দুর্গাপুজোর অন্যতম উপাচার পদ্মফুল। মা দুর্গার পুজোয় পদ্ম মাস্ট। রামচন্দ্র ১০৮টি নীল পদ্মফুল দিয়ে মায়ের পুজো করেছিলেন, তাই সেই প্রথা নাকি আজও চলছে। পুরাণের পাতায় চোখ রাখতে পেলাম দু’রকমের তথ্য। বাল্মিকী রামায়ণে রাম রাবণবধ হেতু মহামায়ার যে পুজো করেছিলেন তাতে পদ্মফুলের কোনও উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কৃত্তিবাসী রামায়ণে পদ্মের উল্লেখ পাওয়া যায়। বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস করে রামচন্দ্র পুজো শুরু করেছিলেন ষষ্ঠীতে। তারপর সপ্তমী, অষ্টমী পুজো করে, নবমীতেও পুজো প্রায় সাঙ্গ, কিন্তু রামচন্দ্রের মনে কোনও আনন্দ নেই। এমন সময় বিভীষণ রামচন্দ্রকে বললেন: ‘তুষ্টিতে চণ্ডীরে এই করহ বিধান।/ অষ্টোত্তর-শত নীলোৎপল কর দান॥/ দেবের দুর্লভ পুষ্প যথা তথা নাই।/ তুষ্ট হবেন ভগবতী শুনহ গোঁসাই॥’
বিভীষণের এই পরামর্শে রামচন্দ্র ভাবলেন কোথায় পাবেন ১০৮টি নীলপদ্ম! মুশকিল আসান হনুমানকে বিভীষণ বলেন, ‘অবনীতে দেবীদহে নীলপদ্ম আছে।’ হনুমান চলে গেলেন নীলপদ্মের খোঁজে দেবীদহে এবং ১০৮টি নীলপদ্ম নিয়েও এলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে এই গল্পের সঙ্গে আরও পাওয়া যায় যে, দেবীদুর্গা ওই ১০৮টি পদ্মের মধ্যে থেকে একটি পদ্মকে সরিয়ে রেখেছিলেন। সেই সময় রামচন্দ্র নিজের একটি চক্ষুকে (নীল-কমলাক্ষ বলে পরিচিত) মায়ের পায়ে নিবেদন করতে উদ্যত হলে, দেবী রামচন্দ্রের সামনে আবির্ভূতা হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেন। আবার কালিকাপুরাণে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ভক্তিযুক্ত হয়ে ১০৮টি রক্তপদ্ম মহাদেবীকে অর্পণ করে, সে মদীয় ধামে অসংখ্য কল্পবাস করে এবং শেষে পৃথিবীতে রাজা হয়ে জন্মগ্রহণ করে।’
সন্ধিপুজোয় ১০৮ পদ্ম কেন লাগে? কেন কম বা বেশি নয়? হিন্দু শাস্ত্র মতে, ১০৮ সংখ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু দেবতার থাকে অষ্টোত্তর শতনাম। ১০৮ পদ্ম, ১০৮ প্রদীপ। যোগের ক্ষেত্রেও ১০৮ সংখ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আয়ুর্বেদ মতে, আমাদের শরীরে ১০৮টি ‘পয়েন্ট’ আছে। হিন্দুশাস্ত্র যন্ত্রের পূজায় বিশ্বাস করে। শ্রীচক্র যন্ত্রে ৫৪টি করে কোনও পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন হিসাবে দেখা হয়, যার থেকে সৃষ্টি, অর্থাৎ এখানেও ১০৮।
পাঁকে জন্ম নিয়েও পদ্ম নির্মল। তার সৌন্দর্য ও সুবাস অমলিন। জন্ম যেখানেই হোক কর্মই আসল পরিচয়। খারাপ জায়গায় জন্মেও ভাল কাজ করে নিজের দৃষ্টান্ত তৈরি করা যায়, পদ্মফুল সেই বার্তাই দেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় রয়েছে— ‘…বড় হও দাদাঠাকুর/ তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো/ যেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর/ খেলা করে’, অথবা ‘বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি একশ আটটা নীলপদ্ম’।
পদ্মফুল পবিত্র সৌন্দর্যের প্রতীক। এটি কন্দ জাতীয় বহু বষর্জীবী জলজ উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Nelumbo nucifera, এটি Nelumbonaceae পরিবারের উদ্ভিদ। পদ্মফুলের বহু নাম রয়েছে, যেমন— কমল, শতদল, সহস্রদল, উৎপল, মৃণাল, পঙ্কজ, অম্বুজ, নীরজ, সরোজ, সরসিজ, রাজীব ইত্যাদি। সারা বছর জল থাকে এমন জায়গায় পদ্ম ভাল জন্মে। তবে খাল-বিল, হাওর, বাঁওড় ইত্যাদিতে এ উদ্ভিদ জন্মে। এর বংশ বিস্তার ঘটে কন্দের মাধ্যমে। পাতা জলের ওপরে ভাসলেও এর কন্দ জলের নিচে মাটিতে থাকে। জলের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে গাছ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাতা বেশ বড়, পুরু, গোলাকার ও রং সবুজ। পাতার বোটা বেশ লম্বা, ভেতর অংশ অনেকটাই ফাঁপা থাকে। ফুলের ডাঁটার ভিতর অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য ছিদ্র থাকে। ফুল আকারে বড় এবং অসংখ্য নরম কোমল পাপড়ির সমন্বয়ে সৃষ্টি পদ্ম ফুলের। ফুল ঊধ্বর্মুখী, মাঝে পরাগ অবস্থিত। ফুটন্ত তাজা ফুলে মিষ্টি সুগন্ধ থাকে। ফুল ফোটে রাত্রিবেলা এবং ভোর-সকাল থেকে রৌদ্রের প্রখরতা বৃদ্ধির পূর্ব পর্যন্ত প্রস্ফুটিত থাকে। রৌদ্রের প্রখরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফুল সংকুচিত হয়ে যায় ও পরবর্তীতে প্রস্ফুটিত হয়। ফুটন্ত ফুল এভাবে বেশ অনেক দিন ধরে সৌন্দর্য বিলিয়ে যায়।
ফুল ও ফলের ভেষজগুণ আছে। পদ্মের মূল, কাণ্ড, ফুলের বৃন্ত ও বীজ খাওয়া যায়। পুরাতন গাছের কন্দ এবং বীজের সাহায্যে এদের বংশবিস্তার হয়। তিন ধরনের পদ্ম ফুল রয়েছে, যেমন— শ্বেতপদ্ম, লাল পদ্ম ও নীল পদ্ম। পাতা বড় এবং গোলাকৃতি, কোনও কোনও পাতা জলে লেপটে থাকে, কোনটা উঁচানো। বর্ষাকালে ফুল ফোটে। হাওর-ঝিলবিল বা পুকুরে বিভিন্ন ফুলের ন্যায় শুভ্রতার প্রতীক সাদা পদ্ম ফুল ফোটে। ফুল বৃহৎ এবং বহু পাপড়িযুক্ত। সাধারণত বোঁটার উপর খাড়া, ৮-১৫ সেমি চওড়া। ফুলের রং লাল, গোলাপি ও সাদা, সুগন্ধিযুক্ত।
পদ্ম ফুল ও ফলের (পদ্ম চাক) ভিতরে থাকা বীজ বা বোঁটা আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগের জন্য খুবই উপকারী। ঔষধী গুণ ছাড়াও পদ্ম চাক, বীজ ও বোটা সুস্বাদু খাবার। উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলায় পুকুর-জলাশয়, লেক ও হাওর-বিলে গোলাপি পদ্ম সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। সেই তুলনায় সাদা পদ্ম বা পদ্ম কমল অনেকটাই অপ্রতুল। আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা গেলেও জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে বর্তমানে সাদা পদ্ম বিলুপ্তির পথে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা না হলে সাদা পদ্ম বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমনটি অভিমত উদ্ভিদবিদদের। পদ্ম জলজ পরিবেশের উৎকৃষ্ট উপাদান। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পদ্মের ভূমিকা রয়েছে।
ইরান, চিন, জাপান, নিউ গায়েনা, বাংলাদেশ, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে পদ্ম জন্মে। সাদা পদ্মের উৎস স্থল জাপান ও নর্থ অস্ট্রেলিয়া। এটি এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার জেলায় বিলুপ্তপ্রায় সাদা পদ্ম এখনও দেখা যায়। সাদা পদ্মের অনেক ঔষধী গুণ রয়েছে। পদ্ম ফলের বীজ হৃদপিণ্ড, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের ঔষধের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ডায়ারিয়া রোগ সারাতে এর বোটা কাঁচা খেলে উপকারে আসে। পদ্মফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি লোটাস চা প্রতিদিন পান করলে গ্যাসট্রিক, ডায়েরিয়া ও হার্টের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে হাই ব্লাড সুগারও নিয়ন্ত্রণে থাকবে এছাড়াও এই চা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও পদ্মের শুকনো মূল গুঁড়ো করে খেলে ফুসফস, কিডনি ও পরিপাকতন্ত্র ভাল থাকে।
ভারতের জাতীয় ফুল পদ্ম। বিখ্যাত রাজনৈতিক দলের চিহ্নও এই পদ্ম। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট, মেচেদা এবং পাঁশকুড়াতে পদ্মফুলের চাষ করা হয়। এছাড়া বীরভূম ও দুই দিনাজপুরের ফুলচাষিরাও পদ্মফুলের চাষ করেন। পূর্ব মেদিনীপুরের ঝিল ও মেদিনীপুরের খালে সবচেয়ে বেশি পদ্ম চাষ হয়। বীরভূমের বড় বড় জলাশয়ে বর্তমানে চাষ শুরু হয়েছে। চৈত্রমাসেই এই ফুলের বীজ রোপণ করা হয়, আষাঢ়-শ্রাবণে ফুল ফুটতে শুরু করে। এক বিঘের একটি ঝিলে একদিন অন্তর প্রায় ২০০-৩০০টি করে পদ্মফুল পাওয়া যায়।
চিত্র: গুগল
