তালা বন্ধ থাকলেও তার দরজার পাল্লা ঠেলে একচিলতে লম্বা ফাঁক দিয়ে টর্চের আলোয় অনেক কিছুই দেখা গেল। বেশ পরিষ্কার, গোছানো ঘর। ট্যুরিস্ট এলে খুলে দিলেই হল। ওপরের ঘরগুলোর বেশ কয়েকটায় একই ভাবে উঁকি দিয়ে দেখে এলাম। সেগুলোও বেশ সাজানো-গোছানো বলেই মনে হল। তুমুল বর্ষার রাতে এই রহস্যময় বিশাল প্রায়-জনশূন্য বাংলোটির আনাচ-কানাচে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ যেন সবকিছু আমার অতিপরিচিত ঠাওর হল। চলুন হিমাংশুদা, রাতের খাবার ঝামেলাটা মিটিয়ে আসি। এই বাংলোর রান্না বেশ ভাল। ভাত, রুটি, সালাড, ডাল, মিক্সড ভেজ, চিকেনকারি আর টক দই দিয়ে জব্বর ডিনার হল। সার্ভ করল সেই হাসিখুশি ছেলেটি। দু’চারটি যা কথা হল তাতে জানা গেল, প্রায় গোটা উত্তরাখণ্ড বিপর্যস্ত। তাই বাংলোর সকলেই যে-যার বাড়ি চলে গেছে। রিসেপশনের ভদ্রলোক, তাঁর স্ত্রী, ড্রাইভার আর সাহায্যকারী দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই আজ। তবে আমরা বিকেলের পর থেকে ওই লাল-হলুদ মাফলার আর হাসিখুশি ছেলেটিকে ছাড়া আর কাউকেই দেখিনি। আমাদের খাওয়া শেষ হতে না-হতেই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সবকিছু সরিয়ে ফেলল সেই হাসিখুশি ছেলেটি। এই তরুণ ছেলেটি তার কাজের ফাঁকে সবসময়ই শিস দিয়ে চলে। এখন সেই উনপঞ্চাশ সালের মহল সিনেমায় মধুবালার লিপে ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি সে শিস দিয়ে ভেঁজে চলেছে। ছেলেটি যতই হাসিখুশি হোক, তার এই শিস দিয়ে সুর তোলার মধ্যে কোথায় যেন একটা বুকচাপা বিষাদ ছুঁয়েছে। আমরা আমাদের ঘরের পথে পা বাড়াতে বাড়াতেই পেছনে সব চুপচাপ আর অন্ধকার হয়ে গেল। ঘরে পৌঁছে অর্কর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

অনেক রাতে কীসের যেন শব্দে হঠাৎ ঘুম ভাঙল। মনে হচ্ছে, পাশের ঘরে কারা যেন আসবাবপত্র টানাটানি করছে! এত রাতে এমন দুর্যোগের মধ্যে কে পৌঁছল! বুঝলাম অর্কর ঘুমও ভেঙেছে। দুজনেই বিছানায় উঠে বসেছি। টর্চ নিয়ে সন্তর্পণে দরজার ছিটকিনিটা খুট করে খুলতেই আওয়াজ বন্ধ। ১০২-এর দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই প্রথমে যেটি চোখে পড়ল, সেটি সেই লাল-হলুদ মাফলার, খাটের পাশে ঝোলানো। তাহলে সিড়িঙ্গেবাবু নিশ্চয়ই এই ঘরেই অধিষ্ঠান করেন, তালা দিয়ে কোথাও বেরিয়েছেন। হঠাৎ আমি ভূতগ্রস্তের মত করিডর ধরে হাঁটছি আর এক-একটা করে ঘরের দরজা ঠেলে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছি। কী আশ্চর্য, প্রতিটি ঘরেই কোথাও না কোথাও দেখছি একটা করে ওই লাল-হলুদ মাফলার ঝুলছে। যত দ্রুত পারি দোতলায় ঘরগুলোর দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সবখানেই এক ছবি। আমি আর অর্ক নির্বাক ঘরে ফিরে এলাম। শুয়ে পড়েছি, লেপের আরামে। শুনতে পাচ্ছি দোতলার ঠিক ওপরের ঘরটিতে আসবাব ঠেলার শব্দ। সকালে যুগপৎ বেড-টি ও হিমাংশুদার ডাকে ঘুম ভাঙল।

পরদিন সকালটায় বৃষ্টির বেগ কমে গেছে। আলো বেশ চকচকে। ব্রেকফাস্ট শেষ হতে হতে যেন হালকা রোদের আভাস দেখা গেল। কাচের দেয়ালঘেরা এই আড়াইতলা উঁচুতে ডাইনিং হলটি থেকে চারপাশের চির, ওক, বাদাম, রডোডেনড্রন গাছগুলোর ঘন ঝাঁকড়া মাথাগুলো ভাল দেখা যাচ্ছে। আর নানান রকম পাখি ছুটোছুটি করে তাদের প্রাতঃরাশ সারছে। গতকাল বৃষ্টিতে এদের কারওরই দেখা মেলেনি। আমরাও ওদের সঙ্গে নাচানাচি করে ছবি তুলতে লাগলাম। প্রায় এগারোটা বাজছে। আবার ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হল। পাখিরা ফিরে গেল; আমরাও ঘরে ফিরে জানালার ধারে চেয়ারদুটোর দখল নিলাম। জানলার কাচের ওপর বাষ্পের আস্তরণে অনচ্ছ। মুছে পরিষ্কার করে দিতেই ডানদিকে খাদের দিকে ঝুঁকে থাকা স্টিলের রেলিংঘেরা সেই ঝুলবারান্দাটা দেখা গেল। এখান থেকে দাঁড়িয়ে বরফঢাকা হিমালয়ের রেঞ্জটিকে খুব কাছে দেখায়। এখন সেসব কুয়াশা আর মেঘের পুরু লেপে ঢাকা। বাইরে হাওয়া দিচ্ছে বেশ। আর দেখছি দূরে ওই ঝুলবারান্দার রেলিংয়ে ঝোলানো একটা লাল-হলুদ মাফলার হাওয়ার তালে দুলছে। হিমাংশুদা স্নান ছাড়া থাকতে পারেন না। অর্ক গেল স্নানের জন্য এক বালতি গরমজল পাঠানোর তদবির করতে। অর্ক ফেরার আগেই গরমজল এসে গেল। হিমাংশুদার সাহসে আমিও যেন স্নানের অনুপ্রেরণা পেলাম। হিমাংশুদার বাথরুমে সেই বালতি রেখে বেরোতে না বেরোতেই আমি আমার দরজায় পৌঁছে মুখ বাড়িয়ে আর-এক বালতি গরমজলের অনুরোধ করতে গিয়ে দেখি ওই মস্ত লম্বা করিডর পেরিয়ে চলে গেছে কোনও ইউসেন বোল্ট। কারও টিকির দেখা নেই। অগত্যা। স্নানের আশা ছেড়ে আমি জানালার কাছটিতে বসে ঝিরঝির বৃষ্টি দেখতে লাগলাম।

রানিং হট ওয়াটার।

দুপুরের খাবারের পর বৃষ্টি দেখলাম একেবারেই নেই। জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে দু’কিমি হাঁটাপথের শেষে বিনসরের জিরো পয়েন্ট। সেই দিকেই অর্ককে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। একটু বৃষ্টি কমতেই কত যে পাখি চোখে পড়ছে। অর্ক খুব খুশি। অনেক ভাল ছবি হচ্ছে তার। কিন্তু বিধি বাম। আবার ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হল; আমরাও ফেরার পথ ধরলাম। ঘরে লেপের নিচে টানটান খানিক শবাসন করতে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া গেল। বিকেলটা অনেক পরিষ্কার। বোঝাই যাচ্ছে কাল রোদ ঝলমল সকাল পাওয়া যাবে। বিকেলে সকলে মিলে খাদের ওপর ঝুঁকে থাকা ঝুলবারান্দায় গিয়ে বসলাম। অর্ক ক্যামেরা ঘাড়ে গাছগুলো স্ক্যান করছে পাখির খোঁজে। নিবিষ্ট দাঁড়িয়ে পড়লেই বুঝতে পারছি, সে তার ঈপ্সিত পাখির সন্ধান পেয়েছে। অর্কই হঠাৎ আমায় ডেকে দেখাল। একটার সঙ্গে আর-একটা এমন পর পর, যেন অনেক অনেক লাল-হলুদ মাফলার বেঁধে বারান্দার কোণে কী যেন খাদের দিকে ঝোলানো রয়েছে। আমি একটু টেনে দেখে বুঝলাম বেশ ভারি কিছু বাঁধা আছে তার শেষ মাথায়। সেই সিড়িঙ্গে লোকটাও হতে পারে। অর্ক আর আমি ওই কোণটা থেকে সরে এলাম। এরপর সন্ধে আর রাত একই রকম। আগের রাতের থেকে এই রাতটাও খুব আলাদা নয়। শুধু শেষরাতে কোথা থেকে এক মহিলা ও একজন পুরুষকণ্ঠে চাপা বাদানুবাদ ভেসে আসছিল। বেশ উত্তেজিত কথোপকথন। মিনিট দশেক পরেই একটা ভোঁতা শব্দ, যেন সাইলেন্সার লাগানো গান-শট।

ব্যাস, সব চুপচাপ।

পরদিন সকাল সত্যিই রোদ ঝলমলে। হিমালয়ের উদাত্ত স্নো-রেঞ্জ জঙ্গলের মাথায় মুকুট পরিয়েছে। আজ আমরা পরের দু’রাতের জন্য চৌকরি চলে যাব। আমাদের ব্যাগপত্র গোছানো। ড্রাইভার সাহেব তার নতুন চকচকে লাল রঙের একটা ফোর-হুইল ড্রাইভ জিপের মধ্যে আমাদের মালপত্র তুলে দিয়েছেন। রিসেপশনে ম্যানেজারকে কিছু টাকা দিয়ে অনুরোধ করলাম কিচেনের সাহায্যকারী দু’জনকে দিয়ে দিতে। ঠান্ডা একটু হাসি ঠোঁটে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। যান্ত্রিক ক্ষিপ্রতায় নোটগুলো একটা বাঁধানো খাতার নিচে গুঁজে দিলেন। আমি একটুকরো সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়ে ওর ফোন নম্বরটা লিখে দিতে অনুরোধ করলাম। উনি পেন দিয়ে ঘসঘস করে নম্বর লিখলেন। চার ভাঁজ করে কাগজটা যত্ন করে আমার পার্সে রেখে দিলাম। রাস্তা যা ভাবা গিয়েছিল, তার চেয়ে দশগুণ খারাপ অবস্থায় রয়েছে। দু’হাত অন্তর ধস, ছোট-বড় নানান গাছ উল্টে পড়ে আছে রাস্তাজুড়ে। পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এমন ভয়ংকর রাস্তায় কোনও ড্রাইভার গাড়ি চালাবেন না। অথচ এই ভদ্রলোক বিনা বাক্যব্যয়ে এগিয়ে চলেছেন। ধসে যাওয়া রাস্তা কিংবা উল্টে পড়া গাছ দেখলেই ‘থোড়িসি চলকে যাইয়ে’ বলে আমাদের নেমে যেতে নির্দেশ দিচ্ছেন। আবার বাধা টপকেই গাড়ি থামিয়ে ‘অন্দর আ যাইয়ে’ এমন সংক্ষিপ্ত আদেশগুলোর সঙ্গে পরপর বাধা টপকে চলেছি আমরা। একটা ইউ-এর মত বাঁকের মুখে হাত দিয়ে নির্দেশ করলেন খাদের দিকে; একটা মরচে ধরা ভাঙা দোমড়ানো জিপ আটকে আছে দুশো ফুট নিচে, পাথরের খাঁজে। সবাই দেখলাম, কিন্তু কেউ আর কোনও কথা বলল না। শেষে যেখানে নামতে হল সেখানে একটা বিশাল চিরগাছ উল্টে পড়েছে রাস্তা জুড়ে। আমরা হাঁচড়-পাঁচড় করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে গাছটার উৎপাটিত গোড়ার পাশ দিয়ে উল্টোদিকে নামলাম। কিন্তু রাস্তা থেকে অন্তত দু-আড়াইফুট উঁচু গুঁড়ি আর ছ’-আটফুট ছড়িয়ে থাকা ডালপালা টপকে গাড়িটা কী করে পার হল, এর কোনও সদুত্তর আমাদের কারও কাছেই নেই। যাহোক, আমরা বিপন্মুক্ত এখন। দূরে জঙ্গলে ঢোকার অনুমতি দেবার অফিসঘরটা দেখা যাচ্ছে। আমাদের নামিয়েই হাওয়ার গতিতেই গাড়িটা ফেরার পথ ধরল। আমরা এতক্ষণে ফোনের টাওয়ার পেলাম। আমাদের গাড়ির চালক নেগীকে ডেকে নিলাম। মুখে কিছু না বললেও স্পষ্ট অবিস্বাস চোখে-মুখে নেগীর।

অরণ্যপথের অর্ধেক ধসের কবলে।

আমরা চৌকরির পথ ধরলাম। প্রায় ছেচল্লিশ ঘণ্টা বিনসরে কাটালাম। না, কোনও নূপুরের শব্দ, কুয়াশার মধ্যে উড়ে যাওয়া সাদা কাপড়, কিংবা কঙ্কালের নাচ, ছায়ামূর্তি, ভূত বলতে যে সব শোনে বা দেখে লোকে, সেসব কিছুই আমি শুনিনি বা দেখিনি। তবে আমি যাদের সঙ্গে দুটো দিন কাটালাম তাদের কারও আচরণের মধ্যেই কোনও শরীরী উত্তাপ আমি দেখিনি। অথচ তাদের অশরীরী আমি বলতে চাই না। ঘনঘোর দুর্যোগের মধ‌্যে তারাই আমাদের যত্নে রাখলেন। অসম্ভবকে সম্ভব করে প্রায় না-থাকা রাস্তা পেরিয়ে নিরাপদ রাস্তায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। আমি আবার আসব এই অদ্ভুত নিরালা বনবাংলোয়। ঘনবর্ষায়। যখন কোনও ট্যুরিস্টের টিকির দেখা মিলবে না। নিরাপদে চৌকরি পৌঁছে বিনসরের ম্যানেজারকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য ভাবলাম একটা ফোন করে দিই। পার্সের মধ্যে মজুত সেই চারভাঁজ করা কাগজ। খুললাম, দু’পিঠই তার সাদা। সেই কাগজে কোনও সংখ্যা কখনও লেখা হয়েছে বলেই মনে হয় না।

উপড়ে পড়া চিরগাছের ছড়িয়ে থাকা ডালপালা দিয়ে ভাঙা রাস্তায় ব্যারিকেড।

যাঁরা শেষ অবধি এই লেখা পড়লেন, তাঁরা বড়মামার মত হয়তো বলে বসবেন, “যা, যা, কতগুলো বাজে স্বপ্ন দেখে তাই নিয়ে গল্প করতে এসেছে।’’ কিন্তু হিমালয়ের এই অতি পুরোনো বাংলো এখনও আছে, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। থাকবে দুর্যোগের রাতে জনশূন্য এই বাংলো। পরখ করে দেখলেই হল।

চিত্র: প্রতিবেদক
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »