Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঢেঁকি ও ধান ভানারি মেয়েরা

ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে! অন্তত বাংলা প্রবাদে তাই আছে। আসলে মানুষের স্বভাবের কথা বলতে গিয়েই এই ঢেঁকি প্রসঙ্গ। তবে স্বর্গে ঢেঁকির ধান ভানার কোনও প্রত‍্যক্ষদর্শী না থাকলেও মর্ত‍্যে আছেন। একটা সময় ছিল যখন কৃষিভিত্তিক গ্রাম-বাংলায় সকাল-সন্ধে কান পাতলেই শোনা যেত ঢেঁকির শব্দ। গ্রাম-বাংলার গরিব মহিলাদের একটি বিকল্প মরসুমি পেশাও ছিল ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া। এঁদের বলা হত ‘ভানারি’।

গৃহস্থের জমির ধানের চাল তৈরি থেকে শুরু করে চিঁড়ে তৈরি এবং পৌষসংক্রান্তির সময় ভেজা চাল ঢেঁকিতে কুটে পিঠের গুঁড়ি তৈরির এক মহা আয়োজন ছিল গ্রাম-বাংলায়। ঢেঁকি থেকে চিঁড়ে তৈরি করতেন মূলত ছুতোর ও রোয়ানি সম্প্রদায়ের মেয়েরা। শিল্পী অমর পালের কণ্ঠে অমর হয়ে আছে এক লোকসঙ্গীত: ‘ও ধান ভানি ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া/ ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া…।’

পাড়ার সরস্বতী পুজোর সময় উদ্যোগী ছেলেমেয়েরা বাড়ি বাড়ি ধান সংগ্রহ করত এবং তারপর সেই ধান দেওয়া হত ছুতোর বাড়িতে। সেখানে ধানের বিনিময়ে আসত দেবীর ভোগের টাটকা খানিকটা লালচে রঙের মিষ্টি স্বাদের চিঁড়ে। এসব আধুনিক হাস্কিং মেশিন আসার আগের কথা। তখনও গ্রামে বিজলি আসেনি, কেরোসিনের লণ্ঠন, হ্যারিকেন, লম্ফু/ লম্ফো ছিল আলোর উৎস।

দুর্গাপুজোর আগে হত বড় ষষ্ঠী বা ষাট মায়ের পুজো। এসময় পাড়ার লোকজন পুকুরপাড়ে বসে পরিবারের সঙ্গে চিঁড়ে-দই খেতেন। আর তার আগে পুকুরপাড়ের ঘাস চেঁছে পরিষ্কার করতেন গ্রামের চৌকিদার। এর বিনিময়ে গোটা গ্রামের সব পরিবারের কাছ থেকে তাঁর পাওনা হতো চিঁড়ে-দই।

আর ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীচৈতন্য পার্ষদ নিত‍্যানন্দ প্রভু তো পানিহাটির গঙ্গার তীরে ছত্রিশ জাতের মানুষকে একসঙ্গে বসিয়ে খাইয়েছিলেন। জাত-পাতের বিরুদ্ধে বাংলায় এটিই ছিল প্রথম সংগঠিত প্রতিবাদ। তখনও কিন্তু চিঁড়ে তৈরি হত ঢেঁকিতেই। কাজেই গ্রাম-বাংলার একটি অর্থনৈতিক প্রতীক ছিল এই ঢেঁকি। সারা বাংলায়, আসাম ও ওড়িশার গ্রামাঞ্চলে এবং বাংলাদেশ, নেপালেও ঢেঁকি ব্যবহারের প্রভূত চল ছিল।

বাংলা কবিতাতেও এসেছে ঢেঁকি। যেমন, রবি ঠাকুরের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার কৃষ্ণকান্ত ওরফে কেষ্টা তার মনিবের কাছে ছিল ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’। মানে বুদ্ধিহীন। কিন্তু এখানে বুদ্ধির ঢেঁকির কথা বলছি না, বলছি গ্রাম-বাংলা থেকে প্রায় উঠে যাওয়া ধান ভানা ঢেঁকির কথা। কয়েকশো বছর ধরে ধান ভানার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতিকে লালন করে এসেছে এই কাঠের ঢেঁকি।

ঢেঁকির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের কৃষি-সংস্কৃতি। একটু ব‍্যাখ‍্যায় আসি। শাস্ত্রেও রয়েছে ঢেঁকির প্রসঙ্গ। স্বর্গের ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’ নারদ মুনির বাহন ঢেঁকি। নারদ সব সময় ‘নারায়ণ নারায়ণ’ জপ করেন। ‘নারায়ণ’ মানে হল, যার আশ্রয়স্থল জল। আবার নারায়ণভক্ত ‘নারদ’ মানে হল, যিনি জলদান করেন।

কৃষিকাজের জন্য অপরিহার্য হল জল। আর সেই কৃষিজ শস্য পিষে দানা বের করা ঢেঁকির কাজ। তাই জলের দেবতা নারদের বাহন হিসেবে কৃষিজীবী মানুষ তাঁকে ঢেঁকিবাহন করেছেন। পূর্ব ভারতেই ঢেঁকির রমরমা ছিল বেশি। তাই শাস্ত্র-পুরাণে নারদের বাহন হিসেবে এর উল্লেখ না থাকলেও পূর্ব ভারতে নারদ মুনি কিন্তু ঢেঁকি-বাহন হিসেবেই পরিচিত।

প্রথমে মানুষ পাথরের ওপর শস্য রেখে আরেকটি পাথর দিয়ে ঘষে তা থেকে খাদ্যদানা বের করত। এরপর এল উদুখল। একটি বড় পাত্রের মধ্যে শস্য রেখে কাঠের দণ্ড দিয়ে তা পেষাই করা হত। তারপর এল পাথরের জাঁতা। সবশেষে এল ঢেঁকি। ঢেঁকি  আবিষ্কারের পর থেকে গ্রামীণ মানুষের প্রধান আশাভরসা হয়ে উঠল এটি।  ঢেঁকি তৈরিতে দরকার শাল, অর্জুন, বাবলা, তেঁতুল কাঠের মত শক্ত কাঠের। ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকি’ কিন্তু একেবারেই অচল।

গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে আলাদা ঢেঁকিশাল বা ঢেঁকিঘর থাকত। ঢেঁকির বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন নাম আছে, যেমন ঢেঁকির সামনের অংশের নাম ‘মুষল’, মুষলের মুখে লাগানো লোহার বেড়ির নাম ‘শামা’, আর মাটিতে যেখানে শস্য রাখা হয়, সেই গর্তের নামটি হলো ‘গড়’। ধান ভানেন যে মহিলা, তার নাম ‘ভানারি’। ঢেঁকির পিছনে চাপ দিলেই ঢেঁকি ওঠা-নামা করে, একে বলে ‘পাড় দেওয়া’। ঢেঁকির কর্মপদ্ধতির সঙ্গে রতিক্রিয়ার মিল খুঁজে পেয়েছে বাঙালি। তাই ঢেঁকিকে নিয়ে চালু গ্রামীণ প্রবাদ: ‘বৌয়ের সঙ্গে গোঁসা করো,/রেতের বেলা গড়ে পড়ো।’

Advertisement

গৃহস্থ ঘরে ঢেঁকি চললে বোঝা যেত সে ঘরে ‘লক্ষ্মী’ অর্থাৎ খাদ্য-শস্য আছে। তাই পবিত্র জায়গা ছিল ঢেঁকিশাল। প্রতিদিন ভোরে এই ঘরে সাঁঝ-মারুলি দেওয়া হত। সাঁঝ মানে সন্ধ্যা-প্রদীপ দেখানো হত এই ঘরে এবং ভোরে ‘মারুলি’ অর্থাৎ গোবর-জল দিয়ে কিছুটা জায়গা গোল করে নিকোনো হত।

ঢেঁকিশাল ছিল মেয়েদের নিজস্ব জায়গা। ধান ভানার পাশাপাশি এখানে নিজেদের মধ্যে খোসগল্প হত, যার জন্য বলা হয়, ‘ধান ভানতে শিবের গীত’। এই ঘরে পুরুষদের প্রবেশ একরকম ছিল নিষিদ্ধ।

নদীয়ার আশানন্দ মুখোপাধ্যায় যাচ্ছিলেন আত্মীয় বাড়ি। রাত হয়ে গেল‌। রাতে আশ্রয় নিলেন এক গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে। সে রাতেই ডাকাত পড়ল সে বাড়িতে। ঢেঁকিশালেই রাতে শুয়েছিলেন আশানন্দ। হাতের কাছে কোনও কিছু না পেয়ে শেষে ঢেঁকিটাই তুলে নিলেন হাতে। আশানন্দের হাতের ঢেঁকি বনবন করে ঘুরতে লাগল সমানে। ঢেঁকি ঘোরাতে ঘোরাতে আশানন্দ ডাকাতদের গঙ্গার ওপারে পাঠিয়ে দিলেন। এভাবেই ডাকাতদের সঙ্গে ঢেঁকি নিয়ে লড়াই করে নদীয়ার শান্তিপুর এলাকার পালোয়ান আশানন্দ মুখোপাধ্যায় হয়ে গেলেন ‘আশানন্দ ঢেঁকি’। নদিয়ার শান্তিপুরে ঢেঁকি কাঁধে আশানন্দর মূর্তি আছে।

‘গড়’ মানে ঢেঁকি যেখানে পড়ে, সেই গর্ত। এছাড়া ঢেঁকির সঙ্গে থাকে ‘আঁক শলাই’ ও ‘মুখ শলাই’ নামে দুটি গোঁজ। এ দিয়েই ঢেঁকি আটকানো থাকে। আর সামনে থাকে বাঁশের তৈরি শরীরের ভর দিয়ে ধরার জন্য ‘ধরনি’। এছাড়া ধান টানার জন্য থাকে একটি বাঁশের লম্বা লগা, নাম— ‘শিকললড়ি’। ভানারি ধান ভানতে ভানতে নিজেই এই বাঁশের লগা দিয়ে ধান টেনে গড়ের কাছে আনেন। তবে ‘আছে’ মানে একসময় ‘ছিল’। এখন আর নেই।

হাস্কিং মিল হবার পর ঢেঁকি এখন বিলুপ্তপ্রায়। তবে গ্রামের দিকে এখনও দু-একটি ঢেঁকি দেখা যায়। সাধারণত পৌষমাসে সংক্রান্তির সময় পিঠের গুঁড়ি তৈরির সময় এই ঢেঁকির ব‍্যবহার হয়। ব্যাস, এই পর্যন্তই।

ঢেঁকি ছাঁটা চাল, ঢেঁকিতে তৈরি মিষ্টি চিঁড়ের দিন শেষ। সেইসঙ্গে কাজ গিয়েছে ‘ভানারি’-র। তাই গ্রাম-বাংলায় রবি ঠাকুরের ভাষায় আজ আর দেখা যায় না, ‘ঢেঁকি পেতে ধান ভানে বুড়ি,/ খোলা পেতে ভাজে খই মুড়ি।’

কয়েকশো বছর ধরে বাংলার সংস্কৃতিকে লালন করে এসেছে যে ঢেঁকি, তার গৌরবের দিন শেষ। যে দু-একটি ঢেঁকি এখন অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলিও যেতে বসেছে উইয়ের পেটে। তবে ঢেঁকি এখনও আছে। পৌষসংক্রান্তির সময় গ্রামের মেয়েরা এখনও পিঠের চাল কোটেন এই ঢেঁকিতেই‌। জানা গিয়েছে, যন্ত্রে তৈরি পিঠের চাল গুঁড়িতে ঠিকমত ‘সরুচিকলি’ হয় না। তাই এখনও ঢেঁকির দিন যায়নি, বছরে অন্তত একবার ঢেঁকির দিন আসে। এখনও আসে।

চিত্রণ: মুনির হোসেন

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

twelve + three =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »