Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

কবিতা: জীবনের নানা দিক

কয়েক টুকরো জীবন

কুচযুগলে আগুন জ্বলে, ঊরু অগুরু গন্ধে ভরা
এ সবই তো জীবন ভেবে হুমড়ি খেয়ে যেই না পড়া
এক কোপেতেই মুণ্ডু ঘ্যাচাং, রইল যে কবন্ধখানা
জীবন মানেই অতল পাতাল, জীবন মানেই খন্দখানা
জীবন মানে শরীর শুধু, শরীর আমার সোনার কাঠি
নেশায় শুধু ভুলিয়ে শরীর তুলছে মুখে বিষের বাটি
জীবন মানেই শরীর মানেই চমকে লাগা দাঁতকপাটি

জীবন মানেই শনি রবি তাসের জুয়া, মদের বোতল
সোডার মত উপচে ওঠা অহংকারের রাশি ফেনা
জীবন মানেই নতজানু ভিক্ষে চাওয়া, পাতা আঁচল
জীবন যে কী নারী পুরুষ, ধনী গরিব কেউ জানে না

জীবন কি এক সূত্রবিহীন ভীষণ জটিল সমীকরণ
স্বপ্নে দেখা জলআলেয়া, তেপান্তরের নীলচে পরী
জন্ম থেকেই আলোর গতি, লক্ষ্য অনিবার্য মরণ
জীবন কি সেই সংশয়িত ইলেকট্রনের ট্র্যাজিকটরি

জীবন মানেই সংকীর্ণ খালের মধ্যে নৌকো বাওয়া
প্রতি প্রহর যে পরিখায় হুংকার দেয় অগ্নিমুষল
জীবন মানেই মিথ্যে হাসি, লুকিয়ে ছুরি জানতে চাওয়া
‘কেমন আছেন’ ইত্যাকারের ফালতু যত প্রীতিকুশল

জীবন্তরা অভিনেতা, রঙ্গমঞ্চে কেউ নামে না
যে যার দামে বিক্রি সবাই, রুই কাতলা চুনোপুঁটি
জীবন মানেই অনন্তদিন হাটের মধ্যে বেচাকেনা
যে যা পারে বিক্রি করে, লজ্জা বিবেক অনুভূতি

কেউবা মারে কলসিকানা, কেউবা বিলোয় ভালবাসা
জীবন সবার শিরার মধ্যে ডাইনি হয়ে রক্ত শোষে
জীবন মানেই প্রতীক্ষাঘর, প্রত্যকের একচিলতে আশা
পারের জাহাজ আসবে কবে, জীবনকুসুম পড়বে খসে।

*

কলকাতা এখনও

তখন ছিল মোহিনী সাজে, কেমন আছে আজ
গড়িয়াহাটে সুন্দরীরা ঝরনাধারায় হাসে!
স্বপ্ন কি আজ বিসর্জনে, এখন শুধু কাজ
তবুও জানি জ্যোৎস্না ঝরে ভিকটোরিয়ার ঘাসে
কেমন আছে কলকাতাটা, আজ সে কেমন আছে
রোদ্দুরে কি ছড়ায় সোনা, বৃষ্টিধারায় নাচে!

গঙ্গাবুকে নৌকো কি আর উচ্ছলতায় ভাসে
উত্তেজনার বিস্ফোরণে কফিহাউস ফাটে
শেয়ালদাতে ভিড়ের মধ্যে জীবন বারোমাসে
কেমন করে কাটায় সে দিন, রাতটা কেমন কাটে
কেমন আছ মায়াবিনী, বলো কেমন আছ
আনন্দ আর দুঃখ নিয়ে উদ্দীপ্ত বাঁচো

লেকের ধারে অন্ধকারে চুম্বনে সংরাগে
যৌবন প্রগলভ হতো, সাক্ষী হতো তার
জলে চাঁদের ছায়া, সে কি বিনিদ্র রাত জাগে,
আজও, নাকি রাতজোনাকির কান্না নিরুচ্চার
কলেজ স্ট্রিটে মুক্তি দশক মুখর প্রতিক্ষণে
তখন হতো, আজ তা নীরব করুণ বিসর্জনে

আমার জীবন বিষণ্ণতায় বন্দি পরবাসে
একই রকম প্রত্যেক দিন, টেনেই চলি ঘানি
তখন ছিল উল্লাসময় জীবন ট্রামে বাসে
রুক্ষ শহর, ভয়াল নদী, গভীর অরণ্যানী
পেরিয়ে এলে তবেই দেখা আজ সে কেমন আছে
পাথরে পা কাটে আমার, হাত কেটে যায় কাচে

ঝুলন্ত সেই সেতুর প্রেমে মজেই ছিল মন
পেরিয়ে এলে সুন্দরী যার উষ্ণ ডাকে সাড়া
না দিয়ে কি থাকতে পারি, অমোঘ আকর্ষণ
মনকে করে আচ্ছন্ন, সজোরে দেয় নাড়া
ঠিক জানি না কলকাতাটা আজকে কেমন আছে
অতীতকালের প্রেমিককে সে ডাকবে কি আর কাছে
একটাই ভয়, শুনতে না হয় ধূসর সায়োনারা।

*

আমস্টারডামে মেঘলা দুপুর

ট্রেনের জানালা থেকে চোখে পড়ে ঘাসের গালিচা
কোমল রোদের স্নেহে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল শান্তির নিদ্রায়
সমুদ্রে দ্বীপের মতো ছোট ছোট বাড়িগুলি ঘাসের শয্যায়
অতি দ্রুত বদলে যায় দৃশ্যাবলি, ট্রেন থামে ব্রাসেলস স্টেশনে
বেলজিয়ামের মোহ দূরে রেখে ট্রেন চলে স্থির নিশানায়
অভ্রান্ত লক্ষ্যের দিকে, আমস্টারডাম ডাকে কুহকী মায়ায়
নগরে পৌঁছেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, সুন্দরী ট্রামেরা
হাতছানি দিয়ে ডাকে, বহু বহুদিন পরে প্রিয় বাহনের
ডাকে সাড়া দিয়ে আমি পৌঁছে যাই মহার্ঘ নিবাসে
তারপর ঘোরাঘুরি, উচ্ছল খালের জলে ভ্রমণের নেশা
এখানে দস্যুরা ছিল, জলের দস্যুরা ছিল ধূসর অতীতে
কত লুন্ঠনের স্মৃতি অপরাধ বুকে নিয়ে প্রাচীন নগরী
এখন রূপসী সাজে, বলে সব ভুলে যেতে, দেখে যাই শুধু
ভ্যান গগ কীরকম ছড়ায় রঙের জাদু প্রতি চিত্রপটে
অ্যান ফ্রাংক রক্তে আঁকে নাজিদের কলঙ্কের ছবি
আজও আছে অমলিন, এখনও তবুও আছে কিছু মনোহারী দৃশ্য
জলবায়ু দূষণের প্রতিরোধে দুর্গ গড়ে সারি সারি ট্রাম
অসংখ্য সাইকেল আছে আরোহী সেবার জন্য, দস্যুতার কালো ছবি মুছে
আলিঙ্গনে ডেকে নেয় বহুবর্ণী যাত্রীদের, নগরী তাদের
উপহারে দিতে চায় ভ্যান গগ, রুবেনসের মোহ সুভেনির
এ সব মায়ায় কাটে ছায়াঘন মেঘলা দুপুর।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
4 months ago

ধন্যবাদ ভাল ভাষা। নতুন বছরের প্রাক্বালে কবি সুজিত বসুর তিনটি মন কেমন করা কবিতা উপহার পেলাম। দীর্ঘ প্রবাসে আছেন, দেশেবিদেশে কবির অধিষ্ঠান; তাই তাঁর স্মৃতিমেদুরতাও অতি প্রশস্ত। জীবনের পথে যাত্রাও তাঁর দীর্ঘ। এই সব মিলে গেছে অসাধারণ তিনটি কবিতায়। কবি লিখেছেন, “সুন্দরী ট্রামেরা হাতছানি দিয়ে ডাকে, বহু বহুদিন পরে প্রিয় বাহনের ডাকে সাড়া দিয়ে আমি পৌঁছে যাই মহার্ঘ নিবাসে,” হায় কবি হয়তো জানেন না কলকাতাতে, তাঁর প্রারম্ভ যৌবনের “কলেজ স্ট্রিটে মুক্তি দশক মুখর প্রতিক্ষণে” আর দুলে দুলে হেঁটে যায়না ট্রাম, হাঁটবে না আর কখনো। কলকাতার এখন ভীষণ অসুখ কবি, হয়তো প্রবাসী কবি জানেন না অথবা জানেন, তবু বুকের ভেতরের সুখস্মৃতির আলোতে সব কালো জলাঞ্জলি দিয়েছেন। “আমার জীবন বিষণ্ণতায় বন্দি পরবাসে,” সে বন্দিদশা শারীরিক মাত্র, মনে মনে তিনি স্মৃতি-অশ্বের সওয়ার হয়ে ছুটে চলেছেন বিশ্বব্যাপী, ছুটিয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁর পাঠকদের। ভালো থাকুন কবি, ভালো থাকুক ভালভাষা।

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »