Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

কালিদাস বিশ্বসাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভা। ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের আগে যুগন্ধর প্রতিভা নিঃসংশয়ে কালিদাস। এদেশের কবি-লেখক জয়দেব-বাণভট্ট-দণ্ডী, বা আধুনিককালে রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ (এই বৈদান্তিক ধর্মপ্রাণ মানুষটির ‘মেঘদূত’ কণ্ঠস্থ ছিল)-বুদ্ধদেব বসু, সকলেই তাঁর প্রতিভার স্বরূপ অন্বেষণ করেছেন। বিদেশেও তিনি সমান শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। বিখ্যাত জার্মান কবি গ্যেটে তাঁকে কবিতায় প্রশস্তি জানান, মাক্স মুলার জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নাটক, আর জার্মানির অন্যতম ধ্রুপদী লেখক শিলার ‘মেঘদূত’-প্রভাবিত নাটক লেখেন, ‘মারিয়া স্টুয়ার্ট’।

চারটি কাব্য ও তিনটিমাত্র নাটক তাঁকে বিশ্ববন্দিত কবি বানিয়েছে। অনেক সমালোচক মনে করেন, তিনি আর কিছু না লিখে কেবল ‘মেঘদূত’ লিখলেই অমর হয়ে থাকতেন। এই কৃশকায় কাব্যটির বিখ্যাত টীকাকার মল্লিনাথ বলেছেন, মাঘ-রচিত ‘শিশুপালবধ’ কাব্য, আর কালিদাসের ‘মেঘদূত’– এই দুটির টীকা লিখতেই তাঁর জীবন শেষ! কাব্যটি খুব বড় নয়। একশো দশ (মতান্তরে আরও কিছু বেশি) শ্লোক আছে এতে। সুকঠিন ছন্দে লেখা কাব্যটি,– মন্দাক্রান্তা। প্রাথমিকভাবে এই প্রবল ঝুঁকি নেবার মধ্যেই তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিচয় মেলে।

বিখ্যাত বহু লেখক তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে কোনও কোনও তারিখকে অমর করে গেছেন। শেকসপিয়ারের ‘Julius Caesar’ নাটকে ভবিষ্যদ্বক্তার সংলাপ ‘Be ware the ides of March’ (অর্থাৎ মার্চের ১৫-ই। প্রাচীন রোমে মার্চ, মে, জুলাই ও অক্টোবরের ১৫ তারিখকে, এবং অন্যান্য মাসের তেরো তারিখকে বলা হত ‘Ides’)। আবার বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ শুরুই করলেন এভাবে, ‘৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদা এক অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমণ করিতেছিলেন’। তারিখ নয়, সাল দিয়ে বঙ্কিম এইভাবে বাংলা উপন্যাসের শুভসূচনা করলেন। অনুরূপভাবে জেমস জয়েস তাঁর ১৯২২-এ প্রকাশিত ‘Ulisses’ উপন্যাসের মাধ্যমে ১৯০৪-এর ১৬-ই জুনকে শাশ্বত করে দিলেন এতটাই যে, ওই তারিখটিকে জেমস-ভক্তরা আজ-ও বিশেষভাবে উদযাপন করেন। সুবৃহৎ ওই উপন্যাসটির ঘটনাবলি ওই একটি তারিখকে অবলম্বন করে রচিত। তারিখটি জয়েসের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ-ও, কেননা ঠিক ওই দিনটিতেই তিনি তাঁর প্রেমিকা ও ভাবী স্ত্রী নোরা বার্নাকলের (Nora Barnacle)-এর সঙ্গে ‘ডেট’ করেছিলেন। তারিখটি অন্য একটি কারণেও ঐতিহাসিক,– সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা প্রথম নারী, ১৯৬৩-র ওই তারিখে যিনি মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহে চড়ে ৪৮ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিলেন।
তেমনই কালিদাস অমর করে গেছেন পয়লা আাষাঢ়কে।

কীভাবে? ‘মেঘদূত’-এর কাহিনিতে দেখি, কুবের অভিশাপ দিচ্ছে যক্ষকে, একবছরের জন্য পৃথিবীতে বাস করতে হবে, স্ত্রীর সঙ্গবর্জিত হয়ে। যক্ষের অপরাধ ছিল, কুবেরের উদ্যান পরিচর্যার সময় সে তার স্ত্রীর কথা ভাবছিল। কুবের ধনের দেবতা। যক্ষ উপদেবতা। যাই হোক, যক্ষ কান্তাবিরহিত হয়ে রামগিরিতে দশমাস কায়ক্লেশে কাটাল। রামগিরিও নির্দেশ করে দেয় কুবের, কেননা সেখানে গেলে যক্ষের স্ত্রীবিয়োগের বেদনা গভীরতর হবে। বনবাসকালে রাম-সীতা ওখানে ছিলেন, আর তাই বনবাসকেও সহনীয় করে নিয়েছিলেন তাঁরা, পরস্পরের প্রতি ভালবাসায়। সেখানকার সরোবর, কালিদাস উল্লেখ করতে ভোলেননি, ছিল সীতার স্নানে পুণ্য। অর্থাৎ রামগিরিতে গেলে শোকের মাত্রা বাড়বে যক্ষের। আমাদের মনে না হয়ে পারে না, লঘু পাপে গুরু দণ্ড! দশমাস কাটলেও আষাঢ় মাসের প্রথম দিনটিতে মেঘের আবির্ভাব যক্ষের বিরহকে অসহনীয় করে তুলল। যে মানুষ স্ত্রীর গলা জড়িয়ে থাকতে অভ্যস্ত, সে এই বর্ষায় একাকী কাটাবে? পয়লা আষাঢ়ের সেই মেঘকে তাই তিনি অলকায় তার প্রিয়া তথা স্ত্রীর কাছে দূত করে পাঠাতে চাইল, তাকে জানাতে, যে সে জীবিত আছে। একান্ত স্ত্রী-অনুরক্ত যক্ষের আশঙ্কা হচ্ছিল, স্ত্রী তার বিরহে বেঁচে আছে তো?

এই যে মেঘকে দূত করে পাঠানো, এর মাধ্যমে কবি একদিকে ভারতের এক ব্যাপ্ত অংশের নিখুঁত ভূগোলের বিন্যাস পাঠকের চোখের সামনে মেলে ধরেছেন, অন্যদিকে কাব্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুনে দিয়েছেন নান্দনিকতার লতাজাল। যার জন্য যুগ যুগ ধরে এ-কাব্যের আবেদন ফুরোয় না। এই কাব্যটিকে বলা হয় ‘দূতকাব্য’। কালিদাসের দেখাদেখি অন্তত পঞ্চাশজন কবি এমন দূতকাব্য লিখেছেন। কিন্তু কালিদাসের কবিপ্রতিভার ধার দিয়েও যায়নি তা। সারা ভারতবর্ষে এ-কাব্য এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, পঞ্চাশটির ওপর কেবল টীকা-ই লেখা হয়েছে এর। আর অনুবাদ? দেশি-বিদেশি কত ভাষাতেই যে হয়েছে! কেবল বাংলাভাষায় একশো জনের ওপর অনুবাদক আছেন!

পয়লা আাষাঢ় তাই একটা কিংবদন্তি হয়ে আছে। এতটাই যে, এখন ভারতে পয়লা আষাঢ়কে কালিদাসের জন্মদিনরূপে পালন করা হয়। কালিদাসের জন্ম কবে ও কোথায় তা এখনও অজানা। কিন্তু তাঁর প্রায় সব রচনায় শিবের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আর বিশেষ করে মেঘদূত কাব্যে উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরের বিশেষ উল্লেখ (মেঘের যাত্রাপথে উজ্জয়িনী পড়ে না, আর তাই রেবানদীর পারে মহাকাল মন্দির-ও। তবু ঘুরপথে মেঘকে একবার সেখানে যেতে বলছে যক্ষ!), এই দুটি ঘটনা কালিদাসকে উজ্জয়িনীর লোক এবং তাঁর জন্মদিন পয়লা আষাঢ়, জনমনে এই বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

শার্লক হোমস আর ওয়াটসনকে কোনান ডয়েল লন্ডনের ২২১/ বি, বেকার স্ট্রিটের কল্পিত ঠিকানায় রেখেছিলেন। সেই ঠিকানা ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে মিউজিয়াম। কল্পনা এইভাবে যুগে যুগে বাস্তবকে জন্ম দেয়।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »