Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে: মন্দ সময়ের উপাখ্যান

ভিক্টোরিয়ান রীতিনীতি সব উচ্ছন্নে যাওয়ার যোগাড়। এতদিনকার মার্জিত ঔদ্ধত্য, লালিত অহংকার রাস্তায় গড়াগড়ি যায় আর কী! লোকটার কোনও এটিকেট নেই, মুখের আগল নেই। শ্লীল-অশ্লীল বোধটাও যেন কম। মাঝখানে যে সূক্ষ্ম পর্দাটা আছে তা তাঁর ভাষার তোড়ে উড়ে যেতে বসেছে। একেবারে দমকা বাতাস। কী অকপট, কী স্বাভাবিক তাঁর উচ্চারণ। মনের ভিতর ঘূর্ণি উঠলেই আগল খুলে দিতে হবে বৈকী— I like men who have a future and women who have a past.

জড়তাহীন এই ঘোষণা যাকে বলে একেবারে বজ্রনির্ঘোষ। এরকম একটা মানুষকে নিয়ে কানাকানি হবে, বিতর্ক হবে, ঝগড়া হবে খুব স্বাভাবিক কারণেই। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক কেঁপে উঠল অস্কার ওয়াইল্ডের ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’ বইটির হাত ধরে। কোনও কোনও সমালোচকের মতে, এই বই ঘরে রাখা যায় না। মানে লুকিয়ে রাখা উচিত কিশোর-কিশোরীদের নাগাল থেকে। এ এক ‘poisoned book’, যার ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে আছে বিষ। ছেলেমেয়েরা সব উচ্ছন্নে যাবে। নষ্ট হবার মত উপাদান কম নেই এখানে। লর্ড হেনরির মুখে এমন সব কথা বসিয়েছেন অস্কার ওয়াইল্ড (পুরো নাম অস্কার ফিঙ্গাল ও’ফ্লাহার্টি উইলস ওয়াইল্ড) নামের মানুষটা, তা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিশুদ্ধবাদীদের ধাক্কা দেয়। মানব কী মানব না, পড়ব কী পড়ব না, এক দোদুল্যমানতায় দোল খাওয়ায়। দাম্পত্য সম্পর্কের যে পিউরিটি তার শিকড় ধরে নাড়া দেয়। কোথাও কোথাও উপড়েও ফেলে— The one charm of marriage is that it makes a life of deception absolutely necessary for both parties. I never know where my wife is, and my wife never knows what I am doing. কী সাংঘাতিক ও সাহসী বিস্ফোরণ। আমাদের সমাজে যেখানে অগ্নিসাক্ষী রেখে জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ার শপথ নিই, সেখানে এ বই নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। সমাজ-সংসার রসাতলে যাবার উপক্রম।

মার্কিন সাময়িকী ‘‘লিপিনকট’স মান্থলি ম্যাগাজিন’’-এর ১৮৯০ জুলাই সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’।

ডোরিয়ান গ্রে যৌবনের প্রতীক, সৌন্দর্যের প্রতীক। বয়সের বলিরেখাও ভয় পায় তার শরীরে থাবা বসাতে। সে উন্নাসিক, উদ্ধত। ঠান্ডা মাথার খুনি। সমাজের উপরতলার প্রতিনিধি। ক্লাব আর পার্টি কালচারে অভ্যস্ত। একদিকে ভিক্টোরিয়ান রাখঢাক আর অন্যদিকে উপরতলার বাসিন্দাদের কেচ্ছার গল্প। ওয়াইল্ড আসলে তার সময়টাকেই ফালাফালা করতে চেয়েছেন। বলা যেতে পারে এ এক সামাজিক ব্যবচ্ছেদ। যেন অপারেশন টেবিলে রোগীকে শুইয়ে খুলে দেওয়া হয়েছে তার বুক। সবাইকে ডেকে দেখানো, এই যে শুয়ে আছ তুমি, তুমি, তুমি…

ডোরিয়ানের সৌন্দর্যে মজেছে চিত্রকর বাসিল। এতটাই যে অন্য কারও মুখে ডোরিয়ানের প্রশংসা বা সমালোচনা তার বুকে বড় বেশি বাজে। কারও কাছে সে প্রকাশ করতে চায় না তার উপস্থিতি, এমনকি তার বন্ধুদের কাছেও— when I like people immensely, I never tell names to any one. হ্যারিও কি মজেনি তার নতুন এই পুরুষবন্ধু ডোরিয়ানের সৌন্দর্যে? প্রথম যেদিন দেখল সে, তার অন্তরাত্মায় বেজে উঠল এক অনির্বচনীয় সুর, ফুটে উঠল হাহাকার— his finely carved scarlet lips, his frank blue eyes… all the candour of youth was there, as well as all youth’s passionate purity. অন্যরকম কোনও গন্ধ পাচ্ছেন পাঠক? হ্যাঁ, সমকামিতার অভিযোগ উঠেছে অস্কারের বিরুদ্ধে। আর সেই অভিযোগে অভিযুক্তও বটে। জেলে কেটেছে লম্বা দুটো বছর। সোয়াশো বছর আগে সমকামিতা আমাদের গ্রহে কোথাওই স্বীকৃত ছিল না। ধরে নেওয়া হত এ হচ্ছে প্রকৃতিবিরুদ্ধ, সৃষ্টিকর্তার খেয়ালি ইচ্ছের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিদ্রোহ।

গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’-র প্রথম দিককার প্রচ্ছদ।

ডোরিয়ান-এর পোট্রেটের মধ্যে অংশত ঢুকে গিয়েছিল চিত্রকর নিজেও। তার আত্মার অংশ হয়ে উঠেছিল সে প্রতিকৃতি— he is much more to me than a model or a sitter… Harry! if only you knew what Dorian is to me! দুই বন্ধুই অতঃপর মুগ্ধতার আড়ালে পরস্পর ঈর্ষার জাল বুনবে, ছিনিয়ে নিতে চাইবে ডোরিয়ানকে। আর অধিকারবোধের চূড়ান্ত মূর্খামির পরিচয় দিয়ে চিত্রকর হয়ে উঠবে ডোরিয়ানের শয়তানির শিকার। হ্যাঁ, ডোরিয়ান শয়তান। তার শয়তানি চোখে-মুখে ফুটে ওঠে না। সেখানে সে বিশুদ্ধ পবিত্র। কিন্তু তার প্রতিকৃতি ধীরে ধীরে বুড়ো হতে থাকে। প্রতিকৃতির চিবুকে জমা হয় ক্রুরতার হাসি, আঁকা হয় ছলনার ভ্রূকুটি। ডোরিয়ান বোঝে সে কথা। আর তাই সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে রাখে তার আত্মপ্রতিকৃতি। শুধু মাঝে মাঝে নিশুতি রাতে চোরের মত লুকিয়ে দেখে আসে কতটা গভীর হলো শয়তানের ক্ষত। বাসিলের কাছে সে মেলে ধরে নিজেকে— each of us has heaven and hell in him, Basil.

বাসিলের জন্য কষ্ট হয়। সে সত্যি সত্যিই তার বন্ধুকে সবসময় পিওর অ্যান্ড প্যাশনেট দেখতে চেয়েছে। শেক্সপিয়ার যেমন তাঁর বন্ধুকে অমরত্ব দিয়েছের তাঁর কবিতার শরীরে— ‘‘when in eternal lines to time thou grow’st’’, তেমনই বাসিলও তার সব মেধা মনন শিল্পীসত্তা ঢেলে দিয়েছে ডোরিয়ানের প্রতিকৃতিতে। জীবনের সেরা ছবি এঁকেছে সে— I have shown in it the secret of my own soul. কিন্তু এই ছবি ডেকে এনেছে তার নিয়তি। ছবির সঙ্গে চিরতরে হারিয়ে গেছে চিত্রকর ডোরিয়ানের অন্ধ কুঠুরিতে। অবশ্য শুধু চিত্রকর কেন, চিরযৌবন প্রত্যাশী ডোরিয়ানও শেষে মাথা কুটে মরেছে এই ছবির সামনে। ছবির ডোরিয়ান শ্লেষে ও বিদ্রূপে ভরিয়ে তুলেছে রক্তমাংসের ডোরিয়ানকে, বাধ্য করেছে আত্মাহুতিতে।

প্রথম প্রকাশিত ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’-র শিরোনাম পৃষ্ঠায় অলংকৃত লিপি।

ভাবতে অবাক লাগে একশো বত্রিশ বছর আগে প্রকাশিত একটি বই এখনও আলোচনার কেন্দ্রে থেকে যেতে পারে। নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়ার যে অভিযোগকে কেন্দ্র করে ঝড় উঠেছিল একসময় তা থামার লক্ষণ কোথায়! অথচ আশ্চর্য, আর একটিও উপন্যাস লেখেননি অস্কার ওয়াইল্ড। হয়তো অভিমানে, হয়তো প্রয়োজন বোধ করেননি। আসলে তাঁরই তো এই সোচ্চার ঘোষণা— all art is useless.

কভার: অস্কার ওয়াইল্ডের ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’-র পাণ্ডুলিপি।

চিত্র: গুগল

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গা মাঈ কী! জয়!

ঢাকা বা সমগ্র বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা আদায়ের চল খুব একটা নেই। মণ্ডপে এসেই পাড়ার লোক চাঁদা দেন। জবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যে বীভৎসতা কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তা অন্তত ঢাকা আর বরিশালে দেখিনি। পুজোর দিনেও অনেকে এসে প্যান্ডেলের পাশে চাঁদা আদায়কারীদের টেবিলের সামনে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। স্বেচ্ছায় এসে চাঁদা দিয়ে যান। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও প্রসঙ্গত

সমসময় তাঁকে চেনেনি। বরং সর্বপ্রযত্নে বানচাল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে তাঁর প্রগতিশীল কাজকর্মকে। এই সময় ও বাঙালি সমাজ-ও কি চিনেছে তাঁকে? তাঁকে তাই শেষ জীবন কাটাতে হল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থেকে দূরে সাঁওতাল পরগনায়। শেষ বয়সে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি, যাদের জন্য তাঁর এই কাজ, সব অপাত্রে দান!

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: দেড়শো বছরের সূচনায়

তাঁকে অনুবাদ করা হয় ভারতীয় নানা ভাষায় নানা সময়ে। তবুও কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ মূল্যায়িত হননি আজ-ও। বেশ কিছু অনুবাদ ছিল তাঁর, প্রথমজীবনে কলকাতা বাসকালে, হিন্দি থেকে ইংরেজিতে, যা হারিয়ে গেছে চিরতরে। বারো বছর রেঙ্গুন-পেরু পর্বে আগুন লেগে পুড়েছে তাঁর আঁকা ছবি, ‘চরিত্রহীন’-এর পাণ্ডুলিপি, পরে আবার যা লেখেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »