Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস

আজ আষাঢ়ের পহেলা, ষড়ঋতুর অন্যতম বর্ষার সূচনালগ্ন। প্রকৃতিকে শস্যশ্যামলা করে এই ঋতু, আবার মানবহৃদয়কেও রঞ্জিত করে ভাবে ও কল্পনায়। তাই কবিদের কাছে বর্ষাঋতু সতত স্বাগত। রবীন্দ্রনাথ গেয়ে ওঠেন, ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।/ আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে’। বৈষ্ণব কবিরা বর্ষাকে অমর করে রেখে গেছেন রাধাকৃষ্ণের বিরহমিলনের পদের পর পদ রচনা করে। আসন্ন বর্ষায় রাধা যাবেন শ্রীকৃষ্ণের অভিসারে। রাধা তাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কীভাবে? পড়া যাক গোবিন্দদাসের এই পদটি, ‘কণ্টক গাড়ি কমলসম পদতল মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি,/ গাগরি বারি ঢারি করি পিছল চলতহি অঙ্গুলি চাপি’— অর্থাৎ পায়ে কাঁটা বেঁধাচ্ছেন (অভিসারে যেতে পথে কাঁটা বিঁধবে তো! তাই অভ্যস্ত হয়ে নিচ্ছেন)! পায়ের নূপুর ছিন্নবস্ত্র দিয়ে বাঁধছেন, (যাতে অভিসারে যেতে নূপুরের শব্দ কারও কানে না যায়), কলসির জল ঢালছেন মেঝেতে, আর তার ওপর দিয়ে আঙুল চেপে চেপে হাঁটার অভ্যেস করছেন, কেননা বর্ষার পথ পিচ্ছিল হয়ে থাকবে! আবার অভিসারকালে বজ্রবিদ্যুৎকে উপেক্ষা রাধার, ‘কোটি কুসুমশর বরিখয়ে যছু পরি/ তাহে কি বজরক আগি?’— যার মাথায় কোটি কুসুমের তির বেঁধা, বজ্রের আগুনে কী-ই বা হবে তার?

অপর এক কবি রায়শেখর। অভিসার যে কতখানি প্রতিকূল, তা ফুটে উঠেছে তাঁর পদটিতে— ‘তরল জলধর বরিখে ঝরঝর/ গরজে ঘন ঘন ঘোর /শ্যাম মোহনে একিল কৈছনে/ পন্থ হেরই মোর!’

বাংলা সাহিত্যে বর্ষার অনুষঙ্গ দেদার, অনিঃশেষ। এক রবীন্দ্রনাথ-ই তো তাঁর গানে আর কবিতার মধ্যে বর্ষার বিচিত্র অনুভূতিমালা গেঁথে দিয়েছেন। মধ্যযুগে চণ্ডীমঙ্গল-রচয়িতা মুকুন্দরামের কাব্যে পাই বর্ষায় মানুষের দুর্গতির কথা, ‘—আষাঢ়ে পূরিল মহী নবমেঘে জল।/ বড়ো বড়ো গৃহস্থের টুটিল সম্বল।।/—/ শ্রাবণে বরিখে মেঘ দিবসরজনী।/ সিতাসিত দুই পক্ষ এক-ই না জানি।।’ বর্ষার উল্লেখ ময়মনসিংহগীতিকায় প্রচুর, সুপ্রচুর। ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালা থেকে সামান্য অংশ: ‘আইলো আষাঢ় মাস লইয়া মেঘের রাণী/ নদীনালা বাইয়া আসে আষাঢ়িয়া পানি। শকুনা নদীতে ঢেউয়ে তোলপাড় করে—’।

বর্ষাকাল গৃহস্থের পক্ষে দুর্বিষহ কষ্টের মাস, কেননা কৃষিভিত্তিক দেশে এসময় চাষ বন্ধ থাকে। অন্নাভাব নিত্যকার ঘটনা। অন্যদিকে কবিরা তাঁদের আবেগ-উচ্ছ্বাসকে কিন্তু বলগাহীন প্রকাশ করেন এই ঋতুটিকে কেন্দ্র করেই। কবিকল্পনায় বর্ষার স্থান সর্বাগ্রে, তারপর বসন্তের স্থান। রবীন্দ্রনাথ বর্ষার গান লিখেছেন সবচেয়ে বেশি, তারপর বসন্তের।

পয়লা আষাঢ় বলতে অবধারিতভাবে যে কবিকে মনে না এসে পারে না, তিনি হলেন মহাকবি কালিদাস। তিনি তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যে পয়লা আষাঢ়কে অমরত্ব দিয়ে গেছেন। এর কাহিনি যক্ষের বিধুর ও মর্মভেদী বেদনায় আকীর্ণ। কুবেরের উদ্যানপালক যক্ষের কর্মে অবহেলা দেখে কুবের তাকে একবছরের নির্বাসনদণ্ড দেয় রামগিরি পর্বতে। যক্ষের নির্বাসনের মেয়াদ পূর্তির দিকে, এমন সময় সে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুং/ বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ’,— পয়লা আষাঢ় পাহাড়ের ওপর থেকে বর্ষার জল নেমে আসছে দেখল। এতদিন কায়ক্লেশে যক্ষ স্ত্রীর বিরহ সহ্য করেছে, কিন্তু বর্ষা তাকে বিরহে আকুল করে তুলল। মেঘকে দূত করে পাঠাল সে অলকায়। অলকা, স্বর্গের রাজধানী, যেখানে যক্ষপ্রিয়া একা বিরহে দিনযাপন করছে। মেঘ তাকে গিয়ে জানাবে, যক্ষ বেঁচে আছে।

কাব্যটির অভিনবত্ব হল মেঘকে দূত করে পাঠানো, আর বর্ষায় প্রিয়বিরহ যে দুঃসহ হয়ে ওঠে, তা অসাধারণ করে প্রকাশ করা। ‘মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ/ কণ্ঠাশ্লেষপ্রণয়িনীজনে কিং পুনর্দুরসংস্থে’। অর্থাৎ মেঘ দেখলে সাধারণ মানুষ-ও উদাস হয়ে পড়ে। আর গলায় গলা জড়িয়ে কাটাত যারা, তাহলে তাদের (বিরহে) কী দশা হতে পারে?

‘কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে/ কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/ লিখেছিলে মেঘদূত—’। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং একটি কিংবদন্তীর জন্ম দিলেন এভাবে। এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, কালিদাস একেবারে দিনক্ষণ হিসেব করে আষাঢ়ের পয়লা তারিখটিতেই মেঘদূত লিখতে বসে গিয়েছিলেন, এবং সে-কাব্যের একশো দশটির মতো শ্লোক (এ-কাব্যের প্রকৃত শ্লোকসংখ্যা নিয়ে সংশয় আছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একদা এর কয়েকটি শ্লোক কালিদাস-রচিত নয় বলে শনাক্ত করেন। পরবর্তীকালে তা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে) ওইদিনের মধ্যে লিখে শেষ করেন। মন্দাক্রান্তা ছন্দে লেখা কাব্যটি, যে ছন্দ অত্যন্ত কঠিন। একদিন কেন, এক-দু’মাসেও সম্ভব নয় মন্দাক্রান্তাছন্দের কঠিন অনুশাসন মেনে অত দ্রুত এমন কালজয়ী কাব্যরচন। প্রসঙ্গত, কালিদাসের অনুকরণে অজস্র এজাতীয় পবনদূত, কাকদূত, ময়ূরদূত ইত্যাদি লেখা হয়েছিল। যাদের ‘দূতকাব্য’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। আজ তা কেউ ছুঁয়েও দেখে না।

কিন্তু পয়লা আষাঢ় পেয়ে গেল অমরত্ব। এবং তা এমন-ই, যে আজ ওই তারিখটি মহাকবি কালিদাসের জন্মদিনরূপে ভারতে পালিত হয়। কালিদাসের জন্মস্থান বা জন্মের সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে ঘোর মতবিরোধ। অথচ পয়লা আষাঢ়কে তাঁর জন্মদিন সাব্যস্ত করায় আপত্তি উঠল না কারও। এইভাবেই হয়তো কিংবদন্তী ইতিহাসের মান্যতা পায়।

আমাদের বঙ্গভাষার আর এক কবি তাঁর বিরহকে বাণীরূপ দিয়ে গেছেন তাঁর অসংখ্য গানে। ‘মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম’, অথবা ‘কেন আসিলে ভালোবাসিলে’, ‘তুমি আমারে কাঁদাও নিজেরে আড়াল রাখি’, বা ‘ঝরলো যে ফুল ফোটার আগেই’ ইত্যাদি গানের পর গানে যে বেদনার সীমাহারা দীর্ঘশ্বাস, তার পেছনেও যে রয়েছে যক্ষপ্রিয়ার মতোই এক নারী,— নার্গিস! একদা তাঁকে যে চিঠি দিয়েছিলেন নজরুল, নার্গিসকে লেখা সেই একমাত্র চিঠিটি লেখা হয়েছিল, আশ্চর্যের বিষয়, পয়লা আষাঢ়! এবং সে-চিঠিতে মেঘদূতের উল্লেখ ছিল। বিরহ নয়, তাতে সান্ত্বনাবাক্য-ও ছিল, ছিল স্বস্তিবচন: লাইলা মজনুকে পায় নি। কিন্তু এমন করে কে-ই বা কাকে পেয়েছে?

পয়লা আষাঢ় কালিদাস-রবীন্দ্রনাথ- নজরুলকে একসুতোয় বেঁধেছে।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »