প্রতিদিনের জীবনে একসঙ্গে জড়িয়ে থাকা অজস্র জীব আমাদের জীবনযাত্রার সহযাত্রী। চারপাশের এই জীববৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত আমাদের চলার পথ যেমন সুগম করছে, তেমনই আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নিখরচায় রক্ষা করে চলেছে। এইসব জীববৈচিত্র্য আমাদের দিনাতিপাতের চিরাচরিত নানান অভ্যাস, ধর্মাচরণ, অর্থকরী রসদ সংগ্রহ কিংবা মনের আরামের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। তাই সেগুলির সুরক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে আমাদের দেশের ভারতীয় জীববৈচিত্র্য বোর্ড যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে।
জীববৈচিত্র্য আইন (২০০২), ধারা ৩৭ ও উপধারা ৩৭ (২) অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্য সরকার তার স্থানীয় পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলির সঙ্গে আলোচনা করে সেই রাজ্যের জীববৈচিত্র্যে ঐতিহ্যপূর্ণ অঞ্চলগুলি (Biodiversity Heritage Site বা BHS) চিহ্নিত করে তার সীমানা নির্ধারণ করার কাজ করবে। রাজ্যের বোর্ড ও কেন্দ্রীয় বোর্ড আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এইসব অঞ্চলগুলি রক্ষা করার নীতি ও পদ্ধতি নির্ধারণ করবে। সেইমতো আমাদের দেশের প্রতিটি রাজ্যেই তাদের নিজ নিজ সরকার এমন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের জীববৈচিত্র্যময় অঞ্চলগুলি চিহ্নিত করেছে ও অঞ্চলগুলির সুরক্ষার ব্যবস্থা নিচ্ছে।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ২০১৫ থেকে ২০২০ অবধি এমন চারটি জীববৈচিত্র্যে ঐতিহ্যপূর্ণ অঞ্চল চিহ্নিত হয়েছিল; আর সম্প্রতি ২০২৩-এ আরও ছ’টি অঞ্চল যোগ হয়ে এখন মোট দশটি এমন অঞ্চল উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে সাগরতট অবধি ছড়িয়ে রয়েছে। প্রথমেই বলি, উত্তরে দার্জিলিং জেলার টংলু BHS (২৩০ হেক্টর) ও ধোতরে BHS (১৮০ হেক্টর) অঞ্চল; হিমালয়ের এই দুটিই ভারি মনোরম স্থান। মূলত এই দুটি অঞ্চলই ঔষধি গাছপালায় সমৃদ্ধ, আর সেই কারণে ২০১৫ সালে BHS হিসাবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
এরপর ২০১৮-য় গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড় কনকদুর্গা BHS (২২.৬২ হেক্টর) ঘোষিত হয়। এই অঞ্চল দীর্ঘদিন পবিত্র উপবন (Sacred Grove) হিসেবে সুরক্ষিত; মালভূমি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বনভূমির অবশিষ্টাংশ এই উপবন আঞ্চলিক মানুষজনের নানান ধর্মীয় আচার ও বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০২০-র গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে আমরা পেয়েছি কোচবিহারের বাণেশ্বর শিব দিঘি BHS (০.৬৬৭ হেক্টর); এই জলাশয় কালো নরম খোলের কাছিমের বাসস্থল। এই কালো সফ্টশেল টার্টল (Black Softshell Turtle; Nilssonia nigricans) এখানেই ধর্মীয় আচারের কারণে বেঁচে আছে। IUCN ইতিমধ্যেই CITES Appendix-I-এ অন্তর্ভুক্ত এই কাছিমের প্রজাতিটিকে তার স্বাভাবিক বন্য বাসস্থানগুলিতে লুপ্ত (Extinct in the Wild, EW) হিসেবে ঘোষণা করেছে।
নদিয়া জেলার রাজ্য উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা এবং উন্নয়ন (State Horticulture Research and Development) সংস্থার অধীনে থাকা ৩৯.৬১ হেক্টর উদ্যান নানান আঞ্চলিক ফুল, ফল ও ঔষধি গাছপালার জিন-বৈচিত্র্যের এক বিপুল ভাণ্ডার। ২০২৩-এর ১০ মার্চ এই উদ্যানটিকে BHS হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। নদিয়ার জেলারই চর বালিডাঙা একই সঙ্গে (২০২৩-এর ১০ মার্চ) আর-একটি ঘোষিত BHS; হুগলি নদীর দুটি চর নিয়ে এই জীববৈচিত্র্য অঞ্চলে জোয়ার-ভাটার জন্য কিনার জুড়ে স্থানে স্থানে পুরু শৈবালের চাদর বিছিয়ে থাকে। সুরক্ষিত বাসস্থান ও নানান খাবারের উপকরণ ছড়িয়ে আছে বলে স্থানীয় ও পরিযায়ী মিলিয়ে ১০০-র বেশি পাখিপ্রজাতির আনাগোনা; এছাড়া নানান প্রজাতির উভচর, সরীসৃপ ও ছোট স্তন্যপায়ীর বাস। এখানে ভাল সংখ্যায় নির্ভয়ে বসবাস করছে আমাদের রাজ্য-প্রাণী, মেছোবেড়াল (Fishing Cat; Prinonailurus viverrinus; IUCN-VU, Schedule -I Part A); এই একই Schedule-I Part A-এ অন্তর্গত অন্যান্য বিরল প্রাণীগুলি, যেমন স্বর্ণগোধিকা (Golden Monitor Lizard; Varanus flavescens; IUCN-EN), মসৃণ প্রলিপ্ত উদ্বিড়াল (Smooth Coated Otter; Lutrogale perspicillata; IUCN-VU), পাতিশিয়াল (Golden Jackel; Canis aureus), খেঁকশিয়াল (Bengal Fox; Vulpes bengalensis), ছোট খটাশ বা ভাম বিড়াল (Small Civet Cat; Viverriculata indica) এখানে অবাধে বসবাস করে। এছাড়া Schedule-IV Appendix-III অন্তর্গত নেউল (Mongoose; Herpestes edwardsii) আর নানান ধরনের ইঁদুরের দেখা মেলে।
একই সময়ে (১০ মার্চ, ২০২৩) দার্জিলিং জেলার নামথিং পোখরি (৪.১৮৯ হেক্টর) বিএইচএস ঘোষিত হয়; এই জলাশয়টিতে অতীব সংবেদী ও বিরল হিমালয়ান স্যালামান্ডার বা ভারতীয় নিউট-এর বাস। সেই প্রাচীন ও মধ্য মিওসিন যুগ থেকে বিবর্তনের পথে আজও টিকে আছে ভারত-নেপাল হিমালয়ের এই নিউট। এটিকে দেখতে কতকটা টিকটিকির মতো হলেও এরা উভচর শ্রেণির; এদের ত্বকে কোনও আঁশ নেই আর জলে ডিম পাড়ে ও জলেই ছানাপোনারা বড় হয়। শুধুমাত্র পূর্ব হিমালয়ের কিছু জলাশয়ে এদের বাস আর তার মধ্যে নামথিং পোখরি অগ্রগণ্য।

২০২৩-এর ১০ মার্চ বীরভূম জেলার আমখই কাষ্ঠ-জীবাশ্ম উদ্যান BHS (১০ হেক্টর) ঘোষিত হয়েছে। এই উদ্যান জুরাসিক যুগের শেষদিকে সৃষ্ট অরণ্যভূমি-জাত কাঠের জীবাশ্মের; এগুলি দীর্ঘদিন ছিল তাদের আদিম স্বাভাবিক বিন্যাসে, কোনও কৃত্রিম সজ্জায় নয়। এখন দর্শকদের উৎসাহী করতে বৈজ্ঞানিক তথ্যসহ সজ্জিত হয়েছে; এককথায়, রাজ্যে এই উদ্যান নিঃসন্দেহে এক বিস্ময়কর ও অনন্য তথ্যভাণ্ডার।

২০২৩-এর ১৬ মে পূর্ব মেদিনীপুরের ৪.৭৩ হেক্টর অঞ্চলের হলদীর চর দ্বীপভূমি একটি BHS-এর মর্যাদা পেয়েছে। এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে স্বাভাবিক বাদাবন; জোয়ার-ভাটার কারণে, বিস্তৃত প্লাবিত উপকূলীয় তটভূমিতে নানান বাদা অঞ্চলের গাছপালা রয়েছে আর সেখানেই বাস করছে নানান প্রজাতির মাছ, উভচর, সরীসৃপ, দেশি ও পরিযায়ী পাখি, ও স্তন্যপায়ী। একই সঙ্গে এই জেলারই আর-একটি BHS হল বিরামপুর-বগুরান জলপাই (৯৫.৯১ হেক্টর) সৈকত। এই বিস্তৃত ৭.৩ কিমি দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকায় নানান কাঁকড়ার মেলা। লাল কাঁকড়া (Ocypod macrocera), ডটিল্লা কাঁকড়া (Dotilla myctiroides), ফিডলার কাঁকড়া (Uca lactea) সহ নানান লিটোরাল প্রাণীকুলের স্বাভাবিক বাসস্থান। এছাড়াও Wildlife Protection Act 1972-এর শিডিউলগুলিতে অন্তর্ভুক্ত এমন নানান প্রাণীর দেখা মেলে এখানে।
দেশের বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পবিত্র বনভূমি ইত্যাদি সংরক্ষণ পদক্ষেপের পাশাপাশি, এই ছড়ানো-ছিটানো ঐতিহ্যপূর্ণ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলিকে সুরক্ষিত করার উদ্যোগ স্বাগত। শ্লাঘার বিষয়, দেশের মধ্যে এই পশ্চিমবঙ্গেই BHS-এর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি; তার মূল কারণ, এই রাজ্যের উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা জুড়ে অসাধারণ ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। সম্প্রতি আমাদের বনদপ্তর, ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া এবং স্থানীয় একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পশ্চিম বর্ধমান জেলার বসতি সন্নিহিত জঙ্গলে বুনো শুয়োর, নেকড়ে, খেঁকশিয়াল ও নানান ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর উপস্থিতি ক্যামেরাবন্দি করেছে। তাই আগামী দিনে এই অঞ্চলের BHS তকমা হয়তো অপেক্ষমাণ। এইভাবে স্থানীয় স্তরে আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্যের সম্ভারকে চিহ্নিত করে বাঁচিয়ে রাখার সাধু উদ্যোগকে সফল করে তোলা আমাদের সকলেরই কর্তব্য।