কালো মানুষ সাদা মানুষ
বাজারে যাচ্ছিলাম;
পাড়ার চায়ের দোকান থেকে ডাক ভেসে এল,
কোথায় চললে হে সুখ?
বুঝলাম এটা ভূমিকা মাত্র, কেন না
বাজারের থলি হাতে তো সবাই বাজারেই যায়;
ঘনকৃষ্ণবাবু খবরের কাগজ থেকে মুখ সরিয়ে বললেন,
দুমিনিটের জন্য একটু এসো না এদিকে;
সুখেন্দু নামে না ডেকে সুখ বলে ডাকার কারণটা বলেছেন একদিন;
আজকাল সুখ জিনিসটা বড় দুর্লভ, তাই
সুখ নামে ডেকে কিছুটা সুখ নাকি উনি উপভোগ করেন;
ওঁর বাবার দেওয়া নাম ঘনশ্যাম বদলে
ঘনকৃষ্ণ করার কারণটাও আমি জানি,
ওতে নাকি নামটা অনেক গভীরতা পায়;
হবে হয়তো,
উনি আবার বললেন, আজকের কাগজটা পড়েছ?
সকালে চা খেতে খেতে চোখ বুলিয়েছিলাম,
রাজনীতি, চুরি ডাকাতি, খুন জখম, ধর্ষণ, বধূহত্যা এসব ছাড়া
তেমন নতুন কিছু দেখেছি বলে মনে হল না
অবশ্য ঘনকৃষ্ণ উত্তরের অপেক্ষায় নেই, বললেন
আমেরিকায় এসব কি হচ্ছে বলো তো!
একটু অবাক হলাম, আমেরিকায় আবার কী হল
আর হলেই বা আমাদের কী!
ধনীর শিরোমণি দেশকে নিয়ে আমার কীসের মাথাব্যথা!
আদার ব্যাপারির জাহাজের খবরে কী দরকার,
এমনিতেই ল্যাজেগোবরে হয়ে আছি;
আবার তীব্র মন্তব্য ভেসে এল,
সাদা পুলিশটা গলায় হাঁটু দিয়ে চেপে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলল কালো লোকটাকে,
বর্ণবৈষম্যের কী সাংঘাতিক পরিণতি!
বহু বছর আগে আমেরিকানরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে কত গালাগাল দিত এর জন্য,
কত প্রতিবাদ, খেলা থেকে বয়কট কত কী!
এখন তো দক্ষিণ আফ্রিকায় কালোদের জয়জয়কার,
ক্রিকেট থেকে শুরু করে সব খেলাতেই তারা বেশ এগোচ্ছে;
এবার মৃদু প্রতিবাদ করতেই হল,
আমেরিকাতেও কিন্তু অনেক কালো অ্যাথলিট ছাড়াও অন্য অনেক খেলাতেও
অনেক ভাল কালো খেলোয়াড আছে;
অলিম্পিকে আমেরিকার বেশি মেডেল তো ওরাই এনে দেয়;
ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন ঘনকৃষ্ণ,
আরে রাখো তোমার অলিম্পিক, ওসব তো লোক দেখানো ভড়ং,
আসলে ওখানে সাদারা কালোদের ভীষণ ঘৃণা করে, সহ্যই করতে পারে না,
অথচ আমাদের দেশকে দেখো, সাদা কালো সবাই কেমন মিলেমিশে আছে;
অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে চুপচাপ চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম;
ঘনকৃষ্ণ আবার আওয়াজ দিলেন,
চন্দনের পাত্রীর খোঁজটা কি করছ?
ছেলের নাম চন্দন, যদিও শ্যামল হলেই কিছুটা মানানসই হত,
ঘনকৃষ্ণ যথেষ্ট কালো, কিন্তু চন্দন রঙের দিক দিয়ে আরও এককাঠি সরেস;
বললাম, আনন্দবাজারে পাত্র চাই দেখলেই তো পারেন, তাছাড়া এধরনের অনেক ওয়েবসাইটও তো আছে;
উনি বললেন, তা তো জানি হে, তবে ওসবে অনেক জোচ্চুরি থাকে তো,
বলবে গৌরবর্ণা, অথচ গিয়ে দেখবে অজস্র মেকআপ দিয়ে রাতকে দিন করার চেষ্টা:
আফসোস করে বললেন, আজকাল তো আর মেয়ের শরীর ঘষে ঘষে
দেখা যায় না রঙটা খাঁটি কি না,
আরে তুমি একটা নামী সাংবাদিক, কত লোকের সঙ্গে যোগাযোগ,
ভাল দেখে একটা পাত্রী খুঁজে দাও দেখি,
জানোই তো আমার কোনও দাবিদাওয়া নেই, তবে গায়ের রংটা যেন কাশ্মীরি বা অন্তত পাঞ্জাবি মেয়েদের মত একেবারে ধবধবে ফরসা হয়,
কালো, তামাটে এসব তো চলবেই না, এমনকি ফ্যাকাসে সাদাও যেন না হয়;
আচ্ছা দেখব বলে পালিয়ে বাঁচলাম,
যেতে যেতে হঠাৎ কীরকম বিভ্রম হল,
চিরপরিচিত সরু অপরিষ্কার রাস্তাটা কোনও যাদুতে চওড়া ঝকঝকে
হলিউডি ছবিতে দেখা আমেরিকার কোনও রাস্তা হয়ে গেল,
দেখলাম এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ হাঁটু দিয়ে চেপে শ্বাসরোধ করে মারছে এক কৃষ্ণাঙ্গকে;
আবার বিভ্রম, পুলিশের মুখ আর গোটা শরীরটা বদলে একটা চেনা মুখ
আর শরীর স্পষ্ট হতে থাকল;
আমার নিশ্বাস আটকে আসছিল,
কোনওমতে নিজেকে সামলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে লাগলাম।
*
মায়াতুষার
শয্যা শিহরণে তন্দ্রাহারা
মোহিনী জ্যোৎস্নায় প্লাবিত তার
শরীর, চমকায় আকাশে তারা
হ্রদের জলে ঝরে মায়াতুষার
ধূপের নির্যাসে ভরেছে ঘর
এখানে ভালবাসা, অঙ্গীকার
প্রেমের, সারারাত মাতাল ঝড়
হ্রদের জলে ঝরে মায়াতুষার
কুহকী কুয়াশায় আধো আভাস
ছিল রহস্যের প্রেমোচ্ছলে
হঠাৎ ঘর ভেঙে ছড়ায় তাস
মায়াতুষার ঝরে হ্রদের জলে
হ্রদের তলদেশে অগ্নিজ্বালা
আগুন জন্তুর উৎপীড়নে
ছিঁড়েছে স্বপ্নের কুসুমমালা
মায়াতুষার ঝরে সমর্পণে
অশ্রুবিন্দুর মত তুষার
অবিশ্রাম ঝরে সারাটি রাত
অথবা প্রতিবাদ ভালবাসার
ব্যর্থ বিক্ষোভে জলপ্রপাত
যা ছিল কল্পনা মনের কোণে
দেবীর পটখানি তা কি এ ছল
শরীর নিয়ে খেলা হিমশীতল!
প্রতিমা ভেসে যায় বিসর্জনে
হ্রদের গভীরে যে তীব্র বিষ
মৃত্যু দিতে পারে সবাই জানে
মায়াতুষার ঝরে অহর্নিশ
তবুও কেন হ্রদে কী সন্ধানে!
*
নিষিদ্ধ নারীর কাছে
নিষিদ্ধ নারীর কাছে যেতে গেলে জ্বরতাপ
হাওয়া কাঁদে আকুল নিস্বনে
সিঁথিতে আগুন আভা ট্রাফিকের লাল আলো
সেকথা পড়েনি তবু মনে
হরিণী শরীরে ছিল স্বেদগন্ধে মাদকতা
চোখের চুম্বকে ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ
যুবক ধাতুর জন্য; অ্যাসিডের তেজ
পোড়াত এ দেহমন; নিভৃতে হত না কোনও কথা
শুধু কিছু উত্তেজনা, শাণিত ধারালো
ছুরির আঘাতও ছিল মোহময়, যেন কোনও সাপ
মেশাত বিষের নেশা ধমনীতে; আচম্বিতে লেজ
নিষিদ্ধ নারীর বেণী, চোখে ছিল মদিরার নেশা
কেটেছে অনেক দিন, বাতাস ভাঙে না আর ঝড়ে
শরীর নিস্তেজ আজ; আশেপাশে ঘোরে হরিণীরা
অনায়াসে যাওয়া যায়, নেই কোনও নিষেধ সংকেত
না গিয়ে সময় কাটে অবিরাম ক্লান্ত অবসরে
চোখে আর নেই কোনও স্বপ্নের মায়াজাল; গলাতেও নেই অশ্বহ্রেষা
হরিণী মুখেও নেই অপরূপ মাধুর্যের ব্রীড়া
তাই তো হয় না যাওয়া; নেই আর উন্মাদনা জেদ
অসহ্য বিষাদ ভরা পরিবেশ; জলে সমুদ্রের স্বাদ নোনা
নিষিদ্ধ নারীর কাছে কোনওদিন যাওয়া তো হল না।
*
স্বপ্নে দিন স্বপ্নে রাত
স্বপ্ন দেখা সারা রাত, স্বপ্নে ভেজা খর তপ্ত দিন
প্লাবন বন্যার শব্দ চাপা দেয় স্বপ্নে শোনা গান
স্বপ্নের নেশার ঘোরে ঘূর্ণিঝড় মুহূর্তে বিলীন
ফুল ঘরে না ফুটুক বহু ফুলে ভরে থাকে স্বপ্নের বাগান
গোলাপ পাপড়ি সুখ ঝরে যায়, কাঁটা হয়ে ফোটে অপমান
স্বপ্ন নিয়ে সারা দিন স্বপ্ন নিয়ে রাতভর থাকি
গোপনের আততায়ী অলক্ষ্যে ছুরিতে দেয় শান
ব্যর্থতা গ্লানির ম্লান অন্ধকারে জ্বলে তবু স্বপ্নের জোনাকি
অজানা আতঙ্কে ভরা ভবিষ্যৎ, বুকে শুধু সাফল্যের তৃষা
দুর্যোগের আশঙ্কায় প্রায় মরুভূমি এই অবাধ্য জীবন
ঘটভরা শান্তিজল নিয়ে আসে স্বপ্নিল মনীষা
রূপান্তরে মরুভূমি বদলে হয় স্নিগ্ধ তপোবন
ছায়াছায়া মায়ামায়া ছায়া মায়া স্বপ্ন ঘেরাটোপে
নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে থাকি, দূরে রাখি ব্যর্থতার গ্লানি
মাঝেমাঝে রাগে জ্বলা, মাঝেমাঝে ফেটে পড়া ক্ষোভে
মুহূর্তে স্বপ্নের মোহে এ জীবন শীতল বনানী
একদিন শরবিদ্ধ হতে হবে, অতিক্রম করে যাব সীমা
জানি তবু স্বপ্ন দেখা, তবুও কুহকী জিজীবিষা
সবুজে উচ্ছল করে এ জীবন, ক্যানভাস জুড়ে শ্যামলিমা
স্বপ্নে ভরা সারাদিন, স্বপ্নে রোজ রাতে মোনালিসা।
ভালভাষাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাদের প্রিয় কবি সুজিত বসুর নতুন স্বাদের শারদ কবিতাগুচ্ছ উপহার দিয়েছেন। দীর্ঘ কবিতাটি ভারি ভালো হয়েছে। মর্মস্পর্শী কিছু লাইন ইচ্ছে হয় মনে রাখি। বয়সের কারণে এখন মনে রাখতে না পারলেও, ফের পড়ে নেবো। নতুন চলনের কবিতাগুচ্ছ। মনে হল আরো বড়ো পাঠককুলের কাছে এসব লেখা পৌঁছানো দরকার। এবার আবার একটা কাব্যগ্রন্থের সময় হয়ে গেছে, সুজিত বসু। ভালভাষা ও কবি সবান্ধবে আমার শারদ শুভেচ্ছা জানবেন
কবি সুজিত বসু আমাদের ভীষণ প্রিয় কবি। ওনার কবিতা আমাদের খুব ই ভালো লাগে। বর্তমান সময়ের উপযুক্ত বলে মনে হয়। এই কবিতা গুলো খুব ই সুন্দর। কিছু কিছু কথা একেবারেই বাস্তব । খুব ই ভালো লাগে। আশা রাখব কবি আমাদের আবারও সুন্দর কবিতা উপহার দেবেন ।
কবি সুজিত বসুর ভাবসম্পন্ন অর্থ পরিপূর্ণ ছন্দেভরা প্রতিটি কবিতা আমার খুবই প্রিয়। তাই উনার বিভিন্ন চিন্তাধারায় লেখা কবিতাগুচ্ছ শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। কবির লেখা শারদকবিতাগুচ্ছ উপহার দেওয়ার জন্য ভালভাষা কে অনেক ধন্যবাদ। আশা করি আগামীতে ও কবির লেখা সুন্দর সুন্দর কবিতা আমাদের পড়ার সুযোগ করে দেবেন।
কবি সুজিত বসুর লেখা ‘কালো মানুষ, সাদা মানুষ’ কবিতাটি খুবই অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। আমি তার লেখার শৈলীর প্রশংসা করি। তিনি যেভাবে দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাগুলোকে মানুষের মনস্তত্ত্বের গভীর পরিমণ্ডলের সাথে যুক্ত করেছেন তা চমৎকার। আমি ভবিষ্যতে তার আরও কাজ পড়ার জন্য অপেক্ষা করছি।