Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

প্রাক-পাল যুগের আয়ুধসহ বিষ্ণুমূর্তি: উদ্ধার প্রসঙ্গে

ইতিহাসে উল্লিখিত বরেন্দ্রভূমির প্রাচীন অংশ আজকের মালদা জেলার গাজোল, পাকুয়া বা হবিবপুরের বিস্তীর্ণ অংশে হিন্দু ও বৌদ্ধযুগের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধারের ঘটনা অতীতে একাধিকবার ঘটেছে। সম্প্রতি গাজোলের শাহজাদপুর পঞ্চায়েতের ভাদো গ্রামের সাতকাদিঘিতে পুকুর খননের সময় উদ্ধার হয়েছে দুটি বিষ্ণুমূর্তি। এই দুই মূর্তিকে কেন্দ্র করে উদ্দীপনা ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে গবেষক ও আঞ্চলিক ইতিহাসে উৎসাহী মহলে।

উদ্ধার হওয়া দুটি মূর্তির মধ্যে একটি সম্পূর্ণ কালো পাথরে নির্মিত আড়াই-তিন ফুট দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট পূর্ণাবয়ব মূর্তি এবং অন্যটি অসম্পূর্ণ ও পরিত্যক্ত। পরিভাষাগতভাবে একে প্রাইমারি আইকনোগ্রাফিক স্ট্রাকচার বলা হয়। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে অনুমান, পাল যুগের প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ অষ্টম-নবম শতকের মধ্যে এই মূর্তিদুটি নির্মিত হয়েছিল। অষ্টম শতকে পাল মূর্তি নির্মাণশৈলীর যে সুষম ভারসাম্য এবং অবয়ব সংস্থান তা বিষ্ণুমূর্তিটির মধ্যে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। সেই হিসেবে দেখতে গেলে মূর্তিটির বয়স আনুমানিক ১৪০০ থেকে ১৫০০ বছর। অসম্পূর্ণ মূর্তিটিরও বয়স কাছাকাছি, তবে কোনও কারণে ভাস্কর এই মূর্তি নির্মাণ সম্পন্ন করেননি। অনুমান করা যায়, ওই অঞ্চলে মূর্তি নির্মাণের কোনও কেন্দ্র ছিল, যেখানে হয়তো ধারাবাহিকভাবে প্রস্তর নির্মিত মূর্তি তৈরি হত।

নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পুরাতাত্ত্বিক উৎখনন হলে আরও ঐতিহাসিক নিদর্শন কি উঠে আসবে না? এই জাতীয় মূর্তি নিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষক ড. অনিন্দ্যবন্ধু গুহ বলেন, ‘ছবি দেখে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, এই মূর্তি প্রাক-পাল যুগের। প্রাক-পাল যুগের মূর্তির সঙ্গে গুপ্ত যুগের মূর্তিশৈলীর একটা স্পষ্ট মিল দেখা যায়। বিষ্ণুমূর্তির মাথার মুকুট বা গলার উপবীত থেকে আরম্ভ করে সমস্ত দেহগঠনের মধ্যে সেই স্ট্রাকচারাল সিমেট্রির ছাপ স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। বিষ্ণুমূর্তির নিচের দুটি হাতে চক্র পুরুষ ও গদা দেবী অবস্থান করছেন। এই জাতীয় মূর্তিকে ভগবানের আয়ুধসহ মূর্তি বলা হয়। নিশ্চিতভাবেই আরও কিছু মূর্তি আশপাশের অঞ্চলে থাকতেও পারে। কেননা, এশিয়াটিক সোসাইটির ক্যাটালগ বলছে, প্রাক-পাল যুগের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মূর্তি উদ্ধার হয়েছিল রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চল থেকে।’

উদ্ধার হওয়া বিষ্ণুমূর্তি।

এই মূর্তি উদ্ধার প্রসঙ্গে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মালদা ডিভিশনের কনজার্ভেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট রোহিত কুমার জানান, মূর্তি উদ্ধারের খবর পেয়ে তিনি থানা ও বিডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুলিশ-প্রশাসনের অনুরোধে তাদের বিশেষজ্ঞ টিম একটি মূর্তিকে পাল যুগের এবং অন্যটিকে অসম্পূর্ণ হিসেবে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে। প্রশাসন যদি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মূর্তিদুটিকে তাদের হাতে তুলে দেয় তাহলে তারা ঠিকভাবে সংরক্ষণ করে কোচবিহার ও মুর্শিদাবাদে অবস্থিত এএসআই-এর কোনও একটি মিউজিয়ামে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারেন।

মালদা থেকে উদ্ধার হওয়া এই মূর্তি মালদাতেই যেন থেকে যায়, এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুনীতি ঘোষ মিউজিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক ড. বিশ্বজিৎ দাস। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়াম আকারে ছোট হতে পারে, কিন্তু এই জাতীয় মূর্তি সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনের সমস্ত ব্যবস্থা আমাদের হাতে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় নতুন ভবন সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে মিউজিয়ামের আকারও বাড়ছে। প্রশাসন যদি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মূর্তিদুটি আমাদের হাতে তুলে দেয়, আমরা নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতের গবেষক ও আগ্রহীদের জন্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারব। আমরা এ নিয়ে আশাবাদী।’

অসম্পূর্ণ মূর্তি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯২৮ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত পুরাতাত্ত্বিক জে. সি. ফ্রেঞ্চের কালজয়ী গ্রন্থ ‘দ্য আর্কিটেকচার অফ পালা এম্পায়ার অফ বেঙ্গল’-এ এই সময়কালের চারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূর্তির উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে— ঢাকার সুখবাসপুরে প্রাপ্ত তারা মূর্তি, ভারতীয় জাদুঘরের রক্ষিত কুমিল্লা থেকে প্রাপ্ত বুদ্ধমূর্তি, রাজশাহী জাদুঘরে রক্ষিত সূর্যমূর্তি ও দিনাজপুরের মঙ্গলবাড়িতে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তি। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের পর্যবেক্ষণ, এই শেষোক্ত মূর্তিটির সঙ্গে গাজোলে প্রাপ্ত মূর্তিটির সাদৃশ্য রয়েছে।

২০২৩-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাদো গ্রামের বাসিন্দা সুবোধ চৌধুরীর পুকুর খননের সময় দুটি মূর্তি উদ্ধার হয়। গ্রামবাসীরা উদ্ধার হওয়া মূর্তিদুটিকে কেন্দ্র করে পূজাপাঠ আরম্ভ করেন। অবশেষে গাজোল থানার পুলিশ অফিসার শুভেন্দুবিকাশ পতির নেতৃত্বে পুলিশকর্মীরা গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে মূর্তিদুটি গাজোল থানায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য, গাজোল থানার পাঁচিলঘেরা সীমানার মধ্যেই একজায়গায় উদ্ধার হওয়া এই জাতীয় অনেকগুলি মূর্তি রাখা রয়েছে— সেখানে নিয়মিত পূজাপাঠ হয়।

বারবার মালদার প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি অঞ্চল থেকে একের পর এক মূর্তি উদ্ধার হয় কিন্তু মালদা মিউজিয়াম বা ইউনিভার্সিটি মিউজিয়ামে তাদের কোনও স্থান হয় না। জেলার ইতিহাসকেন্দ্রিক গবেষণায় এই বিষয়কে নিয়তি হিসাবে মেনে নিয়েও একটা অল্প আলোর মতো দুঃখবোধ গ্রাস করেছে জেলার ইতিহাসপ্রেমী ও গবেষকদের।

চিত্র: প্রতিবেদক
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »