Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

হাওয়াবদলের দেশে

বিভিন্ন শেডের সবুজ বনবনানী, অনুচ্চ কিন্তু বিস্তীর্ণ টিলা পাহাড়, বৃষ্টির জলে পরিপুষ্ট জলধারার শোভায় শোভিত ঝাড়খণ্ড রাজ‍্যের সাঁওতাল পরগনায় অবস্থিত দেওঘর। বাবা বৈদ্যনাথ ধাম এক অতীন্দ্রিয় ধর্মস্থান বলে বহু দিন ধরে সুপ্রসিদ্ধ। হিন্দি শব্দ অনুযায়ী দেওঘর হল দেবদেবতাদের ঘর। এটি হিন্দু ধর্মের একটি পবিত্র স্থান। এখানে হিন্দু ধর্মের ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গসমূহের একটি বৈদ্যনাথ মন্দির অবস্থিত। বৈদ্যনাথ মন্দির চত্বরে মূল বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দির ছাড়াও আরও ২১টি মন্দির আছে। এখানকার মন্দিরসমূহ তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের কাছে শহরটিকে একটি গন্তব্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এছাড়াও, এই শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।

ত্রিকূট পাহাড়।

ঐতিহাসিক মত অনুযায়ী ১৫৯৬ সালে বৈদ্যনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা পূরণমল। ৫১ পীঠের এক পীঠ এই বৈদ্যনাথ ধাম, ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সতীর হৃদয় পড়েছিল এখানে। সারা ভারত থেকে তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে দেওঘরে আসেন বহু পর্যটক ও স্বাস্থ্যান্বেষী। স্টেশন রোড থেকে একটু দূরেই ক্লক টাওয়ার। দেওঘরের প্রাণকেন্দ্র এই ক্লক টাওয়ারকে ঘিরেই জমে উঠেছে বাজারহাট। ক্লক টাওয়ার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত তপোবন। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে নওলাখি মন্দির, বীর হনুমান মূর্তি, কুণ্ডেশ্বরী নবগ্রহ মন্দির। শোনা যায়, এখানে ঋষি বাল্মিকী এসেছিলেন। সীতাদেবী এখানকার কুণ্ডে স্নান করেছিলেন বলেই সীতাকুণ্ডটি বিখ্যাত। দেওঘরে রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম। দেওঘর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ত্রিকূট পাহাড়। এই পাহাড়ে ট্রেকিং করা যায়, রোপওয়ের ব‍্যবস্থাও আছে। পাহাড় এবং জঙ্গলের মিশ্রিত শোভা দেখতে এখানে ভিড় জমান অনেকে। জঙ্গলে রয়েছে নানা জীবজন্তু। আর এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অসাধারণ। ক্লক টাওয়ারের কাছেই অবস্থিত নন্দন পাহাড়। এর চূড়ায় রয়েছে একটি বিনোদন পার্ক। এ ছাড়াও এখানে আছে অনুকূলচন্দ্রের আশ্রম সৎসঙ্গ বিহার।

এরপরের গন্তব্য হতে পারে শান্ত শিমুলতলা। বিহারের জামুই জেলার ঝাঝা ব্লকের অন্তর্গত শিমুলতলা স্টেশন। দীর্ঘ রোগভোগের পরে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বিশেষ করে বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে একসময় হাওয়া পরিবর্তনের লক্ষ্যে হাজারিবাগ, গিরিডি, দেওঘর, মধুপুর, শিমুলতলা প্রভৃতি জায়গায় যাওয়ার চল ছিল। সম্ভ্রান্ত বাঙালিরা এখানে বাড়ি বানিয়ে রেখেছিলেন। কিছু পুরানো জীর্ণ বাড়ি আজও সেই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। শিমুলতলা বেড়াতে এসে এমনই কোনও একটি পুরনো বাড়িতে দু-একদিন থাকবার পরিকল্পনা করাই যায়, তবে শুধুমাত্র স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার নয়, ঘুরে বেড়ানোর জন্যও শিমুলতলা আসাই যায়। হাওড়া-দিল্লি মূল ট্রেন লাইনের ওপর অবস্থিত এই স্টেশন। হাওড়া অমৃতসর এক্সপ্রেস, তুফান এক্সপ্রেস, মোকামা প্যাসেঞ্জার, হাওড়া আনন্দ বিহার এক্সপ্রেস, হাওড়া-দিল্লি জনতা এক্সপ্রেস এইসব ট্রেন শিমুলতলা স্টেশনে দাঁড়ায়।

ঢাকার রানির প্রাসাদ।

শিমুলতলা পৌছে সারাদিনের জন্য একটা ভাড়া করা অটোতে করে, ৩৩৩ এ জাতীয় সড়ক ধরে, ধারারা জলপ্রপাত পৌঁছে যাওয়া যায়। ধারারা নদীর ওপর এই ছোট্ট ও সুন্দর জলপ্রপাতটি অবস্থিত। কাছাকাছি চাষের অঞ্চলটি ধারারা নদীর জলের উৎসের ওপর নির্ভরশীল। তবে শীতকালে গেলে এখানে জলপ্রপাতের কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। জলপ্রপাত দেখে ফেরার সময় রামকৃষ্ণ মন্দির হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় লাট্টু পাহাড়, ঠিক পাহাড় নয় এটি একটি টিলা। পাহাড়চূড়ায় রয়েছে একটি মন্দির। লাট্টু পাহাড় থেকে একেবারে কাছেই শিমুলতলা রাজবাড়ি বা রানিকোঠি। এটি ছিল পূর্বতন ঢাকার রানির প্রাসাদ। তবে দুঃখের বিষয়, উপযুক্ত সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শিমুলতলা স্টেশন থেকে মাত্র তিন কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত এই রাজবাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছু নয়। দর্শনীয় বলতে গেলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। তবে আফসোস না করে “টিলা টিলা শিমুলতলায় ভিলা ভিলা বাড়ি।”-র চার পাশ ঘেরা দিকচক্রবাল রেখায় প্রহরী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণি।

খুবই শান্ত, স্নিগ্ধ, নির্জন পরিবেশে শাল, মহুয়ার অরণ্যে, প্রাকৃতজনের গ্রাম দেখতে দেখতে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে ভোরের শিশির ভেজা লাল মোরামের পথে পথে। পাহাড়ি ম্যালের মত শিমুলতলার এই রেলস্টেশন। রেলস্টেশনের মুখোমুখি দেড় কিমি দূরে শিমুলতলার মূল আকর্ষণ আবার সেই লাট্টু পাহাড়। এবার ১০০০ ফুট উঁচু গাছগাছালিতে ছাওয়া লাট্টুর শিখরে চড়ে দেখে নেওয়া যায় আদিবাসীদের দেবতার থান। সূর্যাস্তের শোভা মায়াবী, মনোরম লাট্টু পাহাড়ে। সত্যজিত রায়ের ‘মহাপুরুষ’ সিনেমার সূর্য ডোবার দৃশ্যের সাক্ষী হতে চাইলে যেতে হবে শিমুলতলায়।

এরপর রেললাইন পেরিয়ে ৬ কিমি দূরে পাহাড় ও অরণ্যের সহ-অবস্থানে মনোরম পরিবেশে হলদি ফলস দেখে আসা যায়। স্টেশনের ২ কিমি দূরে দুর্দম বেগে বয়ে চলেছে লীলাবরণ ফলস, চলার পথে সিকেটিয়া আশ্রম, ধীরহারা ফলসও দেখে নেওয়া যায়। ফলস পরিক্রমার সময় অরণ্যচরদের দেখা মেলাও অসম্ভব কিছু নয়।

এরপর পাড়ি দেওয়া যায় শিমুলতলা থেকে সুলতানগঞ্জ হয়ে ৬৯ কিমি দূরে মধুপুর। তীর্থের সঙ্গে জলবায়ুর গুণে দেওঘর খ্যাত হলেও স্বাস্থ্যকর জায়গা হিসেবে টিলায় ভরা পাহাড়িয়া মধুপুর অধিক খ্যাত। অতীতের শাল, শিমুল, মহুয়া আজ আর নেই। মধুও হয় না মৌচাকের গাছে গাছে। তবু মিষ্টি জল ও স্নিগ্ধ বাতাসের আকর্ষণে পর্যটনবিলাসীরা আজও আসেন মধুপুরের মধুপানে।

মধুপুরে গেস্ট হাউস।

রেলস্টেশন থেকে বেরোতেই বাঁ হাতে ডালমিয়া কূপ, ডানে কালিপুর। স্টেশনকে ডাইনে রেখে কবরখানা ছাড়িয়ে সর্বধর্ম সমন্বয় ও মানবসেবায় ব্রতী প্রভুধাম। আরও এগিয়ে প্রাচীনতম পাথরচাপটি ছাড়িয়ে বৃহত্তম ও তথা নিকটতম বাহান্ন বিঘার সংলগ্ন ১৩২২ সালের কপিল মঠ। আর একটু এগিয়ে যেতেই ধর্ম মন্দির, চতুর্ভুজ নারায়ণ মন্দিরটিও সুন্দর। আশু ঘোষের সোনার বাংলা, আর আহমেদের রিভার ভিউ-ও বাহান্ন বিঘায়। সামনে শেখপুরা। এমনকী বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষের গঙ্গাপ্রসাদ ভবনটিও এই শেখপুরায়। তবে বাড়িটির মালিকানায় বদল ঘটেছে। দেওঘরমুখী লালগড়ের পথেও চেঞ্জারবাবুদের বাড়িঘর উঠেছিল সেকালে। এ পথেই ৬ কিমি যেতে পাতরোল। রয়েছে কষ্টিপাথরের কালী মূর্তি। মন্দিরও হয়েছে দেউলধর্মী, অতীতের শ্মশানভূমিতে। শনি-মঙ্গলে ভক্তদের আধিক্য। এ ছাড়াও রয়েছেন অন্যান্য অনেক দেবতা। কাছেই অতীতের রাজবাড়ি।

উৎসাহীরা মধুপুর থেকে গিরিডি পথে ৮ কিমি দূরে বকুলিয়া ঝরনা, গিরিডিমুখী ৫১ কিমি দূরের ৭ টিলার বড়াই পাহাড়ও বেড়িয়ে নিতে পারেন। অনুচ্চ টিলা এটি, একটিতে বুড়েশ্বরী, একটিতে ত্রিশূলেশ্বরী দেবীর মন্দির।

কলকাতা থেকে মধুপুরের দূরত্ব ২৯৪ কিমি। শিমুলতলা ও জসিডির প্রতিটি ট্রেন যায় মধুপুর হয়ে। মুহুর্মুহু বাসও যায় দেওঘরের ওল্ড মিনা বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে মধুপুরে। যাতায়াতে বাসই সুবিধাজনক। ঘণ্টা দেড়েকের পথ। আর মধুপুর ডাকবাংলো স্ট্যান্ড থেকে গিরিডি, বাজার স্ট্যান্ড থেকে দেওঘর যায় বাস। বাঙালি হোটেল থেকে ধর্মশালা, মধুপুরে থাকার জায়গাও অঢেল।

এবার আসা যাক গিরিডির কথায়। গিরিডি ঝাড়খণ্ড রাজ্যের একটি পুরাতন শহর, যা পাহাড় এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। কয়লা খনিতে ঘেরা এই অঞ্চলের প্রকৃতি একটি উইকএন্ড ব্যয় করার জন্য উপযুক্ত জায়গা। কে আসেননি এখানে? রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য গিরিডিতে বাড়ি ছিল প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, নলিনীরঞ্জন সরকার, সুনির্মল বসু প্রমুখের। এখানকার শান্তিনিবাস এখন স্মারকভিলা। হাওয়া বদল করতে এসেছিলেন এখানে জগদীশচন্দ্র বসুও। প্রশান্তচন্দ্রের ‘মহুয়া’-য় আজ হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ মহিলা বিদ্যালয়। নিচু দিয়ে বয়ে চলেছে উশ্রী নদী।

ধানবাদ-কুলটি সড়কে ৭ কিমি গিয়ে ডান দিকে আরও ৪ কিমি গেলে উশ্রী ফলস। চলার পথে বেশ দূরে দেখা যায় পরেশনাথ পাহাড়। ভিউ পয়েন্ট থেকে নেমে বাঁ হাতি কিছুটা গেলে বোঝা যায় ঝরনার উচ্ছলতা। শহর থেকে ১০ কিমি দূরে খান্ডোলি পাহাড়, ড্যাম, পার্ক।

উশ্রী ফলস।

৩০ কিমি দূরে ঝাড়খণ্ডের উচ্চতম পাহাড় পরেশনাথ (৪৪৭৮ ফুট)। জৈনমহাতীর্থ পরেশনাথ। সকাল সকাল বেরিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ মধুবন পৌঁছে চড়া যেতে পারে পাহাড়ে। পাহাড়ের মাথায় অসংখ্য মন্দির। জৈন ধর্মের ২৪ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে ২০ জন এখানে মোক্ষ লাভ করেন। তাই এই পাহাড়কে বলা হয় ‘শিখরজি’। এই পাহাড়ে চড়া এক বিরল অভিজ্ঞতা। পায়ে হেঁটে বা ডুলিতে চড়ে ন’কিমি পথ ভেঙে শিখরে পৌঁছোতে হয়। জঙ্গল-পথে পড়ে বেশ কিছু ঝরনা। সকাল সকাল পৌঁছে গেলে শিখর থেকে নামতে বিকেল হয়ে যায়। মধুবনেও অনেক মন্দির আছে। তবে পরেশনাথ পাহাড় থেকে দেখা নিসর্গদৃশ্য ভোলার নয়।

পরেশনাথের পথেই আরও ৩৫ কিমি এগিয়ে গেলে তোপচাঁচি লেক। পরেশনাথ পাহাড়মালা দিয়ে ঘেরা এই লেকের সঙ্গে বাংলা সিনেমার অনেক নস্টালজিয়া জড়িয়ে। এছাড়া উশ্রী জলপ্রপাত, স্টিভেনসন মেমোরিয়াল চার্চ, উশ্রী নদী, খানদোলি (পাহাড়, বাঁধ এবং পার্ক) ইত্যাদি গিরিডি ঘুরে দেখার আরও কয়েকটি আকর্ষণীয় স্থান। সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট অনবদ্য চরিত্র প্রফেসর শঙ্কুর বাড়ি এই গিরিডিতেই। গিরিডি স্টেশন থেকে চোদ্দো কিলোমিটার দূরে উশ্রী জলপ্রপাত। চারদিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে শান্ত নদীর জল প্রায় ৪০ ফুট উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তিনটি ধারায় নেমে আসছে।

শহরের ভিড় থেকে দূরে খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস নিতে চাইলে এই রুট হতেই পারে আপনার পছন্দের ঠিকানা। আশা করি এই পুরো ট‍্যুরটা সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার অনেকদিন পরে পর্যন্ত মনে এর রেশ রয়ে যাবে।

জায়গাগুলো সাজিয়ে নিতে পারেন এভাবে জসিডি থেকে দেওঘর, মধুপুর, শিমুলতলা, গিরিডি ঘুরে ধানবাদ হয়ে ফেরা। দেওঘরের কয়েকটি পরিচিত হোটেল হল হোটেল শ্রীহরি, গিরিজা সানরাইজ, হোটেল বৈদ্যনাথ, হোটেল রুদ্রাক্ষ ইন, হোটেল কার্তিক, হোটেল যাত্রিক, ধনরাজ রেসিডেন্সি ইত্যাদি। শিমুলতলার কয়েকটি হোটেল হল অন্য রিসর্ট, হোটেল সত‍্যম প‍্যলেস, হোটেল শিভরাজ, হোটেল হিল ভিউ। মধুপুরের কয়েকটি হোটেল হল হোটেল নীলকণ্ঠ, কুমার ইন্টারন্যাশনাল, স্টোনবেরি হোটেল, মহাদেব প‍্যালেস, গীতাঞ্জলি ইন্টারন্যাশনাল। গিরিডির কয়েকটি নামী হোটেল হল হোটেল অশোকা, দ্য ব্রিজ, মানসরোভর, বৃন্দাবন প‍্যালেস, দ্য অরবিট রিট্রিট।

ঘুরতে গিয়ে রসনা আস্বাদনের ব‍্যবস্থা না থাকলে ঘোরা মধুর হয় না। তাই জানানো হল যে, দেওঘরের দুগ্ধজাত মিষ্টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পেঁড়া, রাবড়ি, ছানার মুড়কি, কাঁচাগোল্লা, রাজভোগ ইত্যাদি অসাধারণ খেতে। টাওয়ার চকের কাছে মিষ্টির দোকানে হানা দিয়ে নানা রকম মিষ্টি নিজে চেখে দেখলেই উপলব্ধি হবে প্রতিটি মিষ্টিই স্বাদে গন্ধে অপূর্ব। দেওঘর বাজারের মধ্যে “পেঁড়া গলি”-তে গেলে গরম গরম পেঁড়া বানানো হচ্ছে দেখতে পাওয়া যায় এবং হাত পাতলে দোকানিরা গরম গরম পেঁড়ার মাখা চাখতেও দেন। তবে সবচেয়ে ভাল পেঁড়া সম্ভবত পাওয়া যায় ত্রিকূট পাহাড় যাওয়ার রাস্তার দোকান দুর্গায়। এছাড়া মণ্ডলের পেঁড়াও নামকরা। মূল দেওঘর শহর বর্তমানে ঘিঞ্জি হয়ে গেলেও শহর থেকে একটু বেরোলেই চারপাশে ধু ধু ফাঁকা মাঠ, পাহাড়, নদী আর সবুজ গাছপালা মন ভাল করে দেয়।

এই শিমুলতলা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল বাঙালির মনোমত একটি উপনিবেশ, স্বাস্থ্যনিবাস। কেন স্বাস্থ্যনিবাস? এর পেছনে একটি গল্প আছে। ১৮৭১ সালে এই অঞ্চলে প্রথম বাঙালি হিসেবে পা রাখেন হুগলি জেলার বিজয়নারায়ণ কুণ্ডু। মধুপুর-গিরিডি শাখার রেললাইন পাতার ঠিকাদারি নিয়ে আসেন এখানে। তাঁর সেই কাজের মেয়াদ একদিন ফুরোয়। কিন্তু বিজয়নারায়ণ আবিষ্কার করেন তাঁর পেটের দুরারোগ্য পুরনো আমাশা রোগ এখানকার জলের গুণে পুরোপুরি ঠিক হয়ে গিয়েছে। তাই তিনি এখানেই নিজের বাড়ি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে বাঙালির এই অঞ্চলে আগমন শুরু। এটাকেই বলা হয় বাঙালির ‘স্বাস্থ্য বদলের পশ্চিম।’

আরও একটা নাম আছে এই অঞ্চলের, ‘ড্যাঞ্চিবাবুদের দেশ।’ তার পেছনের গল্পটাও একটু জেনে নিই। স্বাস্থ্যবদল করতে আসা বাঙালিরা এই সব অঞ্চলের হাটে তাজা শাকসবজি, মাছ, মাংস এই সব কিনতে গিয়ে তাদের দাম শুনে অবাক হয়ে যেতেন। কলকাতার তুলনায় এখানে দাম ছিল অনেক কম। সে কারণে বাজার করতে এসে ইংরেজিতে বলে উঠতেন ‘ড্যাম চিপ।’ বাজারে এই সব বাঙালিবাবুর মুখে নিয়মিত ‘ড্যাম চিপ’ কথাটা শুনে শুনে সেখানকার আদিবাসী মানুষজন এদের নাম দিয়েছিল ড্যাঞ্চিবাবু। ‘ড্যাঞ্চি’ কথাটা আদতে ওই ‘ড্যাম চিপ’ কথারই অপভ্রংশ।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
১. রাতের বেলায় ৮টার পর হোটেল থেকে না বেরোনোই ভাল। কারণ খুব ফাঁকা হয়ে যায়।
২. যদি স্টেশনের পাশে দুপুরে খান, আগে থেকে বলে পয়সা দিয়ে আসাই ভাল। ছোট জায়গা রান্নাও সেভাবে হয়, পরে গেলে আপনার সাধের মুরগি অন্য কারও পেটে চলে যাওয়ার ভয় আছে।
৩. সারাদিন পারলে হোটেলে না থেকে স্টেশনের পাশের ছোট হোটেলগুলোয় (যেগুলোয় দুপুরে খাবেন) গিয়ে দড়ির খাটিয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকুন আর হাওয়া খান। কিছুক্ষণ হাওয়া খেলে বুঝবেন শরীর কত ভাল লাগছে।

চিত্র: গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »