মন্ত্রী এলে কুকুরের পটি পায়
বড়বাবু এই নিয়ে পাঁচবার রাস্তাটায় গাড়ি চেপে যাতায়াত করলেন। প্রতিবারেই কিছু না কিছু ভুলত্রুটির মাঝে কাউকে না কাউকে ধমকানিও দিলেন। অবশ্য যা গেল তাতে ধমকানিটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। শেষবার একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে সবাইকে নিয়ে চা খাওয়ার পাশে দোকানিকে ধমকে কিছু সময়ের জন্য দোকানটা বন্ধ রাখতে বললেন। বেচারা দোকানি ‘কেন?’ জিজ্ঞেস করতেই এক চড় খেলেন। এর মধ্যে রাস্তাটা ভাল করে পরিষ্কার করিয়েছেন। কয়েকদিন আগে কয়েকটি বাতিস্তম্ভের উপরের ঝুলটাকেও পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। ছেলেদের বল খেলার মাঠটা এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ। ওখানেই একটা অস্থায়ী হেলিপ্যাড তৈরি করা হয়েছে। চারদিকে বাঁশ দিয়ে একটা বেড়া করবার পাশে জায়গাটাকে এক্কেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। প্রতিদিন নিয়ম করে পুলিশ আর প্রশাসনের বড় বড় অফিসাররা এসে দেখে যাচ্ছেন। কোনও এক বড় অফিসার হেলিপ্যাডের কাছে এক তাল গোবর পড়ে থাকতে দেখে বড়বাবুকে বেশ কড়া ভাষায় অপমান করেন। বড়বাবু তার থানার এক কনস্টেবলকে দিয়েই গোবরটা পরিষ্কার করান। এখনও গোবরের গন্ধটা শরীর থেকে যায়নি। পাঁচ নম্বর রটারির কাছ থেকে বেলচা দিয়ে ধুলোবালি পরিষ্কার করবার সাথে ব্লিচিংও দেওয়া হয়েছে। রাস্তাটা এতই পরিষ্কার যে, দোকান থেকে চকোলেট নিয়ে ঘরের পথে ফিরে আসার সময় একটা চকোলেট পড়ে যেতেই বাচ্চা ছেলেটা দিব্বি চকোলেটটা মুখে তুলে নেয়। দড়িও কেনা হয়ে গেছে, সব রাস্তা মন্ত্রী এলেই দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হবে। এটা বড়বাবুর প্রথম কাজ। প্রতিবার মন্ত্রী এলেই বড়বাবুকে দড়ি কিনতে হয়। গত পরশুই থানার সব পুলিশদের নিয়ে কীভাবে দাঁড়াতে বা বসতে, খেতে বা শুতে এমনকী টয়লেট যেতে হবে, তার একটা বড় ট্রেনিং হয়ে গেছে।
রামমুখের খাটালটাকে নিয়ে তৈরি হওয়া বড় সমস্যাটাও মিটেছে। বড়বাবু এক্কেবারে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। মুশকিলটা হল বিষয়টা নজরে আসে একটু দেরিতে। এক কনস্টেবল বড়বাবুদের মিটিংয়ের মাঝে হঠাৎ করে প্রসঙ্গটা তুলে সব্বাইকে বিপদে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে এসডিপিও সাহেব না দেখেই বলে ওঠেন, ‘এক্কেবারে রাস্তার ধারেই খাটাল! যেকোনও সময় গরু বা মোষ মন্ত্রীর কনভয়ে চলে এলে কী হবে? মন্ত্রীর গাড়ি সামলাবেন, না গরু মোষ?’
বড়বাবু মাথা নাড়লেও কোনও উত্তর দিতে পারেননি। তার মানে রাস্তাটা এখনও নিরাপদ নয়। আরও বড় মুশকিল হল, এত বড় একটা ফাঁক সেটাও কিনা ধরা পড়ল এক্কেবারে মন্ত্রী আসার আগের দিন! ‘উপায় কী?’ জিজ্ঞেস করতে বড়বাবুর থেকে কোনও উত্তর আসে না। রেগে ওঠেন পুলিশের ও প্রশাসনের আরও সব বড় বা মেজবাবুরা। এদিকে ঘড়ির কাঁটাও বিকালের ঘরে, মন্ত্রী আসবেন বলে কথা, এখনই খাটালে যেতে হবে।
হঠাৎ বিকালে পুলিশের গাড়ি দেখে খাটালের মালিক রামমুখ, তার পরিবার আর সাতটা ছেলের সাথে গরুগুলোও ঘাবড়ে যায়, চেল্লাতে আরম্ভ করে। প্রশাসনের একজন বড় অফিসার রামমুখের কাছে এসে খুব রেগেই বলে ওঠেন, ‘এটা তোমার খাটাল?’
রামমুখ ভয়ে ভয়েই জবাব দেয়, ‘হাঁ, মাই বাপ।’
‘কিতনা গরু হ্যায়?’
‘পন্দররো হবে।’
‘চুপদাও। ঝুট বলছ। আমি তো ইধার ষাটটা গুরু দেখতা হ্যায়।’
‘নেই মাই বাপ। ওসব মোষ, বাছুর আছে। আর দুইটা ষাঁড়।’
‘ঠিক হ্যায়। লেকিন কাল সে খাটাল বন্ধ করতে হবে।’
‘কিউ মাই বাপ?’
‘তুম জানতা নেহি, মন্ত্রী আসেগা। এই রাস্তাসে যায়েগা। এক গরু বা মোষ মাঝ রাস্তামে এসে যায় তো কিয়া হোগা?’
‘কিউ আয়েগা সাব। হাম বাঁধকে রাখেঙ্গে।’
‘দড়ি ছিঁড়ে দিলে?’
‘দুসরা রশশি লায়েঙ্গে।’
শুনেই বড়বাবু দু’জন কনস্টেবলের সাথে কী সব আলোচনা করেই বলে উঠলেন, ‘না, তুমারা খাটাল দু’তিন দিনকে লিয়ে উঠানা পরেগা।’
‘কাঁহা যায়ে মাই বাপ?’
‘মুলুক যাও। ইঁয়া মত রহো।’
শেষের কথাগুলো শুনেই রামমুখের পরিবার ও বাচ্চাগুলো বড় ও মেজবাবুদের কাছে হাজির হয়ে যায়। পরিবার তো এক্কেবারে বড়বাবুর পায়ে পড়ে গিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করে। তার সঙ্গে জুটে যায় সাত-সাতটা ছেলে। সবার কাঁদার আওয়াজে চারদিকটাতে রীতিমতো নাজেহাল অবস্থা হবার আগেই একের পর এক গরু-মোষও ডাকতে আরম্ভ করে। সেই আওয়াজে আশপাশের কয়েকটা পাড়া থেকে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। ঝামেলা আরম্ভ হবার আগেই বড়বাবু যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই গাড়িতে চেপে বসে পালিয়ে যান।
থানাতে যেতে এসডিপিও সাহেব বড়বাবুকে ফোন করে সব কিছু জানতে চান। কিন্তু বড়বাবু কোনও উত্তর দিতে না পারলে বড়বাবুর ওপর সবাই মিলে হম্বিতম্বি আরম্ভ করে দেন। বড়বাবু থানার কনস্টেবলদের ওপর চিৎকার করতে আরম্ভ করেন, আর তারা সেই সময় থানাতে বিশেষ কোনও কাজে আসা মানুষদের ওপর নিজেদের সব রাগ ঝেড়ে ফেলে শান্তি পাবার চেষ্টা করেন।
এদিকে খাটাল জায়গা থেকে না সরানোয় মন্ত্রীর যাবার রাস্তায় একটা সাময়িক ভয় এসে উপস্থিত হয়। প্রশাসনের সব অফিসারদের মুখেই এক কথা, ‘যদি সেই সময় কোনও গরু-মোষ বা কোনও বাছুর চলে আসে, কী হবে? কীভাবে সব কিছু সামলানো যাবে?’ খবরটা অনেক উঁচু মহলে পৌঁছে যাবার কিছু সময়ের মধ্যে উপর থেকে কয়েকটা ট্রাক আর খান দশেক পুলিশের ভ্যান পাঠিয়ে গরুমোষ-সহ সবাইকে তুলে সামনের কোনও স্কুলে রাখবার ব্যবস্থা করতে বলা হয়। কিন্তু সব আলোচনা করতে করতে সন্ধে হয়ে যায়। কোনও উপায় না দেখে পুলিশ সন্ধেবেলা স্কুলের হেডমাস্টারের বাড়ি গিয়ে তাকে একরকম তুলে স্কুলে নিয়ে আসে। স্কুলে এসে তিনি সেই সন্ধেবেলাতেই স্কুল বন্ধের নোটিশ লেখেন। তারপর হেডমাস্টার মশাইকেই ছাত্রছাত্রীদের জানানোর কথা বলে বড়বাবু তাকে ছেড়ে আবার খাটালে আসেন। রামমুখ তার পরিবার বা অন্য সবার বোঝার আগেই এক এক করে একরকম জোর করে গরু-মোষগুলোকে ট্রাকে তুলে স্কুলের ভিতর ছেড়ে দেওয়া হয়। এই কাজে দক্ষ এমনি কয়েক জনকে অন্য খাটাল থেকে নিয়েও আসা হয়। রাতের অন্ধকারে একের পর এক গরু-মোষ স্কুলের ভিতর ঢোকানোর পর প্রশাসনের সবাই একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও বড়বাবুর থানার যেতে না যেতেই আরেক সমস্যা এসে হাজির হল। শেষসন্ধ্যার মুখে থানার সামনে প্রায় শ’দেড়েক লোকের একটা জমায়েত হয়ে যায়। সেখান থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগানের পাশে রাস্তায় অবস্থান বিক্ষোভও আরম্ভ হয়ে যায়। বড়বাবু প্রথমে বুঝতে না পারলেও কিছু সময় পর একজন হোমগার্ড এসে খবর দিলেন, ‘স্যার পরিস্থিতি খুব খারাপ, ওই রামমুখের থেকে যারা দুধ নিতেন তারা সবাই এসে হাজির হয়ে গেছে, বলছে এরকম বেআইনিভাবে আপনি দুধের মতো একটা এসেনসিয়াল কমোডিটিকে কীভাবে বিনা নোটিশে সরিয়ে নিয়েছেন? শুধু তাই না, ওই খাটাল থেকে যেসব মিষ্টির দোকানকে দুধ দিত এবং মিষ্টির দোকানগুলো থেকে যারা মিষ্টি কিনতেন তারাও এসে হাজির।’
বড়বাবু প্রথমে কী করবেন বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলেন, ‘ঠিক আছে ওদের তিনজন প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠান।’
প্রায় আধ ঘণ্টা আলোচনার পর ঠিক হয়, পরের দিন সকাল থেকে অস্থায়ীভাবেই স্কুল থেকে দুধ দেওয়া হবে। যারা সকালে দুধ নিতে আসবেন তাদের জন্য একটা বড় ট্রাকের ব্যবস্থা করা হবে। এমনকী মিষ্টির দোকানগুলিতেও দুধ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে, এবং পুরোটাই হবে থানা এবং পুলিশের ব্যবস্থায়।
সবাই খুশি হয়ে থানা থেকে চলে যাবার আগে এককাপ করে চা আর একটা করে বিস্কুট খেয়ে গেলেন। বড়বাবুর অবস্থা তখন খুব খারাপ। সারাদিন ঘুরেছেন, পেটে কিছু পড়েনি, শরীরও টলছে। সামনে দোকান থেকে চারটে রুটি আনিয়ে খেতে যাবেন, এমন সময় স্থানীয় কাউন্সিলর ফোন করে গালিগালাজ আরম্ভ করে দিলেন। রাস্তা বন্ধ, এমনকী এই রাতেও রেল অবরোধ করবার কথাও বলে দিলেন। বড়বাবু প্রথমে কিছু না বুঝলেও পরে বুঝলেন স্কুলের ভিতর খাটালের গরুদের সাময়িক আস্তানা হবার জন্য সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা থেকে আরম্ভ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রী সবাই রেগে এক্কেবারে ফায়ার। কাউন্সিলর বলে দিলেন, ‘এক ঘণ্টার মধ্যে স্কুল থেকে সব গরু-মোষ সরিয়ে পরিষ্কার না করে দিলে এক্ষুনি মিডিয়াকে জানানো হবে। বুঝতেই পারছেন এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ, একটা ছবি পাঠিয়ে দিলেই সব শেষ।’
বড়বাবুর খাবার উঠল মাথাতে, চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থা হল। আবার গাড়ি ডেকে সব গরু-মোষ সব খাটালে পৌঁছে দিয়ে থানায় ফিরে এসে দেখলেন ভোর হতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। একটু বিশ্রাম নেবার জন্য ইজি চেয়ারটাতে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছেন এমন সময় এসডিপিও সাহেবের ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে মাটিতে নামলেন। দু’বার ‘ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার’ করতেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন শুনলেন, ‘ওই খাটালটার কী খবর?’
বড়বাবু কী উত্তর দেবেন ভেবে পেলেন না। কী করে বলবেন, ‘একটু আগেই স্কুল থেকে সব গরু-মোষগুলোকে আবার খাটালেই রেখে আসা হয়েছে।’ কোনও রকমে উত্তর দিলেন, ‘স্যার ব্যবস্থা করে ফেলেছি, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না।’
কিন্তু ঠিক কী ব্যবস্থা করেছে তা নিজেই জানে না।
ফোনটা রাখতেই দেখলেন বাইরে সেইমাত্র আলো ফুটছে। এদিকে মাথার চুল তখন চড়চড় করে উপরে উঠতে আরম্ভ করে দিয়েছে। কিছুতেই বুঝতে পারছেন না খাটালের ওই জায়গাটা ঠিক কী করা যেতে পারে। এমন সময় চায়ের দোকানের ছেলেটা চা দিতে এসে সব শুনে বলল, ‘স্যার প্যান্ডেল করে দিন।’
‘প্যাণ্ডেল! ইয়েস।’ বড়বাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
এটাই ভাল বুদ্ধি। সঙ্গে সঙ্গে একটা ডেকোরেটরকে ফোন করে খাটালের জায়গাটা কাপড় দিয়ে আড়াল করে দিতে বললেন। যাতে কেউ কোনও রাজনীতি না দেখে, তাই সব রঙের কাপড়ই মিলিয়েমিশিয়ে লাগিয়ে দিতে বললেন।
চায়ে চুমুক দিয়ে দোকানের ছেলেটাকে কথাগুলো বলতে বলতে গর্বে নিজের শুধু বুক নয়, সারাটা শরীর এক্কেবারে ফুলে ঢোল হয়ে যাচ্ছিল। এত্তবড় একটা ঝামেলা কত সহজে মুক্তি পেলেন সেটা ভেবেই খুব ভাল লাগল। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতেই দেখলেন, এসডিপিও স্যার আবার ফোন করেছেন। প্রথামতো দুবার ‘হ্যাঁ স্যার’ বলতেই শুনলেন, ‘সব তৈরি তো, স্যার কিন্তু এসে গেছেন, এবার নামবেন, ওনার স্পেশাল সিকিউরিটি থেকে আমাদের জানাল।’
বড়বাবু সব দেখেশুনে ‘ইয়েস’ বলেই কনস্টেবল-সহ বাকিদের সমস্ত গলিগুলোর মুখে দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। রাস্তার মাঝে একটা জনপ্রাণী নেই, তবে দড়ির ওপারে হাজার হাজার মানুষ, মন্ত্রী আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সাইরেন বাজছে। মন্ত্রী আসছেন। বড়বাবুর ওয়াকিটকিতে ঘন ঘন ফোন আসছে। এই এবার পেরোবেন। হঠাৎ কোথা থেকে একটা লাল কুকুর নড়তে নড়তে মাঝরাস্তায় এসে হাজির হয়ে গেল। বড়বাবু চমকে উঠে একটা হোমগার্ডকে কুকুরটাকে তাড়ানোর জন্য বলবেন, এমন সময় কুকুরটা রাস্তার মাঝখানটা বেশ পরিষ্কার পেয়ে দু’বার শুঁকে বেশ আরাম করে পটি করে চলে গেল। বড়বাবুর মাথায় হাত। কাকে গাল দেবেন বুঝে ওঠার আগেই মন্ত্রীর কনভয়ের প্রথম গাড়ির সামনের চাকাটা একটু কোণ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। একে একে বাকি গাড়িগুলো সেই রাস্তায় গেলেও মন্ত্রীর গাড়ির চাকাটা পড়ল এক্কেবারে কুকুরের গুয়ের ওপর। মুহূর্তের মধ্যে চাকায় লেগে ছেতরে গেল। লেগে গেল রাস্তার বেশ কিছুটা জায়গায়। বড়বাবু খুব সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ দেখলেন। মাথায় ডান হাতের কব্জিটা স্যালুট জানালেও বাঁ হাতটা ততক্ষণে পকেটে রুমাল খুঁজতে আরম্ভ করে দিয়েছে।
চিত্রণ: মনিকা সাহা







