আমার ছোটবেলার উঠোনে যে গন্ধটি আজও মনে গেঁথে আছে, তা হল— হেমন্তের হালকা কুয়াশায় ভেজা এক ‘নিখিলেশ্বরী’ সুবাস, যা একইসঙ্গে কৃষকের নীরব, অস্তিত্ববাদী শ্রমের দর্শন এবং মাটির উষ্ণ স্পন্দনের ঘ্রাণ বহন করে। সেই আদিম সুবাসই আমাদের বাঙালি মনে এক নিরাভরণ আত্মিক হর্ষধ্বনি নিয়ে আসে— নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে। ‘নব’ আর ‘অন্ন’-এর এই মিলন আসলে জীবনের সৃষ্টি, ক্ষয় এবং পুনর্জন্মের অনন্ত চক্রাকার গতির প্রতীক। এটি হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতার মতো শিক্ষা দেয় যে, জীবনের পূর্ণতা আসে পুরাতনকে অতিক্রম করে নতুনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে। এই প্রথম খাবারটি শুধু উদরপূর্তি করে না, এটি আমাদের শেকড়ের সঙ্গে এক আত্মিক পুনর্মিলন ঘটায়। এটি মনে করিয়ে দেয়, আমরা এখনও প্রকৃতির ইচ্ছাধীন এক বিনয়ী জীব এবং অন্নই আমাদের জৈবিক কাঠামোর অপরিহার্য মেরুদণ্ড, যা আমাদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে ধারণ করে।
এই উৎসবের গভীরে প্রথিত রয়েছে গভীর নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক মূল্যবোধের দুর্ভেদ্য শেকড়। হেমন্তের ম্রিয়মাণ আলোয় নতুন চাল যখন প্রথমবার রান্না হয়, সেই পবিত্র খাদ্য তখন প্রথমে আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তিকামনায় উৎসর্গ করা হয়— যা স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের আত্মার সঙ্গে অতীত প্রজন্মের অচ্ছেদ্য যোগসূত্রকে। নতুন চালের খাবার কাককে দেওয়ার প্রথা, যাকে ‘কাকবলী’ বলা হয়, তা লোকবিশ্বাস অনুসারে মৃত পূর্বপুরুষদের কাছে নৈবেদ্য পৌঁছানোর একটি নীরব ও পবিত্র আধ্যাত্মিক মাধ্যম। একসময় ধান উৎপাদনই ছিল অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, তাই নবান্নই ছিল বাংলার আর্থিক বছরের সূচনা। এই উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলে উদযাপন করে। ঢেঁকির তালে মুখরিত হওয়া বাড়ির উঠোন, পিঠে ভাজার মর্মর শব্দ এবং পরিবারের জমায়েত সামাজিক বন্ধনকে একটি নিবিড় কাঠামো দেয়। প্রবীণরা তাই বলেন, ‘যাঁর নেই নবান্ন, তাঁর নেই ঘর’— এই উক্তিটি কেবল সম্পদের নয়, বরং সামাজিক স্থিতি ও পূর্ণতার প্রতীক।
তবে এই উৎসবের ধরনে গ্রামীণ সংস্কৃতি ও নাগরিক সংস্কৃতিতে কিছুটা পার্থক্য আছে, যা একই বাঙালির দ্বৈত সত্তাকে নিরন্তর প্রকাশ করে। গ্রামীণ জনপদগুলিতে নবান্ন আজও কৃষকের অকৃত্রিম উল্লাস, যেখানে ফসলের নরম স্পর্শ, মাঙ্গলিক আলপনা এবং লোকগানই প্রধান। এই নবান্ন শুধু বাঙালি নয়, পাহাড়-সমতলের বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শস্য উৎসবগুলোর সাদৃশ্য ইঙ্গিত দেয় যে, এটি বাংলার মাটির এক সম্মিলিত চেতনা এবং একটি সর্বজনীন প্রার্থনা। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে নবান্ন হল নাগরিক মানুষের নস্টালজিয়া বা হারানো স্মৃতির নিগূঢ় আকর্ষণ। এই দ্বৈত উদযাপন-শৈলীর গভীরে লুকিয়ে আছে বাঙালির সময়ের দর্শন— গ্রামবাংলায় সময় আজও চক্রাকার, কিন্তু শহরাঞ্চলে তা রৈখিক ও যান্ত্রিক। তাই শহুরে নবান্ন হয়ে ওঠে সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, এক প্রকার ‘আত্ম-আবিষ্কারের শিল্প’— যেখানে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে মাটির সঙ্গে তার বিচ্ছিন্ন সংযোগ পুনরুদ্ধার করতে চায়। নবান্ন এইভাবে আধুনিকতার বিপরীতে শেকড়ের ঘোষণা, এক নীরব সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।
দার্শনিক দৃষ্টিতে, নবান্নের এই চিত্রকল্প মানবতার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করে। এই অক্ষয় চেতনাকেই যেন কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কালজয়ী পংক্তিতে ধরে রেখেছেন:
‘হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ বাংলায়’।
এটি আমাদের শেখায়, জীবনের জৈবিক অনিবার্যতার (খাদ্য উৎপাদন) মধ্যেই লুকানো থাকে সূক্ষ্ম আনন্দ ও ঐশ্বরিক সৌন্দর্য। এই উৎসব যেন আমাদের কানে ফিসফিস করে বলে, ‘আত্মার শান্তি পেতে হলে প্রথমে মাটির শান্তি নিশ্চিত করো।’ মাটির ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে মানুষ তার অস্তিত্বের মূল দায়বদ্ধতা স্বীকার করে নেয়। এই উৎসব মানবসমাজকে এক চূড়ান্ত সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। অন্ধ ভোগবাদ ও যান্ত্রিক সভ্যতার শীতল নিশ্বাসে আজ যেখানে সবকিছুর হিসাব হয় কম্পিউটার বা অ্যালগরিদমে, সেখানেও নবান্ন আমাদের সেই অবিচ্ছেদ্য প্রাকৃতিক চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি শেখায় যে, প্রকৃতির দানকে কেবল ব্যবসার সামগ্রী মনে করলে চলবে না। কারণ প্রকৃতির কাছে শ্রমের মূল্য অর্থের মূল্যের চেয়েও বেশি— এই সত্যকে নবান্ন পুনরাবৃত্তি করে।
বস্তুত, নবান্ন হল প্রকৃতির সেই আদিম ভাষা, যা মানুষ ভুলে যেতে বসেছিল। এটি কেবল শস্যের আগমনী নয়; এটি আত্মার নিরাভরণ স্বীকারোক্তি— যে, জীবনের প্রতিটি স্পন্দন মাটির ঋণের বন্ধনে বাঁধা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই চিরন্তন বার্তাটি বিশ্বকে শুনিয়েছিলেন: ‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।’ নবান্নের এই উদাত্ত আহ্বান হল প্রকৃতির মহাকালের সম্মুখে মানুষের নৈমিত্তিক বিনয় প্রকাশের এক গভীর আধ্যাত্মিক সংযোগের মন্ত্রণা। এই উৎসবের শেষ কথা হল: মানবতার অস্তিত্ব নির্ভর করে মাটির প্রতি তার অকৃত্রিম বিনয়ের ওপর। যতদিন মানুষ এই ধূলিকে তার জননী-জ্ঞানে সম্মান জানাবে, যতদিন অন্নকে কেবল পুষ্টি নয়, ‘অন্নময় ব্রহ্ম’ মনে করে বরণ করবে— ততদিন তার সভ্যতা টিকে থাকবে। নবান্ন তাই মহাবিশ্বের অক্ষয় নিয়মের মতো, মাটির গভীরে শক্তভাবে প্রোথিত ফসলের মতো এক শাশ্বত অঙ্গীকার—জীবন ও প্রকৃতির মাঝে রচিত এক অপ্রতিরোধ্য, নান্দনিক চুক্তি।
চিত্র: গুগল







