Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

গ্রামের নাম কড়িধ্যা

বীরভূমের বর্তমান সদর শহর সিউড়ির অদূরে কড়িধ্যা একটি প্রাচীন সমৃদ্ধশালী গ্রাম। এই কড়িধ্যা গ্রামের চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ছোটবড় অসংখ্য মন্দির। আবার এই মন্দিরগুলির মধ্যে শিবমন্দির সংখ্যায় বেশি। মন্দিরগুলি বেশিরভাগ একরত্নবিশিষ্ট ইষ্টক নির্মিত ছোট শিবমন্দির। আর এই মন্দিরগুলির প্রায় প্রতিটিতেই কালো পাথরের শিবলিঙ্গ বিরাজমান। শোনা যায়, সিউড়ির তখনও পত্তন হয়নি। তার আগে থেকেই কড়িধ্যা নামে এই জনপদটি ছিল বেশ সমৃদ্ধ। রাজনগরের রাজ দরবারে যাওয়ার মূল পথ ছিল এই জনপদের উপর দিয়েই।

প্রায় ৩০০ বছর আগে মারাঠিরা রাজনগর আক্রমণের সময় এই ছোট ছোট গ্রামগুলিতে লুটপাট চালাত ও বাড়িঘর ভাঙচুর করত। এই মারাঠি বর্গিদের আক্রমণ থেকে গ্রামবাসীরা তাঁদের ধনসম্পদ রক্ষা করতে এইসব ছোটবড় শিবমন্দির তৈরি করান ও এই মন্দিরে তাঁদের ধনসম্পদ লুকিয়ে রাখতেন। কথিত আছে, মারাঠিরা ছিল শৈব, তাই তারা এই শিবমন্দিরগুলিতে সহজে আক্রমণ করত না।

বীরভূমের প্রাচীনতম জনপদ এই কড়িধ্যা। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে কড়িধ্যা সিউড়ির চেয়েও পুরনো। কড়িধ্যা নামকরণের ইতিহাস জানা না গেলেও মনে করা হয়, কড়ি শব্দ থেকে এই নাম আসতে পারে। বাংলায় বিনিময় মাধ্যম হিসেবে একদা কড়ির প্রচলন ছিল। এখানে সমৃদ্ধ তাঁতি ও শাঁখারি সম্প্রদায়ের মানুষের বাস ছিল। শঙ্খ, কড়ি ইত্যাদি নিয়ে শাঁখারিদের কারবার স্বাভাবিক। কড়িধ্যার জমিদাররাও ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন। এই গ্রামেই জন্মেছেন সমকালীন বাংলা গানের জনপ্রিয় সঙ্গীতকার ও গায়ক শিলাজিৎ মজুমদার, যিনি শিলাজিৎ নামেই সমধিক পরিচিত।

এই কড়িধ্যা গ্রামে গোষ্ঠ, রথযাত্রার মত দোল উৎসবের আগের দিন ‘চাঁচর পোড়া’ একটি প্রাচীন উৎসব। কড়িধ্যা গ্রামে একসময় ‘সেন’ বংশের জমিদারি ছিল। এই সেন বংশের গৃহদেবতা হলেন ‘দামোদর’। এই সেন জমিদারদের হাত ধরেই কড়িধ্যায় এই সমস্ত প্রাচীন উৎসবের সূচনা। সেন বংশের গৃহদেবতা দামোদরের মন্দির ছাড়াও তাঁদের প্রতিষ্ঠিত আরও বেশ কিছু মন্দির ও বিগ্রহ গ্রামে রয়েছে, গুপীনাথ জিউয়ের মন্দির, বলরাম জিউয়ের মন্দির তার মধ্যে অন্যতম। দামোদর হলেন শালগ্রাম শিলা। গুপীনাথ ও বলরামের বিগ্রহ দুটি কষ্টিপাথরে নির্মিত।

এই কড়িধ্যাতেই অষ্টাদশ শতকে সম্ভ্রান্ত ‘নন্দী’ বংশেরও পত্তন। কড়িধ্যা গ্রামের নন্দীবাড়ির ১৩২ বছরের পুরোনো তিনমূর্তি সরস্বতী পূজা ও মন্দিরটিও উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও অনেক প্রাচীন উৎসব, পুজো, প্রাচীন বৈষ্ণব সমাধিক্ষেত্র, পীরের স্থান এই গ্রামে রয়েছে। ঐতিহাসিক দিক দিয়েও অনেক ঘটনা রয়েছে এই গ্রামকে কেন্দ্র করে।

কড়িধ্যা গ্রামের দামোদর জিউ।

গোষ্ঠ: এই গ্রামে গোষ্ঠাষ্টমী খুব সমারোহের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। এই দিন বিকালবেলায় শোভাযাত্রা করে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গোপীনাথ, বলরাম, দামোদর জিউকে মন্দির থেকে বের করা হয় এবং গ্রাম প্রদক্ষিণ করিয়ে গ্রামের একটি স্থানে কদমগাছের তলায় একটি বেদিতে তিনটি বিগ্রহ বসিয়ে পূজা করা হয়ে থাকে। এই স্থানের সংলগ্ন ধানখেতে কয়েকটি গরুকে ফুলের মালা পরিয়ে সুন্দরভাবে সাজিয়ে মাঠের মধ্যে ধানখেতে ছেড়ে দেওয়া হয়ে থাকে। এই গরুগুলি যখন আপনমনে ধান খায়, ঠিক তখন হঠাৎ করে উচ্চস্বরে ঢাক, ঢোল, কাঁসর বাজানো হয়। এর ফলে গরুর দল আতঙ্কিত হয়ে এদিকে-ওদিকে ছুটে পালায়। একে স্থানীয় ভাষায় ‘গরু ছোটানো’ বলে। এইভাবেই এই গ্রামে গোষ্ঠাষ্টমী পালিত হয়। এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব উপলক্ষে কড়িধ্যা গ্রামে মেলাও বসে।

গোষ্ঠাষ্টমীর শোভাযাত্রা।

রথযাত্রা: রথযাত্রা এই গ্রামের একটি প্রাচীন উৎসব। এই গ্রামে একসঙ্গে পাঁচটি রথ বের হয়। রথযাত্রায় এই কড়িধ্যা গ্রামে গোপীনাথ, বলরামের রথ বের হলেও দামোদর জিউয়ের কোনও রথ বের হয় না। গোপীনাথ, বলরাম জিউয়ের রথের সঙ্গে আর একটি রথ বের হয়, সেটি হল গোপালের রথ। এই তিনটি রথ বেশ প্রাচীন। রথগুলি লৌহনির্মিত ও পঞ্চরত্নবিশিষ্ট। গোপীনাথ, বলরাম জিউয়ের রথের তুলনায় গোপালের রথটি আকারে একটু ছোট। এই তিনটি রথ ছাড়াও বর্তমানে আরও দুটি রথ বের হয়, যদিও এই দুটি রথ নবতম সংযোজন। তার মধ্যে একটি শঙ্করবাবার আশ্রম নামে একটি আশ্রমের রথ, আর অপরটি হল একটি বৈষ্ণব পরিবারের রথ। এই উৎসব উপলক্ষে গ্রামে রথযাত্রার দিন থেকে উল্টো রথযাত্রা পর্যন্ত মেলা বসে ও প্রচুর মানুষের সমাগম হয়।

পঞ্চরত্নবিশিষ্ট রথ।

চাঁচর পোড়া: দোল পূর্ণিমার আগের দিন সন্ধেবেলায় নেড়া পোড়া বা চাঁচর পোড়া, আবার অনেক জায়গায় বুড়ির ঘর পোড়ানো গ্রামবাংলার এক প্রাচীন প্রথা। বীরভূমের গ্রামাঞ্চলেও দোলের আগের দিন এই ‘চাঁচর পোড়া’ হয়ে থাকে। তবে কড়িধ্যা গ্রামের এই ‘চাঁচর পোড়া’ বা ‘নেড়া পোড়া’ এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এদিন সন্ধেবেলায় শোভাযাত্রা সহকারে দোলায় চড়ে দামোদর, গোপীনাথ ও বলরাম একসঙ্গে বের হন। গোপীনাথ জিউ ও বলরাম জিউ মন্দিরদুটি পাশাপাশি হলেও দামোদর জিউয়ের মন্দিরটি একটু দূরে অবস্থিত।

ঢাক, ঢোল ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে দামোদর জিউ প্রথম মন্দির থেকে বের হন এবং গোপীনাথ জিউ এবং বলরাম জিউকে সঙ্গে নিয়ে শোভাযাত্রা এগিয়ে চলে গ্রামের প্রায় শেষপ্রান্তে ‘বড় পুকুর’ নামে একটি বড় জলাশয়ের ধারে। এই শোভাযাত্রায় গ্রামের প্রচুর মানুষ মিলিত হন। শোভাযাত্রার মধ্যিখানের দোলায় অবস্থান করেন দামোদর জিউ এবং তাঁর দুপাশে থাকেন গোপীনাথ জিউ ও বলরাম জিউ। প্রতিটি দোলায় থাকেন চারজন বাহক। দামোদরের দোলাটিতে একজন বড় ছত্র ধরে থাকেন। তুলনামূলকভাবে দামোদর জিউয়ের দোলার আকৃতিটি একটু বড়।

এরপর জলাশয়ের ধারে নির্মিত তিনটি প্রাচীন বেদিতে তিনটি বিগ্রহকে বসানো হয় ও পুজো করা হয়ে থাকে। এবং এই তিনটি বেদির পাশে সরকাঠি নির্মিত তিনটি উঁচু স্তূপ তৈরি করা হয় ও সেগুলিতে আগুন ধরানো হয়ে থাকে। এটিকেই স্থানীয় ভাষায় ‘চাঁচর পোড়া’ বলা হয়। এর সঙ্গে এই জলাশয়ের ধারে প্রচুর রকমের আতশবাজি পড়ানো হয়। অনেকের বিশ্বাস, এই চাঁচর পোড়ার সরকাঠি ঘরে রাখলে ছারপোকা ও বিভিন্ন পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই অনেকেই এই পোড়া সরকাঠি সংগ্রহ করে ঘরে নিয়ে আসে। সমগ্র এই প্রথাটি সম্পূর্ণ করে বিগ্রহগুলিকে পুনরায় মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। এই প্রাচীন উৎসবটি দেখতে আশেপাশের গ্রাম থেকেও বহু মানুষের সমাগম হয়।

চিত্র: স্বরাজ মণ্ডল, শুভঙ্কর দত্ত ও সায়ন ভদ্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 + 11 =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »