Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। কেবল আলঙ্কারিক অর্থেই নয়, প্রকৃত-ই। ‘আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যতো উঠে ধ্বনি/ আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি,’— তাঁর এই উচ্চারণ আক্ষরিকভাবেই সত্য। কবিতা, গান, প্রবন্ধ এবং নাটকে বৈশ্বিক ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত ধরা পড়েছে তাঁর লেখায়, তা সে চীনে ইংরেজদের আফিমের ব্যবসার দুর্বিষহতা-ই হোক, কিংবা আফ্রিকায় বুয়োর যুদ্ধ, বা চীনে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রুজভেল্টকে লেখা তাঁর উৎকণ্ঠিত চিঠি।

আবার প্রবলভাবে তিনি ভারতীয়। বেদ-উপনিষদে তাঁর আকৈশোর অবগাহন, প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার অনুসরণে তিনি বোলপুরে গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম। মারাঠী সাধক তুকারামের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন, আর কবীরের দোঁহা ইংরেজিতে। তবু এসব সত্ত্বেও তিনি আদ্যন্ত বাঙালি। মনেপ্রাণে বাঙালি। আর এই বাঙালিত্ব অর্জিত হয়েছিল শৈশবে গৃহের পরিবেশে। ছোটবেলাতেই যোগ্য শিক্ষকদের হাতে তাঁর ইংরেজি ও সংস্কৃত শিক্ষা চললেও বাড়িতে তাঁকে বাংলাও দস্তুরমত শিখতে হয়েছে সেজদা হেমেন্দ্রনাথের উদ্যোগে। রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখছেন, ‘যখন চারিদিকে খুব করিয়া ইংরেজি পড়াইবার ধূম পড়িয়া গিয়াছে, তখন যিনি সাহস করিয়া আমাদিগকে দীর্ঘকাল বাংলা শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেই আমার স্বর্গত সেজদাদার উদ্দেশে সকৃতজ্ঞ প্রণাম নিবেদন করিতেছি।’

রবীন্দ্রনাথের বাঙালিত্ব অর্জিত হয়েছিল নানাপথে। বাড়িতে বাংলা বইয়ের অফুরন্ত সম্ভার, বাংলা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সাম্প্রতিকম লেখার সঙ্গে পরিচয় তো ছিলই, তাছাড়া ঠাকুরবাড়ি থেকেই প্রকাশিত হত একাধিক পত্রিকা,— তত্ত্ববোধিনী, বালক, ভারতী। কিশোর বয়স থেকেই এসব পত্রিকায় তিনি লিখেছেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের যে সমালোচনা লিখেছিলেন, তা পড়ে বোঝা যায়, মঙ্গলকাব্য, কৃত্তিবাস-কাশীরাম দাস-রামপ্রসাদ-ভারতচন্দ্র তো বটেই, এমনকি হরুঠাকুরের পাঁচালীও তাঁর পড়া হয়ে গিয়েছিল ওই বয়সের ভিতর। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে যিনি শেকসপিয়ারের ম্যাকবেথ অনুবাদের সাহস রাখেন, তাঁর মাতৃভাষায় পারদর্শিতা অসংশয়িত।

কৈশোরে সাহচর্য পেয়েছেন বিহারীলাল, রাজনারায়ণ বসু, অক্ষয়চন্দ্র সরকারের। আর শিলাইদহ-পর্বের টানা দশবছর তিনি গাঢ় স্নান করেন বাংলার ভূপ্রকৃতি আর সহজ গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে, যা তাঁর বাঙালিত্ব অর্জনের মহীসোপান। এ সম্পর্কে তিনি লিখছেন, ‘…কতবার সমস্ত বৎসর ধরে পদ্মার আতিথ্য নিয়েছি, বৈশাখের খর রৌদ্রতাপে, শ্রাবণের মূষলধারাবর্ষণে।… এইখানে নির্জন সজনের নিত্যসঙ্গম চলছিল। অহরহ সুখদুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলরব এসে পৌঁচচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল।… সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হলো আমার জীবনে’ (সূচনা, ‘সোনার তরী’)।

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

নবজাতকের নামকরণে রুচিকর বাংলা শব্দ খুঁজেছেন, বৃক্ষলতাদির নামকরণেও। অমর্ত্য, নবনীতা, শান্তিদেব, কণিকা, চিত্রলেখা নামগুলি তাঁর-ই দেওয়া, যেমন বীলমণিলতা, সোনাঝুরি নাম রাখেন গাছেদের। আবার উত্তরায়নের বাড়িগুলির নাম শ্যামলী, কোনার্ক, উদীচী, উদয়ন, এসব-ও তাঁর দেওয়া। আম্রকুঞ্জ, তালধ্বজ, শালবীথি, এসব নাম-ও। বিজয়া (ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো), নলিনী (আনা তড়খড়), হৈমন্তী (অমিয় চক্রবর্তীর বিদেশিনী স্ত্রী হিওর্ডিস সিগার্ড [Hjordis Siggard])-কে, হিমের দেশ ডেনমার্কের মেয়ে বলে), এরকম বহু উদাহরণ পাই।

নিজের বহু লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। কিন্তু সর্বদাই আগে বাংলায় লিখে তারপর তার অনুবাদ করতেন। অর্থাৎ প্রাথমিক ভাবনাটা মাতৃভাষার মাধ্যমেই মস্তিষ্কে সঞ্চারিত হত। একমাত্র ব্যতিক্রম ‘The Child’ কবিতাটি। এটিই তিনি প্রথমে ইংরেজিতে লিখে পরে ‘শিশুতীর্থ’ নামে এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন।

চিত্র সৌজন্যে: স্কোরার এরিনা
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Manas Das
Manas Das
3 months ago

রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে নিজেদের জমিদারি বাঁচাবার জন্য এবং মুসলিম প্রজাদের ঠান্ডা করার জন্য নীচ জাতের হিন্দু প্রজাদের বসিয়েছিলেন – অন্য রবীন্দ্রনাথ

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সুকান্ত ভট্টাচার্য: ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর এক কবি

‘–ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে’, সুকান্ত লিখেছেন নিজের সম্পর্কে। বলেছেন, ‘আমি এক অঙ্কুরিত বীজ’। এই বীজ মহীরুহে পরিণত হতে পারল না, বাংলা সাহিত্যের পরম দুর্ভাগ্য এটা। কিন্তু তাঁর একুশ বছরের জীবনে তিনি আভাস দিয়ে গেছেন, তাঁর সম্ভাবনা কতদূর প্রসারিত হতে পারত। সুকান্ত মানে একজন কবিমাত্র নন, তার চেয়েও আরও অধিক কিছু।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও প্রসঙ্গত

প্রয়াণের আগে, সব হিসেব বাদ দিয়ে যদি তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছরের কথা-ই ধরি, দেখব, কত প্রিয়জনের মৃত্যুশোক বহন করতে হয়েছে তাঁকে। যেহেতু তিনি ছিলেন মানুষের সান্নিধ্যপ্রিয়, তাই অন্যের চেয়ে ঢের ঢের বেশি মৃত্যুবেদনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এসব মৃত্যু তাঁকে বেদনার্ত করলেও নিজের মনোবলের জোরে সে-অরুন্তুদ বিষাদকে কাটিয়েও উঠেছেন। পাশাপাশি মৃত্যু নিয়ে তাঁর দর্শন গড়ে উঠতেও তা ভূমিকা রেখেছে। তাই তিনি বলতে পারেন, তিনি-ই বলতে পারেন, ‘দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে/ তাইতে যদি এতই ধরে/ চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?’ কেন পারেন?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার: অন্য ও অনন্য

তাঁর জন্মদিনের চেয়েও মৃত্যুদিনটিকে অধিকভাবে স্মরণ করা হয়, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। তাছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র-জগতে তো কম খ্যাতিমান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়নি, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল, ছবি বিশ্বাস-কানন দেবী-সুচিত্রা-সৌমিত্র, তবু তাঁর মতো, ঠিক তাঁর মতো স্মরণযোগ্য হয়ে রইলেন না কেউ। শ্রাবণের অনুষঙ্গে নয়, উত্তমকুমারের প্রয়াণদিবসটি চিহ্নিত চব্বিশে জুলাই তারিখটির বিধুরতায়। ১৯৮০-র এই দিনটিতে বাংলা চলচ্চিত্র-জগতের এই দিকপাল প্রতিভার জীবনাবসান ঘটে। আজ তাঁর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্তিতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে উত্তম সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্যের ডালি।

Read More »
শৌনক দত্ত

রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী

নাটকটির নাম প্রথমে রেখেছিলেন যক্ষপুরী, তারপর নন্দিনী এবং পরিশেষে রক্তকরবী নামে থিতু হয়। শিলং-এ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে যে নাটক লেখা শুরু হয়েছিল তার দশম খসড়া প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রায় দেড় বছর পর আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দে—১৯২৪ সালে। প্রকাশিত হবার পরেও, একাদশতম খসড়া প্রস্তুত করার কথা ভাবেন নাট্যকার। অনেকেই বলেছেন, এটি নাট্যকারের হৃদয়ে লালন করা কোনও স্বপ্ন। কেউ কেউ এই নাটকের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম চেতনার ছায়া খুঁজেছেন। নানা প্রশ্ন, নানা যুক্তি নিয়ে নাটকটি রচনার পর থেকে সমসাময়িক সময় পর্যন্ত দারুণ আলোচিত ও জনপ্রিয়। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত নাটকটি নিয়ে বহু আলোচনা। শতবর্ষে এসে দাঁড়ানো সেই রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নানামাত্রায় বিবেচনাযোগ্য একটি নাটক; বহুমাত্রিক এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।

Read More »
নুশান জান্নাত চৌধুরী

নুশান জান্নাত চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ

কিছুকাল ঘুমিয়ে, কিছুকাল লুকিয়ে,/ কিছু শহর, কিছু মানুষের ভিড়ে হারিয়ে/ আমি দেখি—// কোনও এক/ পথহারা দেবদূতের বিষণ্ণ ডানার পাশে/ আমি বুক পেতে দিয়েছি// চুলের ভেতর জন্ম নিয়েছে/ ঘাসফুল থোকা থোকা, বুকের মাঝখানে একটা প্রাচীন পেরেক,// ঝরাপাতার রাজ্যপাটে/ আমার বাম হাঁটুতে গেঁথে আছে—/ আগামী বছরের প্রথম সন্ধ্যা;

Read More »