Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

জাপানের গল্প: স্বজন সমাগমে একটি দিন

কাজুও ইশিগুরো

অনুবাদ: মানব সাধন বিশ্বাস

জাপানের প্রশান্ত সাগরীয় উপকূলে ফুগু নামের একরকম মাছ পাওয়া যায়। সে-মাছ যে কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেটা ভালভাবে বুঝতে পারি যখন আমার মা ওরকম একটি মাছ খেয়ে মারা যান। ওই মাছগুলোর জনন-গ্রন্থির দুটি পলকা থলিতে বিষ থাকে। রান্নার জন্যে মাছটা কাটার সময়ে ওই থলিগুলোকে অতি সাবধানে অবশ্যই বাদ দিতে হয়। যেমন-তেমন করে কাজটা করলে ওই বিষ রক্তের শিরায় চলে যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, মাছটা রান্নার জন্যে তৈরি করে নেওয়ার কাজটা ষোলোআনা ঠিকঠাক হল কিনা সেটা বোঝা বেশ মুশকিল। সত্যি বলতে কী, একমাত্র খাওয়ার পরেই সব সাবুদ সামনে আসতে পারে।

ফুগু-র বিষক্রিয়া বীভৎস রকমের কষ্টকর— প্রায় সবক্ষেত্রেই পরিণাম মারাত্মক। এ-মাছ সন্ধেবেলায় খেলে ব্যথায় কাতরানো শুরু হবে রাতে, ঘুমের মধ্যে। বেশ কয়েক ঘণ্টা অতীব কষ্টে কাহিল হয়ে মানুষটা গড়াগড়ি করতে থাকবে, আর মোটামুটি সকাল নাগাদ সে মারা যাবে। এই মাছটা জাপানে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যুদ্ধের পর থেকে। আরও কড়া নিষেধবিধি জারি হওয়ার আগে অব্দি অনেকেরই নিজেদের রান্নাঘরে এই মাছের পেট কাটার ঝামেলার কাজটা একরকম বাতিকের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। একাজটা সেরে তারা পাড়াপড়শি ইয়ারবন্ধুদের ভূরিভোজনে ডাকত।

মা মারা যাওয়ার সময় আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকতাম। ওই সময় নাগাদ আমার সঙ্গে মা-বাবার কিছুটা মনকষাকষি চলছিল, যার ফলে মায়ের মৃত্যুকে ঘিরে ওই সময়ের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে তেমন কিছু আমার জানা ছিল না। জানলাম তার দুবছর পরে টোকিওয় ফিরে। ফুগু মাছটা যে মা একেবারেই খেতে চাইতেন না, তা বেশ বোঝা যেত। কিন্তু একবার তাঁকে এক স্কুলের বন্ধু তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছিলেন। সেই বিশেষ উপলক্ষে বন্ধু যাতে অখুশি না হন, সেজন্যে তিনি তাঁর অবস্থান বদল করলেন। এয়ারপোর্ট থেকে আমরা গাড়িতে কামাকুরা জেলায় তাঁর বাড়িতে আসছিলাম; পথে বাবা বৃত্তান্তটি আমাকে বিশদে বললেন। শেষ পর্যন্ত আমরা যখন পৌঁছলাম, শরতের সেই রোদ-ঝলমল দিনটা তখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।

‘প্লেনে খেয়েছিস কিছু?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন। তখন আমরা তাঁর চায়ের ঘরের তাতামি-বিছানো মেঝেতে বসে আছি।

‘একটা হাল্কা টিফিন দিয়েছে।’

‘তাহলে তোর খুব খিদে পেয়ে গেছে। কিকুকো এখনি এসে পড়বে— ও এলেই আমরা খেতে বসে যাব।’

আমার বাবা ভয়াল চেহারার মানুষ। বড়সড় শক্ত চোয়াল, সেই সঙ্গে রাগি রাগি কালো ভুরু। এখন সেইসব পুরনো দিনের কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয় বাবার চেহারায় চিনের কমিউনিস্ট নেতা চউ এন-লাইয়ের একটা আদল ছিল; যদিও এধরনের তুলনায় তিনি যে বিশেষ আত্মশ্লাঘা বোধ করবেন, এমনটি কোনওমতেই নয়। কেননা তাঁর শরীরে বয়ে চলেছে পরিবারের খাঁটি সামুরাই রক্ত। তাঁর স্বাভাবিক উপস্থিতি সহজভাবে হাল্কা মেজাজে মন খুলে কথা বলার পক্ষে যেমন মোটেও অনুকূল ছিল না, তেমনি তাঁর অদ্ভুত ধরনের প্রতিটি মন্তব্য ছিল শেষকথা, অন্য সবকিছুই অবান্তর। আসলে সেদিন আমি তাঁর মুখোমুখি বসেছিলাম। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছিল। সেদিন বাবার মার খেয়েছিলাম; ‘বুড়িদের মত বকবক’ করার জন্যে অনেকবার আমার সারা মাথায় গাঁট্টা কষিয়েছিলেন। সুতরাং অবধারিতভাবেই, এয়ারপোর্টে আসা থেকে এপর্যন্ত আমাদের কথাবার্তার মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু লম্বা বিরতি ছিল।

‘কোম্পানির খবরটা শুনে খারাপ লাগছে।’ আমরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিলাম। এক সময় আমি বললাম কথাটা। বাবা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন।

‘আসলে গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি,’ বাবা বললেন, ‘কোম্পানি লাটে ওঠার পরেই ওয়াতানাবে আত্মহত্যা করল। সে অসম্মানের লজ্জা নিয়ে বাঁচতে চাইল না।’

‘বুঝলাম।’

‘টানা সতের বছর পার্টনার ছিলাম আমরা। ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ ছিল; খুব শ্রদ্ধা করতাম।’

‘ব্যবসা আবার শুরু করার কথা ভাবছেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমি এখন রিটায়ামেন্ট নিয়ে নিয়েছি। এখন আর নতুন করে নিজে হাত লাগিয়ে তেমন করে কাজকর্ম সামলাতে পারব না, সেই বয়েস আর নেই— বড্ড বেশি বুড়ো হয়ে গেছি। এখন ব্যবসা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে; বিদেশি খদ্দেরদের সঙ্গে কাজকর্ম করতে হয়, তাদের মর্জি-মত চলতে হয়। বুঝতে পারছি না, কীভাবে এমন অবস্থা হল। ওয়াতানাবেও বুঝতে পারেনি।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বড় সুন্দর নীতি-পরায়ণ মানুষ ছিল।’

চায়ের ঘরের মুখোমুখি বাগান। যেখানে বসেছিলাম, সেখান থেকে পুরনো ইঁদারাটাকে চিনতে পারলাম। ছেলেবেলায় সেটাকে ভূতুড়ে মনে করতাম। ঘন লতাপাতার মধ্যে দিয়েও কিন্তু সেটা ঠিকঠাক আমার নজরে আসছিল। সূর্য ততক্ষণে অনেক নিচে নেমে গিয়েছে, বাগানে ছায়াঘন অন্ধকার নেমে এসেছে।

‘যাই হোক, তোর ফিরে আসার সিদ্ধান্তে আমি খুশি হয়েছি’, বাবা বললেন, ‘আশা করি তোর এই আসাটা খুব স্বল্পমেয়াদি হবে না।’

‘ঠিক কী করব— বুঝে উঠতে পারছি না।’

‘আমি অতীত ভুলতে রাজি আছি। তোর ব্যবহারে তোর মা বড় দুঃখ পেয়েছিল; কিন্তু তুই ফিরে আসবি, এটা তোর মাও মন থেকেই চাইত— সে তোকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ করতে তৈরি ছিল।’

‘আপনার মনের কষ্ট বুঝি। কিন্তু, আমি যা বললাম— কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।’

‘এবার আমি বুঝলাম, তোর মনে কোনও গলদ নেই’, বাবা বললেন, ‘মনে হচ্ছে তুই বিগড়ে গিয়েছিলি কোনও কারণে, —যেমন অনেকের ক্ষেত্রেই হয়।’

‘এসব ভুলে যাওয়াই ভাল, যেমন আপনি বললেন।’

‘যা ভাল বুঝিস, কর। আর একটু চা নিবি?’

ঠিক তখন একটি মেয়ের গলার আওয়াজে বাড়িটা সরগরম হয়ে উঠল।

‘শেষে উনি এসে পৌঁছলেন।’ বাবা উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ‘কিকুকো এসে গেছে।’

বয়েসের ব্যবধান তো ছিলই, তা সত্ত্বেও বোন আর আমি— দু’জনে বরাবরই কাছাকাছি ছিলাম। আমায় দেখতে পেয়ে সে বাড়াবাড়ি রকমের উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। প্রথমদিকে সে চুপচাপ ছিল, কিছু করেনি— শুধু নার্ভাস হয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। তবে তাও মাত্র কিছুক্ষণের জন্যে; কিন্তু এবার বাবা যখন তাকে ওসাকা আর ইউনিভার্সিটি নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করলেন, সে কিছুটা দমে গেল; অতি সংক্ষেপে প্রশ্নগুলোর গতেবাঁধা জবাব দিচ্ছিল। এরপর বোন আমাকে কিছু প্রশ্ন করল। মনে হল তার মধ্যে কিছু অস্বস্তি-মেশানো জড়তা ছিল; প্রশ্নগুলো শেষঅব্দি আরও অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ টেনে আনতে পারে— হয়তো এমন কিছু ভয় তার ছিল। কিছু সময় পরে বাক্যালাপ ক্রমশ আরও কমতে কমতে কিকুকো আসার আগের পর্যায়ে নেমে এল। বাবা দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘উঠি, দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিকুকো তোর দেখভাল করুক।’

বাবা চলে যাওয়ার পরে বোন যে ফের চাঙ্গা হয়ে উঠল, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে খোলাখুলি ওসাকায় তার ইয়ারবন্ধুদের সম্বন্ধে আর ইউনিভার্সিটির ক্লাস নিয়ে বকবক শুরু করল। তারপর একেবারে আচমকাই থেমে গিয়ে ঠিক করে ফেলল, আমরা তো বেশ বাগানে গিয়ে একটু হাঁটতে পারি। আমরা বেরিয়ে গেলাম বারান্দায়। সেখানে মেঝেয় রেলিং বরাবর রেখে দেওয়া খড়ের হাল্কা পাতলা চটি পায়ে গলিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাগানে গেলাম। দিনের আলো তখন প্রায় ফুরিয়ে গেছে।

‘সেই আধঘন্টা ধরে একটা সিগারেট খাওয়ার জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে আছি’, সিগারেট ধরাতে ধরাতে সে বলল।

‘তো খেলি না কেন?’

সে কিছু একটা লুকোনোর ভঙ্গিতে বাড়ির দিকে চাইল; তারপর দুষ্টুমির হাসি হাসল।

‘বুঝেছি।’ আমি বললাম।

‘কী বল তো? —আমার একজন বয়ফ্রেন্ড জুটে গেছে।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা, তাই?’

‘শুধু ভাবছি এখন কী করব। এখনও মনস্থির করতে পারছি না।’

‘বুঝতে পারছি।’

‘দেখ, সে অ্যামেরিকা যাওয়ার প্ল্যান করছে। আমার পড়াশোনা শেষ হলে সে আমাকেও নিয়ে যেতে চায়।’

‘বুঝেছি। তুই অ্যামেরিকা যেতে চাস?’

‘যদি যাই, তো বেশ হবে, আমরা হিচ-হাইকিং— মানে নিখরচায় যাব।’ আমার মুখের সামনে বুড়ো আঙুলটা বাগিয়ে দোলাতে দোলাতে কিকুকো বলল। ‘অনেকে বলে, জিনিসটা বিপজ্জনক। তবে আমি নিজে ওসাকায় ওটা করে দেখেছি— দারুণ ব্যাপার।’

‘বুঝলাম। তাহলে তুই চিন্তা করছিস কী নিয়ে?’

আমরা ঝোপে ঘিরে থাকা একটা সরু পথ ধরে হাঁটছিলাম। সেটা শেষ হয়েছে পুরনো কুয়োটার কাছে। যখন হাঁটছি, কিকুকো অদ্ভুত নাটুকে কায়দায় সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিল।

‘হ্যাঁ, শোন, আমার প্রচুর বন্ধু হয়েছে ওসাকায়। বেশ লাগে ওখানে। এখনি এখনি কী করে যে ওদের সবাইকে ছেড়ে আসব ভেবে পাচ্ছি না। আর সুইচি— ওকে আমার বেশ লাগে। জানি না ওকে খুব বেশি সময় দিতে পারব কি না। বুঝলি ব্যাপারটা?’

‘খুব বুঝেছি।’

‘শুনেই বোন আবার হেসে উঠল। সে এবার আমাকে পেছনে ফেলে কুয়োর কাছে পৌঁছে গেল। ‘মনে পড়ে’, আমি তার কাছাকাছি চলে এলে সে বলল, তুই এই কুয়োটাকে কীভাবে ভূতুড়ে বলতি?’

‘হ্যাঁ, মনে পড়ছে।’

আমরা দুজনেই উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম কুয়োর ধারটা।

‘মা আমাকে সব সময় বলত— ও হল আনাজের দোকানের বুড়িটা। সেদিন রাত্তিরে তুই ওকেই এখানে দেখেছিলি’, সে বলল, ‘আমি কিন্তু মায়ের কথা একেবারেই বিশ্বাস করিনি। কুয়োটা ভূতুড়ে বলতিস কী করে? সেই থেকে আর একা এখানে আসতাম না।’

‘মা কথাটা আমাকেও বলেছিল। মা আমাকে এটাও বলেছে, বুড়িটা নিজেই স্বীকার করেছিল যে, সে সত্যিই ভূত। আদতে মনে হয়, আমাদের এই বাগানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে সে হাঁটা রাস্তা কমাতে চেয়েছিল। অনুমান করতে পারছি, তারপর সামনের পাঁচিলটা টপকানোর মত মুশকিলের কাজটা সাহসে কুলোয়নি।’

কিকুকো ফিক করে হেসে ফেলল। এবার সে ঘুরে কুয়োর দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে বাগানটা দেখতে লাগল।

‘মা সত্যিই তোকে কোনও দোষ দেয়নি।’ সুর পাল্টে সে বলল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। ‘মা আমাকে সবসময় বলত তোকে ঠিকমত মানুষ করতে না পারার মধ্যে তাদের— মানে মা আর বাবার— গলতিটা কী ছিল।’ মা বলত, আমার ওপর তাদের আরও সাবধানী নজর ছিল। আর সেই জন্যেই আমি এত ভাল হয়েছি।’ সে মুখ তুলে ওপরের দিকে চেয়ে রইল। সেই দুষ্টুমি-ভরা হাসিটা তার মুখে আবার ফিরে এল। ‘অভাগা মা আমার’, সে বলল।

‘হ্যাঁ, মা সত্যিই অভাগা।’

‘তুই ফিরে যাচ্ছিস ক্যালিফোর্নিয়ায়?’

‘জানি না। দেখি।’

‘সেই তার কী হল? —সেই ভিকি, তার খবর কী?’

‘ওসব চুকে গেছে’, আমি বললাম, ‘ক্যালিফোর্নিয়ায় এখন আর বিশেষ কিছু পড়ে নেই।’

‘তোর কি মনে হয়, ওখানে যাওয়া উচিত আমার?’

‘কেন নয়? —আমি জানি না। তোর হয়তো পছন্দ হতে পারে।’ আমি বাড়িটার দিকে চেয়ে রইলাম। ‘চল, আমরা বরং ঘরে যাই। খাবার রেডি করতে আমরা বাবার সঙ্গে হাত লাগাই।

কিন্তু আমার বোন কুয়োটার ভেতরে ফের একবার দেখে নিল। সে বলল, ‘কোনও ভূত তো চোখে পড়ছে না।’ তার আওয়াজের হাল্কা একটা প্রতিধ্বনি হল।

‘ব্যবসা বরবাদ হয়ে গেল বলে বাবা ভেঙে পড়লেন?’

‘জানি না। বাবাকে কক্ষনো এসব কথা বলে বলিস না, বুঝলি?’ তারপর সে হঠাৎ সিধে হয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাবা তোকে ওয়াতানাবের কথা বলেছেন? উনি কী করেছেন?’

‘শুনলাম উনি আত্মহত্যা করেছেন।’

‘শোন, সেটাই সবটা নয়। উনি গোটা পরিবার-সুদ্ধ সঙ্গে নিয়ে গেছেন— ওনার স্ত্রী আর ওনার দুই মেয়ে।’

‘সে কী!’

‘বড় ফুটফুটে ছিল ওই ছোট্ট মেয়ে দুটো। ওরা যখন সবাই ঘুমিয়ে, উনি গ্যাস অন করে দিলেন। শেষে মাংস কাটার ছুরি দিয়ে নিজেই নিজের পেট কেটে ফেললেন।’

‘হ্যাঁ, বাবা একটু আগে বললেন, ওয়াতানাবে কতটা ন্যায়নীতির মানুষ ছিলেন।’

‘অসুস্থ।’ বোন এবার কুয়োর দিকে ঘুরে গেল।

‘সাবধান, একেবারে ভেতরে পড়ে যাবি কিন্তু।’

‘আমি তো কোনও ভূত-টুত দেখতে পেলাম না’, সে বলল, ‘আমাকে তোরা সব সময় মিথ্যে বলে আসছিস।’

‘কুয়োয় ভূত আছে একথা আমি কক্ষনো বলিনি।’

‘তাহলে সেটা আছে কোথায়, বলবি?’

গাছপালা, ঝোপঝাড়ে ভরে থাকা চারপাশটা আমরা দেখতে লাগলাম। বাগানটায় আলো অনেক কমে গেছে। মোটামুটি গজদশেক দূরের একটা ছোট্ট খোলা জায়গা দেখিয়ে দিলাম।

‘ঠিক ওখানেই দেখেছি— ঠিক ওখানে।’ বললাম আমি।

আমরা সেদিকে এগিয়ে গেলাম।

‘কী দেখলি?’

‘খুব ভাল করে দেখতে পাইনি। অন্ধকার ছিল।’

‘তাহলেও, কিছু তো নিশ্চয়ই দেখেছিস।’

‘ও একটা বুড়ি ছিল। শুধু ওখানে দাঁড়িয়েছিল, আর আমায় দেখছিল।’

আমরা সেদিকে তাকিয়ে রইলাম— সন্মোহিতের মত।

আমি বললাম, ‘ওর গায়ে ছিল সাদা কিমোনো’, কিছু চুল আলুথালু উস্কোখুস্কো, চুল বাঁধেনি— হাওয়ায় এদিকওদিক উড়ছিল।’

আমার হাতে কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে কিকুকো বলল, ‘আঃ, কথা বলিস না। আবার তুই আমায় ভয় পাইয়ে দিচ্ছিস কিন্তু।’ সে সিগারেটের ফেলে দেওয়া টুকরো পায়ে মাড়াল; কয়েক মুহূর্তের জন্যে হতভম্ব হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। পড়ে থাকা কিছু পাইন পাতার ছুচালো ডগা পায়ে ঠেলে সেখানে রেখে সে আবার বোকার মত হাসি হাসতে লাগল। ‘দেখি, দুপুরের খাওয়ার কদ্দুর কী হল, সে বলল।’

আমরা বাবাকে রান্নাঘরে দেখতে পেলাম। তিনি আমাদের এক পলক দেখে নিলেন, আবার তাঁর কাজ করতে থাকলেন।

‘সব কিছু সামলানোর কাজ নিজের হাতে নিয়ে বাবা কিন্তু এখন একজন জবরদস্ত শেফ।’ কিকুকো হাসতে হাসতে বলছিল। বাবা একথা শুনে ঘুরে গিয়ে শীতল দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালেন।

‘গর্ব করার মত কোনও দক্ষতা আমার নেই’, বাবা বললেন, ‘কিকুকো, এখানে আয়, কাজে হাত লাগা।’

কয়েক মুহূর্তের জন্যে বোনের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল। তারপর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ারে ঝোলানো একটা অ্যাপ্রন টেনে নিল।

‘শুধু এই সবজিগুলো এখন রান্না করতে হবে’, তাকে বাবা বললেন, ‘বাকিগুলো শুধু দেখে যেতে হবে।’ তারপর মাথা তুলে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালেন কয়েক সেকেন্ড। শেষমেশ বললেন, ‘আমি বলি, বাড়ির আশপাশটা একটু ঘুরে দেখ’, হাতের চপস্টিক দুটো নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, ‘বহুদিন তো বাড়িটা দেখিসনি।’

আমরা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি একটু ফিরে কিকুকোর দিকে ফিরে দেখি, শুধু তার পেছন দিকটাই দেখা যাচ্ছে।

‘খুব ভাল মেয়ে।’ বাবা শান্ত গলায় বললেন।

ঘরগুলো দেখার সময় আমি বাবার পেছনে পেছনে যাচ্ছিলাম। বাড়িটা যে কত বড় সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। একটা ঘরের দরজার চৌকো প্যানেল সরালেই খুলে যায় পাশের আর একটি ঘর, তারপর আরও একটি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, প্রতিটি ঘরই একেবারে খালি। একটি ঘরে আলো প্রায় আসে না; আমরা জানলা দিয়ে আসা একচিলতে আলোয় সেই ঘরের শূন্য দেয়াল আর তাতানি মাদুর বিছানো মেঝেটা দেখছিলাম।

‘একজন একলা মানুষের জন্যে এবাড়ি বড্ড বেশি বড়’, বাবা বললেন, ‘এখন এর বেশিরভাগ ঘর কাজে লাগে না।’

কিন্তু শেষে এমন একটা ঘরের দরজা খুললেন যেখানে প্রচুর বই আর কাগজপত্রে ঠাসা। সেখানে ফুলদানিতে ফুল আছে, দেয়ালে ছবি আছে। আমার নজর পড়ল ঘরের কোণে রাখা একটা নিচু টেবিলে। আমি তার কাছাকাছি চলে এলাম; দেখি প্লাস্টিকে তৈরি ছাই রঙের একটা যুদ্ধজাহাজের মডেল।

বাবা এবার হেসে ফেললেন। তিনি এসে টেবিলের মডেলটা হাতে তুলে নিলেন।

‘ব্যবসাপত্রের পাট তুলে দেওয়ার পর থেকে’, তিনি বললেন, ‘হাতে একটু বেশি সময় পাচ্ছি তো।’ আবার বাবা হাসলেন; এবার আরও অদ্ভুতভাবে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে তাকে শান্ত নিরুদ্বেগ মুখে দেখলাম। ‘একটু বেশি সময়।’

‘অদ্ভুত লাগছে আপনার কথা’, আমি বললাম, ‘আপনি সবসময়ই খুব ব্যস্ত থাকতেন।’

‘মনে হয় বড্ড বেশিই ব্যস্ত ছিলাম।’ তিনি মৃদু হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন। ‘তার চেয়ে বোধহয় ভাল হত— যদি আর একটু বেশি যত্নশীল বাবা হতাম।’

আমি হাসলাম। তিনি তাঁর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে নিবিষ্ট মনে দেখতে লাগলেন। এবার আমার দিকে তাকালেন। ‘এটা তোকে বলতে চাইনি। হয়তো যা করি, সব ঠিকই আছে। আমার মনে হয় কি জানিস, তোর মায়ের মৃত্যুটা একেবারেই কোন দুর্ঘটনা ছিল না। বহু কষ্ট উদ্বেগ ছিল তাঁর মনে। কিছু হতাশা ছিল।’

আমরা দুজনেই প্লাস্টিকের যুদ্ধজাহাজটাকে দেখছিলাম।

শেষে আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই। মা আশা করেননি, আমি চিরকালের জন্যে এখানে থেকে যাই।

‘স্বাভাবিক, এসব তুই দেখিস না। তুই দেখতে পাস না, কিছু কিছু বাবা-মায়ের কাছে এসবের মূল্য কী। অবধারিতভাবে তারা ছেলেমেয়েদের হারিয়ে ফেলা শুধু নয়, তারা ছেলেমেয়েদের হারিয়ে ফেলে এমন সবকিছুতে— যা তারা নিজেরাই বোঝে না।’ বাবা আঙুল দিয়ে জাহাজটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে কথা বললেন। ‘এই খুদে কামান-সাজানো জাহাজগুলো আরও একটু আঁটোসাঁটো করে বানানো যেত, তাই না?’

‘মনে হয়। এও বেশ লাগছে।’

‘যুদ্ধের সময়ে মোটামুটি এরকমই একটা জাহাজে বহুদিন কাটিয়েছি। কিন্তু আমার আসল লক্ষ্য ছিল এয়ারফোর্স। আমি সেইভাবেই ভাবতাম। শত্রুপক্ষ যদি তোমার জাহাজের রাস্তা আটকায়, তবে যা তুমি করতে পারো তা হল— প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে জাহাজের ‘কাছি’ বা রশিটাই জন্যে উদগ্রীবভাবে আশা করা। কিন্তু একটা অ্যারোপ্লেনের বেলায়— শেষ অস্ত্র সবসময়ই তৈরি থাকে। তিনি মডেলটা আবার স্বস্থানে রেখে দিলেন। ‘আমি মনে করি না তুমি যুদ্ধে বিশ্বাস করো।’

‘একদমই বিশ্বাস করি না।’

তিনি ঘরটা ভাল করে দেখে নিলেন। ‘এতক্ষণে খাবার রেডি হয়ে যাওয়ার কথা’, বাবা বললেন, ‘তোদের নিশ্চয়ই বেশ খিদে পেয়ে গেছে।’

রান্নাঘর-লাগোয়া একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে খাবার আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। টেবিলের ওপরে একটা বড়সড় লন্ঠন ঝোলানো; সেটাই ঘরের আলোর একমাত্র উৎস। ঘরের বাকি অংশে ছায়া ছড়িয়ে ছিল। খেতে বসার আগে আমরা প্রত্যেকের কাছে নিয়মমাফিক মাথা নুইয়ে নিলাম, তারপর খেতে বসে গেলাম।

কথাবার্তা খুব কমই হল তখন। আমি যখন খাবার নিয়ে অল্প-স্বল্প প্রশংসা করছিলাম, কিকুকো ফিক ফিক করে হাসছিল। তবে তার সেই পুরনো মিইয়ে-যাওয়া ভাব ফের ফিরে এল তার চোখে-মুখে। বাবা বেশ কিছুক্ষণ কোনও কথা বললেন না। এবার তিনি বললেন:

‘জাপানে ফিরে এসে এসব নিশ্চয়ই তোর কাছে অদ্ভুত লাগছে।’

‘হ্যাঁ, তা একটু লাগছে বৈকী।’

‘হতে পারে, অ্যামেরিকা ছেড়ে এসে এরই মধ্যে তোর খারাপ লাগতে শুরু করেছে।’

‘তা একটু বটে। তবে এমন কিছু নয়, কিছুই তো সেখানে ফেলে আসিনি— ওই কয়েকটা ফাঁকা ঘর ছাড়া।’

‘বুঝলাম।’

আমি টেবিলের ওপাশে বাবাকে দেখছিলাম। আধা অন্ধকারে বাবার মুখ কঠিন ও কঠোর হয়ে উঠল। আমরা চুপচাপ খেতে থাকলাম।

এবার আমার চোখ পড়ল ঘরের মধ্যে একটু দূরে থাকা কিছু একটা জিনিসের দিকে। খাওয়ার সময় প্রথমদিকে তেমন কিছু মনে হয়নি, হঠাৎ আমার হাত থমকে থেমে গেল। সেটা খেয়াল করে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বাবার কাঁধ ছাড়িয়ে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে সেদিকে নজর করতে লাগলাম।

‘কে ওটা? ওই ফটোগ্রাফটায়?’

‘কোন ফটোগ্রাফের কথা বলছিস?’ আমার নজর লক্ষ্য করে বাবা সামান্য ঘুরে সেটা দেখার চেষ্টা করলেন।

‘ওই যে সবচেয়ে নিচে— সাদা কিমোনো-পরা বুড়িটা।’

বাবা চপস্টিক নামিয়ে রাখলেন। তিনি প্রথমে ফটোগ্রাফের দিকে তাকালেন, তারপর আমার দিকে।

‘তোদের মা।’ তার গলার আওয়াজ ভীষণ রুক্ষ হয়ে উঠল, ‘নিজের মাকেও চিনতে পারিস না?’

‘আমার মা। দেখছ তো, সব অন্ধকার। খুব ভাল দেখতেও পাচ্ছিলাম না।’

কেউ কোনও কথা বলল না পরের কয়েক সেকেন্ড। তারপর কিকুকো উঠে দাঁড়াল। সে দেয়াল থেকে ফটোগ্রাফটা নামিয়ে এনে আমার হাতে দিল।

‘ওঁকে অনেক বেশি বয়স্ক লাগছে।’ আমি বললাম।

‘এটি তার মারা যাওয়ার কিছু আগে তোলা হয়েছে।’ বাবা বললেন।

‘অন্ধকার ছিল; একবারেই ভাল করে দেখতে পাইনি।’

আমি ওপরে তাকালাম; দেখলাম বাবা একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাকে আমি ফটোগ্রাফটা দিলাম। বাবা সযত্নে খুব ভাল করে দেখলেন ছবিটা। তারপর কিকুকোর দিকে ধরলেন। বোন উঠে দাঁড়াল, ছবিটা ফের দেয়ালে টাঙিয়ে দিল।

টেবিলের একবারে মাঝখানে একটা বড় পাত্র তখনও খোলা হয়নি। কিকুকো ফিরে এসে বসার পর, বাবা একটু এগিয়ে পাত্রটার ঢাকনা খুললেন। ভাপের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে লন্ঠনের দিকে উঠে যাচ্ছিল। তিনি পাত্রটা আমার দিকে একটু ঠেলে দিলেন।

‘তোর খুব খিদে পেয়েছে বুঝতে পাচ্ছি।’ বাবা বললেন। তার মুখের একটা দিকে ছায়ায় ঢেকে ছিল।

‘ধন্যবাদ।’ আমি চপস্টিক নিয়ে এগিয়ে বসলাম। ভাপটা বেশ গরম। ‘কী এটা?’

‘মাছ।’

‘গন্ধটা ভারি সুন্দর।’

মাছের টুকরোগুলো সুরুয়ার মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে প্রায় গোলাকার বলের মত লাগছিল। একটা তুলে নিলাম আমার বাটিতে।

‘তুলে নাও— অনেক আছে।’

‘ধন্যবাদ।’ আমি একটু বেশি নিলাম। তারপর পাত্রটা ঠেলে দিলাম বাবার দিকে। দেখলাম বাবা বেশ কয়েক টুকরো তুলে নিলেন। এবার কিকুকো নিল— আমরা দুজনেই দেখলাম।

বাবা একটু ঝুঁকলেন। আবার বললেন, ‘তোর নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে। একটু মাছ মুখে তুলে নিয়ে খেতে শুরু করলেন। তারপর আমিও একটা বেছে নিয়ে মুখে দিলাম। বেশ বুঝছিলাম, মাছটা জিভে রেখে নরম আর বেশ মাংসল লাগল।

‘দারুণ’, আমি বললাম। ‘কী এটা?’

‘কেন, মাছ!’

‘দারুণ মাছ তো!’

আমরা তিন জন চুপচাপ খেতে লাগলাম। বেশ কিছু মিনিট সময় কেটে গেল।

‘দেব আর?’

‘বেশি আছে?’

‘ঢের আছে— সবার জন্যেই যথেষ্ট আছে।’ বাবা ঢাকনা খুলতেই পাত্র থেকে আবার ভাপের ধোঁয়া ওপরে উঠতে লাগল। আমরা নিজেরাই হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলাম।’

‘শোন, এই শেষ মাছটা তোর।’

‘ধন্যবাদ।’

আমরা খাওয়া-দাওয়া শেষ করার পর বাবা হাতদুটো তুলে লম্বা একটা হাই তুললেন খুশির মেজাজে। ‘কিকুকো’, বাবা বললেন, ‘এবার চা তৈরি করতে হবে।’

বোন বাবার দিকে একটু তাকিয়ে কোনও কথা না বলে ঘর থেকে চলে গেল। বাবা উঠে পড়লেন।

‘চল, অন্য ঘরে যাই, বিশ্রাম করা যাক। এখানে বেশ গরম।’

আমি উঠে পড়ে বাবার পেছনে পেছনে চায়ের ঘরের দিকে গেলাম। সেখানে স্লাইডিং জানলাটা খুলে রাখা ছিল, বাগান থেকে মৃদুমন্দ বাতাস ঘরে আসছিল। আমরা খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।

শেষে আমি বললাম, ‘বাবা, একটা কথা বলি।’

‘কী কথা?’

‘কিকুকো বলছিল, আদরণীয় ওয়াতানাবে নাকি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গোটা পরিবারকেও নিয়ে গেছেন।’

বাবা চোখ নামিয়ে ঘাড় নাড়লেন। তারপর কিছুক্ষণ তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। ‘ওয়াতানাবে তার কাজে ভীষণ নিবেদিতপ্রাণ ছিল।’ শেষে বললেন, ‘কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়া তার কাছে ছিল বিশাল আঘাত। আমার আশংকা, এঘটনা তার বিচারশক্তিকেও দুর্বল করে দিয়েছিল।’

‘তুই কি ভাবছিস, সে যা করেছে, ভুল করেছে?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তাই। তুমি কি অন্যকিছু দেখছ?’

‘না, একদম নয়; নিশ্চয়ই নয়।’

‘কাজ ছাড়া অন্য জিনিসও থাকতে পারে এর মধ্যে।’

‘হ্যাঁ, থাকতে পারে।’

আমরা সবাই আবার চুপ হয়ে গেলাম। বাগানের ফড়িঙের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালাম। কুয়োটা আর দেখা গেল না।

‘কী করবি ঠিক করলি?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছুদিন জাপানেই থাকছিস তো?’

‘সত্যি বলছি। আমি অতদূর এখনও ভাবিনি।’

‘যদি থেকে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে— মানে, এই বাড়িতে, খুব ভাল কথা— থেকে যাস। এর মানে হল, যদি একটা বুড়ো মানুষের সঙ্গে থাকতে তোর কোনও অসুবিধে নেই, তো থেকে যা।’

‘ধন্যবাদ। আমাকে একটু ভাবতে হবে।’

আমি আবার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকালাম ।

‘তবে মানছি, নিশ্চয়ই’, বাবা বললেন, ‘এ বাড়ি এখন বড় বিষণ্ণ, নিরানন্দ জায়গা। সন্দেহ নেই, মনে হচ্ছে খুব শিগগিরিই অ্যামেরিকাতেই ফিরে যাবি।’

‘হয়তো তাই। এখনও জানি না।’

‘আমার সন্দেহ নেই, অ্যামেরিকায় তুই ফিরে যাবিই।’

বাবা কিছুক্ষণ হতোদ্যম হয়ে রইলেন। ওপরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

‘সামনের বসন্তে কিকুকোর পড়াশোনা শেষ হচ্ছে।’ বাবা বললেন, এবার সে হয়তো বাড়ি ফিরবে। সে ভাল মেয়ে।’

‘হয়তো।’

‘তখন অবস্থার কিছু উন্নতি হবে।’

‘হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।’

আমরা আবার চুপচাপ হয়ে গেলাম, কিকুকোর চা নিয়ে ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

***

লেখক পরিচিতি

কাজুয়ো ইশিগুরো (১৯৫৪- ) আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম খ্যাতিমান লেখক। তিনি ১৯৫৪ সালে জাপানের নাগাসাকি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বয়েস যখন মাত্র পাঁচ, তখন লেখকের পরিবার দেশ ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসে ইংল্যান্ডের কেন্টে। ইস্ট অ্যাংগ্লিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লিখনশৈলী নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফরাসি ভাষাতেও তিনি একজন পরিচিত লেখক। সক্রিয় সমাজকর্মী, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার হিসেবেও তিনি প্রতিষ্ঠিত। ১৯৮২ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তার পরের বছর থেকেই তিনি পুরোপুরিভাবে সাহিত্যসেবায় আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৮৫ সালে তিনি বুকার পুরস্কার পান এবং নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ২০১৭ সালে। নোবেল কমিটি তাদের অভিজ্ঞানপত্রে উল্লেখ করে: ‘…তিনি তাঁর সুতীব্র আবেগ-সম্পৃক্ত উপন্যাসে আমাদের মননের অতলান্ত গভীরের কাল্পনিক চেতনার সঙ্গে বাস্তব-পৃথিবীর যোগসূত্রের বিষয়টি উদ্ঘাটিত করেছেন।’ তাঁর ‘দ্য পেইল ভিউ অফ হিলস’ (১৯৮২), ‘অ্যান আর্টিস্ট অফ দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’ (১৯৮৬), ‘দ্য রিমেইন্স অফ দ্য ডে’ (১৯৮৯), ‘দ্য আনকনসোল্ড’ (১৯৯৫), ‘হোয়েন উই অয়্যার অরফ্যান্স’ (২০০০), ‘নেভার লেট মি গও’ (২০০৫), ‘দ্য বেরিড জায়েন্ট’ (২০১৫), ‘ক্লারা অ্যান্ড দ্য সান’ (২০২১) প্রভৃতি উপন্যাস এবং ছোটগল্প সংকলন ‘নকচারনেস: ফাইভ শর্ট স্টোরিজ অফ নাইটফল’ (২০০৯) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

Advertisement
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »
মোহাম্মদ কাজী মামুন

বালকেরা অচেনা থাকে : এক অবিস্মরণীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ

কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।

Read More »