Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: আশ্চর্য থেরাপিস্ট

দে বা শি স  দা শ

‘তিন-টুকরো কাগজ নিয়ে গোটা-গোটা হরফে লিখতে হবে: ভালবাসা, অবহেলা আর ঘৃণা’, জ্যোতিপ্রকাশ আমাকে এক উদ্ভট পরীক্ষার প্রস্তাব জানাল, ‘‘তারপর ছোট-ছোট তিনটে কাচের পাত্রে সামান্য পরিমাণে জল নিয়ে তাজা ছোলার বীজ ভিজিয়ে রাখতে হবে। পাত্রগুলোর মুখ ভাল করে ঢেকে, কাগজের টুকরোগুলো আলাদা-আলাদা এক-একটা পাত্রের গায়ে সেঁটে দিয়ে আলোয় রাখতে হবে। প্রতিদিন সকালে প্রথম পাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে তিনবার বলবে, ‘ভালবাসা, ভালবাসা, ভালবাসা’। দ্বিতীয় পাত্রটাকে অবহেলা দেখিয়ে ফেলে রাখবে। তৃতীয়টাকে ঘৃণার ভাব দেখাবে আর জোরে-জোরে তিনবার ‘ঘৃণা’ শব্দটা উচ্চারণ করবে। যথাসম্ভব আবেগের সঙ্গে কাজটা করতে হবে টানা এগারো দিন। তারপর, পাত্র থেকে অঙ্কুরিত বীজগুলো বের করে দেখে আমাকে ফোনে রেজ়াল্ট জানাবে। বাকি কথা তখনই বলব, কেমন?’’

আমি রীতিমতো অবোধ চাহনি মেলে জ্যোতিপ্রকাশের কথাগুলো শুনলাম। বাড়ি ফেরার পথে মনে-মনে বললাম, ‘দেখাই যাক না শেষমেশ কী হয়!’

দিনদশেক বাদে, আমার সমস্ত সংশয় ঘুচিয়ে পরীক্ষার ফলাফল এল। সেটা জ্যোতিপ্রকাশের জাদুবলে, নাকি প্রকৃতির খামখেয়ালে, তা বলার মতো সামর্থ্য হল না আমার। আমি লক্ষ করলাম, ‘ভালবাসা’-চিহ্নিত পাত্রে যে-বীজটি ছিল, তার পূর্ণ অঙ্কুরোদ্গম ঘটেছে। অন্যদিকে, অবহেলিত পাত্রের বীজ থেকে নামমাত্র শিকড়ের আভাস দেখা যাচ্ছে। তিন-নম্বর বীজটির জীর্ণশীর্ণ দশা আমাকে হতচকিত করল— অঙ্কুরোদ্গমের পরিবর্তে কালচে হয়ে বীজটি যেন পচে গিয়েছে।

||১||

আমি অনীশা। একসময়, আমার সঙ্গে একটা মেডিক্যাল কোম্পানির গবেষণাগারে সিনিয়র পোস্টে কাজ করত জ্যোতিপ্রকাশ। পরে কী-একটা পরীক্ষায় ব্যাপক সাফল্য পেয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিল সে। পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপের মেয়াদ শেষ করে ফিরে আসার পর বেঙ্গালুরুতে ছিল বেশ কিছুকাল। অনেকদিন কোনও যোগাযোগ ছিল না আমাদের। হঠাৎ এক সন্ধ্যায়, আমার পুরনো সেই কোম্পানির আর-এক কলিগ রঞ্জনদা’র সঙ্গে দেখা হয়ে যায় একটি নার্সিংহোমে। তিনি আমাকে জ্যোতিপ্রকাশের কন্ট্যাক্ট নম্বর দেন।

গত পাঁচ বছর ধরে আমার বাবা স্নায়ুরোগে আক্রান্ত। কিছুদিন যাবৎ উপসর্গ প্রকট হয়ে উঠেছে। সমস্যা ঘোরতর। আগে অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই কোনও সুরাহা হয়নি। জ্যোতিপ্রকাশ এই শহরের একজন উঠতি সাইকো-থেরাপিস্ট। রঞ্জনদা বললেন, ‘একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সঙ্গে জ্যোতির অনেক ফারাক। ওর মতো মেধাবী বিজ্ঞানচর্চাকারী হাতে-গোনা। জ্যোতিপ্রকাশের থেরাপি-সেন্টারটির এখনও তেমন নামডাক শোনা যায় না ঠিকই, কিন্তু কয়েকটা ইউনিক কেসে ওর ট্রিটমেন্ট অভাবনীয় ফল দিয়েছে। একবার যোগাযোগ করে দেখতে পারো। তাছাড়া, বহু নামীদামি সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গেও হৃদ্যতা আছে ওর।’

***

চেহারায় বেশ পরিবর্তন ঘটেছে জ্যোতিপ্রকাশের। এক্স-কলিগ থাকাকালীন যেমনটি দেখেছিলাম, তার তুলনায় ওর হাবভাব অনেক পালটে গেছে। পরনে ধোপদুরস্ত পোশাক-আশাক, গালে ঋষিসুলভ দাড়িগোঁফ। দু’চোখের তারায় অজানা আলোর সংকেত!

‘বাবার যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে করে কিছুতেই কোনও উপায় পাচ্ছি না’, আমি জ্যোতিপ্রকাশকে সমস্ত মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখাতে-দেখাতে বলছিলাম, ‘এখন তুমি যেমনটা সাজেস্ট করবে, তার উপরেই ভবিষ্যৎ-কর্তব্য নির্ভর করছে।’

‘চিন্তা কোরো না অনীশা’, আমাকে আশ্বস্ত করল সে, ‘আগে কয়েকদিন বাড়িতে থেকেই কাজ করতে হবে। তারপর দেখা করার প্রসঙ্গ আসবে। তুমি হয়তো ভাবছ, অঙ্কুরোদ্গমের পরীক্ষাটা নিছকই এক-ধরনের রসিকতা। কিন্তু আসলে ওটা আমার ট্রিটমেন্টের একটা মেন্টাল স্টার্টার। মানুষের মস্তিষ্ক এক আজব যন্ত্র! আমরা যা অনুভব করি, তা-ই আসলে বাস্তব হয়ে আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। কোয়ান্টাম ফিজ়িক্সের ‘ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট’-এর কথা মনে আছে তোমার?’

উত্তরের তোয়াক্কা না করেই বলে চলল জ্যোতিপ্রকাশ, ‘স্লিট-ডিটেক্টরের চোখ যাকে কণা বলে শনাক্ত করে, ডিটেক্টর না থাকলে সেটাই এক তরঙ্গের মতো এঁকেবেঁকে পারস্পরিক ইন্টারফিয়ারেন্স-প্যাটার্ন তৈরি করে। অর্থাৎ নজর করলে বিড়াল, নজরদারি ছেড়ে দিলেই রুমাল! এর মানেটা কী দাঁড়াল, একবার ভাবো। আমরা যখন কোনও-কিছু দেখি, তা বাস্তবের যে-রূপটাকে দৃশ্যমান করে তোলে, সেটাই ধ্রুব সত্য নয়। যখন দেখছি না, তখন কিন্তু তার অন্য একটা রূপ রয়েছে। আসলে কী জানো তো, আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কে স্নায়ুর তারগুলো দিয়ে বৈদ্যুতিক সিগনালের তরঙ্গ অনবরত ঢুকছে। নার্ভাস সিস্টেমের মধ্যেই প্রোগ্রামিং করা থাকে বিশেষ এক-একটা অর্থ, যা কিনা ইন্দ্রিয়ে-ইন্দ্রিয়ে বাস্তব-অনুভূতি হয়ে ফুটে ওঠে। এই বোধগম্য সিগনালগুলোই আমাদের কাছে রিয়্যালিটি। সাইকোটিক রোগে আক্রান্ত মানুষেরা অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা। তাদের সঙ্গে আমাদের চেনা-পরিচিত বাস্তবের মিল ঘটানো দুষ্কর। এক্ষেত্রে এনার্জি-থেরাপিই হল একমাত্র সঠিক চিকিৎসা-পদ্ধতি।’

‘বাবাকে আমাদের বাস্তব-দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনা কি আদৌ সম্ভব নয়?’ আমি আকুলভাবে প্রশ্ন করলাম।

‘আমাদের কাছে যে-জগৎ অবাস্তব, তা-ই কিন্তু তোমার বাবার মতো মানুষের কাছে ভয়ংকর রকমের বাস্তব’, জ্যোতিপ্রকাশকে একজন সম্মোহনবিদের মতো রহস্যময় দেখাচ্ছিল।

||২||

নির্দিষ্ট দিনে থেরাপি-চার্জ বাবদ কুড়ি হাজার টাকা অগ্রিম জমা করা হল। আজ আমরা জ্যোতিপ্রকাশের নিরাময়-কেন্দ্রে বাবাকে নিয়ে এসেছি। এর আগে ফোনে এবং ইমেলে বিভিন্ন নির্দেশ পাচ্ছিলাম। সেই অনুসারে হপ্তাদুয়েক ধরে যা আমাদের করতে হয়েছে, তা যথার্থই অলৌকিক। অন্যান্য সমস্ত ওষুধ শেষ কয়েকদিনের জন্য নিষেধ করে দিয়েছিল জ্যোতিপ্রকাশ। আমরা, অর্থাৎ আমি এবং মা নিয়মিতভাবে প্রতিদিন বেশ কয়েকবার বাবার বিছানার কাছে বসে নির্দিষ্ট একটা ডকুমেন্ট পড়ে শোনাতাম (সেই মেটাফিজ়িক্যাল লেখাগুলোর প্রিন্ট-আউট থেরাপি-সেন্টার থেকেই কিনে আনতে হয়েছিল), তারপর আধঘণ্টা বাবার কানের কাছে একটা অডিও চালিয়ে রাখতাম (বলা-বাহুল্য, অডিওটাও জ্যোতিপ্রকাশ-প্রেরিত একটি লিঙ্ক থেকে কিনে ডাউনলোড করতে হয়েছিল)।

সল্টলেকের বহুতল ট্রিটমেন্ট-সেন্টারের সামনে গাড়ি থেকে কোনওমতে বাবাকে নামানো হয়েছে। আমি এবং মা ছাড়াও সঙ্গে এসেছে আমার এক পিসতুতো দাদা। জ্যোতিপ্রকাশের সঙ্গে প্রথম যখন যোগাযোগ করেছিলাম, সে-সময় বাবার মানসিক ভারসাম্য প্রায় সম্পূর্ণই লুপ্ত। আস্তে-আস্তে এনার্জি-থেরাপির মাধ্যমে, অথবা কোনও অতিলৌকিক প্রক্রিয়ায়, বাবার অবস্থার আশ্চর্যজনক উন্নতি লক্ষ করি। দিন দশ-পনেরো আগেও, বাবাকে বাড়ি থেকে বাইরে আনা অকল্পনীয় ছিল। সুতরাং, জ্যোতিপ্রকাশের ওপর আমাদের আস্থা ক্রমবর্ধমান।

হুইল-চেয়ারে বসিয়ে লিফটে করে বাবাকে তেতলার একটি বড় রুমে আনা হল। প্রশস্ত সেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করে হতবাক হয়ে গেলাম। চারদিকে বিভিন্ন দেয়ালচিত্র— বেশিরভাগই প্রাচীন গ্রিক ও মিশরীয় ছবি! একপাশে বেদির ওপর স্থাপিত ধ্যানরত গৌতম বুদ্ধের ভাস্কর্য। ঘরের মাঝখানে শ্বেতশুভ্র চাদরে ঢাকা একটি বেড, যার ওপর খুব সাবধানে শুইয়ে দেওয়া হল বাবাকে। বাবা মুখে কোনও কথা বলতে পারছে না, কিন্তু তার ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে বাস্তবগ্রাহ্য অভিনিবেশ।

থেরাপিস্ট জ্যোতিপ্রকাশ একটি বোতামে চাপ দিতেই প্রার্থনাসঙ্গীতের সুরে কলিংবেল বেজে উঠল। ইন্টারকানেক্টেড দরজা খুলে ঘরে ঢুকল ইউনিফর্ম-পরা দু’জন নার্স। চাকা-লাগানো বড়সড় একটা ট্রলিবাক্স ঠেলে এনে ওরা বাবার বেডের পাশে রাখল, এবং দ্রুত-হাতে বিভিন্ন আকৃতির কয়েকটি জল-ভরা পাত্র ঘরের এককোণে ফাঁকা বেদির ওপর সাজিয়ে বসাল।

জ্যোতিপ্রকাশ এগিয়ে গিয়ে একটি ড্রয়ার খুলে দুটো ইস্পাতের দণ্ড নিয়ে এল, তারপর দু’হাত নাচিয়ে জলপাত্রগুলোয় রড ছুঁইয়ে-ছুঁইয়ে আশ্চর্য সুরেলা শব্দ উৎপন্ন করতে শুরু করল। পেশেন্ট-পার্টিকে এবার জলতরঙ্গ-মুখর এই ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে হবে। রিসেপশন থেকে জানানো হয়েছিল, এটা একটা মেন্টাল অপারেশন থিয়েটার, যেখানে পেশেন্টের ওপর একান্তে ঘণ্টাখানেক লাইট-অ্যান্ড-সাউন্ড হিপনোসিস চলবে।

পাক্কা দেড়ঘণ্টা বাইরে ঘোরাঘুরি করলাম আমরা। নিচে ফুটপাতে চা খেতে নামলাম একবার। আমার পিসতুতো দাদার নাম লিটন। সে এখানকার ব্যাপার-স্যাপার দেখে রীতিমতো সন্দিহান।

যথাসময়ে রিসেপশন থেকে আমার মোবাইলে একটা কল এল, ‘পেশেন্ট ঘুমোচ্ছে। ডিসচার্জের আগে একতলার ক্যাশ কাউন্টারে এসে ইনভয়েস ক্লিয়ার করে নিন।’

সবেমাত্র রাস্তা ক্রস করে ফিরছি, এমন সময় একটা কাণ্ড ঘটল। একখানা এসইউভি এসে থেরাপি-কেন্দ্রে ঢুকল। জনাপাঁচেক গুন্ডাজাতীয় লোক নেমে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করল। তারপর ভেতর থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ এবং কর্মীদের সন্ত্রস্ত চিৎকার ভেসে এল। লিটনদা পুলিশ-হেল্পলাইনে ফোন লাগাল।

তাণ্ডব থামার পর জানা গেল, কোনও রাজনৈতিক নেতার ছেলে এখানে চিকিৎসার পর কাল রাতে মারা গিয়েছে। পুলিশ এসে জ্যোতিপ্রকাশ-সমেত সকলকে উদ্ধার করল।

বাবাকে অক্ষতদেহে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পারলেও, গোটা ঘটনার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারলাম না। মিডিয়ায় রাতে সম্প্রচারিত হল, জ্যোতিপ্রকাশকে বেআইনি চিকিৎসার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে।

||৩||

গল্পটার কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

থেরাপি-কেন্দ্র থেকে ফিরে আসার পর, বাবার চোখমুখে যেন এক অপরিসীম শান্তি লক্ষ করলাম। নিজে থেকে মতপ্রকাশের অবস্থায় না পৌঁছলেও অঙ্গসঞ্চালন ও চাহনি যেন অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিল। আমরা কল্পনাও করতে পারিনি, কী-নিষ্ঠুর পরিহাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল।

সকালে ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণ পরে, মা প্রথম আবিষ্কার করে, বাবার শরীরে কোনও সাড় নেই। গা বরফের মতো ঠান্ডা। অল্প সময়ের মধ্যেই আমি একজন প্রতিবেশী ডাক্তারকে ডেকে আনি। তিনি শান্ত ও নিশ্চিত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, বাবা আর আমাদের মধ্যে নেই। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার।

‘অনি রে!… ওই থেরাপিই কাল হল’, মা চিৎকার করে জ্যোতিপ্রকাশকে দোষারোপ করতে থাকে, ‘এতদিন তবু প্রাণটুকু ছিল…!’

কাকতালীয়ভাবে, মানসিক অপারেশন-কক্ষে ট্রিটমেন্ট-গ্রহণের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই, রাজনৈতিক নেতার আকস্মিকভাবে প্রয়াত ছেলেটির মতোই আমার বাবাও মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছে। আমার মনে একটা ধারণা হানা দিল: জ্যোতিপ্রকাশের রোগীরা নির্ঘাত কোনও অবৈজ্ঞানিক টর্চারের শিকার।

মৃতদেহ সৎকার করার পর, একটা অদ্ভুত জিনিস আমাদের নজরে এল। ঘরের বুকশেল্ফ থেকে একটি বিদেশি বই টেবিলে নামানো হয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর, ঘরে দু’-চারজনের আনাগোনা ঘটেছিল। তাহলে কি তাদের মধ্যেই কেউ…?

ওটা যথাস্থানে রাখার উদ্দেশ্যে হাতে তুলে নিলাম। নজরে পড়ল, বইয়ের ভেতর থেকে এক-টুকরো কাগজ উঁকি মারছে। খুলে বিস্মিত হলাম। দেখলাম, স্পষ্ট হস্তাক্ষরে কিছু লেখা রয়েছে। একখানা চিঠি!

হাতের লেখাটা দেখে চিনতে পারলাম। বাবা ছাড়া অমন অক্ষরের গড়ন কাউকে লিখতে দেখিনি আমি। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাকে মুহূর্তের জন্য চমকে দিল। বক্তব্যের নিচে যে-তারিখটা জ্বলজ্বল করছে, তা সবেমাত্র গতকালের!

টেবিলেই একটি জেলপেন পাওয়া গেল। ড্রয়ার থেকে সঠিক কলম খুঁজে বের করে লেখালেখি করা কী করে সম্ভব হল বাবার পক্ষে, ভেবে পেলাম না। যে-মানুষটা ঠিকমতো চিন্তা করতে বা হাত নাড়াতে পারত না, গভীর রাতে উঠে একা-একা কীভাবেই-বা সে এমন বয়ান লিখে থাকতে পারে? লেখাটা পড়তে-পড়তে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমারই উদ্দেশে চিঠি লিখে রেখে গিয়েছে বাবা:

প্রিয় অনু-মা,

এই কথাগুলো লিখে যাওয়া নিতান্তই জরুরি মনে করছি। বুঝতেই পারছিস, স্নায়ুদৌর্বল্য, স্মৃতিভ্রংশ আর যাবতীয় মনোরোগ থেকে এই মুহূর্তে আমি প্রায় সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গিয়েছি। এ এক মিরাকল্ বলা যেতে পারে।

কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছিল, কেউ যেন নিজের শুভচেতনা দিয়ে প্রাণপণে আমাকে ভাল করে তুলতে চেষ্টা করছে। কোনও আশ্চর্য পন্থায় আমার মধ্যে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হয়ে উঠেছে।

আজ, আমাকে যে-চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার কথা কী-ভাষায় লিখে যাব সঠিক জানি না। জন্ম-জন্মান্তরের ঘুম ভেঙে আমি মহাকাশের অগণ্য নক্ষত্রমণ্ডলীর এক ছোট্ট কোণে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। চারদিকে জলতরঙ্গের ধ্বনিপ্রবাহ। মস্তিষ্কের ভেতর বিচিত্র মেলোডিয়াস কম্পন!… ডাক্তার ঘরের আলোগুলো একে-একে নিভিয়ে দেওয়ার পর, হাজারখানেক স্নিগ্ধ টুনিবাল্ব জ্বলে উঠল। মোহময় জ্যোতি ঠিকরে আসতে শুরু করল আঁধারের ভেতর থেকে। দুটো চোখ সম্পূর্ণ বুজে রেখেছিলাম, চেতনায় ধরা পড়ছিল অদৃশ্য বর্ণালির আলোয় তৈরি রংবেরঙের সব উপভোগ! স্বর্গীয় লাগছিল সমগ্র পরিবেশ।

এরপর আমি ডুবে গেলাম তন্দ্রার ভেতর। ঘোর দুঃস্বপ্ন দেখলাম, রাক্ষসেরা স্বর্গ তছনছ করে দিতে এসেছে।

আবার যখন জেগে উঠলাম, তখন সবকিছু বহু বছর আগের মতোই স্বাভাবিক! তোদের কথাবার্তা, চালচলন একেবারে স্পষ্ট। কিন্তু একথাও বুঝতে বাকি ছিল না যে, এ এক সাময়িক ভ্রান্তির মতো। আমার মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারবে না। স্নায়ুতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। হঠাৎ কেন যেন নিজের শৈশবজীবন মনে পড়তে লাগল। আমার বাবা-মা, যাঁরা অনেক আগেই বিগত হয়ে গিয়েছেন, তাঁরা কোন দূর মহাশূন্য থেকে ডাক পাঠাচ্ছিলেন আমাকে…

চিকিৎসক, নাকি দেবদূত, কে আমাকে সাময়িকভাবে চাঙ্গা করে তুলল? আমি জানি, মানসিক জরার হাত এড়িয়ে যতই সুস্থ হয়ে উঠি না কেন, অরিজিনাল অবস্থায় ফিরে আসা অসম্ভব। বরং অন্য একটা জগতে পাড়ি দেওয়া ভাল। সেই অরূপ-দুনিয়ার সম্রাটের উদ্দেশে এখন আমার গাইতে ইচ্ছে করছে জরাহীন দুঃখরহিত মৃত্যু-উত্তীর্ণ গান: ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই—/ কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই…’।

ভাল থাকিস।
ইতি, তোর বাবা
২৭ অগস্ট, ২০২৩।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
4.5 4 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
6 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
গৌতম ভাদুড়ি
গৌতম ভাদুড়ি
10 months ago

অভিনব প্লট, উপস্থাপন সেও ব্যতিক্রমী। অপূর্ব স্বাদের এ গল্প ফেলে রাখতে পারবে না কেউই সেখানেই মুন্সিয়ানা। খুব ভালো লাগলো। পত্রিকা ও লেখক উভয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা।

দেবাশিস দাশ
দেবাশিস দাশ
10 months ago

অনেক ধন্যবাদ। আপনার প্রেরণা আমার সম্বল

মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
10 months ago

একটি নতুন ভাবনার গল্প। অভিনব এবং অনবদ্য। খুব ভালো লাগল।

দেবাশিস দাশ
দেবাশিস দাশ
10 months ago

আমার সৌভাগ্য, ম্যাডাম

Dr. Kausik sur
Dr. Kausik sur
10 months ago

অসাধারণ লেখা। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের অপূর্ব মেলবন্ধন। একজন ডাক্তার হিসাবে বলতে পারি, Music Therapy তে অনেক গবেষণায় ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে।

দেবাশিস দাশ
দেবাশিস দাশ
10 months ago
Reply to  Dr. Kausik sur

অনেক ধন্যবাদ। এমন কমেন্ট লেখায় ভরসা জোগায়।

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »
মোহাম্মদ কাজী মামুন

বালকেরা অচেনা থাকে : এক অবিস্মরণীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ

কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।

Read More »