Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

আমাদের বাদাবন

ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের তটভূমির দৈর্ঘ্য ৫,৪২৩ কিমি আর দ্বীপভূমির তটরেখার দৈর্ঘ্য ১,১৯৭ কিমি। এই বিপুল দৈর্ঘ্যের মাত্র ৮% জুড়ে রয়েছে ভারতীয় বাদাবন বা লবণাম্বু উদ্ভিদের অরণ্য। তাই বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, তটভূমির বিশেষ কিছু চরিত্র বাদাবন গড়ে ওঠার জন্য জরুরি। সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে যেখানে মাটি সূক্ষ্ম কাদা-মাটি ও মিহি বালুকণা দিয়ে তৈরি, যেখানে ছোট-বড় নদীর মিঠেজলের স্রোত সমুদ্রের লবণাক্ত জলকে কিছু কম লবণাক্ত করে তুলেছে, যেখানে আবহাওয়া বছরের সব সময়েই গরম ও আর্দ্র, শীতকালেও বাতাসের গড় তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের আশেপাশে থাকে, যেখানে সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে না, কিন্তু নিয়মিত জোয়ারে মাটি জলের নিচে ডুবে থাকে আবার ভাটায় ভিজে কর্দমাক্ত তটভূমি জেগে ওঠে; তেমনই বিশেষ পরিবেশগত পরিস্থিতিতে বিশেষ ধরনের গুল্ম ও বৃক্ষের অরণ্য গড়ে উঠেছে। যেহেতু গাছগুলি বেশি পরিমাণে লবণযুক্ত জল ও মাটির সংস্পর্শে বেড়ে ওঠে, তাই এগুলি লবণাম্বু উদ্ভিদ। গরান, গেঁওয়া, বাণ, পশুর, সুন্দরী, কাঁকড়া, হোগলা, হেঁতাল, গোলপাতা, ধানিঘাস আরও কয়েক ধরনের বিশেষ ঘাস সহ ভারতের লবণাম্বু উদ্ভিদের অরণ্যে বা বাদাবনে প্রায় ৬৫ প্রজাতির এমন লবণাম্বু উদ্ভিদের দেখা মেলে। ওদের অনেকেরই বীজ গাছে থাকার সময়েই অঙ্কুরিত হয় (জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম)। মাটি নোনা ও জলে ডুবে থাকার কারণে মূলে অক্সিজেনের যোগান থাকে না তাই তাদের শ্বাসমূল মাটি ফুঁড়ে বাতাসের সংস্পর্শে আসার জন্য মাটির ওপরে উঠে আসে; আমরা বলি শুলো। সাগরের তীরে বা বড় নদীর মোহানায় নির্দিষ্ট পরিবেশ ছাড়া বাদাবন গড়ে উঠতে পারে না।

ভারতে বাদাবনের পরিমাণ কমবেশি ৪,৯২১ বর্গকিলোমিটার; ভারত ভূখণ্ডের মাত্র ০.১৫% জুড়ে। এই পরিমাণের প্রায় ৪৩% রয়েছে আমাদের রাজ্যে আর বাকিটা ছড়িয়ে আছে গুজরাত, অন্ধ্র, কেরল ও আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন স্থানে। আমরা ভাগ্যবান, আমাদের রাজ্যে রয়েছে বাদাবনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল, সুন্দরবন। এই জাতীয় অরণ্য ও ব্যাঘ্রবনের নানান আন্তর্জাতিক খ্যাতি মিলেছে; সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভও অধুনা রামসার সাইট। গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের মত বড় নদীগুলি সমুদ্র-সঙ্গমের সন্নিহিত অঞ্চলে কম লবণাক্ত এসচুয়ারি এলাকা তৈরি করেছে। ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে তার পরিমাণ ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি; তার ৬০% বাংলাদেশের আর বাকি ৪০% এই পশ্চিমবঙ্গে। বাদাবনের গাছগুলির পাতা মোহনার জলে ঝরে পড়ে আর পচে পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যে পরিণত হয়। সেই খাবারের টানে প্রায় সাড়ে তিনশো প্রজাতির মাছের বসবাস ও ডিম পাড়ার উপযুক্ত স্থান হয়ে উঠেছে আমাদের রাজ্যের বাদাবন। সুন্দরবনের জলে মাছ ছাড়াও রয়েছে বাদার কুমির, তিন প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ, কামট, শুশুক, ভোঁদড়, নানান কাঁকড়া, চিংড়ি ইত্যাদি। প্রায় ৩৬০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। শীতে উপযুক্ত খাবারের সন্ধানে পূর্ব অস্ট্রেলিয়া-এশিয়া ও মধ্য এশিয়া উড়ানপথ বেয়ে উড়ে আসে নানান প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। সুন্দরবনের জগৎবিখ্যাত বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও রয়েছে হরিণ, বাঁদর, শজারু আর বন্যশূকর। শঙ্খচূড়, নানান কেউটে, শাঁখামুটি, চন্দ্রবোড়া, গেছোবোড়া, অজগর সহ বাইশ প্রজাতির নানান সাপ ও আট রকমের উভচর। নানান রকম পোকামাকড়ের মধ্যে আমাদের বাদাবনের মৌমাছির উল্লেখ না করলেই নয়। সুন্দরবনে বিভিন্ন ফুলের রেণু থেকে এই মৌমাছিরা যে বিপুল পরিমাণ মধু আর মোম তৈরি করে সেগুলি ভারত-বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেশ বড় ভূমিকা পালন করে।

বিশ্বের বাদাবন বিপুল পরিমাণ কার্বন জমিয়ে রেখে বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিহত করতে সাহায্য করছে। হিসেব বলছে, শুধুমাত্র ভারতীয় সুন্দরবন চার কোটি মেট্রিক টন কার্বন বাতাস থেকে শুষে নিচ্ছে। এর অর্থমূল্য প্রায় ঊনআশি বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। ঘন বাদাবন ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ করে; সামুদ্রিক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিহত করতেও বিশেষ সহায়ক। জ্বালানি ছাড়া বাদাবনের গাছের তেমন অর্থকরী মূল্য না থাকলেও বাদা অঞ্চলের মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, মোম, মধু ইত্যাদি সম্পদ আঞ্চলিক অর্থনীতির মেরুদণ্ড। অথচ বসবাস ও মাছের ভেড়ি কিংবা চাষের জমির জন্য আমরা নির্বিচারে বাদাবন ধ্বংস করে চলেছি। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে পরিবেশগত পরিবর্তনে বাদাবন সংকুচিত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। সমুদ্রতলের উচ্চতা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় (বছরে গড়ে ২.৯ মিমি) মোহনার ব-দ্বীপগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত আছে ভূ-অবনমন (বছরে গড়ে ২.৯ মিমি)। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বছরে গড়ে প্রায় ৬.৫ মিমি সমুদ্রতল উঁচু হয়ে মূল ভূখণ্ডের দিকে এগিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় সুন্দরবনে দ্বীপের সংখ্যা ১৩৫; এগুলির ১০০টিতে বাদাবন ও ৩৫টিতে মানুষের বসবাস। সুন্দরবন ব-দ্বীপ অঞ্চলে চারটি দ্বীপের সমন্বয়ে একসময়ের ঘোড়ামারা দ্বীপভূমি ছিল সুন্দরবনে ইংরেজ শাসকদের আবাদ করা দ্বীপগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। এখন ঘোড়ামারা মূল দ্বীপটির ২০ শতাংশ বাদে সবটুকুই জলের নিচে ডুবে গেছে। যদি ভারত-বাংলাদেশ সুন্দরবনের কথা বলি তবে বলা যায়, বাদাবন নিশ্চিহ্ন হলে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার মোহনার নিকটবর্তী বিস্তীর্ণ উর্বর সমভূমির গড়ে ওঠা জনপদ বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে দেরি হবে না।

চিত্র: গুগল
Advertisement
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »