Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সেই আমার বাড়িটা

বরাবর যে আমি ভাড়াবাড়িতে থেকে এসেছি এমনটা নয়। এক সময় আমার নিজেরই একটা বাড়ি ছিল। কেবলমাত্র থাকার জায়গা নয়। সেটা বাড়ি-ই ছিল। ঝড়, জল, রোদ, বৃষ্টি, শীতের হাত থেকে বাঁচার নেহাত একটা আশ্রয় ছিল না। সেটা ছিল যেন সব কিছু হারিয়ে যাওয়ার থেকে বাঁচার আশ্রয়। আশ্রয়, সবকিছু আনন্দে ভরিয়ে রাখার। তাই তার ছাদ থাকতেও ছাদ ছিল না যেন। দেয়াল থাকতেও ছিল না দেয়াল। বাড়িটার শিরা-উপশিরার মধ্যে অবারিত ঢুকে পড়ত ঝড়, জল, রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা, জ্যোৎস্না, পাখি, জোনাকি সবাই। কোনও বাধা ছিল না। মানুষও যেন আসত কত সব অতিথি হয়ে। ঘুরত ফিরত গান গাইত, অদ্ভুত দেশের অদ্ভুত সব গল্প বলত তারা। কলহাস্যে মুখর করত সকাল থেকে সন্ধ্যা। উৎসবের বাজনা বাজত। আর সারাটা দিন পর নিবিড় হয়ে রাত ঘনিয়ে এলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই চোখে জড়িয়ে আসত বড় নিশ্চিন্ত আরামের ঘুম।

কিন্তু কী যে এক অঘটন ঘটল! কত দিন, কত মাস, কত বছর হয়ে গেল আমার সে বাড়িটা আর খুঁজে পাচ্ছি না। কবে আর কেন যে সে বাড়ি ছেড়ে এলাম তাও ঠিক মনে পড়ে না এখন। আর দুর্ভাগ্য এই যে, এ পরিস্থিতিতে আমাকে এখন ভাড়াবাড়িতেই থাকতে হয়। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার নানা জটিলতায় আমাকে বারবার বাড়ি-বদল করতে হয়েছে। আর প্রত্যেকবার প্রত্যেকটা বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার বুকের ভেতরটা ছত্রাখান হয়ে গেছে। প্রত্যেকবারেই মনে হয়েছে হায় জীবনের কতটা সময় আমার অজ্ঞাতেই হারিয়ে গেল আমার অবহেলাতেই। আমার শুশ্রূষাটুকুও পায়নি সেই হারিয়ে যাওয়া রঙিন দিনগুলো।

কাজকম্মের ফাঁকে এখন যখন চুপচাপ বসে থাকি ছেড়ে আসা সেসব বাড়িগুলো মনের মধ্যে মাঝে মাঝেই উঁকি মারে। পথচলতি হঠাৎ হয়তো কোনও বাড়ির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল— বাড়িটা আমার দিকে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে। চিনতেই পারে না যেন। কোনও বাড়ি আবার যেন বলে ওঠে— আবার মরতে এসেছ কেন এখানে? আসলে তখন অন্য ভাড়াটে এসে গেছে সেই বাড়িতে। ছাদের দড়িতে শাড়ি, পাজামা, বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে বাসনপত্রের টুংটাং আওয়াজ। একটা বাচ্চা পড়া মুখস্থ করছে। কারও একটু কাশির শব্দ। এক বৃদ্ধ হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। এসব ক্ষেত্রে ‘আপনারা এখানে কবে এসেছেন, আগে কোথায় থাকতেন?’ এরকম গায়ে পড়া প্রশ্ন অনায়াসেই করা যায় আর সে ইচ্ছে যে হয় না একেবারে তাও নয়, কিন্তু তখনই মনে হয়েছে অন্য আর এক দিন এসে আলাপ করা যাবে, এখন মনে হচ্ছে ভদ্রলোক খুব ব্যস্তসমস্ত। আলাপ তো পরে এসেও যখন খুশি করাই যায়।

বছর পনেরোর মধ্যে কিছু না হলেও সাত-আটবার বাড়ি পালটাতে হয়েছে আমাকে। কোনও নির্জন দুপুরে বারান্দার নরম আলোতে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে পাতা কাঁপা রোদ-ছায়ার খেলার মত স্মৃতির আঁকিবুঁকি চলতে থাকে। আশ্বিন দুপুরের ঝকঝকে নীরবতাকে নিবিড়ভাবে ঘনিয়ে তোলে একাকী ঘুঘুর ডাক। কেমন অলস খেলার মত মনে পড়ে পড়ে যায় কবে কোন বাড়িতে কোন কোনার ঘরে, কোনও বাড়ির বারান্দা লাগোয়া ফুলেভরা কামিনীর গন্ধভরা বিকেলে অথবা কোনও ঘরে মাদুর পাতা খাটে বৃষ্টিঝরা রাতে কত মান অভিমান রাগারাগি যন্ত্রণা জটিলতায় ভুলে যাওয়া ভুলে না যাওয়ার মধ্যে উদাস বিচরণের কত ঝাপসা গল্পের কথা। মন খুব কেমন করলে মনে হয় যেতেই তো পারি যে কোনও বাড়িতে সেই কামিনী গাছ হয়তো এখনও আছে, তার তলায় দাঁড়িয়ে মনেই আনতে পারি সেসব পুরনো দিনের কোনও কথা। তারপর এখনকার ভাড়াটেদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে এককাপ চা খেয়ে চলেই আসতে পারি এক শীতের সকালে। সে এমন কিছু নয়। কিন্তু কীভাবে যাব হারিয়ে যাওয়া আমার সেই নিজের বাড়িটায়? যাকে অন্তত একবার চোখের দেখা দেখার জন্য বুকের ভিতর হাহাকার করে ওঠে। কত দিন, কত মাস, কত বছর হয়ে গেল তার হদিশ-ই পাচ্ছি না আর। কোথায় যে বাড়িটা ছিল কিছুতেই মনে করতে পারছি না, এ কেমন স্মৃতিভ্রম ভেবে কুল পাই না কোনও।

টেবিলে, দেরাজে, আলমারিতে যেখানে যত পুরোনো কাগজপত্র স্তূপীকৃত জমা হয়ে আছে সব পাগলের মত ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকি। তখন তো স্মার্টফোন ছিলই না আর মোবাইল-ও বাজারে আসেনি। তখন চিঠি-ই লিখত সবাই। কখনও কেউ কি একটা চিঠি লেখেনি সেই বাড়ির ঠিকানায়? একটা পোস্টকার্ড পেলেই তো সব মিটে যেত। সেখানেই তো পেয়ে যেতাম সে বাড়ির ঠিকানা। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পেলাম না ডাকঘরের রাজার সেই চিঠি। বারবার বাড়ি পাল্টানোর তাড়নায় কোথায় চলে গেছে সেসব। তবে আমার মনের মধ্যে উঁকি দিতে থাকে দুটি নাম রাজডাঙ্গা আর রাঙ্গাগ্রাম। এর কোনও একটাতে নিশ্চয়ই ছিল বাড়িটা। এমনই দুর্ভাগ্য যে এসব যন্ত্রণা হঠাৎ শুরু হল এত বয়সে এসে। আগে হলে নয় মা, বাবা, কাকা, জ্যেঠা এদের কারও কাছ থেকেই জানা যেত বাড়িটার হদিশ। এত বছর পর তারা কেউই তো আর নেই। কী করে থামাব আমার বুকের ভেতর সেই বাড়ির সঙ্গে আমার বিচ্ছিন্নতার এই গভীর কান্না। শেষটায় খেয়াল হল একেবারে ছেলেবেলার দু-একজন বন্ধু তো আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এখানে-ওখানে, তাদের কারও পক্ষে হয় তো এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করা সম্ভব হলেও হতে পারে।

এর পরেই একদিন দৈবক্রমে রাস্তায় হঠাৎ একেবারে ছেলেবেলাকার বন্ধু সমীরণের সঙ্গে দেখা। অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মত জিজ্ঞাসা করলাম— হাঁ রে, তুই যে একবার আমাদের রাজডাঙ্গার বাড়ি গিয়েছিলি— মনে আছে কীরকম দখিনা হাওয়া দিত সেখানে? কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে সমীরণ বলল, রা জ ডা ঙ্গা! সে আবার কোন জায়গা? সাতজম্মে তো নামও শুনিনি। যাওয়া তো দূরের কথা। আমি সবেগে বলে উঠলাম— আরে না, না, ভুল বললাম। জায়গাটার নাম রাঙ্গাগ্রাম। সমীরণ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সজল গলায় বলল— এ বয়সেই তোকে ডিমেনসিয়া ধরল! কী সব বলছিস পাগলের মত?

মনে মনে হাসলাম, ‘তুই এ কথা বলছিস সমীরণ! কয়েকবছর আগেই তোর মাথারই একটা সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আমাদের ছোটাছুটি করতে হয়েছিল।’ যাই হোক এরই কিছুদিন পর ব্যাঙ্কে যাচ্ছিলাম একটা কাজে। একই ভাবে রাস্তার মাঝখানে ছোটবেলার আর এক বন্ধু পারিজাতের সঙ্গে দেখা। হাত উঁচিয়ে সোৎসাহে বলে উঠল,

—আরে অমল যে! কতদিন পর দেখা বল তো! তা এই রোদ্দুরে মাথা নীচু করে যাচ্ছিস কোথায়? একটা ছাতাও নিসনি সঙ্গে? বউ কী করে তোর? ও ভাল আছে তো? হ্যাঁ কোথায় যাচ্ছিস বললি না তো?

—এই একটু ব্যাঙ্কে। ওর হাত ধরে টেনে এনে একটা অশ্বত্থের ছায়ায় এসে দাঁড়াই। জিজ্ঞাসা করি— আচ্ছা পারিজাত, একটা কথা বল তো— তুই অনেক বছর আগে যে একবার আমাদের বাড়ি গিয়েছিলি—

—কি চাঁদপাড়ার বাড়ির কথা বলছিস?

—না, না— আরও আনেক আগে রাজডাঙ্গা আথবা রাঙ্গাগ্রাম কোথায় এখন ঠিক মনে পড়ছে না— সেখানে আমাদের নিজেদের বাড়ির কথা বলছি।

পারিজাত অবাক গলায় বলল— আরও আগে? রাজডাঙা? রাঙ্গাগ্রাম? নিজেদের বাড়ি? কী সব আবোলতাবোল বকছিস। চাঁদপাড়ার বাড়িতেই তো তোর সঙ্গে প্রথম আলাপ। তার আগে আবার তোর সঙ্গে আমার দেখা হল কবে? বাংলাদেশ থেকে সবে এসেছিস তখন। আর বরাবর ভাড়াবাড়িতেই তো ছিলি জানতাম। তার আগে কোথায় কোন বাড়িতে ছিলি সে কী করে জানব! আর এ ব্যাপারে কখনও আমাকে বলিসনিও কিছু। কী করে জানব বল? বুঝেছি এই রোদে হেঁটে মাথাটা তোর গরম হয়ে গেছে। কাঁধে হাত রেখে বলল,

—যা কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যা। আমারও তাড়া আছে। যেতে যেতে বলল, ফোন করে তোর বাড়ি চলে যাব একদিন।
বাড়ি ফিরে এসে ভাবতে লাগলাম— এ কী করে সম্ভব! আমার একেবারে ছেলেবেলার বন্ধু এরা সব। আমাদের বাড়িতে আমার মার প্রশ্রয়ে অবাধ ছিল এদের আসা যাওয়া থাকা খাওয়া সব। অথচ এরা কেউ একবার মনে করতে পারছে না সে বাড়ির কথা! আমার জীবনের ওপর দিয়ে না হয় অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে যা হয়তো সবার ভাগ্যে ঘটে না। যার ফলে কিছু স্মৃতিভ্রংশ আমার হতেও পারে। কিন্তু এদের! অথচ মনে মনে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বাড়িটা। কিন্তু চোখের দেখা দেখতে পারছি না বলে বুকের ভেতরটা ব্যথায় টনটন করে উঠছে।
ওই তো দেখতে পাচ্ছি বাড়িটা। নরম আলো আর অফুরন্ত হাওয়ায় উত্তাল হয়ে উঠেছে। দরজা জানালাগুলো সব হা হা খোলা। অজস্র পর্দা হাওয়ায় উথালপাতাল। উড়িয়ে নিতে চাইছে কোন দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে, আশেপাশের শাল সেগুনগুলো ঝুঁকে পড়ে সবুজ ডানার ঝাপটা মারছে বাড়িটার গায়। বলছে, চলো চলো। মাটিতে ঘন সবুজ লতাগুল্মের উদ্দাম ঢেউয়ের মাথায় বাড়িটা জাহাজের মত দুলছে। হ্যাঁ এইতো— সেই বাড়িটাই তো এটা। ওই তো পাশ দিয়ে লাল সুড়কি ঢালা রাস্তাটা, শুনেছি ওটা বয়ে গিয়ে নাকি স্টিমারঘাটে পড়েছে। কী যেন নদীটার নাম ঠিক মনে পড়ে না।

ওই তো বাড়িটার ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে কত মানুষের কলধ্বনি। সুখের, আনন্দের। কত হাসিঠাট্টা কত আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা ছিল বাড়িটায়। কে যেন দূরের কাউকে ডাকছে। স্টিমারের ভোঁ? দূরে যাওয়ার অথবা দূর থেকে কাছে আসার ডাক। ওই তো ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে সব। লক্ষ্মী নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। সব-পরিপাটি। বেশ মনে পড়ে ঋতুগুলো তাদের ডালি নিয়ে নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ত ঘরগুলোর মধ্যে। কোনও বাঁধা ছিল না।

ওই তো, কে যেন অমল বলে ডাকল না! মা নাকি! কতদিন হয়ে গেল মার গলা শুনিনি। কী করে শুনব! পড়ে আছি তো কোন বিদেশবিভূঁইয়ে। ওই তো সেই পেয়ারা গাছটা। পেয়ারার ভেতরটা কেমন লাল ছিল! পেয়ারাগুলোর অর্ধেকটাই পাখি আর কাঠবেড়ালির পেটে চলে যেত। পাশেই তো ওই কালোজাম গাছটা। জাম পাড়তে গিয়ে একবার মুসলমান পাড়ার হাসার হাত ভেঙে গিয়েছিল ওই গাছ থেকে পড়ে। ওই তো পাশের মাঠটায় কলহাস্যে কারা নাচছে গাইছে লুকোচুরি খেলছে। হ্যাঁ আমিও তো খেলছি। আমরা কত ভাই বোন— তার সঙ্গে মাসতুতো মামাতোরা তো আছেই। —কে যেন ডাকল না? —মাসি, মামি না কাকি? —আর কত তোরা খেলবি? খাবিদাবি না? কী আদর! কী স্নেহ! কী ছিল সেই গলায়!

আচ্ছা ওখানে কি মৃত্যু ছিল? ঠাকুমাকে একবার খালি দেখেছিলাম— ঝাপসা মনে পড়ে খাটের ওপর শুয়ে পায়ে আলতা। ফুলের মালায় ঢাকা। সুগন্ধি ধূপের ধোঁয়ায় ঘর ভরে গিয়েছে। পায়ের কাছে বসে বাবা আর কাকা— যাদের এমন বিষণ্ণ কখনও দেখিনি। তখনও ঠিক জানি না জীবনের কোন অবস্থা এটা। ওই তো দেখতে পাচ্ছি পাগলা হাওয়া হাত ধরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে ছাতে। যেখানে আকাশ বন্ধুর মত রহস্যের হাতছানি দিয়ে ডাক দেয়। যেখানে হাসি খেলা আর গান আর মুক্তি, মুক্তি আর অপার আনন্দ।

সব যেন আমার মনে আছে। অথচ তাকে ধরতে পারছি না, ছুঁতে পারছি না, না দেখতে পাচ্ছি চোখে। আর কী আশ্চর্য, পারিজাতের কথা না হয় বাদ দিলাম সমীরণ আমার একেবারে ছোটবেলার বন্ধু, অনেক বছর আমরা কাছাকাছি ছিলাম। আমার ডিমেনসিয়া বলে কথাটা একেবারে উড়িয়েই দিল! এরপর আর কাকে জিজ্ঞাসা করব তাই ভাবছি। বাড়িটাকে অন্তত একবার চোখের দেখা না দেখা পর্যন্ত মন কিছুতেই মানছে না। এ তো প্রাণের ডাক। কীভাবে এড়াই একে।

নন্দিতা আমার ঘরণী হলেও খুব অল্প বয়স থেকেই আমাদের পরিবারের সঙ্গে ওর পরিচয়। ওর তো এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারার কথা। কিন্তু ওর সঙ্গে বাড়ি সংক্রান্ত কোনও কথা বলতে মন চায় না। নানা আজেবাজে কথা উঠে একটা তিক্ততার সৃষ্টি হবে।

কিন্তু মনটা এত ব্যাকুল হয়ে ছিল যে আর পারলাম না, ওরই শরণ নিতে হল একদিন। শীতের দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের সঙ্কীর্ণ জানালা দিয়ে আসা একচিলতে রোদ্দুরে বসে হারিয়ে যাওয়া বাড়িটার কথা ভাবছিলাম। নন্দিতা পাশের বারান্দার রেলিংয়ে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় তুলতে এসেছিল। একথা-সেকথার পর বলে ফেললাম, আচ্ছা নন্দিতা, আমাদের সেই রাজডাঙ্গার বাড়িটার কথা মনে আছে? ছুটির দিন এই শীত দুপুরের রোদে ঘুঘুর ডাক শুনতে শুনতে কেমন বেলা গড়িয়ে যেত। সেই যে দুয়ারের সামনে দিয়ে লাল রাস্তাটা— কথা শেষ হওয়ার আগেই সাপের মত ঘাড় বেঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে ছোবল মারার ভঙ্গিতে নন্দিতা বলল— আমাদের বাড়ি! অক্ষমের দিবাস্বপ্ন! কবে আবার আমাদের নিজেদের বাড়ি ছিল! রূপকথার গল্প শোনাচ্ছ নাকি? রাজডাঙ্গা! কীসে করে যায় সেখানে? ব্যাঙ্গমার পিঠে চেপে বুঝি? সঙ্কুচিত হয়ে বল্লাম— না না, তুমিই বলো না! জায়গাটার নামটা হয় তো মনে পড়ছে না ঠিক— হ্যাঁ হ্যাঁ মনে হচ্ছে রাঙ্গাগ্রাম। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে পাথরের গলায় বলল— ইয়ার্কি মারছ না কি? তোমার সঙ্গে সে সম্পর্ক আছে মনে হয়? নিজের মনে একটার পর একটা গল্প বানিয়ে যাচ্ছ! তোমার মত অযোগ্য মানুষের অবশ্য এ ছাড়া আর কী করার আছে! বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে। পারলে কি সত্যি নিজেদের একটা বাড়ি বানাতে? উদ্বাস্তুদের মত একবার এ-বাড়ি একবার ও-বাড়ি করে জীবন কেটে গেল। আর কীসব বাড়ি! এক একটা ঘরে একটা খাট পাতলে আর পা ফেলার জায়গা নেই, বারান্দা নেই, জানালা নেই ঠিকমতো, আলো হাওয়া খেলে না, দমবন্ধ হয়ে আসে।

একটু দম নিয়ে বলে— কী আর বলব, নিজের পাপের শাস্তি ভুগতে তো হবেই। বাবা-মার কথা শুনিনি তখন। জাঁক করে বলেছিলাম তখন, সরকারি চাকরি করে না তো কী হয়েছে? রীতিমতো লেখাপড়া করা মানুষ, কীসে আটকাবে তাঁকে? ভাবলে হাসি পায় এখন। আমার বন্ধুদের— শিক্ষিতদের কথা বাদই দিচ্ছি, সাধারণ মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ স্বামীরা কীসব বাড়ি হাঁকিয়েছে! দেখে তাক লেগে যায়। তাদের আশেপাশেও এখন আর যাই না, নিজেকে ভিখিরি মনে হয়। আর ইনি দেখো! চাকরি গেছে তো জমানো টাকাই ভাঙিয়ে খাচ্ছেন দিনের পর দিন। টিউশনিও তো করতে পারেন একটা, তাও না। দিনরাত হাতে একটা বই নিয়ে বসে আছেন। শিক্ষিত! কী হবে এই শিক্ষা দিয়ে! পারবে অন্তত মাথা গোঁজার মত একটা বাড়ি বানাতে? আছে সে মুরোদ তোমার? ভাবলাম লালনের মত করে একবার বলি— কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার— কিন্তু কী হবে বলে। এর মর্মব্যথা ও কী বুঝবে!

হিস হিস করে বিষ ছেটাতে ছেটাতে নন্দিতা চলে যায়। চুপ করে বসে থাকি। হায় হায় কী প্রশ্নের কী উত্তর পেলাম। যে ময়দানবদের কথা বলে গেল নন্দিতা, তাদের প্রত্যেকেই যে বাঁ-হাতের খেলায় ওস্তাদ, তা নন্দিতাও ভালমতই জানে। মনটা তেতো হয়ে গেল। অবশ্য ভেবে দেখতে গেলে ওরই বা দোষ কী! অতি সাধারণ ছাপোষা মেয়ে সে। এর থেকে বেশি কী আর আশা করা যায় ওর কাছ থেকে। আর সত্যি, মিথ্যে তো আর কিছু বলেনি ও।

কতদিন কত বছর যে নন্দিতার সঙ্গে কেটে গেল এরকম অপ্রেমে, এরকম অপরিসর, সঙ্কীর্ণ প্রাণহীন বাড়িগুলোর মধ্যে একটার পর একটা। অথচ আমার প্রাণভোমরা খুঁজে মরছে যে বাড়িটা। তার দেখা কী আর কোনওদিনই মিলবে না? শুধু তাঁর দূরবিস্তৃত স্মৃতি মাঝে মাঝে বুকে এসে বসন্তের হাওয়া হয়ে লাগে। সব কিছু উথালপাথাল হয়ে যায়।

এরপর আরও অনেককে, আমার আরও বন্ধুদের আরও অনেক আত্মীয়স্বজনদের সেই বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করে করে ফিরেছি। কিন্তু কেউ-ই কিছু বলতে পারেনি, কেউ ভেবেছে এটা স্মৃতিবিষয়ক কোনও দুর্বলতা, কেউ বা মুখ টিপে হেসেছে মাথার কোনও গণ্ডগোল ভেবে। আজকাল তাদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে কেউ কেউ হাসি চেপে মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলে,

—কী? বাড়িটার খোঁজ পাওয়া গেল?

ক্লান্ত হতাশায় এখন মায়ামৃগের পেছনে দৌড় ছেড়েও দিয়েছি। কী হবে আর বুকে এই কুহেলিকা পুষে রেখে। দেড় কাঠার মত একফালি পৈতৃক জমি ছিল পাড়ার এক কোণে। তাঁর চারপাশ ঘিরে এখন সব আকাশছোঁয়া বাড়ির পাঁচিল। ভাবলাম দেখি যদি সেখানে একটা মাথা গোঁজার আস্তানা বানিয়ে অযোগ্য শিরোপাটা ঘোচানো যায়— ধারকর্জ লোন যা হোক কিছু একটা করে। ব্যাঙ্কে লোনের দরখাস্ত-ও করে দিয়েছি একটা।

এরই মধ্যে দিল্লি থেকে মেয়ের ফোন এল একদিন। আগামী সপ্তাহের পরের সপ্তাহে আমাদের দিল্লি যেতে হবে। মেয়ে দিল্লিতেই থাকে। জামাই সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে। ফলে মাইনেপত্র ভালই। বেশ ভাল একটা হাউসিংয়ের একটা ফ্লোরের একটা দিক কিনে নিয়েছে ওরা। দশতলায়। বেশ সুন্দর নাকি! নীচে সমস্ত শহরটা ছবির মত দেখায়। সেখানে গৃহপ্রবেশের আমন্ত্রণ।

অনেকদিন পরে নন্দিতার মুখে একটা খুশির আলো দেখলাম। স্বাভাবিক। মেয়ের ইচ্ছাপূরণের মধ্য দিয়ে নিজের নিরুদ্ধ ইচ্ছা কিছুটা মিটেছে তো বটেই। আমার বুকেও অবশ্যই ঢেউ উঠল। মেয়ের এই সাংসারিক সুখ ছাড়াও আরও দুটি কারণ ছিল তার— কিছুদিনের জন্য এই সংসারবদ্ধতা থেকে মুক্তি আর ‘পুকু’— আমার দৌহিত্র। আমি যার তাতু। এখন তিন বছর বয়স। মেয়ের সঙ্গে আমাদের ফোনে যে কথাবার্তা হয় তাঁর সিংহভাগটাই জুড়ে থাকে ও। কথা বলতে শিখেছে অনেক দেরিতে তাই এখন মুখে সারাদিন আধো আধো কথার ফুলঝুরি। কাউকে বুঝতে কিছু অসুবিধে হলেই সে এখন ওর কাছে ‘পাগন’। পাগল শব্দটা সদ্য শিখেছে ওর মার কাছ থেকে। তাই ওর কাছে এখন পাগনের আর শেষ নেই।

দিল্লির ফ্লাইটের ভাড়া নেহাত কম নয়। একটু কষ্ট করেই সেটা যোগাড় করতে হল। উড়ে চলে গেলাম দিল্লি। অনেকদিন পর দেখা। আমার দিকে দুহাত উঁচু করে ছুটে এল পুকু। হাওয়ায় উড়ছে ওর এলোমেলো চুল, মুখ তার সকালবেলার আলো, চোখে শরতের আকাশ। তাতু বলে হেসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কোলে। স্বাবাভিকভাবেই বুকটা ভরে গেল আমার।

কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন আমার পুকুর সঙ্গে হেসেখেলে। অনুষ্ঠানও সব চুকেবুকে গেছে আনন্দেই। এবার ফিরে যাবার পালা। মনখারাপ হয়ে ছিল। একদিন খাওয়াদাওয়ার পর চুপচাপ বসে আছি সোফার ওপর, এমন সময় ধপ করে একটা শব্দ। পেছন থেকে গলা জড়িয়ে রিনরিনে গলায় শুনলাম— দেকো পুকুর কত বই। অনেকগুলো বই সামনে পড়ে আছে দেখলাম। কাঠের মত শক্ত মোটা আর্ট বোর্ডে চকচকে ঝকঝকে ক্যাটক্যাটে রঙে ছাপা সব ছবি। বাচ্চা ও তাদের অভিভাবকদের মন কাড়ার সস্তা চেষ্টা। অত্যন্ত অসুন্দর। বলাই বাহুল্য বইগুলোতে পাতাজোড়া সব ছবি। ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, বাঃ পুকুর কী সুন্দর বই। ‘এই দেকো’ বলে দেখাতে লাগল সব বইগুলো— কোনওটা ফুলের কোনওটা ফলের কোনওটা জন্তু-জানোয়ারের কোনওটা পাখির। শেষে একটা বই দেখিয়ে বলল, এই দেকো কোতো বাই। বিভিন্ন রকমের সব বাড়ির ছবি।

পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ও দেখাতে থাকে। এই দেকো এটা আম্মার বাই। এটা দিয়ার, এটা মিদার এইভাবে মা মাসি মামি যাকে যেভাবে ডাকে সেভাবে এক একজনকে বাড়ি বিতরণ করতে লাগল। শেষে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল এই দেকো এটা পুকুর বাই। ওর গালটা টিপে বললাম, বাঃ কী সুন্দর বাই পুকুর। কিন্তু তাতুর তো একটাও বাই নেই।

—আছে তো এই দেকো। আঙুল দিয়ে একটা বাড়ি দেখায়। টকটকে লাল রঙের টালির ছাদ। ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙের জানালা, ঝকঝকে হলুদ দেয়াল, বেগুনি রঙের পরদা। মুখে মৃদু হাসির মধু মাখিয়ে ও আমার দিকে অপলক নিষ্পাপ দেবদূতের চোখে তাকায়, দেকো তো তাতুর কী সুন্দর বাই। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, বাঃ কী সুন্দর বাই দিয়েছে আমাকে পুকু। কিন্তু কী আশ্চর্য এরকম কি দেখেছি কখনও? ওর চোখের মণিতে ভেসে উঠেছে বাড়িটার ছায়া। আরও আশ্চর্য যে বাড়িটার ছবিটা পালটে পালটে যাচ্ছে। লাল টালির ছাতটা ছেয়ে গেল আনন্দ রঙের বোগেনভিলিয়ায়। দরজা জানালার কটকটে সবুজ রংটা উধাও হয়ে কখন একটা নরম আলো পড়া রং ফুটে উঠল। আর দরজা জানালাগুলো যেন কে এসে হাট করে সব খুলে দিল। উৎকট বেগুনি রঙের পর্দাগুলি হঠাৎ কী মন্তরে শান্তিনিকেতনী পর্দা হয়ে হাওয়ায় উথালপাথাল করতে লাগল। আর তখনই প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, আরে এই তো আমার সে হারানো বাড়ি! তৃষ্ণার্ত মরুচারীর মরূদ্যানের সন্ধানে মরুভূমিতে ছুটে বেড়ানোর মত আমি যাকে খুঁজে বেড়িয়েছি কত মাস কত বছর! আমার হারিয়ে যাওয়া রঙিন দিনগুলি যার মধ্যে ছোটাছুটি করে বেড়ায়। ওই তো যেন শুনতে পাচ্ছি কাদের আনন্দের কলহাস্য— ভালবাসার মাধুর্যের সখ্যের। উৎসবের ঢাক বাজছে না? হঠাৎ চমক ভাঙল। পুকু দুহাতে আসার চিবুক পেছনে ঠেলে দিয়ে ডাকছে তাতু, তাতু। কতক্ষণ নিথর হয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি খেয়াল নেই। তাতেই ও হয়তো অবাক হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ঘোর ভাঙে না।

ওর চোখ থেকে চোখ সরাতে পারি না। চলমান ছায়াছবির মত দেখতেই থাকি এলোমেলো হাওয়ায় কম্পমান মহীরূহগুলি। নিচে ভাট, তেলাকুচো, আশশ্যাওড়া, আরও নাম না জানা লতাগুল্মের ঝোপঝাড়ের উত্তাল সবুজ ঢেউয়ের দোলায় জাহাজের মত দুলছে, বাড়িটা। ভেসে যেতে চাইছে যেন আলোর কোন মহাসমুদ্রের দিকে।

স্বপ্ন, মাধুর্য, আনন্দ, মুক্তির আশ্বিন-রোদে টলমল করছে বাড়িটা। আমার এতদিনের খুঁজে না-পাওয়া বাড়িটা। আবার কানে বাজে আমার বীণার তার, তাতু, তাতু। কিন্তু আমি স্বপ্নাবিষ্টের মত ঘুরে বেড়াতে থাকি বাড়িটার চারপাশে। ওই তো সেই লাল রাস্তাটা, যেটা চলে গেছে নদীর দিকে। আমি হাঁটতে থাকি সেই রাস্তা ধরে। দুহাতের মুঠিতে আমার চুল শক্ত করে ধরে খিলখিল করে হেসে হেসে দুলে দুলে আমার মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে পুকু বলতে থাকে— তাতু তুমি একটা পাগন। স্বপ্নাবেশে চোখ জড়িয়ে আসে, কতকাল পর দেখা মিলেছে আমার কবেকার সে হারানো বাড়িটার।

চিত্রণ: নিশিতা নাথ
4.3 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
স্বপ্না অধিকারী
স্বপ্না অধিকারী
3 years ago

ভালভাষা র প্ল্যাটফর্ম এ আমার স্মৃতি আর এক বার রোমন্থিতহলো, লেখককে আমার সশ্রদ্ধ প্রনাম

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »