Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

হাম্পি: পুরাণ-ইতিহাস-মহাকাব্য ছুঁয়ে

‘গঙ্গার জলে স্নান, তুঙ্গার জল পান’।

প্রথমবার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ পড়ার সময়ে এই লাইন দুটো মনে গেঁথে গিয়েছিল। আর সেই থেকেই তুঙ্গভদ্রাকে দেখার ও ভারতের একসময়ের সমৃদ্ধ বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্পর্শ পাওয়ার ইচ্ছে। ছেলেবেলার সেই ইচ্ছে সম্প্রতি পূরণ হল হাম্পি গিয়ে। হাম্পি, সে তো শুধু বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ইতিহাসের গল্প নয়। একদিকে, সে বিশ্বের চার মহাকাব্যের অন্যতম ‘রামায়ণ’-এর এক অংশ এবং অন্যদিকে পুরাণের নানা গল্পগাথার মণিমাণিক্যে পরিপূর্ণ। যদিও অন্যান্য জায়গার মত কিষ্কিন্ধ্যা পর্বত পরিবৃত হাম্পি যাওয়ারও সবচেয়ে ভাল সময় অক্টোবর থেকে মার্চের প্রথম দিক। কিন্তু আমার ছুটিছাটা ম্যানেজ করে মার্চের শেষের দিকে হাম্পি যাওয়া সাব্যস্ত হল।

বিজয় বিট্‌ঠল মন্দিরের সামনে পাথরের রথ।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গল্পগুলো ছুঁতে গেলে একবিংশ শতকের ভারতবর্ষের আইটি সাম্রাজ্যের রাজধানী ব্যাঙ্গালোর ছুঁয়ে যেতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি। সকালে ব্যাঙ্গালোরে নেমে দিনের বেলাটা শহরের তাপউত্তাপ বুঝে রাত্রে হাম্পির উদ্দেশে যাত্রা। এখানে বলে রাখা ভাল, হাম্পি যেতে গেলে রাতের বাস বা ট্রেন ধরতে হয় ব্যাঙ্গালোর থেকে যা আপনাকে হস্পেট পৌঁছে দেবে। সেখান থেকে অটো করে হাম্পি। আর ব্যাঙ্গালোর থেকে কর্নাটক সরকারের কিছু বাস আছে যা সোজা হাম্পি পৌঁছে দেয়। তবে সেই বাসে সারা রাত বসেই যেতে হবে, কারণ, সেইসব বাসে এসি বা শুয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। আর তাই আমি আগে থেকে রেড বাসের মাধ্যমে বুক করে রাখা এসি স্লিপার বাসে আনন্দ রাও সার্কেল বাস টার্মিনাস থেকে হাম্পি টু হস্পেট যাত্রা শুরু করি।

বিজয় বিট্‌ঠল মন্দিরের ভেতর।

থাকার জায়গা বলতে হাম্পির একাধিক হোমস্টে। সেই হোমস্টে আগে থেকে বুক করে রাখতে পারলে ভাল। আর যদি সেটা একান্তই সম্ভব না হয় তবে সোজা হাম্পি পৌঁছে সেখানে গিয়েও হোমস্টে বুক করা যায়। হোমস্টে ও গাইডের পেশাই হল বর্তমানে এই মূলত হাম্পির মূল অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি।

রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে যখন হাম্পির বাসে উঠছি তখন হোমস্টে থেকে গাইড কাম অটো ড্রাইভার যোগাযোগ করেন। নাম পরশুরাম। এ যেন মহাকাব্যের জায়গা ছুঁতে যাওয়ার আগে মহাকাব্যের আমাকে ছুঁয়ে যাওয়া।

বিজয় বিট্‌ঠল বাজার।

বাস ভোর চারটে-সাড়ে চারটে নাগাদ হস্পেট পৌঁছে যায় আর বাস পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগেই পরশুরাম ফোন করে জানিয়ে দেন যে তিনি আমায় নিতে এসে গেছেন। আধা-ঘুম আধা-জাগরণে যখন হস্পেট পৌঁছাই, হাস্যময় এক যুবক আমার দিকে এগিয়ে এসে হোমস্টের নাম কনফার্ম করেন, বুঝলাম এই হলেন পরশুরাম। যদিও রাতে বাস আসে বলে আপনার অটো বুক না থাকলেও হস্পেট থেকে হাম্পি যাওয়ার অটো বাসস্ট্যান্ডে পেয়ে যাবেন।

হস্পেট থেকে হাম্পি ২০ কিমির কিছু বেশি দূর। এই রাস্তা নিশ্চয়ই কিষ্কিন্ধ্যা পর্বতমালা ও দক্ষিণ ভারতের গ্রামগুলি ছুঁয়ে যায়। তবে এই পথে দুবারের যাত্রাপথই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আগে পরে হওয়ায় তার প্রকৃত রূপ আমি ধরতে পারিনি। কিন্তু আঁধারের মধ্যেও এই পথ আমায় এটুকু ভাল করেই বুঝিয়ে দেয় যে, এই ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যে যাওয়ার পথ। এই পথ শুধুই নতুন জার্নির গল্পের পথ নয়, এ তার চেয়ে অনেক বেশি পুরাণ-ইতিহাস-মহাকাব্য ছুঁয়ে থাকার পথ।

ভোর পাঁচটায় যখন হাম্পি পৌঁছে বিছানায় গা এলিয়ে জার্নির ক্লান্তি সারাব ভাবছি, তখনই আমায় পরশুরাম জানান যে আমি যদি আজই সূর্যোদয় দেখতে চাই তবে এখনই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যাওয়া ভাল। কারণ সামনেই মাতঙ্গা পর্বতের চূড়া হাম্পির সূর্যোদয় দেখার অন্যতম স্পট। তাই সেই সুযোগ আমিও হাতছাড়া করতে চাইনি। আর ফ্রেশ হয়ে আবার আমার হাম্পি রথে চেপেই চলে গেলাম হোমস্টে থেকে একটু দূরে অবস্থিত ‘মাতঙ্গা’ পর্বতে। মাতঙ্গা পর্বতের শিখরে উঠতে যদিও কিঞ্চিৎ বেগ পেতে হয়েছিল।

কৃষ্ণ বাজার।

কিষ্কিন্ধ্যা পর্বতমালার গায়ে কোনও সিঁড়ি নেই, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পা রেখে এগিয়ে যেতে হয়। বেশ কিছুটা ওঠার পরে দেখা যায় শ্রী মাতঙ্গা বীরভদ্র মন্দির। এই মন্দিরে বীরভদ্ররূপে মহাদেব আজও পূজিত হন। দিনে একবার বাইরে থেকে পুরোহিত এসে পুজো করে যান। আর এই মন্দিরকে বাঁদিকে রেখে একটু এগিয়ে গেলেই সূর্যোদয় স্পট। সারারাতের বাস জার্নি ও মাতঙ্গা পর্বতে ওঠার ক্লান্তি একনিমেষে শেষ হয়ে যায় এখানে এলে। সূর্যদেব যেন অপেক্ষায় থাকেন বিশ্বচরাচরকে আলোকিত করার জন্য। ধীরে ধীরে যখন সূর্য উদয় হয় সেই রূপ বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি সেই দিনের সেই ভোর ও সকাল হওয়ার মুহূর্ত আজীবন স্মৃতির পাতায় থেকে যাবে। ভিউ হয়তো ক্যামেরাবন্দি করা যায়, কিন্তু মুহূর্ত? নাহ মুহূর্তকে বন্দি করা যায় শুধু মনের মণিকোঠায়। সূর্যোদয় দেখতে গিয়ে সেদিন জীবনে প্রথম বিশ্বাস হল যে, সত্যি সপ্তাশ্বের রথে চড়ে বিশ্ব চরাচর চরে বেড়ান আদিত্য। তবে আমার এই থমকে যাওয়া এখানেই শেষ না, দুদিনের হাম্পি ট্রিপের পুরোটাই ছিল বারংবার বিহ্বল হওয়ার মুহূর্ত।

কৃষ্ণ মন্দির।

সূর্যোদয় দেখে ফিরে দিনের বেলা হোমস্টের আতিথ্যে কাটিয়ে, দুপুরে খেয়েদেয়ে আমার সারথি পরশুরামের সঙ্গে বেরলাম হাম্পির বাইরের কিছু জায়গা দেখতে। বাইরে বলতে তুঙ্গভদ্রার অন্য পাড়ে। যেদিকে আছে পম্পা সরোবর, আছে বিজয়নগরের মূল রাজধানী, আছে মহাকাব্যের মহাবীর হনুমানের জন্মস্থান।

নদীর ওপারে আমাদের প্রথম গন্তব্য ‘হানিগুন্দি’ যা কিনা ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী। এবং আছে ‘গগনাপ্যালেস’ (স্থানীয় উচ্চারণ), যা উৎসবের সময় রাজারা ব্যাবহার করতেন। ছোট্ট এই প্রাসাদের ভেতরে এখন ঢোকা যায় না, সংস্কার কার্য চলছে বলে। তবে এই প্রাসাদের ভেতর দিয়ে মূল প্রাসাদে যাওয়ার গুপ্তপথ ছিল বলে কথিত। উৎসবে গান-নাচ বা মল্লযুদ্ধের প্রদর্শন হত এই প্রাসাদের সামনেই।

বালি গুহা। এখানেই নাকি মায়াবী ও বালির যুদ্ধ হয়।

এই একই দিনের গন্তব্যে ছিল ‘বালিকেল্লা’, ‘বালি গুহা’, ‘অঞ্জনেরি’, ‘শবরী গুহা’। কথিত এই বালিকেল্লাতে আজও বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গুপ্তধন গুপ্ত অবস্থায় সুরক্ষিত। যদিও বালিকেল্লা প্রবেশের আগে আপনাকে দেবী দুর্গার মন্দির পেরিয়ে যেতে হবে। দেবী এখানে সিংহবাহিনীরূপেই পূজিতা।

এর পরের গন্তব্য অঞ্জনেরি যা হনুমানের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত। এই রাস্তায় পড়বে বালি গুহা। বালি গুহাই রামায়ণের সেই বিখ্যাত জায়গা যেখানে নাকি মায়াবী ও বালির যুদ্ধ হয় ও সুগ্রীব বালি হত হয়েছেন ভেবে সেই গুহার দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসেন। এই গুহায় অবশ্য যাওয়া যায় না। তবে গুহার গায়ে সেই যুদ্ধের মোটিফ দেখা যায়।

বালি গুহার গায়ে যুদ্ধের মোটিফ।

এর মধ্যে শবরী গুহা ও পম্পা সরোবরও যাওয়া হল। কথিত, এখানেই রামচন্দ্রের সঙ্গে তপস্বী শবরীর সাক্ষাৎ হয়।

এর পরে অঞ্জনেরি। এই পাহাড়টি বেশ উঁচু। এখানে প্রসাদ হিসাবে নারকেল দেওয়া হয়। পাহাড় চূড়ার মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য সিঁড়ি, শেড, বসার জায়গা ও পানীয়জলের ব্যবস্থা আছে। কারণ তা না হলে এই মন্দির পর্যন্ত পৌঁছাতে বেগ পেতে হত বিস্তর। দীর্ঘ সিঁড়ি ভাঙার পরে মন্দির (কথিত আছে, এখানেই হনুমানের জন্ম হয়)। ছোট্ট এই মন্দিরটি খুব পরিষ্কার-পরিছন্ন। পুজো বলতে আপনার ইচ্ছেমত দক্ষিণা ও প্রসাদের প্যাকেটে যা থাকে সব পুরোহিতকে দিয়ে দিতে হয়, শুধু নারকেল ভেঙে দেওয়ার জন্য মন্দিরের বাইরে একটি নির্দিষ্ট জায়গা আছে।

অঞ্জনেরি। কথিত আছে, এখানেই হনুমানের জন্ম হয়।

এই পাহাড় চূড়াও হাম্পির সূর্যাস্ত দেখার চারটি স্পটের একটি। বাকি দুটি স্পটের একটি মাতঙ্গা হিল ও অন্যটি মাল্যবন্ত পর্বত (দুই জায়গাই একইসঙ্গে সূর্যোদয় দেখার জন্যও বিখ্যাত) এবং চতুর্থ স্পট হল বিরুপাক্ষ মন্দির। যদিও আমি দিনেদুপুরে যাওয়ায় অঞ্জনেরি থেকে সূর্যাস্ত দেখতে পারিনি। তবে এখান থেকে দেখেছি দূরে রূপালি রেখার ন্যায় তুঙ্গভদ্রাকে, চারিদিকের কিষ্কিন্ধ্যা পর্বতমালাকে।

অঞ্জনেরি থেকে।

পরের গন্তব্য মাল্যবন্ত রঘুনাথ মন্দির। পূর্বমুখী এই মন্দিরটির গাত্র-কারুকার্য ও স্ট্রাকচার আর পাঁচটা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্থাপত্যের মতই। এই মন্দিরটি ষোড়শ শতকে তৈরি। এবং লোককথা অনুসারে এখানেই প্রথমবার দেখা হয় রাম-হনুমানের। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, তারও আগে বনবাসকালে এখানেই নাকি রামচন্দ্র পিতৃবিয়োগের কথা অনুভব করেন এবং পিতৃতর্পণ করেন। তবে রুক্ষ কিষ্কিন্ধ্যায় জল না থাকায় রামচন্দ্র ও লক্ষ্মণ তির দিয়ে পাথর ভেদ করে জল আনেন ও সেখানেই ২৪টি শিবলিঙ্গ স্থাপনা করে পুজো করেন। সেই জায়গাটি বর্তমানে আছে এবং সেখানে পাথরের মধ্যে ক্ষীণ জলের স্রোত দেখা যায় আর সঙ্গে শিবলিঙ্গ ও নন্দীর মোটিফ দেখা যায়। তবে সেইসব প্রথমেই না।

মাল্যবন্ত রঘুনাথ মন্দির।

মন্দিরের প্রথমে দেখা যাবে রাম-লক্ষণ ও সীতার মূর্তি, সেখানে আজও চব্বিশ ঘণ্টা রামায়ণ পাঠ চলে। এখানে রামমূর্তির বৈশিষ্ট্য এই যে, রাম-লক্ষ্মণের মূর্তি এখানে বসা অবস্থায় দেখা যায়। পাশে আছে হনুমান মন্দিরও। মন্দির থেকে বেরিয়ে পেছনের দিকে গেলেই সেই জলের স্রোত দেখা যায়। আর এখানে আর একটি শিব মন্দির আছে, যেখানে আপনি ইচ্ছে হলে নিজে পুজো দিতে পারেন। আর সঙ্গে ২৪টি শিবলিঙ্গের অনতিদূরে শ্বেত শিবলিঙ্গও দেখার মত।

মাল্যবন্ত রঘুনাথ মন্দির।

মাল্যবন্ত পর্বতের এই শেষ প্রান্তটিই হচ্ছে সূর্যাস্ত দেখার জায়গা। সকালের সূর্যোদয় যেমন আমায় বিশ্বাস করিয়েছিল আদিত্য সপ্তাশ্ব রথে চেপে বিশ্বজুড়ে আলো দেন, সন্ধ্যা নামার প্রাক্‌মুহূর্ত আমায় বিশ্বাস করাল যে, ঠিক এইখানেই মহাকাব্যিক রাম ও হনুমানের দেখা অবশ্যই হয়েছিল।

মাল্যবন্ত রঘুনাথ মন্দিরের সেই জলাধার।

পরের দিন সকাল থেকে শুরু আমার বিজয়নগর সাম্রাজ্য পরিদর্শন। পনেরোশো শতকের ভারতবর্ষে যে ক’টি সমৃদ্ধ নগরী ছিল তার মধ্যে অন্যতম এই বিজয়নগর। তবে বিজয়নগর সাম্রাজ্য পরিদর্শনের আগে হাম্পির বিরূপাক্ষ মন্দির একবার ভাল করে ঘুরে নেওয়া ভাল। এই মন্দিরে আজও নিত্য পুজো হয়। সকাল ছ’টা থেকে রাত ছটা সাড়ে ছটা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। মন্দিরে বিরূপাক্ষ মহাদেবের সঙ্গে দেবী দুর্গার দুই রূপও পূজিতা হন। এখানকার কারুকার্য বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মন্দির গাত্রের কারুকার্যের মতই। এই মন্দিরে বর্তমানে একটি হাতিই আছে যার নাম লক্ষ্মী। শান্ত লক্ষ্মীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় পর্বটিও বেশ মনোরম।

বিরূপাক্ষ মন্দির।

হাম্পি বা বলা ভাল বিজয়নগরে ছিল মূল পাঁচটি বাজার। প্রথম বাজারের নাম ‘বিরূপাক্ষ’ বাজার, যা মন্দিরের সামনেই অবস্থিত। এই বাজারটি ছিল মূলত জুয়েলারি বাজার, যা সারা সপ্তাহই খোলা থাকত। বাজারের পাথরের স্ট্রাকচার আজও বর্তমান। বর্তমান হাম্পির ছোট্ট বাজারও এই অঞ্চলেই বসে, তবে তা নেহাতই একবিংশ শতকের দক্ষিণ ভারতীয় এক বাজার, সেখানে জুয়েলারি খুঁজে না পেলেও কল্পনার সাম্রাজ্যে রত্নখচিত সেই পুরাতন বাজারকে চিনে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এছাড়া আছে ‘কৃষ্ণ বাজার’। সেই বাজারে সব্জি ও মশলাপাতি বিক্রি হত। এই বাজারের উল্টো দিকেই কৃষ্ণ মন্দির, যে মন্দিরের গায়ে বিষ্ণুর কল্কি অবতারের অবয়ব অঙ্কিত আছে। তৃতীয় বাজার মাতঙ্গা হিলের পাশে অবস্থিত ‘সুলে বাজার’। সুলে অর্থে স্লেভ, এই বাজারে মূলত দাস কেনাবেচা হত। চতুর্থ বাজার ‘হাজারি রামা বাজার’, যেখানে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি হত। পঞ্চম ও শেষ বাজার হল ‘বিজয় বিট্‌ঠল’ বাজার। যা বিজয় বিট্‌ঠল মন্দিরের সামনে অবস্থিত। সেই বাজারে বিক্রি হত হাতি-ঘোড়া-শিকারি কুকুর সহ বিভিন্ন পশু-পাখি। এর মধ্যে সুলে বাজার, বিরূপাক্ষ বাজার ও বিজয় বিট্‌ঠল বাজার প্রতিদিন খোলা থাকত। বাকি দুই বাজার সপ্তাহে তিনদিন খোলা থাকত।

বিরূপাক্ষ বাজার।

প্রতিটি বাজারের বৈশিষ্ট্য এই, বাজারগুলিতে বড় বড় জলাশয় ছিল তবে এইসব জলাশয় বাজারের পানীয়জলের জন্যই ছিল। শুধু মন্দিরের উৎসবের সময়ে এই জলাশয়গুলিতে বিশেষ পুজো হত।

বিরূপাক্ষ মন্দির।

হাম্পির প্রতিটি সৌধ ও মন্দিরের কথা বলতে গেলে সেগুলির বিষয়ে আলাদা আলাদা করে না বললেই নয়। তবে তাতে এই লেখনী অতি লেখায় দুষ্ট হবে। ইচ্ছে আছে কখনও প্রতিটি জায়গা নিয়ে আলাদা করে লেখার। তবে হ্যাঁ, কিছু স্থাপত্যের কথা না বললেই নয়। তার মধ্যে অন্যতম হাজারি রামা মন্দির। এই মন্দিরগাত্র রামায়ণ চিত্রিত। এই মন্দিরে আছে কালো পাথরের চারটি পিলার এই পিলার আনা হয়েছিল বাইরে থেকে।

হাজারি রামা বাজার।

এছাড়া আছে রানিদের গ্রীষ্মকালীন আবাস, পুরাতন ভগ্ন রাজপ্রাসাদ। আছে পাতাল শিবমন্দির। আর অবশ্যই বলতে হয় বিজয় বিট্‌ঠল মন্দিরের কথা। এই মন্দিরেই একমাত্র পাথরের তৈরি রথ দেখা যায়। অন্যান্য সব মন্দিরের রথ কাঠের। এই মন্দিরের থেকে অনতিদূরে অবস্থিত তুঙ্গভদ্রা।

ভগ্ন রাজপ্রাসাদ।

সব শেষে বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে দেখা সূর্যাস্তের কথা না বললে হাম্পি দর্শন বিষয়ে বলা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে আর সঙ্গে বলতেই হয় ‘হেমকুন্তা’-র কথা। কথিত, দেবী সতীর মৃত্যুর পরে দেবাদিদেব মহাদেব এই হাম্পিতেই কঠোর তপস্যায় রত ছিলেন। সমস্ত দেবকুলের চিন্তা নিবারণের জন্য যখন মদনদেব (কামদেব) মহাদেবের ওপর নিজ বাণ বর্ষণ করেন, তখন মহাদেবের তৃতীয় নেত্র ক্রোধে উন্মোচিত হয় ও মদনদেবকে ভস্মীভূত করেন এই ‘হেমকুন্তা’-তেই।

হেমকুন্তা থেকে সূর্যাস্ত।

শুরুতেই বলেছিলাম তুঙ্গভদ্রার কথা। শেষে যদি তাকে ছুঁয়ে না যাই তবে আমার এই ভ্রমণকাহিনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তুঙ্গভদ্রার যে রুদ্ররূপের কথা পড়া সেই রূপ না দেখতে পেলেও তাকে অনুভব করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। আর সবচেয়ে ভাল আমার হোমস্টের ছাদ থেকে এক দিকে বিরূপাক্ষ মন্দির ও অন্য দিকে তুঙ্গভদ্রা, যাকে না ছুঁয়ে থাকা যায় না।

তুঙ্গভদ্রা তীরে।

দ্বিতীয় দিন রাতে হাম্পিকে বিদায় জানিয়ে আসার সময়ে গহন আঁধারে মনে হল বিজয়নগর সাম্রাজ্য আমায় যে সম্পদে পূর্ণ করল, আজীবন সে অতুলনীয় সম্পদ হয়ে থেকে যাবে।

কভার: হেমকুন্তা থেকে বিরূপাক্ষ মন্দির।

চিত্র: লেখক
5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Tamal bose
Tamal bose
3 years ago

আরেকবার হাম্পি যাওয়ার ইচ্ছেকে উসকে দিলেন লেখা ও ছবির মাধ্যমে। ধন্যবাদ

Subrata Sanyal
Subrata Sanyal
3 years ago

চমৎকার লেখা।

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »